শেষের পাতা
সরাইলে খাসজমির ধান কাটা নিয়ে সংঘর্ষে নিহত ১, গ্রেপ্তার ২৬
মাহবুব খান বাবুল, সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) থেকে
১৬ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবারসামান্য ঘটনা। খাসজমিতে ধান চাষ করেন কাউছার আফজাল মাসুকরা। ধান পাকে। কাটার সময় আসন্ন। বাধা দেন পাশের জমির মালিক মোশাররফ রিপন ইকবালরা। তাতেই থেমে থাকেনি মোশাররফরা। লিখিতভাবে বিষয়টি প্রশাসনকে জানায়। শুরু হয় জেতার প্রতিযোগিতা। উভয় গ্রুপই শাহাজাদাপুর গ্রামের বাসিন্দা। ভাবটা এমন যে কেউ কাউকে ছেড়ে দিবেন না।
সরজমিন অনুসন্ধানে পুলিশ ও স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, শাহজাদাপুর তিতাস নদীর পাড় সংলগ্ন রিপনদের ফসলি জমি। ওই জমির আইলের পরই নিচের অংশ খাস। খাস জায়গায় দীর্ঘদিন ধরে চাষাবাদ করে আসছে মাসুক ও কাউছার গংরা। নিজেদের আইল সংলগ্ন হওয়ায় এই বছর মাসুকদের চাষ করতে নিষেধ করেন মোশাররফ গংরা। এতে দুই গ্রুপের মধ্যে সূত্রপাত হয় দ্বন্দ্বের। ধান পেকে গেছে। কাটার সময়ও হয়ে যাচ্ছে। ধান কাটতে গেলেই উভয় পক্ষ মুখোমুখি হয়ে সংঘাতে জড়াতে পারে। মোশাররফরা বিষয়টি জানায় প্রশাসনকে। গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে আসে প্রশাসন। পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের উপস্থিতিতে উভয় পক্ষকে নিয়ে সভা করেন। সভায় সিন্ধান্ত দিলেন কোনো পক্ষই ধান কাটতে পারবে না। সময় হলে ধান কাটবেন চেয়ারম্যান। সিদ্ধান্ত মেনেও পরে বেঁকে বসলেন মাসুক কাউছার গংরা। শুক্রবার ভোরে কাউছারদের শতাধিক লোক দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ওই জমির ধান কেটে নেয়। প্রতিপক্ষ তখন পর্যন্ত কোনো শব্দও করেননি। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লুকিয়ে রাখা ধান উদ্ধার করে জব্দ করেন। দিন শেষে ওই ধান ৬০ মণ হিসাব করে কাওসার নামের এক ব্যক্তির জিম্মায় রেখে আসে পুলিশ। এই কাওসার হলো জুয়েল মেম্বারের চাচা মাসুকের আপন ছোট ভাই। যারা ধান কেটে ছিল তাদেরই ঘনিষ্ঠ স্বজনের কাছে ধান রেখে যাওয়ার বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেয়নি রিপনরা। তারা ক্ষুব্ধ হয়। পরদিন শনিবার সকালে দুইজন কনস্টেবল নিয়ে সেখানে হাজির হন বিট অফিসার এসআই মো. জসিম উদ্দিন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে উভয় পক্ষের সহস্রাধিক লোক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় হামলা পাল্টা হামলা ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ। গোত্র, স্বজন আর সম্পর্কের টানে এই সংঘর্ষ পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। দফায় দফায় সংঘর্ষ চলতে থাকে। এক সময় পুরো শাহজাদাপুর গ্রাম রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সরাইল থানার ২০ পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি পরিস্থিতি সামাল দিতে জেলা থেকে ডেকে আনেন ২০ জন অতিরিক্ত পুলিশ। ঘটনাস্থলে হাজির হয়েছিলেন সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেজবা উল আলম ভূঁইয়া, জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) সোনাহর আলী। ১২ রাউন্ড রাবার বুলেট ছুঁড়ে আড়াই ঘণ্টা পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন পুলিশ। ততক্ষণে ইউপি চেয়ারম্যান আছমা আক্তার, ৬ পুলিশ সদস্যসহ উভয় পক্ষের অন্তত অর্ধশতাধিক নারী পুরুষ আহত হয়। আহত পুলিশ সদস্যরা হলেন- এসআই জয়নাল উদ্দিন-১, এসআই নাজমুল আলম, এএসআই আলা উদ্দিন, কনস্টেবল মামুন মিয়া. মাহাবুবুল আলম ও মেহেদী হাসান। মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত জুয়েল মেম্বারের ভায়রা ভাই কামাল উদ্দিনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় সরাইল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। খুনের খবরটি এলাকায় প্রচার হওয়া মাত্র বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায় একটি পক্ষ। এই সুযোগে অপর পক্ষের লোকজন শুরু করে হামলা লুটপাট। ধান, গরু, ঘরের ফ্রিজসহ গুরূত্বপূর্ণ সামগ্রী লুটপাট হতে থাকে। প্রতিপক্ষ বা তাদের স্বজন বুঝতে পারলেই চলে মারধরের তাণ্ডব। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গোটা গ্রামে। ইউপি চেয়ারম্যান মোছা. আছমা আক্তার বলেন, ইউএনও ও ওসি স্যার ইউপি সদস্য জুয়েল মিয়ার উপস্থিতিতে ধান কাটা আর মাড়াইয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমাকে। আমি বিট অফিসার ও নায়েবকে নিয়ে কাটার লোকও ঠিক করেছিলাম। আমাকে কিছু না জানিয়ে শুক্রবার ভোরে তারা ধান কাটতে যাচ্ছে জেনে জুয়েলকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলে অস্বীকার করেন। পরে জানতে পারি প্রায় অর্ধশতাধিক লোক নিয়ে ধান কাটছেন। তখনো জুয়েলকে ফোন দিয়ে বন্ধ পায়। পুলিশের ধান উদ্ধার করে কাওসারের কাছে রেখে যাওয়াটা ঠিক হয়নি। কারণ কাওসার অভিযুক্ত মাসুকের ছোট ভাই। কাওসারের কাছে ধান রেখে যাওয়ার পর জুয়েলদের কিছু লোক রিপনদের বাড়ির সামনে গান গেয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিতে নাচানাচি করেছে। এতে রিপন ও তাদের লোকজন ক্ষুব্ধ হয়েছে। রাতে পরিস্থিতি খারাপ আঁচ করতে পেরে শনিবার ভোর পাঁচটা থেকে গ্রামের সকল মুরুব্বি ও সালিশকারক নিয়ে সংঘর্ষ প্রতিরোধের চেষ্টা করেছি। শুরু থেকে যখন যা হয়েছে আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। কর্তৃপক্ষের পরামর্শ ও আদেশে দাঙ্গা ঠেকাতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছি। চেষ্টা কেন করছি তাই এক পক্ষের জনৈক ব্যক্তি আমার অবস্থা ভালো হবে না বলে হুমকিও দিয়েছেন। এলাকার শান্তির স্বার্থে প্রতিবাদ করিনি। তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। এখন লুটপাট হচ্ছে। দিনের চেয়ে রাতে বেশি আতঙ্কে আছে লোকজন। ইরি ধানগুলো পেকে ঝনঝন করছে। ধান কাটা বন্ধ হয়ে গেছে। ৪-৫ দিন পর ধানগুলো মাটিতে পড়ে যেতে পারে। খুনের ঘটনায় আমি প্রকৃত অপরাধীদের আইনি পক্রিয়ায় দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।
পুলিশ অ্যাসল্ট মামলার আসামি ৩ শতাধিক:
সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে ১২ রাউন্ড রাবার বুলেট ছুঁড়তে হয়েছে। আড়াই ঘণ্টা মাঠে ঘাম জড়িয়েছেন প্রায় অর্ধশত পুলিশ। ছিলেন পুলিশের জেলা ও উপজেলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এরপরও পুলিশ আহত হয়েছেন উভয় পক্ষের হামলায় ও আক্রমণে। তাই পুলিশ বাদী হয়ে সাড়ে ৩ শতাধিক লোকের বিরূদ্ধে পুলিশ এ্যাসল্ট মামলা করেছেন। গ্রেপ্তার করেছেন উভয় পক্ষের ২৬ জনকে।
লুটপাটের শিকার যারা:
খুনের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরই বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায় একটি পক্ষ। এই সুযোগে চলে লুটপাট ও মারধরের তাণ্ডব। সরজমিন জানা যায়, প্রায় অর্ধশতাধিক গরু ছিনিয়ে নিয়েছে কে বা কারা। এরমধ্যে সাবেক ইউপি সদস্য ফারুক মিয়া ও তার আশপাশের স্বজনদের ১৮টি, উচাবাড়ির মাসুক মিয়ার ৫টি, জয়নাল খানের ৬টি, আহম্মদ সরকারের ৫টি, আব্দুল্লাহর ৪টি গরু নিয়ে গেছে। এ ছাড়া চান মিয়ার ৩টি ও ১টি ফ্রিজ, আসুক মিয়ার ৩টি গরু ও ৩টি ফ্রিজ, ফারুক মেম্বারের আত্মীয়-স্বজনের ৪ শতাধিক মণ ধান ও ধনু ফকিরের ১টি ফ্রিজ ও ৩ ড্রাম চাউল লুট হয়েছে। মারধরের শিকার হয়েছেন সরকার বাড়ির বৃদ্ধ ব্যক্তি আব্দুল হামিদ সরকার (৫৮)।
এত অস্ত্র পেলো কোথায়?
এই জনপদের দাঙ্গা প্রতিরোধে পুলিশ দীর্ঘদিন সময় দিয়ে পাড়ায় মহল্লায় ও গ্রামে গ্রামে অভিযান করে দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করেছে। পিকআপ ভ্যানে করে এনে থানায় অস্ত্রের স্তূপ করেছেন। অস্ত্র উদ্ধারে থানাকে পুরস্কৃতও করা হয়েছে। এত বড় বড় অভিযানের বছর তিন পরই শাহজাদাপুরের লোকজন এত টেঁটা বল্লমসহ দেশীয় অস্ত্র পেলো কোথায়? এই প্রশ্ন ওই গ্রামের সাধারণ মানুষদের। শনিবার দিন তো তারা পুলিশের উপস্থিতিতেই দেশীয় অস্ত্রের কারিশমা দেখিয়েছেন। এই মজুত ছিল কোথায়?
রিপন ও মোশাররফ বলেন, প্রশাসনের নিষেধ অমান্য করে শনিবার ভোরে ইউপি সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জুয়েল, নাজমা বেগম, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুন্না, আজিজ ও ময়েজের নেতৃত্বে শতাধিক লোক দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ওই জমির ধান কেটে নেয়। এর আগে তারা ওই সরকারি জায়গা থেকে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকার মাটি বিক্রি করেছেন। পুলিশ ওই ধান জব্দ করেছে। সমগ্র দিন নীরব থেকে প্রশাসনের দিকেই চেয়েছিল আমাদের লোকজন। উদ্ধারকৃত ধান পুলিশ অভিযুক্ত মাসুকের ছোট ভাই কাওসারের কাছে রেখে যাওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়েছেন আমাদের লোকজন। পরদিন প্রতিপক্ষের উস্কানিতে জড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষে। আর এখন তো তাদের নেতৃত্বেই চলছে ব্যাপক লুটপাট ও মারধর। অনেকের পুকুরের মাছ লুটেরও পরিকল্পনা করছে তারা।
আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মো. মুন্না ও ইউপি সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জুয়েল মিয়া বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো মিথ্যা-বানোয়াট। আমরা ধান কাটায় নেতৃত্ব দেয়নি। যার ধান সেই কেটে নিয়ে গেছে। সারা দেশেই সরকারি জায়গায় এইভাবে লোকজন ধান চাষ করে থাকে। খুনের পরে হয়েছে পুলিশ অ্যাসল্ট মামলা। আমাদের কোনো লোক এলাকায় নেই। গরু নিয়ে যাওয়া ও লুটপাটের ঘটনা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
সরাইল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) ও ভারপ্রাপ্ত অফিসার ইনচার্জ আসম আতিকুর রহমান বলেন, ছোট একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে হঠাৎ করে ৪-৫ শতাধিক লোক এভাবে টেটা-বল্লম নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া কল্পনাতীত বিষয়। দায়িত্ব পালনকালে তারা আমাদের ৬ জন পুলিশ সদস্যকে আঘাত করেছে। তাই পুলিশ এ্যাসল্ট মামলা করেছি। ওই গ্রামে এখনো পুলিশ অবস্থান করছে। নিহত কামাল উদ্দিনের ছেলে মো. তোফায়েল মিয়া শতাধিক লোককে আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মেজবা উল আলম ভূঁইয়া বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মতামতের ভিত্তিতে চাষি কাওসারের কাছে ধান জিম্মা রাখা হয়েছিল। মালিকানার কাগজপত্র দেখে ধানের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা। ধান কোথায় রাখলাম সেটা মূল বিষয় না। সেখানে ঈদগাহ’র জামাতের ইমাম নিয়োগ, এলাকায় নিজেদের আধিপত্য, নেতৃত্ব, নির্বাচন, বিভিন্ন পন্থায় আয় রোজগারে প্রতিবন্ধকতা, গ্রাম্য রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন গোত্রে গোত্রে বিভেদ কাদা ছোড়াছুড়ি দীর্ঘদিনের। এই দাঙ্গা প্রতিরোধে আমি ও অফিসার ইনচার্জ সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। তারপরও এমন অরাজকতা সংঘাত-সংঘর্ষ ও খুনের ঘটনা ঘটিয়েছেন তাদের কাউকেই আইন ছেড়ে দিবে না। তদন্ত করে উস্কানি ও ইন্ধনদাতাসহ সকলকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে।
পরিদর্শনে এমপি:
রোববার দুপুরে শাহজাদাপুর গ্রাম পরিদর্শন করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. মঈন উদ্দিন। তিনি খুন হওয়া কামাল উদ্দিনের বাড়িতে যান। এমপিকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন কামাল উদ্দিনের স্ত্রী, সন্তান ও স্বজনরা। তিনি তাদের শান্ত্বনা দিয়ে শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন। এমপি ওই গ্রামে লুটপাট বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে এ বিষয়ে যথাযথ তদারকি করতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি সকলকে ধৈর্য্য ধারণ করে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।