ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

বায়ুদূষণ, প্রতিবেশী দেশ থেকে আসছে দূষণের উপাদান

মরিয়ম চম্পা
২৮ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার
mzamin

রাজধানীর এলিভেটেড এক্সপ্রেস কাওরান বাজার মুখে দীর্ঘ গাড়ির সারি ইফতারকে সামনে রেখে অপেক্ষায়, কখন ছুটবে যানজট -ছবি: শাহীন কাওসার

বাংলাদেশের মোট বায়ুদূষণের ৩৫-৪০ শতাংশই প্রতিবেশী দেশ ভারত-নেপালসহ আশপাশের দেশগুলো থেকে আসছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু আন্তঃদেশীয় এই বায়ুদূষণ প্রতিরোধে দেখা যাচ্ছে না দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ। বিভিন্ন হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের একটি ঢাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে আসা বায়ুদূষণ। ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত বায়ুদূষণ বিষয়ক ‘স্ট্রাইভিং ফর ক্লিন এয়ার: এয়ার পলিউশন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ ইন সাউথ এশিয়া’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের বায়ুদূষণের ৩০ শতাংশই মূলত ট্রান্সবাউন্ডারি বায়ুদূষণ। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শহরগুলোর বায়ুদূষণের আনুমানিক ৩০ শতাংশেরই উৎপত্তি ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। সেখান থেকে তা বাতাসের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে আসে বাংলাদেশে।

২০২৩ সালের মার্চে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ১০টি শহরের ৯টিই দক্ষিণ এশিয়ায়। ঢাকা সেগুলোর মধ্যে একটি। বাংলাদেশের মোট অকালমৃত্যুর দুই শতাংশের জন্য দায়ী বায়ুদূষণ। শহরে গড় গাড়ি চালানোর গতি সাড়ে ৪ কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির কাছাকাছি।

বিজ্ঞাপন
ইটভাটা, সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ, শিল্প-কারখানার দূষণ এবং প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ধেয়ে আসা ধোঁয়াশার সঙ্গে যোগ হয় স্থানীয় গাড়ি থেকে নির্গত ডিজেল ও পেট্রোলের ধোঁয়া। সব মিলিয়ে এমন এক বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যা বাসিন্দাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করছে।

গবেষণায় বায়ুদূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য শক্তিশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গীকার দরকার বলে মন্তব্য করা হয়। ‘নির্মল বায়ুর জন্য চেষ্টা: দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুদূষণ ও জনস্বাস্থ্য’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানমাত্রার চেয়ে এখানকার শহরগুলোর বায়ু ৬ থেকে ২৫ গুণ মান খারাপ। ওই দূষিত শহরের মধ্যে অন্যতম শীর্ষে ঢাকা শহর। আর ঢাকার দূষিত বায়ুর ৩০ শতাংশ আসে ভারত থেকে। তবে ঢাকার বাইরের

শহরগুলো থেকেও ৪০ শতাংশ দূষিত বায়ু প্রবাহিত হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে।
বাংলাদেশের বায়ুদূষণের বড় একটি অংশের জন্যই দায়ী ট্রান্সবাউন্ডারি বায়ুদূষণ, অর্থাৎ প্রতিবেশী দেশগুলোর বায়ুদূষণ। জানুয়ারি মাসে এমনটাই জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের বায়ুদূষণের ৩৫ শতাংশই হয় ট্রান্সবাউন্ডারি বায়ুদূষণের কারণে। তিনি আরও বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েছে। রিজিওনাল ডাইমেনশনে এখন বায়ুদূষণ হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য আঞ্চলিকভাবে পদক্ষেপ নেয়া উচিত। 

গত ২৬ বছর ধরে বায়ুদূষণ নিয়ে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালাম। তার সঙ্গে কথা হয় মানবজমিন এর। রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সালামের মতে, ট্রান্সবাউন্ডারি বায়ুদূষণ আমাদের নিজস্ব না। এটা বাতাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। শীতকালে উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিমের দেশ থেকে আমাদের দেশে বাতাস আসে। বাতাসের সঙ্গে বায়ুদূষণের এই উপাদান আসে। অর্থাৎ আমাদের দেশের সীমানার বাইরে থেকে আসা বাতাসের সঙ্গে এটা আসে। বিশেষ করে অক্টোবরের শুরু থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এ বিষয়ে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা যৌথভাবে একটি উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে বার্ষিক পিএম হচ্ছে ৮০ শতাংশ। যেটাকে পার্টিকেল বলে। আব্দুস সালাম বলেন, এই দূষিত পার্টিকেল আমাদের দেশের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে যে দূষণ বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং একইভাবে বাংলাদেশ থেকে সেইসব দেশে যে দূষণ যায়, সেটিই হচ্ছে আন্তঃসীমানা বায়ুদূষণ। এজন্য প্রতিবেশী দেশ থেকে শিখতে হবে, তারা কীভাবে দূষণ কমাচ্ছে। একই পদ্ধতি অনুসরণ করে দূষণ কমাতে আমাদেরও পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও চীনের একটি অংশ থেকে দূষণ বাংলাদেশে আসে। এতে দেশের পুরো অঞ্চল দূষিত হয়। শীতকালে এ দূষণটা বেশি আসে। তিনি বলেন, শীতকালে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে এ দূষণ বাংলাদেশে আসে। বর্ষাকালে কিছু জিনিস বাংলাদেশ থেকে ভারতে যায়। বাংলাদেশে যদি ১০০ শতাংশ বায়ুদূষণ থাকে, তার ত্রিশ থেকে ৩৫ শতাংশ আসে বাইরের দেশ থেকে। আমরা অনেকেই মনে করি রাস্তার ধুলো থেকে বায়ু দূষণ হয়। কিন্তু এই ধারণা ঠিক না। রাস্তার ধুলো বেড়ে যাওয়া কিংবা কমে যাওয়ায় বায়ু দূষণ হয় না। রাস্তার ধুলো বড় বড় পার্টিকল (কণা), এগুলো নাকের ভেতরে ঢুকতে পারে না। যেগুলো নাকের মধ্যে না-ঢুকতে পারে, সেগুলো মানুষের কোনো ক্ষতি করে না। পার্টিকলের (কণা) আকার যত ক্ষুদ্র হবে, সেটা ততই ক্ষতিকর হবে। বড় পার্টিকলগুলো নাকের মধ্যে ঢোকে না, যে কারণে মানুষের তত ক্ষতি করে না। এই সমস্যা থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের যানবাহন থেকে যে দূষণ হয় তা সমাধানের পদক্ষেপ নিতে হবে। পুরোনো গাড়িগুলো ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এ ছাড়া যে জ্বালানি তেল ব্যবহার করা হচ্ছে, তারও একটি নির্দেশিকা তৈরি করার পাশাপাশি পরিচ্ছন্ন তেল ব্যবহার এবং নতুন গাড়ি চালাতে হবে। এ ছাড়া পল্যুশন এর সোর্সগুলোকে বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি সার্কভুক্ত দেশগুলোকে একসঙ্গে বসে যৌথভাবে পলিটিক্যাল লেভেলের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।  

ট্রান্সবাউন্ডারি বায়ুদূষণ প্রসঙ্গে মানবজমিনের সঙ্গে কথা হয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন অনুবিভাগ, অতিরিক্ত দায়িত্ব) ড. ফাহমিদা খানম এর। তিনি বলেন, ট্রান্সবাউন্ডারি বা আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ রোধে আমরা ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের একটি রিজিওনাল প্রকল্প আইডার ফাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছি। প্রকল্পটি ইন্ডিয়া, নেপাল, বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশ মিলে ট্রান্সবাউন্ডারি দূষণ প্রতিরোধে এবং এই দূষণকে (অ্যাড্রেস করা) খুঁজে বের করাই হলো আমাদের প্রধান কাজ। প্রকল্পটি ডেভেলপ হচ্ছে। এখন আমাদের ডিজাইনের কাজ চলছে। ভারতে এ ধরনের বায়ুদূষণ রোধে তারা যে যে কাজগুলো করবে, বাংলাদেশ, নেপাল কি কি কাজ করবে সেগুলোর রোডম্যাপ হচ্ছে। কীভাবে ভাগ করে করে কাজগুলো একসঙ্গে করা যায় সেটার রিজিওনাল মিটিং থেকে শুরু করে সবকিছুই হবে। এটা পুরোটাই ট্রান্সবাউন্ডারি এয়ার পল্যুশন নিয়ে আইডা ফাণ্ডের একটি প্রকল্প। তিনি বলেন, এটা প্রথমিক অর্থাৎ প্লানিং পর্যায়ে আছে। বিশ্বব্যাংকের প্লানিং ফেস থেকে চূড়ান্ত পাস হওয়া পর্যন্ত বেশকিছুটা সময় লাগবে। পরবর্তীতে আমাদের আবার সরকার থেকে এটা পাস করাতে হবে। এই প্রকল্প ছাড়াও আমরা রিজিওনাল সাইটে একটি মিটিং করার চেষ্টা করছি। নেপালে আগামী জুন মাসের শেষের দিকে আমাদের একটি মিটিং হবে। এই মিটিং এর আগে রিজিওনাল এয়ার কোয়ালিটি বা বায়ুদূষণ নিয়ে একটি বড় ওয়ার্কশপের পরিকল্পনা চলছে। আমরা অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে বসছি যাতে ট্রান্সবাউন্ডারি বায়ুদূষণ নিয়ে কীভাবে একসঙ্গে কাজ করা যায় সে বিষয়ে।    

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status