ঢাকা, ১৬ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিঃ

ঈদ সংখ্যা ২০২৪

রহস্যঘেরা ১৫ই আগস্ট

নঈম নিজাম

(১ মাস আগে) ১২ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৯:১৫ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ১২:০৮ অপরাহ্ন

mzamin

মাত্র সাড়ে তিন বছর একটি জাতির জন্য, দেশের জন্য বড় কোনো সময় ছিল না। সদ্য স্বাধীন দেশটি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি চেয়েছিলেন উন্নত বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় একটা আত্ম-মর্যাদাশীল জাতি তৈরি করতে। উন্নয়ন সমৃদ্ধিতে সবাইকে চমকে দিতে। একটা দেশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সারা বিশ্বে তার আলাদা মর্যাদা ছিল। বিশাল দেহের মানুষটি হেঁটে গেলে মাটি কেঁপে উঠতো। বিশ্ব নেতারা তাকে জড়িয়ে ধরতেন। বলতেন, তুমি পেরেছ একটি জাতি, দেশ তৈরি করতে। তোমাকে স্যালুট। কেউ ভাবতেও পারেননি মাত্র সাড়ে তিন বছরে ষড়যন্ত্র চক্রান্তের কাছে সবকিছু পরাজিত হবে।

বিজ্ঞাপন
দেশি-বিদেশি খুনিদের একটি গ্রুপ ছিল সামনে। আরেকটি গ্রুপ সব করছিলেন আড়াল থেকে। সব রহস্য এখনো বের হয়নি। পরিষ্কার হয়নি দেশবাসীর সামনে অনেক কিছু। জানা যায়নি কেন আগাম তথ্য জানাতে ব্যর্থ হয়েছিল রাষ্ট্রীয় সকল গোয়েন্দা সংস্থা। কেন রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করতে পারেনি রাষ্ট্রের সকল বাহিনী। শুধু রক্ষীবাহিনীর ওপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের আড়াল করেন অনেকে। ব্যর্থতার দায় সবাইকে নিতে হবে। এমনকি হত্যার প্রতিবাদ করতে না পারার ব্যর্থতা আওয়ামী লীগকেও নিতে হবে। দায় কেউ এড়াতে পারেন না। 

 আরও অনেক গবেষণা হবে। ৩ ও ৭ই নভেম্বর অভ্যূত্থান পাল্টা অভ্যূত্থান নিয়ে অনেকে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। অনেক কিছু ছিল নিজেদের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াই। ইতিহাস ঘাটলে শুধুই কালো অধ্যায় আর ব্যর্থতা বেরিয়ে আসে। কর্নেল জামিল ছাড়া জীবন উৎসর্গ করতে একটা লোককেও খুঁজে পাওয়া যায়নি; বরং সেনা কর্মকর্তারা ব্যস্ত হয়ে উঠেন নিষ্ঠুরতার পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতে। খুনি সেনাদের রক্ষা করতে। আওয়ামী লীগ নেতারা সকাল বেলায় নিজের বাড়ি থেকে সটকে পড়েন জীবন বাঁচাতে। লে. কর্নেল হামিদের বই পড়লে অনেক বাস্তবতা বেরিয়ে আসে। এ এল খতিব, অ্যান্থনি মাসকারেন্স অনেক কঠিন সত্য লিখে গেছেন। রক্ষীবাহিনীর আনোয়ারুল আলম শহীদ, সরোয়ার হোসেন মোল্লা নিজেদের ব্যর্থতার কথা জানিয়েছেন। পাশাপাশি লিখেছেন-বলেছেন, অন্যদের ব্যর্থতার কথাও। রক্ষীবাহিনী প্রধান কর্নেল নুরুজ্জামান আমেরিকার পথে লন্ডনে ছিলেন। উপ প্রধানরা কারও কাছ থেকে নির্দেশ পাননি। নিজেদের বাহিনী প্রধানও কেন তখন আমেরিকা যাচ্ছিলেন তাও পুরোপুরি তাদের কাছে স্পষ্ট ছিল না। দুই উপ প্রধান কর্নেল সরোয়ার মোল্লা ও আনোয়ারুল আলম শহীদ দিনভর নেতাদের কাছে যান কথা বলতে। ফোন করেন। কেউ সাড়া দেননি। সবাই ছিলেন নিজেকে রক্ষা নিয়ে ব্যস্ত।  অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অধিকারী সেনা কর্মকর্তারা রক্ষীবাহিনীকে গুটিয়ে নিতে ব্যয় করেছেন ১৫ আগস্টের সারাটি দিন। অসহায়, ব্যর্থ সেনাপ্রধান সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন। কেউই তার কথা শোনেননি। কেউ তাকে পাত্তা দেয়নি। সিজিএস খালেদ মোশাররফ, ৪৬ পদাতিক বিভাগ কী করেছে এখনো অনেক প্রশ্ন। মানবসভ্যতার ইতিহাসে নিষ্ঠুর করুণ ঘটনার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ হয়নি। 

 ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে সারাটা দিন পড়ে থাকলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মরদেহ। কেউ এগিয়ে গেল না। খুনিরা ভোরে চলে যাওয়ার পর কেউ এসে উঁকি মারলো না। চিৎকার করে বললো না, আওয়ামী লীগ অথবা বাকশাল কর্মীরা বেরিয়ে আসো। ছাত্রলীগ, যুবলীগ আসো, দেখো তোমাদের জাতির পিতাকে ওরা খুন করেছে। রেহাই দেয়নি বঙ্গমাতা, শিশু রাসেলসহ কাউকে। আসো আমরা প্রতিবাদ করি। শোক জানাই। নীরব কষ্টে অনেক কর্মী অপেক্ষায় ছিল একটি ডাকের। একটি আহ্বানের। ঢাকার নির্ধারিত কিছু এলাকা ছিল খুনিদের নিয়ন্ত্রণে। তখনো দেশে সামরিক শাসন জারি হয়নি। সারা দেশে সেনাবাহিনী নামেনি। পুলিশ ও অন্য বাহিনী ছিল হতভম্ব, নির্দেশবিহীন। খুনিদের গোলাবিহীন ট্রাঙ্ক দুটি রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টারের সামনে দাঁড়িয়ে। টার্গেট ভীতি তৈরি করা। তারা প্রতিপক্ষ হিসেবে নিয়েছিল রক্ষীবাহিনীকে। তারপরও সদর দপ্তরে প্রবেশে কাউকে বাধা দেয়নি। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর, মীরপুর রোড, বেতার ভবন, টেলিভিশন ভবন ও শাহবাগে ছিল খুনিদের পাহারা। বিচ্ছিন্নভাবে ট্যাংক ও খুনিদের একটা পাহারা ছিল। ঢাকার বাকি অঞ্চল ছিল মুক্ত। সারা দেশে বাধা দেয়ার কেউ ছিল না। খুনিদের ভেতরেই আতঙ্ক ছিল। তারা ভেবেছিল প্রতিরোধের মুখে পড়বে। একটা ছোটখাটো যুদ্ধ করতে হবে। সারা দেশে বিক্ষোভ হবে। দলীয় কর্মীরা বেরিয়ে আসবে। তাদেরকে সামাল দিতে হবে।

 বিভিন্ন বাহিনী তখনো আনুগত্য প্রকাশ করেনি খুনিদের প্রতি। একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি ১৫ই আগস্টের সারাবেলা। বেদনাবিধূর একটা পরিবেশ। নীরব আর্তনাদে সময় পার করছিলেন নগরবাসী। সাপ্তাহিক বাজারে কেউ বের হয়নি। একটা ভয়াবহ আতঙ্কজনক অবস্থা। রেডিওতে ভেসে আসছিল খুনিদের কণ্ঠস্বর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। রক্ষীবাহিনীর একজন কর্মকর্তা বলেছেন, আমরা ভেবেছিলাম সবাই বেরিয়ে আসবে। রাজনৈতিক কর্মীদের ঘিরে আমরাও নামবো। কেউ আসলো না। খুনিদের আক্রমণের সময় জাতির পিতা ফোন করলেন সবাইকে। কেউ এগিয়ে যায়নি। কোনো বাহিনী, সংস্থা পারলো না রক্ষা করতে ইতিহাসের মহানায়ককে। রাষ্ট্রনায়ককে রক্ষা করতে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতায় শামিল হলো সবাই। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নয়, বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগ একটা প্রতিবাদ মিছিল করতে পারলো না। খুঁজে পাওয়া গেল না ছাত্রলীগ, যুবলীগকে। রাষ্ট্রপতি রক্ষা করতে পাল্টা অবস্থান নিলো না সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ। জেনারেল শফিউল্লাহ নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করেই বলছেন, তিনি অধীন সবাইকে ফোন করেছেন। জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, সাফায়েত জামিল সবার সঙ্গে কথা বলেছেন। সবাইকে ডেকেছেন। বারবার বলেছেন ব্যবস্থা নিতে। তার কোনো কমান্ড ছিল না। তিনি ব্যর্থ ছিলেন। ৪৬ ব্রিগেড আসতে পারতো। আসেনি। সকালে সবাইকে নিয়ে বৈঠক করলেন। রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের ডেকে আনা হলো। তাদেরকে বলা হলো চুপ থাকতে। পরিস্থিতি রক্তাক্ত না করতে। সবকিছু থমকে দাঁড়ালো। বিশাল আকাশটা কালের সাক্ষী হলো। অবাক হয়ে দেখলো সবার ব্যর্থতা ও বিভ্রান্তিকর অবস্থান।  

১৪ই আগস্ট রাতে শেখ কামাল গিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতির পিতার অনুষ্ঠান। তিনি দেখলেন সারা দেশ থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জমায়েত হয়েছে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীও ক্যাম্পাসে। তিনি সন্তোষ প্রকাশ করে বাড়ি ফিরলেন। সবাইকে সতর্ক থাকতে বললেন, জাসদের গণবাহিনী ও সিরাজ সিকদারের সর্বহারা সম্পর্কে। তাদের অস্ত্রধারীদের সম্পর্কে। একই রাতে কাদের সিদ্দিকী বের হয়েছিলেন। তিনি পিজি হাসপাতালে অসুস্থ মাকে দেখতে যান। হঠাৎ ৭১ সালের এই যোদ্ধার কাছে কোনো কিছু স্বাভাবিক মনে হলো না। তিনি দেখলেন রাস্তায় ট্যাংক। তিনি অজ্ঞাত আশংকায় নিজের গাড়ি চালিয়ে মতিঝিল গিয়েও একটা ট্যাংক দেখলেন। তিনি ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর গেলেন। সব বললেন। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতরা বললেন, বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। তাই বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সেই রাতে কাদের সিদ্দিকীর ভালো ঘুম হলো না। ভোরে ঘুমানোর পর ছোট বোন ডেকে তুললো। জানালো জাতির পিতা আর নেই।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত ছিল দলীয় কর্মীদের। ঢাকায় ছিলেন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত জেলা গভর্নররা। তারা ঢাকা এসেছিলেন ২১ দিনের প্রশিক্ষণের জন্য। ২১ জুলাই প্রশিক্ষণ শুরু হয়। পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে গভর্নররা দায়িত্ব নেবেন। দেশকে এগিয়ে নিতে জেলাভিত্তিক উন্নয়নের সমন্বয় করতে বঙ্গবন্ধু সকল জেলায় একজন করে গভর্নর নিযোগ দিয়েছিলেন। ১৫ই আগস্ট তাদের প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার কথা। তারাও ঢাকায় ছিলেন। বর্বর নিষ্ঠুর হত্যার পর তারাও সবাই নিজের জেলায় একটা ফোন করতে পারতেন। নির্দেশ দিতে পারতেন প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের। বলতে পারতেন, সবাই মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়ো। চলে আসো ঢাকায়। এক কাদের সিদ্দিকী ছাড়া কেউই কোনো পদক্ষেপ নিলেন না। বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা শোনে আওয়ামী লীগ নেতারা বের হলেন কাপুরুষের ভূমিকা নিলেন সবাই। দেশের উপ-রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীদের অনেকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন নিরাপদ আশ্রয়ে। অন্য নেতাদের অবস্থানও একই ছিল। জাতির পিতার মৃত্যুতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ শোকে নির্বাক। তারা অপেক্ষায় ছিল। ভেবেছিল একটা ডাক আসবে। কিছু মানুষ সেই দিন সাহস করলেই বদলে যেতো সবকিছু। হত্যার বিচারের জন্য আমাদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো না। বাংলাদেশ তখনই ঘুরে দাঁড়াতো।  

বড় কষ্ট হয়। দুঃখ হয়। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পাশেই ছিল বিডিআর সদর দপ্তর। তখন বিডিআর প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান। ১৯৯২ সালে দৈনিক ভোরের কাগজে তার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তখন ভোরের কাগজে কাজ করতাম। এই লোকটি ৮৬ ও ৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচন করেন। দলীয় পদও পেয়েছিলেন কেন্দ্রে। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, ১৫ আগস্ট ভোরে কোথায় ছিলেন? বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর তিনি কীভাবে পান? জবাবে তিনি বলেন, খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠি। বাড়িতে সেভ করছিলাম। তখন রেডিওতে খবরটি শুনি। জাতির পিতাকে রক্ষা করার জন্য কোনো ফোন কী পাননি? অথবা নিজ থেকে কোনো তাগিদ অনুভব করেননি? এত কাছে থেকে গোলাগুলির শব্দ কী পাননি? জবাবে তিনি দাবি করেন অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। পরে সেনা সদরের বৈঠকে গিয়েছিলেন। বাস্তবে বঙ্গবন্ধু ও জেনারেল শফিউল্লাহ তাকে ফোন করেছিলেন। অনুরোধ করেছিলেন দ্রুত বিডিআর পাঠাতে। তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। পিলখানা থেকে বিডিআর বের হলে খুনিরা কিছুই করতে পারতো না। বিডিআর প্রধান শুধু ব্যর্থ ছিলেন না তার ভূমিকাও ছিল রহস্যময়। রক্ষীবাহিনীর অস্ত্র তখন রাতে রাখা হতো পিলখানা বিডিআর সদর দপ্তরে। অস্ত্র রাখার জন্য রক্ষীবাহিনীর নিজস্ব কোনো কোত বা অস্ত্রাগার ছিল না। এই কারণে বিডিআর সদর দপ্তরে অস্ত্র রাখতো তারা। ১৫ই আগস্ট সকালে রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিলেন তাদের অস্ত্র নিয়ে আসবেন। রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান আবুল হাসান খান ফোন করেন জেনারেল খলিলুর রহমানকে। তিনি কোনো অস্ত্র ফেরত দেননি। রক্ষীবাহিনীর যিনি বিডিআর সদর দপ্তরে গেলেন ট্রাক নিয়ে অস্ত্র আনতে তিনি ফিরলেন শূন্য হাতে। বিকালে খন্দকার মোশতাক চিফ অব দ্যা ডিফেন্স স্টাফ নিয়োগ দেন এই খলিলুর রহমানকে। জেনারেল ওসমানীকে করেন নিরাপত্তা উপদেষ্টা। এটা কিসের পুরস্কার ছিল? তারপরও খলিলুর রহমান আবার আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। মনোনায়ন নেন। ভোট করেন। অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা ভাবলে গা এখনো শিউরে ওঠে। ভয় ধরে যায় মনে।  ১৫ই আগস্ট রক্ষীবাহিনীর দুই উপ-পরিচালক সরোয়ার মোল্লা ও আনোয়ারুল আলম শহীদকে বঙ্গভবনে ডেকে নেন সিজিএস খালেদ মোশাররফ। তারা দেখলেন, ভারতের হামলার আশংকার কথা বলছেন খালেদ মোশাররফ। তিনি হামলা প্রতিরোধে অপারেশন কক্ষ স্থাপন করছেন। জেনারেল ওসমানী সবার সঙ্গে কথা বলছেন। বঙ্গভবনে খুনি ফারুক-রশীদরা ব্যস্ত। তারা বিভিন্ন নির্দেশ আদেশ দিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে উঠেন আরও অনেক কর্মকর্তা। আমিন আহমেদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের দায়িত্ব নেন। বঙ্গভবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেন লে. কর্নেল এম এ মতিন। জিয়াউর রহমান বারবার বৈঠক করছেন বিডিআর প্রধান খলিলুর রহমান, পুলিশ প্রধান এ কে নুরুল ইসলাম ও ব্রিগেডিয়ার মশহুরুল হকের সঙ্গে। আনোয়ারুল আলম শহীদ সেই দিনের ঘটনা নিয়ে বলেছেন, ‘বঙ্গভবনের কেবলই কথা হচ্ছে ভারতীয় হামলা নিয়ে। কোথায়ও নির্দেশ দিতে দেখলাম না সীমান্তে সেনা মোতায়েন করার। জিয়াউর রহমান রক্ষীবাহিনীর দুই কর্মকর্তার কাছে জানতে চান, তোফায়েল আহমেদ কী রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে? জবাবে তারা মাথা নাড়তেই জিয়াউর রহমান আবার বলেন, তাকে আটক করার জন্য পুলিশের এসবির কর্মকর্তা আবদুস সালামকে পাঠানো হয়েছে। তোমরা তাকে সহায়তা করবে। আবদুস সালাম রক্ষীবাহিনীর অফিস থেকে তোফায়েল আহমেদকে আটক করে গাড়িতে তোলেন। আর কোনো নির্দেশ না থাকায় ঢাকা শহর ঘুরিয়ে পরে তার বাড়িতে রেখে আসেন।  

কর্নেল সরোয়ার মোল্লা বললেন, সেনাবাহিনীর মনোভাব ছিল রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে। যে কর্মকর্তাদের আমাদের পক্ষের মনে করতাম তারা পরামর্শ দিলেন যেন চুপ থাকি। বাড়াবাড়ি না করি। রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ের সামনে ট্যাংক। রক্ষীবাহিনীর বেশির ভাগ সদস্য সাভার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা বারবার সেনা প্রধানের সঙ্গে কথা বলেন। রক্ষীবাহিনীর নুরুজ্জামান ১২ই আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেই সময়ে তিনি কেন আমেরিকা গেলেন? তাকে কারা পাঠানোর সুপারিশ করেছিলেন? প্রশ্ন অনেক। উত্তর নেই। তার অনুপস্থিতিতে মেজর আবুল হাসান খান ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। সেনাবাহিনীর ওপর সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। উপ-সেনাপ্রধান ছিলেন জিয়াউর রহমান। চিফ অব দ্যা জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফ। আর ৪৬ ডিভিশনের দায়িত্বে সাফায়েত জামিল। তাদের নিজেদের ভেতরে অভ্যন্তরীণ বিরোধ ছিল। ক্ষমতার লড়াই ছিল। দুর্বলচিত্তের শফিউল্লাহকে কেউই মানতেন না। পাত্তাও দিতেন না।  

সিজিএস খালেদ মোশাররফ ফোন করেন রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তা আনোয়ারুল আলম শহীদ ও সরোয়ার মোল্লাকে। তাদেরকে জানান দুইজনের একজনকে রেডিও স্টেশনে যেতে হবে। তিনি আরও জানান, সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ, বিমানবাহিনী প্রধান এ কে খন্দকার, নৌবাহিনী প্রধান এমএইচ খান, পুলিশ প্রধান এ কে নুরুল ইসলাম ও বিডিআর প্রধান খলিলুর রহমান খুনি সরকারে প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবেন। রক্ষীবাহিনীও যেন যায়। সরোয়ার ও শহীদ তাকে জানান তাদের বাহিনী প্রধান কর্নেল নুরুজ্জামান দেশের বাইরে। তার কাছ থেকে কোনো নির্দেশ না পেলে তারা যেতে পারেন না। আবুল হাসান ভারপ্রাপ্ত প্রধানের দায়িত্বে। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন করেন খালেদ মোশাররফ। এবার বললেন, সরোয়ার ও শহীদ যেন রেডিও স্টেশনে যান। এটা সেনা সদরের সিদ্ধান্ত। তাদেরকে কথা বলতে না দিয়েই তিনি ফোন রেখে দেন। রেডিও স্টেশন যান রক্ষীবাহিনীর দুই কর্মকর্তা। তারা সেখানে গিয়ে দেখেন মোশতাক ও তাহের উদ্দিন ঠাকুর বসে আছেন। ডালিমসহ আরও কিছু খুনি অস্ত্রহাতে ঘুরাঘুরি করছে। এইভাবে সেইদিন সকল বাহিনীর সদস্যরা খুনি সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলো। সেই সময় দেশের রাষ্ট্রপতির মরদেহ পড়ে থাকলো ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে। 

 রেডিও স্টেশন থেকে বের হয়ে সরোয়ার ও শহীদ তাদের অফিসে আসলেন। তারা ফোন করলেন আওয়ামী লীগ নেতা, তখনকার বাকশালের আবদুর রাজ্জাককে। জানানো হলো, রাজ্জাক ভাই বাড়িতে নেই। তারপর তারা ফোন করলেন তোফায়েল আহমেদকে। তাকে অনুরোধ করলেন রক্ষীবাহিনী সদর দপ্তরে আসতে। তোফায়েল আহমেদ রক্ষীবাহিনী অফিসে আসতে সম্মত হলেন। রক্ষীবাহিনীর লিডার দীপক কুমার হালদারকে পাঠানো হয় তোফায়েল আহমেদকে নিয়ে আসতে। তোফায়েল আহমেদ রক্ষীবাহিনী অফিসে আসলেন। তখনো তিনি অনেক কিছু জানতেন না। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার কথা শুনে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। হাউমাউ করে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। তাকে সান্ত্ব্তনা দিলেন রক্ষীবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারপর আনোয়ারুল আলম শহীদ ও সরোয়ার মোল্লার অনুরোধে তোফায়েল আহমেদ রক্ষীবাহিনী অফিসে বসে ফোন করলেন, সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ, দলের সিনিয়র মন্ত্রী ও নেতাদেরকে। সারোয়ার মোল্লা জানান, কারও কাছ থেকে কোনো সাড়া ফেলেন না তোফায়েল আহমেদ। কেউ সম্মত হলেন না বের হতে। অসহায় অবস্থান নিয়ে তোফায়েল তাকালেন রক্ষীবাহিনীর দুই কর্মকর্তার দিকে। তারপর আবার কাঁদলেন। বসে থাকলেন চেয়ারে। তিনি বললেন, আমি এখানেই থাকি। তোমরা যেভাবে বলবে কাজ করবো।  

এদিকে একই সময়ে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা লে. কর্নেল আমিন আহমেদ চৌধুরী সাভার রক্ষীবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যান। তিনি সেখানকার একজন ভারতীয় প্রশিক্ষক মেজর বালা রেডিউকে আটক করে ঢাকায় নিয়ে আসেন। পরে তাকে রেখে যান রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে। কার নির্দেশে জয়দেবপুরে কর্মরত আমিন আহমেদ চৌধুরী এই কাজ করেছিলেন তা আজও রহস্যবৃত্ত। পরে বালা রেডিউ রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেন তাকে ভারতীয় হাইকমিশনে পাঠিয়ে দিতে। রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা তাই করেন। আর বিকালে খুনি সরকারের প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিবের দায়িত্ব নেন আমিন আহমেদ চৌধুরী। কী অদ্ভুত সব সমীকরণ! প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ছিলেন তখন রুহুল কুদ্দুস, প্রধানমন্ত্রীর সচিব ছিলেন আবদুর রহিম। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন এইচটি ইমাম। তারাও কেউই রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করতে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। এইচটি ইমাম খুনি সরকারের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। তাকে কোনো সেনা কর্মকর্তা বঙ্গভবনে ডেকেছিলেন কিনা জানা যায়নি। তবে তিনি এবং তখনকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ফকরুদ্দিন একই গাড়িতে করে গিয়েছিলেন।  

রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা ছিল নজীরবিহীন। উপ-রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবর্গ, ক্ষমতার মসনদে বসে কী করেছিলেন? মোশতাক ও তার দোসরা শপথ নেয়ার পূর্বপর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। তাদের কাজ কী ছিল? ষড়যন্ত্রের প্রধান হোতা মোশতাকের সঙ্গে অন্যরা অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করলেন। অনেকে যোগ দিলেন মোশতাক মন্ত্রিসভায়। ফণিভূষণ মজুমদার তখন হাসপাতালে ছিলেন। খুনি সেনারা তাকে শপথ নিতে পিজি হাসপাতাল থেকে নিয়ে যান। হাসপাতালে বাধা দিয়েছিলেন কবি জসিমউদ্‌দীন। তিনিও তখন সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মানুষটা বাঁচবে না। ফণিভূষণ, আবু সাঈদ চৌধুরীসহ কয়েকজনকে মোশতাক নিয়েছিলেন নিজের স্বার্থে। দেখাতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু নাই। বাকি সব ঠিক আছে। জীবনের অর্ধেক কবরে যাওয়ার মুহূর্তে এই বয়োবৃদ্ধরা গিয়েছিলেন জীবন বাঁচার তাগিদে। আবার তাহের উদ্দিন ঠাকুরের মতো অনেকে গেলেন ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে।  

জাতির পিতা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতদের মধ্যে কর্নেল জামিল ছাড়া আর কেউ জীবন দেননি। কেউ প্রতিরোধে যাননি। নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনকারীরা ব্যর্থ হয়েছিলেন। তারপরও তাদের পরিবার পরিজন অনেকেই গত ১৫ বছরে পুরস্কার পেয়েছে। পাচ্ছে। এমনকি সরাসরি সেনাবাহিনীর ভেতরে আলাদা বিদ্রোহী সেনা তৈরির কারিগর কর্নেল তাহেরের পরিবারও পুরস্কার থেকে বাদ যায়নি। বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা অনেক উদারতা দেখিয়েছেন। দুনিয়াতে এমন উদারতা নজীরবিহীন। পিতার মতো মন পেয়েছেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। 

 বঙ্গবন্ধু একবারও ভাবেননি তাকে কোনো বাঙালি হত্যা করতে পারে। পাকিস্তানিরা তাকে হত্যার চেষ্টা করেছিল। সাহস পায়নি। খুনির বেশে আসা সেনাদের দেখে তিনি অবাক হন। মৃত্যুর আগে সবাইকে ফোন করেন। সেনাবাহিনী, রক্ষীবাহিনী, পুলিশ, বিডিআর, রাজনীতিবিদ কেউই বাদ ছিল না। বঙ্গবন্ধুকে ভোরে শেখ মনি ফোনে জানান, রক্ষীবাহিনী তার বাড়িতে কালো পোশাক পরে হামলা করেছে। বঙ্গবন্ধু ফোন করেন রক্ষীবাহিনীর আনোয়ারুল আলম শহীদকে। বঙ্গবন্ধু ফোনে তাকে বলেন, মনির (শেখ মনি) বাসায় কালো পোশাকধারী কারা যেন হামলা করেছে। একটু দেখ। জাতির পিতাকে তখন আনোয়ারুল আলম বলেন, স্যার আমি দেখছি। একটু পর তোফায়েল আহমেদও ফোন করেন আনোয়ারুল আলম ও সরোয়ার মোল্লাকে। বললেন, মনি ভাই’র বাড়িতে হামলা করেছে রক্ষীবাহিনীর একটি গ্রুপ। তোমরা এখনই দেখো। তারা খোঁজ নিলেন। দেখলেন রক্ষীবাহিনীর কোনো টিম শেখ মনির বাড়ির দিকে যায়নি।  

বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়ে জেনারেল শফিউল্লাহ ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়েত জামিলকে বারবার ফোন করেন। কিন্তু তাকে পাননি। সেনাপ্রধান তার অধীন সবচেয়ে ক্ষমতাবান কর্মকর্তাকে রাষ্ট্রের কালো অন্ধকার সময়ে ফোনে পান না, কী অদ্ভুত! এরপর তিনি জিয়াউর রহমান ও খালেদ মোশাররফকে ফোন করেন। তাদেরকে বঙ্গবন্ধুর ফোনের কথা জানান। ব্যবস্থা নিতে বলেন। সকালে জিয়াউর রহমান, সিজিএস খালেদ মোশাররফ, ডিজিএফআই প্রধান আবদুর রউফকে নিয়ে অসহায় সেনাপ্রধান বৈঠক করেন। সেনাপ্রধানের সামনে সবাই আলাপ করলেন সাংবিধানিক ধারা নিয়ে। সেনা আইন লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি আসলো না। 

 বঙ্গবন্ধু শেষ মুহূর্তে তার বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক সহযোগীকেও ফোন করেন। তারা কেউ সরাসরি এগিয়ে যাননি। কর্মীদের কোনো নির্দেশ দেননি। সকালে রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাড়িতে যান। গিয়ে জানতে পারেন ভোরে তিনি এক আত্মীয়ের সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছেন। তাকে তারা খুঁজে পাননি। মনসুর আলীর বাড়ি গিয়ে জানতে পারেন তিনিও বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছেন। সঙ্গে ছিলেন তার একান্ত সচিব। রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবুল হাসান খান ফোন করেন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে। বারবার অনুরোধ করেন তাদের পিলখানায় রক্ষিত অস্ত্র গোলাবারুদ ফেরত দিতে। তারা ডেপুটি লিডার হাফিজ উদ্দিনকে অস্ত্র আনতে পাঠিয়েছেন পিলখানায়। খলিলুর রহমান অস্ত্র দেননি। তিনি হাফিজ উদ্দিনকে পিলখানায় প্রবেশ করতে দেননি। সাভারে রক্ষীবাহিনীর দুটি ব্যাটালিয়ন ছিল। বেশির ভাগ কোম্পানি ঢাকার বাইরে বিভিন্ন মহকুমা ও জেলায় নিয়োজিত ছিল অস্ত্র উদ্ধারে। তারা সবাই ছিল মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা। নির্দেশের অভাবে নীরবে কেঁদেছিলেন তারা। দুইজন সাধারণ সিপাই সাভারে আত্মহত্যা করেন। সেনাবাহিনীতে বঙ্গবন্ধুর সমর্থক সেনা কর্মকর্তারা কোনো লড়াই চাননি নিজেদের ভেতরে। রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা যোগাযোগ করেন তাজউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, তোমরা উপ-রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলো। তারা বললেন, যোগাযোগ করেছি। তারা বাসা ছেড়ে চলে গেছেন। তখন তাজউদ্দিন আহমেদ ভেঙে পড়েন। ডিজিএফআই’র ঢাকা ডিটাচমেন্ট কমান্ডার ছিলেন মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ। তিনি রক্ষীবাহিনীর অফিসে আসেন। সরোয়ার মোল্লা ও আনোয়ারুল আলম শহীদকে সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে পাঠিয়েছেন সিজিএস খালেদ মোশাররফ। জিয়া উদ্দিনের গাড়িতে চড়ে ৪৬ ব্রিগেডে গেলেন তারা। ব্রিগেড কমান্ডারের রুমে তারা প্রবেশ করলেন। ব্রিগেড কমান্ডারের চেয়ারে খালেদ মোশাররফ। পাশে সাফায়েত জামিল। ৩০ থেকে ৩৫ জন অফিসার দাঁড়িয়ে। তাদেরকে খালেদ মোশাররফ নির্দেশ দিচ্ছেন। কোনো নির্দেশ খুনিদের উৎখাতের ছিল না। তারা চিন্তিত দেশের অস্তিত্ব নিয়ে। সরোয়ার মোল্লা ও আনোয়ারুল আলম শহীদ বলেছেন, আমরা ভেবেছিলাম তিনি আমাদেরকে নিয়ে প্রতিরোধে নামবেন। তেমন নির্দেশ দেবেন। তারা তা করেননি। 

 ১৫ই আগস্ট একটা দিন কেটে গেল দায়িত্ববানদের সিদ্ধান্তহীনতায় আর খুনিদের উল্লাসনৃত্যে। চক্রান্তকারীরা ব্যস্ত ছিল শিয়াল চোখে সব কিছু সামলে উঠার তৎপরতায়। আওয়ামী লীগ নেতারা কাপুরুষতা দেখিয়েছেন সারা দেশে। ইতিহাসের ভয়াবহতার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ কেউই করলেন না। সেনাবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন গুটিকয়েক খুনির বিরুদ্ধে সেইদিন কেউই রুখে দাঁড়ালেন না। সবাই ব্যস্ত ছিলেন নানামুখী হিসাব-নিকাশে আর নিজেদের রক্ষা নিয়ে। লে. কর্নেল হামিদ লিখেছেন, কীভাবে ৩২ নম্বরে পড়ে থাকা জাতির পিতা ও তার পরিবারের মরদেহগুলো পড়েছিল। তারা তালিকা করে দাফনের ব্যবস্থা করেন। দলের কোনো নেতা, সিভিল প্রশাসনের শীর্ষ বা নবীন কর্মকর্তাদের কেউই আসেননি, যাননি ৩২ নম্বরে। অথচ একদিন আগেও সবাই ব্যস্ত ছিলেন কীভাবে এই পরিবারটির সঙ্গে একটু সাক্ষাৎ ও আনুকূল্য পাওয়ার আশায়।   

সেনা কর্মকর্তাদের মতো ব্যর্থ ছিলেন রাজনীতিবিদরাও 

খুনিদের নিষ্ঠুরতা বর্বরতায় পুরো ৩২ নম্বর বিষাদ সিন্ধুর কারবালা ময়দানকে হার মানায়। বিশ্বমানবতা, সভ্যতা, মানচিত্র ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল রাতভর খুনিদের তাণ্ডবলীলায়। ১৫ই আগস্ট সারাদিন শেষ হয়ে রাত অব্দি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে পড়ে থাকলো। কেউ এগিয়ে গেল না। রাত ১২টায় একটি দিন শেষ হয়ে গেল। ঘড়ির কাঁটায় যোগ হলো ১৬ই আগস্টের। লে. কর্নেল হামিদ বঙ্গভবনের নির্দেশে ১৬ই আগস্ট ভোর রাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গেলেন সকল মরদেহ দাফনের ব্যবস্থা করতে। তার যাওয়ার পূর্বপর্যন্ত বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার মরদেহ সিঁড়িতে পড়েছিল। কোনো আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাকে ধানমণ্ডির আশপাশে দেখা গেল না। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে নেতার লাশ রেখেই কাপুরুষের মতো আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতারা ব্যস্ত হলেন নিজেদের বেঁচে থাকার চিন্তায়। অনেকে বাড়ি ছেড়ে পালালেন। আরেক দল বেঈমান যোগ দিলেন মোশতাকের মন্ত্রিসভায়। নির্লজ্জের মতো শপথ পড়লেন। অথচ মাত্র বারো ঘণ্টা আগেও বঙ্গবন্ধু কার দিকে তাকালেন আর কার দিকে তাকালেন না এনিয়ে তারা ঘুম হারাম করতো। সেই নেতারা বঙ্গবন্ধুর মরদেহ সিঁড়িতে রেখেই ব্যস্ত হলেন ক্ষমতার ভাগ নিয়ে। বঙ্গভবনে মন্ত্রিসভার শপথ পরিচালনা করলেন কেবিনেট সচিব এইচটি ইমাম। বঙ্গবন্ধু সরকারের বিভিন্ন বাহিনী প্রধানরা চূড়ান্ত বেহায়পনা নিয়ে সেই শপথে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারা শপথ শেষে স্যালুট দিলেন মোশতাককে। অনেকে খুনি ফারুক, রশিদ, ডালিম চক্রকে অভিনন্দন জানালেন।  আচ্ছা আওয়ামী লীগ কেন প্রতিরোধ গড়তে পারলো না? সেনাবাহিনীর কর্নেল জামিল জীবন দিলেন। দায়িত্বরত পুলিশের একজন ডিএসপিসহ দুইজন সদস্য লড়ে প্রাণ হারালেন। নির্দেশের অভাবে রক্ষীবাহিনীর তিনজন সদস্য কিছু করতে না পারার কষ্টে আত্মহত্যা করলেন। চট্টগ্রামের ব্রিগেড কমান্ডার (জিওসি পদ ছিল না) ব্রিগেডিয়ার দস্তগীর ১৫ই আগস্ট খুনিদের বিরুদ্ধে পাল্টা অবস্থানের ঘোষণা দেন। তিনি চট্টগ্রাম বেতার ভবনে গিয়ে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদের ডাকলেন। ফোন করলেন। অনুরোধ করলেন মিছিল নিয়ে বেরিয়ে আসতে। তার আহ্বানে কেউ সাড়া দিলেন না। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর ঢাকায় ব্যাপক সাংগঠনিক অবস্থান ছিল না। তিনি ছিলেন টাঙ্গাইলে একক জনপ্রিয়। তারপরও জাতির পিতার নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে তিনি বসে থাকতে পারলেন না। ঢাকা ছাড়লেন। নিজের অঞ্চলে গিয়ে ডাক দিলেন প্রতিরোধ যুদ্ধের। শুরু করলেন আরেক সশস্র সংগ্রাম। সেই যুদ্ধ নিয়ে আলাদা করে একটা অংশ লিখবো। ফিরে আসি ১৫ই আগস্ট সকালে ঢাকার আওয়ামী লীগের চিত্র নিয়ে। সিনিয়র সকল নেতার সঙ্গে কথা বললেন রক্ষীবাহিনীর দুই কর্মকর্তা সরোয়ার মোল্লা ও আনোয়ারুল আলম শহীদ। তারা নেতাদের অনুরোধ করলেন, সারা দেশের কর্মীদের মিছিল নিয়ে বেরিয়ে আসার নির্দেশ দিতে। রক্ষীবাহিনী জেলায় জেলায় পাশে থাকবে। কারও সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়াই দুই তিনটি জেলা নিজ উদ্যোগে মিছিল করেছিল। বাকিরা বের হয়নি। এখন যত কথা বলুক সেই দিনের প্রতিরোধ ব্যর্থতার দায় তখনকার পুরো আওয়ামী লীগের সকল শীর্ষ নেতাদেরকে কম বেশি নিতে হবে। 

 রক্ষীবাহিনীর কর্নেল (অব.) সরোয়ার মোল্লা বলেছেন, তারা সকালে ফোন করেছিলেন, তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাককে। যোগাযোগ করেছেন আরও অনেক নেতার সঙ্গে। একমাত্র তোফায়েল আহমেদ তাদের অফিসে এসেছিলেন। তোফায়েল আহমেদকে দিয়ে তারা সারা দেশে কিছু ফোন করান। আবদুর রাজ্জাক কথা দিয়ে বলেছিলেন, আসবেন। তিনি যাননি রক্ষীবাহিনী অফিসে। তার বাড়িতে গিয়ে তাকে পায়নি রক্ষীবাহিনী। এনিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিন আহমেদ কিছুদিন আগে আমাকে বলেছেন, ১৫ই আগস্ট তিনি পাবনাতে ছিলেন। ঢাকার বাইরে গুটিকয়েক জেলায় বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ হয়েছিল পাবনা তার মধ্যে একটি। সকালে মোহাম্মদ নাসিমের সঙ্গে ফোনে আলাপের ভিত্তিতে তিনি মিছিলের নেতৃত্ব দেন। মনসুর আলী সাহেব চেয়েছেন পাবনা থেকে আন্দোলন শুরু হোক। ছাত্রলীগ নেতা বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিন রক্ষীবাহিনীর স্থানীয় লিডারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। রক্ষীবাহিনীর জেলা লিডার তাকে জানান, ঢাকা থেকে নির্দেশ এসেছে প্রস্তুত থাকার। পাল্টা ব্যবস্থা নেবে রক্ষীবাহিনী। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে হেডকোয়ার্টার থেকে। পাবনা জেলা সেভাবেই প্রস্তুত ছিল। রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা স্পষ্টভাবে বলেছেন, তাদের পরিচালক দেশে ছিলেন না। সিআইএ’র আমন্ত্রণে আমেরিকা যাওয়ার পথে তিনি লন্ডন ছিলেন। সকাল থেকে তাকে কেউ পাচ্ছিলেন না। লন্ডনে তখন মধ্যরাত। পরে পাওয়া গেলে তিনি আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশ ফলো করতে বলেন।  

জানের ভয়ে ভীত আওয়ামী লীগ নেতারা চুপসে যান ভোর বেলায় খুনি ডালিমের বেতারের ঘোষণায়। সেইদিন কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ ছিলেন শপথে ব্যস্ত, কেউ নিজের জীবন রক্ষায়। নেতাদের ভীতুর মতো অবস্থানই সর্বনাশ ঘটিয়ে দেয়। কর্মীরা সিদ্ধান্তহীন হয়ে পড়ে। ব্যর্থতা ও দ্বিধাদ্বন্দ্বের এই সুযোগকে কাজে লাগায় খুনি খন্দকার মোশতাক চক্র। মোশতাক শপথে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে নেন সেনাবাহিনী পাঠিয়ে। আবার কেউ কেউ নিজেরাই মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেতে যোগাযোগ করে ফুল নিয়ে যান। তখনকার পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা ফণিভূষণ মজুমদার। তাকে হাসপাতাল থেকে নেয়া হয়। ফণিবাবু সেনাবাহিনী দেখে ভুলে গিয়েছিলেন তিনি বৃটিশবিরোধী আন্দোলন করেছিলেন। তার প্রিয় মানুষ বাংলাদেশের জাতির পিতাকে খুন করা হয়েছে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী চূড়ান্ত ভদ্রলোক ছিলেন। তার স্ত্রী জার্মানিতে ফোন করে বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের খবর নিয়েছিলেন ১৫ই আগস্ট সকালে। মোশতাকের নির্দেশে তাকেও আর্মিরা তুলে নেয় শপথে। বহির্বিশ্বের সুনাম তৈরি করতে মোশতাক তাদের শপথে নেয়। মন্ত্রিসভার বাকি সদস্যদের প্রায় সবাই যোগ দেন উৎসাহ নিয়ে। শপথ অনুষ্ঠানে দেখা গেল বঙ্গবন্ধুর এডিসিরা হয়ে গেলেন মোশতাকের এডিসি।  

মোশতাকের উপ-রাষ্ট্রপতি হন মোহাম্মদ উল্লাহ। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পড়ে জানা যায়, একজন সাধারণ উকিল থেকে বঙ্গবন্ধু দলীয় পদ অফিস সেক্রেটারি দিয়েছিলেন মোহাম্মদ উল্লাহকে। স্বাধীনতার পর করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। এ ছাড়া মোশতাক মন্ত্রিসভায় যোগ দেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, ফণিভূষণ মজুমদার, মনোরঞ্জন ধর, আবদুল মোমেন, আসাদুজ্জামান খান, ড. এ আর মল্লিক, ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী, আবদুল মান্নান ও সোহরাব হোসেন। প্রতিমন্ত্রী হন, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, দেওয়ান ফরিদ গাজী, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর এবং কে এম ওবায়দুর রহমান। ২০শে আগস্ট শপথ নেন আরও পাঁচ জন। তারা হলেন, মোসলেম উদ্দিন খান, ক্ষিতিশ চন্দ্র মণ্ডল, রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন ও মোমিন উদ্দিন আহমেদ। ২০শে আগস্ট সেনা পাঠিয়ে শপথ গ্রহণের জন্য জিল্লুর রহমান ও তোফায়েল আহমেদকে বঙ্গভবনে ধরে নিয়ে যান মোশতাক। হুমকির মুখে দুইজনই অসম্মতি জানিয়েছিলেন মোশতাক মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে। মিজানুর রহমান চৌধুরীকে ফোন করে বঙ্গভবনে নেয়া হয়েছিল। তিনি মোশতাককে কৌশলে এড়িয়ে যান। মিজান চৌধুরী তখন মোশতাককে বলেছেন, তিনি মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন বদনাম নিয়ে। তাকে নেয়া ঠিক হবে না। তিনি আরও বলেছিলেন, আমি রাজনৈতিক কর্মী। মন্ত্রিসভায় নয়, সুযোগ পেলে আওয়ামী লীগ করবো। কথাগুলো অনেক বছর আগে তিনি ১৯৮৯ সালে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার জন্য প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন আমাকে।  

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এনএসআই প্রধান এবিএস সফদর পদোন্নতি পান মহাপরিচালক হিসেবে। শফিউল আজমকে ক্যাবিনেট সচিব করা হয়। মাহবুবুল আলম চাষীকে করা হয় মুখ্য সচিব। তোবারক হোসেনকে করা হয় পররাষ্ট্র সচিব। কেরামত আলীকে সংস্থাপন (এখনকার জনপ্রশাসন) সচিব করা হয়। এই কেরামত আলী ৯১ সালে বিএনপি’র মন্ত্রী ছিলেন। রাজাকার জহির উদ্দিনকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত করা হয়। ইয়াহিয়ার মন্ত্রী কাজী আনোয়ারুল হক হলেন খুনি রাষ্ট্রপতির নতুন উপদেষ্টা। সার্বিক পরিস্থিতি বিপরীত দিকে ঘুরতে থাকে। হত্যার খবর শুনে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভেঙে পড়েন। পরে তিনি আটক হন সরকারি বাড়ি থেকে। ২৫শে আগস্ট তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, জিল্লুর রহমান আটক হন। তাদেরকে চোখবেঁধে শাহবাগ পুলিশ কন্ট্রোল রুমে রাখা হয়। তোফায়েল আহমেদের এপিএস মিন্টুকে নির্যাতন করে খুনি সেনা কর্মকর্তারা হত্যা করে। ২২শে আগস্ট স্পিকার আবদুল মালেক উকিল লন্ডন যান ইউরোপিয়ান সংসদীয় পার্টির বৈঠকে যোগ দিতে। মহিউদ্দিন আহমেদ মস্কো গিয়েছিলেন বিশেষ দূত হয়ে। তিনি আবার ৪ঠা নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দেন। কয়েকজন এমপি মোশতাক সরকারকে শক্তিশালী করার পক্ষে বিবৃতি দেন। তাদের নাম প্রকাশ করা জরুরি জাতির সামনে। 

 বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিন ঢাকাতে ছিলেন নবনিযুক্ত সকল জেলা গভর্নর। এমপিরা ছিলেন নাখালপাড়া হোস্টেলে। কেন্দ্রীয় নেতারা সবাই ঢাকায় ছিলেন। ছাত্রলীগ নেতারা সারা দেশ থেকে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। এমপি, গভর্নর আর কেন্দ্রীয় নেতারা বের হলেই পরিস্থিতি বদলে যেতো। তারা হেঁটে ৩২ নম্বর গেলে কতোজনকে খুনিরা হত্যা করতে পারতো? বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে বের হয়ে ছাত্রলীগ পাড়া-মহল্লায় ছড়িয়ে মিছিল ছড়িয়ে দিতে পারতো। তারা কেউ বের হননি। সবাই তখন ব্যস্ত নিজের নিরাপত্তা নিয়ে। জাতির পিতা ও তার পরিবারের কী হয়েছে, কে বেঁচে আছে, কে নেই সেই খবর নেয়ার কেউ ছিলেন না। ১৫ই আগস্ট জাতির পিতার জন্য আওয়ামী লীগের কেউ জীবন দিলেনও না। চট্টগ্রাম সেনা ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার দস্তগীর আশা করেছিলেন, ঢাকার ৪৬ ব্রিগেড, রংপুর ব্রিগেডের হুদা ভূমিকা নিয়ে বেরিয়ে আসবেন। তারা ভূমিকা নেননি। ঢাকা থেকে ওয়ারলেসে সবাইকে শান্ত থাকার অনুরোধ যাচ্ছিলো বারবার। ব্রিগেডিয়ার দস্তগীর কারও অনুরোধ শুনলেন না। তিনি চট্টগ্রামের সকল নেতাকে ফোন করেন। তিনি বলেন, বেতারে ঘোষণা দিচ্ছি খুনি মেজর ও তাদের খুনি প্রেসিডেন্টকে আমরা মানি না। আপনারা আসুন। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নিয়ে মাঠে নামুন। সবাই মিলে খুনিদের উৎখাত করবোই। চট্টগ্রামের কোনো নেতাই যোগ দেননি দস্তগীরের সঙ্গে। তারপরও দস্তগীর রেডিওতে গিয়ে বলেছেন, আমরা সংবিধান রক্ষা করবো। অবৈধ মোশতাক সরকারকে আমরা মানি না। দস্তগীরের ঘোষণা খুনিদের ভেতরে কম্পন ধরিয়ে দেয়। এই সময় ঢাকার সিনিয়র অফিসাররা লাইন ধরে খুনিদের সমর্থন না জানালে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারতো। আর আওয়ামী লীগ নেতারা বেরিয়ে আসলে কর্মীরা সারা দেশ হতো উত্তাল। ১৫ই আগস্ট সবাই কাপুরুষের ভূমিকায় নিলেন। নীরবে কাঁদলেন কর্মীরা।  

১৫ই আগস্ট ভোরে পুলিশের আইজি নুরুল ইসলাম, সেনাপ্রধান শফিউল্লাহকে ফোন করেন প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী। শফিউল্লাহ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ফোনের কথা স্বীকার করেন। মনসুর আলী ফোনে শফিউল্লাহ ও আইজিপিকে বলেন, কিছু লোক রেডিও অফিস দখল করেছে। তাদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নিন। সেই ব্যবস্থা নিতে যাননি সেনাপ্রধান ও পুলিশ প্রধান। মনসুর আলী সাহেব তখনো জানতেন না বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। তার অনুরোধে বেতার ভবনে যায় রক্ষীবাহিনীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টহলরত একটি দল। তারা বেতার ভবনে প্রবেশের মুহূর্তে তাদেরকে ভারী অস্ত্র তাক করে হ্যান্ডসআপ করান মেজর ডালিম ও শাহরিয়ার। তাদেরকে বেতার ভবনের ভেতরে আটকে রাখা হয়। রক্ষীবাহিনীর গাড়ির ব্যাটারি ব্যবহার করে বেতারের জেনারেটর চালু করা হয়। তারপর ডালিম ঘোষণা দিতে থাকেন। 

 বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাজনীতিবিদদের টালমাটাল চিত্র দেখে প্রথম ক্ষোভ প্রকাশ করেন ছাত্র নেতারা। তারা রাজনীতিবিদদের ওপর চাপ প্রয়োগ শুরু করেন প্রতিবাদ শুরু করার জন্য। ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধু হত্যা মেনে নিতে পারছিল না। সবার আগে ছাত্রলীগ ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করে। অন্য প্রগতিশীল ছাত্রনেতারাসহ তারা নিজেদের মধ্যে বসতে শুরু করে। এনিয়ে অধ্যাপক আবু সাইয়ীদ লিখেছেন, ছাত্র নেতাদের মধ্যে রবিউল আলম, ওবায়দুল  মোকতাদির চৌধুরী, ইসমত কাদির গামা, মমতাজ হোসেন, নুরুল ইসলাম নাহিদ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, কাজী আকরাম হোসেন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে কাজ শুরু করেন। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ের আরও অনেকে যুক্ত হন। অধ্যাপক আবু সাইয়ীদের বইতে এমপিদের অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত রয়েছে। এমপিদের একটি গ্রুপ মোশতাককে বৈধতা দিতে বঙ্গভবনে বৈঠকের তৎপরতা শুরু করে। ছাত্রনেতারা মোশতাকের সঙ্গে বৈঠকের বিরুদ্ধে ছিল। তাদের মতো বৈঠকের বিরুদ্ধে তখনকার এমপি সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, শামসুদ্দিন মোল্লা, এডভোকেট সিরাজুল হক, ডা. এসএ মালেক, ঝিনাইদহের কামরুজ্জামান, ডা. আবুল খায়ের, নুরুল আলম, রওশন আলী, এখলাস উদ্দিন আহমেদ, সালাহ উদ্দিন ইউসুফ, সরদার আমজাদ হোসেন, কসিমুদ্দিন আহমেদ, তফিজ উদ্দিন আহমেদ, সাইফুল ইসলাম, ডা. মেসবাহ উদ্দিনসহ অনেকে অবস্থান নেন।  

১৬ই অক্টোবর সকালে শতাধিকের বেশি এমপি একত্রিত হন নাখালপাড়া এমপি হোস্টেলে। অধ্যাপক সাইয়ীদ লিখেছেন, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, সোহরাব হোসেন ও রফিকুদ্দিন ভূঁইয়ার দ্বৈত ভূমিকার কারণে এমপিরা বঙ্গভবনে যান। চিফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম ও হুইপ আবদুর রউফ বঙ্গভবনে যাওয়ার বিরোধীকারী এমপিদের সঙ্গে বাড়াবাড়ি করেন। অন্য হুইপ মোহাম্মদ হানিফ ছিলেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীদের পক্ষে এবং বঙ্গভবনে যাওয়ার বিরুদ্ধে। শেষপর্যন্ত এমপিরা বঙ্গভবনে যান। এডভোকেট সিরাজুল হক সেইদিন বঙ্গভবনে কড়া ভাষায় ইংরেজিতে বক্তব্য রাখেন। সিরাজুল হক বলেছিলেন “মি. মোশতাক আমি আপনাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সম্বোধন করতে পারি না। কোন আইনের বলে আপনি রাষ্ট্রপতি হয়েছেন তাও জানিনে। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে তাদের সঙ্গে আপনি বঙ্গভবনে আশ্রয় নিয়েছেন এবং আমাদেরকে বলেছেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে মেনে নিতে। আপনি যদি রাষ্ট্রপতি থাকতে চান, তাহলে বঙ্গবন্ধুকে কেন হত্যা করা হয়েছে তা আমাদের জানাতে হবে। আইন অনুযায়ী আপনাকে বৈধ রাষ্ট্রপতি বলা যায় না।”  

অ্যান্থনি মাসকারেন্স লিখেছেন, মোশতাকের সঙ্গে রশীদ সাক্ষাৎ করেন ২রা আগস্ট। এই সময়ে মোশাররফ হোসেন মসু নামে একজন ছিলেন, যিনি মোশতাকের বন্ধু। মূলত মসু নিয়ে যান মোশতাকের কাছে রশীদকে। রশীদ সেইদিন মোশতাককে নিয়ে আসার আগেই তাহের উদ্দিন ঠাকুর উপস্থিত ছিলেন রেডিও স্টেশনে। খন্দকার মোশতাক খুনিদের বলেছেন সূর্যসন্তান। আর ১২ জনকে বিদেশে চাকরি দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। অ্যান্থনি মাসকারেন্স কে দেয়া সাক্ষাৎকারে ফারুক-রশীদ বলেছেন, তারা ২০শে মার্চ ১৯৭৫ সালেই জিয়াকে বলেছেন সরকার পরিবর্তন করতে চান। জিয়া তাদেরকে বলেছেন, “দুঃখিত আমি এমন কিছু করতে পারবো না। তোমরা ইয়াং অফিসার যা খুশি করো গিয়ে।’’ সেনা আইন অনুযায়ী এমন আলাপ করলে কোর্ট মার্শাল হওয়ার কথা। জিয়া সব জেনেও ছিলেন নীরব। আর মোশতাক সব জেনেও চুপ ছিলেন ক্ষমতা দখলের নেশায়। 

 আওয়ামী লীগের পুরো রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাফল্য ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদান। সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা জাতির পিতাকে রক্ষা করতে না পারা এবং হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে প্রতিবাদ, প্রতিরোধে দেশকে উত্তাল না করা। জীবনের ঝুঁকি জাতীয় নেতৃত্বের কেউ নিলে সারা দেশকে উত্তাল করতে পারতো। ১০ হাজার লোক নিয়ে ঢাকায় মিছিল করার সক্ষমতা ছিল। একটা কিছু শুরু করলে তা ছড়িতে পড়তো সারা দেশে। প্রতিবাদী জনতার কতোজনকে খুনিরা শেষ করতে পারতো? সেই দিনের সিদ্ধান্তহীনতা, ব্যর্থতার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েই আওয়ামী লীগকে আগামীর পথে চলতে হবে। আরেকটা প্রজন্মের কাছে জবাবদিহিতার জন্য মুখোমুখি থাকতে হবে সবসময়।   

রক্ষীবাহিনীর ব্যর্থতায় কঠিন বাস্তবতা 

একটা ব্যর্থতার গ্লানি এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে রক্ষীবাহিনীর ১২ হাজার সদস্যকে। বাংলাদেশের জাতির পিতাকে রক্ষা করতে পারেননি রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা। ব্যর্থতা ছিল খুনিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলারও। সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘাতে না জড়ানোর অনুরোধ অথবা নির্দেশ এসেছিল সেনা হেড কোয়ার্টার থেকে। কারা দিয়েছিলেন সেই নির্দেশ? কেন দিয়েছিলেন? আড়ালের ষড়যন্ত্র কী ছিল? এখনো অনেক প্রশ্ন ঘুরপাঁক খাচ্ছে। রক্ষীবাহিনী প্রধান কর্নেল নুরুজ্জামান দেশে ছিলেন না। ১৯৭৫ সালের ১২ই আগস্ট তিনি ঢাকা ছাড়েন। গন্তব্যস্থল ছিল আমেরিকার ওয়াশিংটন। উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য বিষয়ে আলোচনার জন্য তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমন্ত্রণ পান। অধ্যাপক আবু সাইয়ীদ বইতে লিখেছেন, ‘এই আমন্ত্রণ ছিল সিআইএ থেকে পাওয়া।’ রক্ষীবাহিনীর তখনকার অনেক কর্মকর্তা বলেছেন, অন্য কথা। তারা বলেছেন, আমন্ত্রণ সিআইএ থেকে সরাসরি ছিল না। আমন্ত্রণপত্র ছিল আমেরিকান সরকার থেকে। রাষ্ট্রপতির অনুমতি নিয়ে তিনি ঢাকা ছাড়েন। যাওয়ার আগে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেন লে. কর্নেল আবুল হাসান খানকে। ১৫ই আগস্ট কর্নেল নুরুজ্জামান ছিলেন লন্ডনে যাত্রাবিরতিতে। জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের খবর তিনি যখন পান তখন বাংলাদেশ সময় দুপুর। রক্ষীবাহিনীর দুই কর্মকর্তা আনোয়ারুল আলম শহীদ ও সরোয়ার মোল্লা তাকে ফোনে পাওয়ার চেষ্টা করেন ভোর থেকে। তিনি ছিলেন ঘুমিয়ে। লন্ডন সময় সকালে যখন ফোনে পান তখন বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন খুনি মোশতাক। অন্য বাহিনীর মতো রক্ষীবাহিনীও নির্বিকার।  

বঙ্গবন্ধু হত্যাণ্ডের খবরে ঢাকায় সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভূমিকার খবর নেন নুরুজ্জামান। তিনি তাদের অবস্থানে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তারপর রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ও দুই উপ-পরিচালককে নির্দেশ দেন খালেদ মোশাররফ ও রংপুর ব্রিগেডের কর্নেল হুদার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে। খুনিরা বঙ্গভবনে বসে ঢাকা ফেরায় নুরুজ্জামানকে বাধা দেন। নুরুজ্জামান আমেরিকাতে আর যাননি। তিনি লন্ডনে অবস্থান নেন। এই সময়ে রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কর্নেল নুরুজ্জমানের যোগাযোগ ছিল। কোনো ধরনের বার্তা বা অ্যাকশনের বিষয়ে রংপুর থেকে কর্নেল হুদা রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের দেননি। তারা এই বিষয়ে কথা বললে তিনি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে বলেন। পাশাপাশি অনুরোধ করেন খালেদ মোশারফের নির্দেশ মানতে। ব্যক্তিগত জীবনে খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা ও হায়দার ছিলেন বন্ধু।  

১৫ই আগস্ট রক্ষীবাহিনীর অবস্থান ছিল দিশাহারার মতো। ভোরে রক্ষীবাহিনীর দুই কর্মকর্তা আনোয়ারুল আলম শহীদ ও সরোয়ার হোসেন মোল্লা অফিসে ছুটে আসেন। তাদের পর আসেন ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবুল হাসান খানও। তারা দেখেন তাদের অফিসের সামনে সেনা ট্যাংক মোতায়েন। সকল ট্যাঙ্কের নল রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরের দিকে তাক করানো। তারা জানতেন না এরমধ্যে কোন গোলা নেই। শুধু সক্রিয় ছিল মেশিন গান। তারা ট্যাংক উপেক্ষা করে ভেতরে প্রবেশ করেন। তারপর সবাই চারদিকে যোগাযোগ শুরু করেন। টহল দলের এক গ্রুপকে পাঠানো হয় ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের দিকে। খুনি দলের সদস্য ও বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত আঁতাতকারী সেনা সদস্যদের যৌথ বাধায় তারা ৩২ নম্বর যেতে পারলেন না। এই সময়ে প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীর ফোন পেয়ে রক্ষীবাহিনীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে টহলরত গ্রুপ যায় শাহবাগ বেতারে। মনসুর আলী রক্ষীবাহিনীকে জানান, শাহবাগ কেউ দখল করে উল্টাপাল্টা কথা বলছে বলে তিনি খবর পেয়েছেন। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের ঘটনা তিনি তখনো হয়তো জানতেন না। শাহবাগ রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের দেখে ক্ষুব্ধ হন মেজর ডালিম। সেনা সদস্যদের তিনি নির্দেশ দেন ব্যবস্থা নিতে। তারা রক্ষীবাহিনীর একজন লিডারসহ পুরো টিমকে হ্যান্ডসআপ করিয়ে অস্ত্র কেড়ে নেয়। তাদের আটক করে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে রাখে দুপুর পর্যন্ত। তাদের গাড়ির ব্যাটারি দিয়ে চালু করে বেতারের জেনারেটর। রক্ষীবাহিনীর  সদস্যদের পরে ছাড়া হয় খালেদ মোশাররফের নির্দেশে। ছাড়া  পেয়ে তারা রিপোর্ট করেন হেডকোয়ার্টারে। 

রক্ষীবাহিনীর প্রায় সকল কর্মকর্তা ও সদস্য ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। জাতির পিতার প্রতি তাদের অঙ্গীকার ১৯৭১ সালে অর্জিত। রক্ষীবাহিনীর পরিচালক ছিলেন ব্রিগেডিয়্যার এ এন এম নুরুজ্জামান বীর উত্তম। উপ-পরিচালক প্রশাসন ছিলেন লে. কর্নেল আবুল হাসান খান, উপ-পরিচালক অপারেশন সরোয়ার হোসেন মোল্লা (পরে কর্নেল, রাষ্ট্রদূত সাচিব), উপ-পরিচালক প্রশিক্ষণ আনোয়ারুল আলম শহীদ (পারে কর্নেল, রাষ্ট্রদূত সচিব), উপ-পরিচালক সিগন্যাল স্যাবিহ উদ্দিন আহমেদ (পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল), চট্টগ্রাম জোনাল কমান্ডার ছিলেন এ কে এম আজিজুল ইসলাম (পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল), উপ- পরিচালক মেডিকেল ছিলেন লে. কর্নেল এ এম খান। এ ছাড়া সহকারী পরিচালক ছিলেন মেজর সালাহ উদ্দিন, এম এ হাসনাত, ফকির মোহাম্মদ ও তৈয়বুর রহমান। লিভার হিসেবে সারা দেশে দায়িত্ব পালন করেছেন ২১২ জন কর্মকর্তা। সাভারে প্রশিক্ষণে ছিলেন আরও কিছু কর্মকর্তা। তারা অপেক্ষায় ছিলেন লিডার হিসেবে নতুন দায়িত্বের। মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ১২ হাজার। ১৫টি ব্যাটালিয়নের ১২টি ছিল নিয়মিত, আর তিনটি প্রশিক্ষণের। সাধারণ সদস্যরাও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এই কারণে রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের প্রতি একটা আশাবাদ ছিল মানুষের। 

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর একটা প্রতিরোধ যুদ্ধে রক্ষীবাহিনী যেতে পারতো। তারা তা পারেননি। কেন পারেননি? ১৫ই আগস্ট রাতে পাঁচ শীর্ষ কর্মকর্তা একসঙ্গে বৈঠক করেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন সকল ইউনিটকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেবেন। তারা তাই করলেন। রেশন পাঠানোর সময় মেশিনগানসহ কিছু অস্ত্র পাঠালেন ঢাকার বাইরে। সবাইকে বললেন, নির্দেশ দেয়ামাত্র স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নিয়ে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে। সেই নির্দেষ কার্যকর হয়নি। কেন হয়নি? রক্ষীবাহিনীর উপ-পরিচালক সরোয়ার মোল্লা বলেছেন, "বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দায়িত্ব রক্ষীবাহিনীর ওপর ছিল না। তারপরও অস্বীকার করার উপায় নেই একটা ব্যর্থতার গ্লানি আমাদেরকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।” তিনি আরও বলেন, রক্ষীবাহিনী ছিল প্যারামিলিশিয়া বাহিনী। দায়িত্ব ছিল দেশের আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখা। জাসদের গণবাহিনী, সর্বহারাসহ উগ্রপন্থিদের হামলা বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া। সদ্য স্বাধীন দেশের অস্ত্র উদ্ধার, চোরাচালান, কালোবাজারি বন্ধ, অস্থিতিশীলতা প্রতিরোধে রক্ষীবাহিনী কাজ করতো। এখন র‍্যাব যা করছে রক্ষীবাহিনীও তখন তা করতো। এনিয়ে সেনাবাহিনীর ভেতরে জাসদের কর্নেল তাহের ও বাম চিন্তার কর্নেল জিয়া উদ্দিন ও পাকিস্তান প্রত্যাগতদের প্রচারণা ছিল পুরোটাই মিথ্যাচার। 'পুনি ফারুক-রশীদও একই ধরনের প্রচারণা চালাতো বঙ্গবন্ধু সরকারকে বিব্রত করতে। মিথ্যাচার ও আর গুজবের কারখানা বানানো হয়েছিল সেনানিবাসকে। বাস্তবে রক্ষীবাহিনীর কোনো ভারী অস্ত্র ছিল না। ঢাকাতে তাদের নিজস্ব কোনো অস্ত্রাগার ছিল না। সকল অস্ত্র রাতে রাখা হতো পিলখানায় বিডিআরের অস্ত্রাগারে। সকালে সেই অস্ত্র নিয়ে আসা হতো রক্ষীবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে। ১৫ই আগস্ট সকালে অস্ত্র আনতে গিয়েছিলেন রক্ষীবাহিনীর একজন লিডার। সেই অস্ত্র দেননি বিডিআর প্রধান ব্রিগেডিয়ার খলিলুর রহমান। অন্যদিকে ১৭ই আগস্ট অ্যাডজুডেন্ট জেনারেল কর্নেল মইনুল হোসেন চৌধুরী রক্ষীবাহিনী অফিসে যান। তিনি সবাইকে শান্ত থাকার অনুরোধ করেন। আর কর্নেল আমিন আহমেদ চৌধুরী ১৫ই আগস্ট যান সাভার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। তিনি ভারতীয় একজন প্রশিক্ষককে নিয়ে আসেন। পরে তাকে পাঠিয়ে দেন ভারতীয় দূতাবাসে। 

রক্ষীবাহিনীর ভেতরে একটা চাপা কষ্ট ও ক্ষোভ ১৫ই আগস্ট সকালেই ভর করে। সাভারে দুইজন রক্ষীবাহিনীর সদস্য সকাল থেকেই প্রথম চিৎকার করেন সবাইকে বেরিয়ে পড়তে। অন্যরা উপরের নির্দেশের অপেক্ষার কথা বলার কারণে এই দুই সদস্য আত্মহত্যা করেন। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, রক্ষীবাহিনীকে সিদ্ধান্তহীন করতে বাহিনী প্রধানকে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। পুরো বিষয় কাকতলীয় মনে করার কারণ নেই। সবকিছুই ছিল দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গোছানো একটা নিষ্ঠুর ছক। সেই ছকে আটকা পড়েন রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা। সব শেষ হওয়ার পর তাদের করার কিছু ছিল না। এই বাহিনীর দুই কর্মকর্তা সরোয়ার মোল্লা ও আনোয়ারুল আলম শহীদকে ১৫ই আগস্ট ৪৬ ব্রিগেডে নিয়ে যাওয়া ছিল পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা। সাফায়েত জামিল ও খালেদ মোশাররফ রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের শান্ত থাকার অনুরোধ করেন। সেই অনুরোধ রক্ষায় রক্ষীবাহিনীর উপ-পরিচালকদের বেতার ভবনে যেতে বাধ্য করা হয় খুনি মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানে। খালেদ মোশাররফ শপথে গিয়েছিলেন সিভিল পোশাকে। তিনি বার সিগারেট খাচ্ছিলেন। তার মেজাজ ছিল খারাপ। জিয়াউর রহমান ছিলেন সামরিক পোশাকে। কালো চশমার আড়ালে ঢাকা ছিল তার প্রতিক্রিয়া। তিন বাহিনী প্রধান ছিলেন অনেকটা বিব্রতকর অবস্থায়। তাদেরকে কেউ মানছিলেন না। তাদের অবস্থান ছিল যাত্রা টিমের নিরীহ সিপাহীর মতো। 

খুনিরা শুরু থেকেই টেনশনে ছিল রক্ষীবাহিনী নিয়ে। বাহিনী প্রধান নুরুজ্জামান ৭১ সালের বীর উত্তম খেতাব পাওয়া যোদ্ধা। বাকিরা ছাত্রলীগ করা। এই কারণে রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি লড়াইয়ের দায়িত্ব নিজের কাছেই রাখলেন খুনি ফারুক। ১৫ই আগস্ট ২৮টি ট্যাংকের গোলা ছিল না। ৩৫০ জন সৈনিক ফারুক নিজের সঙ্গে রাখলেন রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করতে। ১২টি ট্রাকে এই সৈনিকদের উঠানো হলো। তাদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হলো রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ প্রস্তুতির। আর রশীদের দায়িত্ব ছিল সব কাজ শেষ করে পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেয়া। সমস্ত ঘটনাই ঘটছিল আর্মি ইন্টিলিজেন্স অফিসের পাশে। শাফায়েত জামিলের বাসাও তার ইউনিটের পাশ ঘেঁষেই ট্যাংকগুলো এগিয়ে চলছিল সামনে। ট্যাংকগুলোর ব্যারেল ছিল রক্ষীবাহিনী হেডকোয়ার্টারের দিকে তাক করা। রক্ষীবাহিনীর অফিসাররা জানতেন না এই ট্যাংকে গোলা নেই। তারা নিজেদের অস্ত্রও আনতে পারেননি বিডিআর সদর দপ্তর থেকে। বিডিআরের ডিজি খলিল রক্ষীবাহিনীর রক্ষিত অস্ত্র ১৫ই আগস্ট ফেরত দেননি। ডাইরেক্টর মিলিটারি অপারেশন ছিলেন কর্নেল নুরুদ্দিন। রক্ষীবাহিনী অফিসে কর্নেল ফারুক গিয়েছিলেন। তিনি ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কর্নেল হাসানকে ফোনে মিলিয়ে দিলেন কর্নেল নুরুদ্দিনকে। এর আগে ফোন করলেন সিজিএস খালেদ মোশাররফ ও ৪৬ ব্রিগেডের সাফায়েত জামিলকে। ফারুক নিজে রক্ষীবাহিনী অফিসে প্রবেশ করে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হাসানকে হুমকি দেন। তাকে বলেন, সব উড়িয়ে  দিব মুহূর্তে। ভয়াবহ যুদ্ধ করে ধ্বংস করা হবে রক্ষীবাহিনীকে। 

বেতার ভবনে রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের আটক করার খবরের প্রভাব অন্যখানেও পড়ে। তারপরও তারা অপেক্ষায় ছিলেন সেনাবাহিনীতে বঙ্গবন্ধুর সমর্থক কর্মকর্তারা বেরিয়ে আসার। তারা ভেবেছিলেন রক্ষীবাহিনী তাদের সঙ্গে যোগ দেবে। কোথায় থেকে কেউ আসলো না। রক্ষীবাহিনীর তখনকার কর্মকর্তারা এখন বলছেন, বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করা ও হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিরোধ করতে না পারা পুরোটাই রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার দায় শুধু রক্ষীবাহিনীর একার নয়। তৎকালীন ক্ষমতাবান সকল বাহিনীকে নিতে হবে। সত্য কেউ এড়াতে পারেন না। রক্ষীবাহিনীও না। রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীতে বিলুপ্ত করার আগ পর্যন্ত একটা অস্বস্তি ছিল সেনাবাহিনীর ভেতরে। রক্ষীবাহিনীর সকল সদস্যই মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক ছাত্রলীগ হওয়ার কারণে এমন হয়েছিল। রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীতে বিলুপ্ত করতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর। তিনি ছিলেন দিল্লি হাইকমিশনে সামরিক অ্যাটাসি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে তিনি ঢাকা ছুটে আসেন ১২ ঘণ্টার মধ্যে। এত দ্রুত কীভাবে আসলেন, কেন আসলেন, কার অনুমতি নিয়ে এসেছেন তা এখনো বের হয়নি। 

পুরো ঘটনা নিয়ে সরোয়ার মোল্লা বলেছেন, ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসের একদিন সন্ধ্যার পর এসবির ডিআইজি ই এ চৌধুরী রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে যান। তার সঙ্গে ছিলেন ঢাকার পুলিশ প্রধান এসপি মাহবুব উদ্দিন আহমেদ। পরিচালক কর্নেল নুরুজ্জামান, উপ-পরিচারক আনোয়ারুল আলম শহীদ ও সরোয়ার হোসেন মোল্লা পরিচালকের রুমে ছিলেন। ই এ চৌধুরী তাদেরকে জানান, বঙ্গবন্ধুর ওপর আজ রাতে হামলার খবর তিনি পাচ্ছেন। ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। সিদ্ধান্ত হয় ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরকে ঘিরে রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। স্পটে থাকবেন এসপি মাহবুব ও রক্ষীবাহিনীর দুই উপ-পরিচালক ও শহীদ। সারা এলাকা ঘিরতে গিয়ে শেখ মনির বাড়ির পাশেও রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা ছিলেন। রাতে বাংলার বাণী অফিস থেকে ফেরার সময় তাদেরকে এইভাবে দেখে ক্ষুব্ধ হন শেখ মনি। এনিয়ে ভুল বুঝাবুঝি হয়। শেখ মনি মনে করেছিল কারও প্ররোচনায় রক্ষীবাহিনী তাকে ভয় দেখাতে গেছেন। বিচার বঙ্গবন্ধুর কাছে যায়। সরোয়ার হোসেন মোল্লা বলেছেন, তারা সবকিছু স্বাভাবিক করতে পরে বাংলার বাণী অফিসে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন শেখ মনির কাছে। তার কাছে আসল ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছিল, কেন সেই রাতে গিয়েছিলেন। সিদ্ধান্ত ছিল টানা বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ও ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রাতে ঘিরে রাখার। রাজনৈতিক ভুল বুঝাবুঝির কারণে রক্ষীবাহিনী আর যেতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নিরাপত্তা পুলিশের এসবি ও সেনা ইউনিটের ওপর ছিল। ১৫ই আগস্ট পুলিশ সক্রিয় থাকলেও সেনা ইউনিট মুহূর্তে যোগ দেয় খুনিদের সঙ্গে। তারা উল্লাস করে। 

সরোয়ার মোল্লা লিখেছেন, ৩২ নম্বরের নিরাপত্তা নিয়ে কর্নেল নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে তিনি, শহীদ ও সাবিহ উদ্দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাবিহ উদ্দিন 'অ্যা ম্যান অন হর্স ব্লাক' নামে একটি বই নিয়ে যান সঙ্গে। এই বইতে দুনিয়া জুড়ে তখনকার সামরিক ক্যুর কথা ছিল। তারা বঙ্গবন্ধুকে বুঝানোর চেষ্টা করেন ৩২ নম্বরের বাড়ি নিরাপত্তাহীন। এই বাড়িতে থাকা ঠিক হবে না। ১৫ই আগস্টের অনেক কিছুই ছিল রহস্যময়। এনএসআই প্রধান এবিএম সফদার ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা। তার সহযোগী ছিলেন পুলিশের আরেক কর্মকর্তা ডিআইজি এসএ হাকিম। ১৯৭১ সালে সফদার ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে। তিনি চাকরি করেছেন পাকিস্তানিদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে, তাদের সহযোগিতা করে। তার বিষয়ে কানাঘুষা ছিল তিনি সিআইএ'র সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনি মোশতাক সরকার পদোন্নতি দিয়েছিল সফদারকে। এটা কিসের পুরস্কার ছিল আজও বের হয়নি। স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি ছিলেন ই এ চৌধুরী। তিনিও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার আনুগত্য ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতি। তিনি কয়েকদফা রক্ষীবাহিনীকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিলেন। 

ডিজিএফআই প্রধান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আবদুর রউফ। তিনি ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনা কর্মকর্তা। ১৫ই আগস্টের কয়েকদিন আগে তাকে সরিয়ে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল কর্নেল জামিলকে। একমাত্র সেনা কর্মকর্তা জামিলই তার শপথ রক্ষা করে রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করতে জীবন দিয়েছিলেন। জামিলকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে বিলম্ব করছিলেন ব্রিগেডিয়ার রউফ। কেন করেছিলেন আজও বের হয়নি। সেই রাতে খবর পেয়ে কেন ব্যবস্থা নেননি সামরিক গোয়েন্দা প্রধান তাও বের হয়নি। অন্যদিকে প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব হিসেবে নিষ্ঠুর আগস্টে নিয়োগ পেয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হক। তিনিও পাকিস্তান প্রত্যাগত কর্মকর্তা। সরোয়ার মোল্লা বলেছেন, পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসাররা ছিলেন বেশির ভাগ সিনিয়র পদে। মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা ছিলেন জুনিয়র। এই কারণে তাদেরকে নিয়োগ দেয়া হতো না। চারদিকে ছিল পাকিস্তান প্রত্যাগতরা। 

বঙ্গবন্ধু ছিলেন ইতিহাসের রাখাল রাজা। যেমন ছিল তার উচ্চতা, তেমনি ছিল হৃদয়। পাকিস্তান প্রত্যাগতদের কাছে প্রত্যাশা ছিল তারা পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করবেন। কেউ তা করেননি। বঙ্গবন্ধু ধানমণ্ডির বাড়ি ছাড়েননি গণমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশংকায়। ৩২ নম্বর বাড়ির দরজা ছিল সবার জন্য খোলা। মানুষ অবাধে প্রবেশ করতে পারতো। আটকাতো না কেউ। এমনকি প্রশ্নও করতো না। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার একজন পরিচালক এই বাড়ির নিরাপত্তা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশ তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাকে কেউ হত্যা করবে না। বঙ্গবন্ধু ভুলে গিয়েছিলেন, বাঙালির পরতে পরতে বেঈমানির রক্ত প্রবাহমান। এই বাঙালি নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে পরাজিত করতে ইংরেজ বাহিনীকে সহায়তা করেছিল। সিরাজের সেনাপ্রধানসহ ঊর্ধ্বতনদের বেঈমানি ও বিশ্বাসঘাতকতায় স্বাধীনতার সূর্য নিভে গিয়েছিল পলাশীর আম্রকাননে। আবার স্বাধীনতার সূর্যকে যিনি এনে দিয়েছিলেন ১৯৭৫ সালে তাকেও পরিবারসহ হত্যা করা হয় একইভাবে নিষ্ঠুরতা নিয়ে। সেই রাতে ও পরের দিন বঙ্গবন্ধুর পাশে কেউ ছিলেন না। কেউ না। চারদিকে শুধুই সেনা, রাজনীতিবিদ, ব্যর্থতার ইতিহাস।

 

পাঠকের মতামত

লেখক সেদিন কি করেছেন সেটা জাতি জানতে চায়... তিনি কার কাছে বঙ্গবন্ধু খুনের খবর পেলেন, এরপর তিনি কি করছেন?

Faruk Hossain
১৪ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ১১:০৮ পূর্বাহ্ন

তাল গোল ঠিক ।

Md Abdus Sattar
১৩ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১২:৫৩ অপরাহ্ন

লেখাটা এক চোখা।

আব্দুল আউয়াল
১৩ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৯:২৫ পূর্বাহ্ন

একটি অগোছালো লেখা।

সিদ্দিক
১৩ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৬:২৮ পূর্বাহ্ন

ঈদ সংখ্যা ২০২৪ থেকে আরও পড়ুন

   

ঈদ সংখ্যা ২০২৪ সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status