ঢাকা, ১৬ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিঃ

ঈদ সংখ্যা ২০২৪

কারাকোরাম হাইওয়েতে দশ দিন

এম সাখাওয়াত হোসেন
১১ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার
mzamin

আমরা মানসেরার ছোট উপত্যকায়। মানসেরা এবোটাবাদ হতে প্রায় ২৫ কি.মি. এক ঘণ্টার কম সময় লাগবার কথা। আমার ক্যাডেট দিনের স্মৃতি বিজড়িত এক সময়ের এই ছোট ঘুমন্ত শহর। কাকুলের সব মহড়াগুলো এ জায়গাতেই হতো। এখন মাঝারি স্তরের টাউন বলা যায়। আমরা ফিরতি পথে এখান হয়ে এবোটাবাদে রাত কাটাবো। সে সময় আমার ওইসব দিনের স্মৃতিময় কয়েকটি জায়গা দেখবো বলে আশা রাখি। এ জায়গাটির বুক চিড়ে বয়ে গেছে ছোট ছোট কিছু ঝরনা যার বড়টির নাম সিরান নদী। অত্যন্ত খরস্রোতা এই ঝরনার সৃষ্টি ছোট ছোট নদী বা আমাদের সংজ্ঞায় খালগুলো। নির্মল মিঠা পানি যার উৎস পাহাড়ের বরফ গলা পানি।

বিজ্ঞাপন
বেশ ঠাণ্ডা হয় এই পানি যদিও এখন এখানেও প্রচুর গরম।

 


মানসেরা এবোটাবাদের কাছাকাছি হলেও এটা পাখতুনখোয়া প্রদেশের সীমানা। অতি সুন্দর ছোট শহর। অবশ্য আমরা শহরের বাইরে দিয়ে যাচ্ছি। আশে পাশে সবুজ পাহাড় আর টিলা। গাঁয়ে বাড়িঘর। চারিদিকে সাইপ্রাস, পাহাড়ি ঝাউ আর ফার বৃক্ষ। চারিদিকে মনোরম সবুজ। ছোট উপত্যকায় চাষাবাদ হয়। এখন বেশির ভাগ ক্ষেতে আলু আর পিয়াজে ভরা। আমরা মোটরওয়ে ছেড়ে আঞ্চলিক রোডে। কিছুদূর গিয়ে গাড়ি থামলো। সারতাজকে জিজ্ঞাসা করলাম এখানে থামবার হেতু? সারতাজ বললো, এটা আমাদের চালক সাত্তার-এর গ্রাম, এখানে কাছেই তার বাড়ি। এই সম্পূর্ণ ক্ষেত তাদের সম্পত্তি। আমি নামলাম সঙ্গে তানভীর, ফারুক, শামসেরও নামলো। তিনজন মানুষ দাঁড়ানো। সাত্তার পরিচয় করালো বয়স্কজন তার চাচা আর সাত্তারের দুই ছেলে স্কুলে পড়ে। বড়টার বয়স ১২ আর পরেরটার ৯/১০ বছর। খবর পেয়েছে তাদের বাবা এই রাস্তায় পর্যটকদের নিয়ে যাবে তাই বাড়ি থেকে কিছু খাবার নিয়ে এসেছিল। সঙ্গে এক বস্তা পিয়াজ। এদেরই ক্ষেতের। সাত্তারকে জিজ্ঞাসা করলাম এত পিয়াজ সে কি করবে। কারণ দুজনই তো আমাদের সঙ্গেই খাওয়া-দাওয়া করে। সাত্তার একটু হেসে বললো, ‘আপ লগোকে লিয়ে’ (আমাদের জন্য)। আমার পেছনে ডা. নাসরুল্লাহ দাঁড়ানো। এবার সারতাজ বললেন, “আপনাদের পিয়াজ খুব পছন্দ। সব খাবারের সঙ্গেই অনেক পিয়াজ খান, বিশেষ করে ডাক্তার সাহেব। তাই সাত্তারের বাড়ির পিয়াজ আপনাদের জন্য। এখানকার পিয়াজ বেশ মিষ্টি এবং সালাদের জন্য দারুণ।”


আমরা সবাই বেশ অভিভূত। এতটা আশা করিনি। আমরা সবাই মিলে দুই ছেলেকে কিছু টাকা দিলাম কিছু কিনে খেতে। পরে জানলাম সারতাজের বাপ চাচারা সবাই বাস তথা পর্যটকদের জন্য বাসের চালক। আমরা যে গাড়িতে রয়েছি সেটি কোম্পানির কিন্তু চালক এ অঞ্চলেরই হয়। বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকার জন্য। লক্ষ্য করলাম এখানে গরম একটু কম। মানসেরা প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ফুট উচ্চতায় চারিদিকে সুবজ পাহাড়ে ঘেরা তাই গরম কম। এখানে ছোট টিলার উপরে সম্রাট অশোকের বাণী ক্ষোদিত বিশাল এক পাথর একটি আচ্ছাদনের নিচে রক্ষিত। তবে সেটি এই ছোট শহরের অপরপ্রান্তে। 


ঘণ্টাখানেক পরে আমরা আমাদের পথে রওয়ানা হলাম- সবুজ প্রান্তর ক্রমেই অপসৃয়মাণ হতে লাগলো।
২০২২ সালে প্রায় দুই বছর (করোনার সময়) পরিকল্পনা আর জল্পনা-কল্পনা করে আমাদের আড্ডার শিরোমণি জনাব হাবিবুর রহমান খানের অতি উৎসাহের কারণে পাকিস্তান সফরে এসেছিলাম। মোটামুটি ২৭ দিন আমরা করাচি হতে ট্যুরিস্ট বাসে লাহোর, ইসলামাবাদ হয়ে বিশ্বের বিস্ময় বলে আখ্যায়িত কারাকোরাম হাইওয়ে হয়ে উত্তরে পাক-চীন সীমান্তের পথে ছিলাম।  কারাকোরাম হাইওয়ের একাংশকে নতুন সিল্ক রুটও বলা হয়। ঐতিহাসিক পুরাতন সিল্করোডের সমান্তরাল কারাকোরাম ও নতুন সিল্করোড। সবার আগ্রহ পৃথিবীর অন্যতম সুউচ্চ এবং যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ, ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত রোমাঞ্চকর রাস্তায়।
আমি ছাড়া আমাদের এ দলের তেরোজনের জন্যে জীবনে প্রথম এ-অঞ্চলে আসা। আমার অভিজ্ঞতা হুনজা পর্যন্ত তার আগে আর যাইনি। যাই হোক আমরা এতদিনের গরম কাটিয়ে ঠাণ্ডা এলাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আমাদের গাইড হুনজার বাসিন্দা সারতাজ এবং দক্ষ চালক, এ অঞ্চলের সঙ্গে পরিচিত সাত্তার।


আমরা পাঞ্জাবের সবুজ প্রান্তর আর পাহাড় ছেড়ে ধূসর প্রান্তরে প্রবেশ করলাম। কারাকোরাম হাইওয়ের নিচ দিয়ে প্রবাহিত সিন্ধু নদীর খরস্রোতা উৎপত্তিস্থল হতে ধেয়ে আসা জলরাশি দেখতে দেখতে চলছি।  ক্রমেই পাঞ্জাব আর পাখতুন খোয়া প্রদেশের সবুজ প্রান্তর ছেড়ে ধূসর পাহাড়ের পাদদেশের আঁকাবাঁকা রাস্তায় প্রবেশ  করলাম। আর কিছুদূর হতে বিশ্বখ্যাত কারাকোরাম হাইওয়ে শুরু হবে। বস্তুতপক্ষে বেশাম থেকেই যে রাস্তা হবে তা আমাদেরকে চিলহাঁস হয়ে গিলগিটে নিয়ে যাবে। সময় প্রায় ৩টা। বেশাম যেতে আরও ৩ ঘণ্টা তার মানে সন্ধ্যা ৬টার দিকে পৌঁছবার কথা। আগেই বলা ছিল যে আমরা রাতে এ রাস্তায় চলতে চাইবো না নেহায়েত প্রয়োজন না হলে বা বাধ্য না হলে। এ অঞ্চল খাইবার পাখতুন খোয়া হলেও এখানে পাঞ্জাব আর পাখতুনের সংমিশ্রণ। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তা। খুব বেশি উচ্চতায় নয়, প্রায় ২৫০০ ফুট। রাস্তাটি উভয়দিকের, যাকে আমরা টু ওয়ে বলে থাকি। ২০০০ ফুট নিচে দিয়ে নদ প্রবাহিত বা নদীর উৎস হতে প্রবাহিত। যেহেতু উপরে বরফ গলা ও হিমবাহ হতে পানি নিচে নেমে আসছে তাই যথেষ্ট খরস্রোতা। পানি মনে হয় সাদা ফেনা তুলে যাচ্ছে। এত উপর থেকে মনে হয় শুভ্র দুগ্ধের নহর বা ঝরনা। আমাদের প্রায় সকলেই জীবনে প্রথম এই ধরনের রাস্তা দিয়ে চলার অভিজ্ঞতা। অসংখ্য বাঁক। একধারে সুউচ্চ ধূসর কঠিন পাথরের পাহাড়, অপরদিকে সরাসরি দুই হতে আড়াই হাজার ফুট সোজা খাড়ি। গাছপালা নেই বললেই চলে। অপরপ্রান্তে সমান উচ্চতার একই ধরনের পাহাড়। মাঝখানে নদী। আমাদের সঙ্গে যেন নদীও চলছে।


নদী বা বরফ গলা পানি আমাদের ছেড়ে দক্ষিণে প্রবাহিত আর আমরা উত্তরে চলছি। রাস্তার বাঁকগুলো কোথাও কোথাও নব্বই হতে ১০০ ডিগ্রি কোণে। সমান্তরাল ওপারের পাহাড়ের গায়ে কালো রেখার মতো এ সড়ক হতে আরও হাজার ফুট উপরে হবে। সারতাজ সবার উদ্দেশ্যে জানালেন যে, ওপারে যে কালো রেখার মতো দেখা যায় ওটাই পুরাতন সিল্ক রোড বা উর্দূতে ‘রেশম রোড’। এ রাস্তা মধ্য এশিয়া হতে এ অঞ্চল হয়ে পারশিয়া (বর্তমান ইরান)কে যুক্ত করতো। আমি উৎসুক হয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে হতবাক নয়নে এই বিশ্বখ্যাত ঐতিহাসিক ‘সিল্ক রোড’ দেখছিলাম। নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সিন্ধু নদীর উৎস যার স্থানীয় নাম ‘আবাসিন’।
সিল্ক রোড, যদিও প্রধান অংশ আরও সামনে চিলাস হতে ইউনেস্কো দ্বারা প্রদেশের সংরক্ষিত। তবে মধ্যযুগে ছিল বিশ্বের অতীব আশ্চর্য। এর উৎস মধ্যচীন যার অস্তিত্ব পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী যা ১৫ শতাব্দীতে প্রধান বাণিজ্যিক রাস্তা হয়ে ওঠে। প্রায় ৬,৪০০ কি.মি. দৈর্ঘ্য মধ্য এশিয়া হতে ইউরোপের দ্বারপ্রান্ত পর্যন্ত ছিল। এ রাস্তা দিয়েই চীনের ভুবন খ্যাত সিল্ক বা রেশমের বাণিজ্য হতো সমগ্র মধ্য এশিয়ায় যখন আফগানিস্তানসহ এ অঞ্চল ছিল মধ্য এশিয়ায়। বেশাম হতে একটি আঞ্চলিক সড়ক উত্তর-পশ্চিমে চিত্রালের দিকে যাচ্ছে। ঐতিহাসিকদের ধারণা যে, এ রাস্তা ধরেই মেসিডোনিয়া হতে যুবক আলেকজান্ডারের আগমন ঘটেছিল। এ পথ ধরেই অশোক মহাত্মা বুদ্ধের বাণী ছড়িয়েছিলেন।
আমরা রাস্তায় চায়ের জন্য থেমে যখন বেশামে পৌঁছলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। আমরা রাতের জন্য সিন্ধু নদীর পাড়ে বেশাম ইন নামক সুন্দর একটা কাঠের তৈরি দোতলা হোটেলে পৌঁছলাম। তখন সূর্য্য ডুবে গেছে। দোতলার বারান্দা দিয়ে সিন্ধু নদী দেখা যায়। নদীটি চওড়ায় ১০০ ফুটেরও কম হবে।
রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম সকালে ৯টার মধ্যে রওনা হতে হবে গিলগিটের উদ্দেশ্যে। আমরা দু’জনে সকালে উঠে কিছুক্ষণ সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হোটেলের সামনের ছোট সবুজ চত্বরে সাইপ্রাস গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে নদীর পানির কলতান শুনছিলাম। বেশ ভালোই লাগলো। নিস্তব্ধ। কিছু পাখির কলতান, নদীর কুলকুল শব্দ আর মাঝে মধ্যে পেছনের সড়ক দিকে বিকট আওয়াজে দৈত্যের মতো ধেয়ে যাওয়া লরীর বেসুরো আওয়াজ শব্দ দূষণ করতে করতে ধেয়ে যাওয়া।
নাস্তা সেরে এবার রওনা হলাম বেশাম ছেড়ে গিলগিটের পথে। আসলে বেশাম হতে শুরু হয় কারাকোরাম হাইওয়ে। এ পর্যন্ত যে রাস্তায় এসেছি সেটাকে কারাকোরাম হাইওয়ের অংশ বলা হলেও তা ছিল হাজারা হাইওয়ে। আমরা বেশাম নামক ছোট শহরটি ছাড়ছি। এর অবস্থান সবুজে ঘেরা একটি উপত্যকায় যার উপরে কারাকোরাম হাইওয়ে বা কে কে এইচ। যেহেতু রাস্তাটি কারাকোরাম পর্বতমালার বুকচিড়ে তৈরি তাই এর নাম কারাকোরাম হাইওয়ে।
আমাদের বাঁ দিকে প্রায় ২০০০ ফুটের খাড়ি আর ডানে ধূসর পাথরের পাহাড় আর তারই কোলে এই রাস্তা। নিচের দিকে দেখলাম বেশাম বর্ধিষ্ণু গ্রাম তার পাশ দিয়েই সিন্ধু নদী। বাড়িঘরগুলো সবুজ বাগানে ঘেরা। বেশ কিছু কৃষি জমি। এ সময়ে গম, বজরা এবং আলু পিয়াজের চাষ হয়। মাঠে দাঁড়ানো গম বা বজরার গুল্মগুলো। এখানে রয়েছে কিছু ফলের বাগান। মূলত আপেল আর নাশপাতি, কিন্তু এর সময় হলো সেপ্টেম্বরের দিকে। এখন বাগান পরিচর্যার সময়। এ-এক দারুণ দৃশ্য। দারুণ রোমান্টিক। শীতের সময় যখন কুয়াশায় ঘিরে রাখে এ-ধরনের গ্রামকে তখনকার দৃশ্য আরও রোমান্টিক।
কারাকোরাম হাইওয়ের অপর পাশেও একই রকম পাহাড়ের দৃশ্য। পুরাতন সিল্ক রোড। আর আমাদের চালক সাত্তার আপন মনে প্রত্যেকটি বাঁক দিয়ে অতি সহজে চালিয়ে যাচ্ছে। ভিতরে গান চলছে এবং আমাদের জন্য সারতাজ মোবাইল ওয়াইফাই নিয়ে নেট সচল রেখেছে। বিষয়টি আগেই বলে দেয়া হয়েছিল। সেই প্রথম দিন হতেই আমরা এই ব্যবস্থায় গাড়িতে ফোন ব্যবহার করছি। হাবিব সাহেব তো ফোন ছাড়া থাকতেই পারেন না। তিনি থেকে থেকেই বন্ধু শামসেরকে বিভিন্নজনকে ফোনে যোগাযোগ স্থাপন করতে গিয়ে আলাপ জুড়িয়ে দেন। এখানেও কোনো ব্যতিক্রম নেই। কোথায় আছেন সেই সঙ্গে কারাকোরামের বর্ণনা। পুরো বাসে কেউ এই পথের নাম শোনেনি কাজেই কারও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। আমিও এ পথে আসিনি। এর আগে এসেছিলাম স্কার্দু নামক জায়গায় সামরিক বিমানে যেখান হতে হুনজার আমীরের বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিলাম। তখনো সিল্ক রুট সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি।
আমার বাঁদিকের সারির পেছনে আমার গিন্নি বসা আর তার পেছনে শামসের ভাবী। চোখ বন্ধ করে দোয়া দরুদ পড়ছেন। একপর্যায়ে আমাকে ডেকে বললেন ভাই কোথায় আসলাম। নিচের দিকে তাকালে তো খুব ভয় করছে।
বললাম, ভাবী বাঁদিকে তাকাবেন না। সামনের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আল্লাহ আল্লাহ করেন। এখান থেকে পড়লে ঝিলামে খোঁজ করতে হবে। বেশি ভয় পেলে করাচিতে বোনদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলেন।
পেছন থেকে মামা যশোহরী ভাষায় বলে উঠলেন ‘ব্রিগেডিয়ার সাহেব কনে আইনলেন? এতে খালি আপ আপ যাচ্ছি। ডাউন যাবে না?
বললাম, ‘এখন শুধু আপই যাবেন সপ্তাহ পর ডাউনে যাবেন। ইসলামাবাদের ডাক্তার দেখাবার পর মামার চোখ নাকি ভালোর দিকে আর মনি-এর (হাবিবের শালী) পায়ে ড্রেসিং করাতে ভালো আছেন। এদের দু’জনকেই ডাক্তারখানায় নিয়ে গিয়েছিল আমাদের গাইড সারতাজ।
কারাকোরাম হাইওয়ে দিয়ে চলাচলে যারা অভ্যস্ত নয় তাদের জন্য ভয়েরই ব্যাপার। কারাকোরাম হাইওয়ের দু’টি ভাগ। গিলগিট পর্যন্ত কারাকোরাম পর্বতমালার নামেই সড়ক আর গিলগিট হতে পাক-চীন সীমান্ত খুনজারাবো গিরিপথ পর্যন্ত রেশম সড়ক বা নতুন সিল্ক রোড যা চীনের আসাগাবাদকে যুক্ত করে।
আমরা চুলের পিনের বাঁকের মতো রাস্তায় চলছি। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম শামসের ভাবী চোখ বন্ধ করে, মনে হলো দোয়া দরূদ পড়ছেন। ভয় পাবারই কথা বাঁকগুলো একেবারে অন্ধের মতো না পার হলে বোঝা যায় না। নিচে পড়লে সোজা ২৫০০ ফুট নিচে। অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না ।


আমরা বেশামের শেষ প্রান্ত পার হয়েছি একটু সামনের বাঁক পেরুলেই কারাকোরাম হাইওয়ে। বেশাম একটি পুরাতন জনপদ। এ অঞ্চলে সম্রাট অশোকের সময়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার হয় এবং বহু বৌদ্ধ ভিক্ষু এখানে বাস করতেন। পরবর্তী সময় হিন্দুরা এ অঞ্চল দখল করতে থাকলে বৌদ্ধরা আরও উত্তরে চলে যায়। এখানে অশোকের শিলালিপি রয়েছে। এ অঞ্চল পশতুন এলাকা আজিখেল সম্প্রদায়ের বাস এখানে। এ সময়ে মোটামুটি গরম আবহাওয়া। তবে ডিসেম্বর হতে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তীব্র শীত পড়ে। পাশেই সিন্ধু নদী। এখন বেশ খরস্রোতা কারণ হিমবাহগুলোর বরফ গলা শুরু হয়েছে।
ইতিহাস খ্যাত সিন্ধু নদী। যার অববাহিকায় বসবাসকারীদেরকে হিন্দু বলা হতো। আন্তঃবর্ডার এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ নদী প্রায় ৩১২০ কি.মি. দৈর্ঘ্য। এর উৎপত্তি পশ্চিম তিব্বতের কৈলাশ পর্বতের হিমবাহ হতে। কাশ্মীর হয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করে যা করাচির সন্নিকটে ‘রান অব কচ’ এলাকা হয়ে আরব সাগরে পতিত হয়। এরই অববাহিকায় গড়ে উঠে এই উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা যার অন্যতম নিদর্শন ‘মহেঞ্জোদারো’ মাত্র দশ দিন পূর্বে আমরা দেখে এসেছিলাম।
আমরা এখন গিলগিটের পথে। রাস্তায় পড়বে, বেশাম পাত্তান, দাসু, বিলাস তার পরে গিলগিট। আমাদেরকে ৩৩০ কি.মি. প্রায় ৮ ঘণ্টায় পার হতে হবে। সুযোগমতো দুপুরের খাবারের বিরতি। মাঝপথে থাকবার কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি। তবে আমরা রওয়ানা হয়েছিলাম সকাল ৮টায়। এখন প্রায় ১১টা। কোথাও থামবার প্রয়োজন রয়েছে।
কারাকোরাম হাইওয়ে। খুবই কষ্টকর তৈরি একটি সড়ক যা ক্রমে উঁচুতে উঠে এবং পাকিস্তান অংশে সর্বোচ্চ জায়গা চীন সীমান্ত ১৬ হাজার ফুটে। আগেই বলেছি দৈর্ঘ্যে ১৩০০ কি.মি.। যা হাসান আবদাল হতে শুরু হয়। কারাকোরাম হাইওয়ে তৈরি হয় চীন ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগে। গিলগিটের উত্তর থেকে নিউ সিল্ক রোডই চীনের তৈরি। পৃথিবীর অন্যতম উচ্চতর পাকা সড়ক এবং বলা হয় পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য্য। প্রচুর দেশি-বিদেশি পর্যটকের সমাগম হয় এই কারাকোরাম হাইওয়েতে। বিশেষ করে যারা ‘মাউন্টেন ট্রেকিং’ পছন্দ করেন। তবে করোনার কারণে দুই বছর বন্ধ হয় পর্যটকদের আনাগোনা যা এখনো শুরু হয়নি। মাত্র খুলেছে। আমরা বোধকরি এ পর্যন্ত সবচাইতে বড় দল হিসেবে এখানে।

 


কারাকোরাম হাইওয়ে, পরিকল্পনা করা হয়েছিল ১৯৬৩-এরপর বিশেষ করে পাক-চীন সীমান্ত সমস্যা সমাধানের পর। পাকিস্তান চীনের চাহিদা মোতাবেক উত্তরের একাংশ সাক্সাম উপত্যকা চীনকে দিয়ে দেয় যা নিয়ে ভারতের সঙ্গে এক ধরনের ঠাণ্ডা যুদ্ধের জন্ম নেয়। ভারতের দাবি মতে সম্পূর্ণ উত্তরাঞ্চল মানে গিলগিট বালটিস্তান ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কাশ্মীরের এক-তৃতীয়াংশ দখল করে নেয়। মূলত এ অংশটি লাদাখেরই অংশ যার একাংশ আকসাই চীন চীনের দখলে এবং ১৯৬২ সালে চীন-ভারতের যুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল কাশ্মীরের লাদাখ সীমান্ত রেখাকে স্বীকৃতি না দেয়া। অবশ্য গিলগিট বালটিস্তান অঞ্চলে পাকিস্তানের কোনো প্রদেশ নয় কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল। তবে সারভাজের মতে ইমরান খান সরকার পাকিস্তানের প্রদেশ বানাতে গিয়ে বানাননি। কারণ সময় কাশ্মীর অঞ্চল এখনো অমীমাংসিত বিষয় বলে পরিগণিত।
আমরা এখনো পাখতুন খোয়া প্রদেশের প্রায় শেষ সীমান্তে। প্রায় দুই ঘণ্টা হয়েছে একটা বিরতির প্রয়োজন পড়েছিল। ছোট একটা বাজারের মতো জায়গায় থামলাম টয়লেটের সন্ধানে। এর পাশে ছোট একটি চায়ের দোকান ঠিক তার পাশে অস্থায়ী দুটো ওয়াশরুম রয়েছে। আমাদের দেখে ছোট ছোট বাচ্চারা দৌড়ে আসলো। বেশভূষায় বেশ গরিব এবং এলাকার অবস্থাও গরিব মনে হলো। সামনের ছোট মনিহারি দোকান। ওয়াশরুমও তার আওতায় কাজেই ওয়াশরুম ব্যবহার করে ১০ রুপি করে দিতে হলো। ওয়াশরুমগুলো মোটামুটি পরিষ্কারই ছিল। জায়গাটি বেশ শুষ্ক। খুব একটা গাছপালা নেই। প্রায় ১০টা বাজে। শিশুগুলো মহিলাদের পিছু নিলো কিছু পয়সার জন্য। বেশকিছু বিস্কুটের প্যাকেট কিনে দিলে বেশ হৈ-হুল্লোড় করে দৌড়ে চলে গেল।
এ জায়গাটি পশতুন এলাকা। খাইবার পাখতুন খোয়া প্রদেশের শেষ প্রান্তে। এরপরেই গিলগিট বালটিস্তান অঞ্চল শুরু।
কারাকোরাম হাইওয়ে তৈরি শেষ হয় ১৯৭৯ সালে এবং সম্পূর্ণ ব্যবহার যোগ্য এবং খুলে দেয়া হয় ১৯৮৬ সালে। এর শেষ সীমানায় চীনের সিনজিয়াং প্রদেশের শহর কাশগড় যা পাক-চীন বর্ডার অতিক্রম করতে হয় খুনজারাবো গিরিপথ ধরে। আমরা মাত্র পাট্টান এলাকা ছাড়লাম। পাট্টান খাইবার পাখতুন খোয়ার নিম্ন কোহিস্তান জেলায়। এখানকার অধিবাসীরা সাধারণত কোহিস্তানী নামে পরিচিত। লম্বা চওড়া গড়নের ফর্সা। সাধারণত নীলাভ চোখের অধিকারী। মহিলারা পর্দানশীল তবে গড়পড়তা দেখতে সুন্দর নাক নকশার। জায়গাটি প্রায় ২৭০০ ফুট। এ সময়ে মোটামুটি গরম তবে শীতকালে উচ্চতা বেশি না হলেও অবস্থানের কারণে বেশ শীত পড়ে।
আবার সেই পথ। আঁকাবাঁকা। বাঁয়ে নিচে কারাকোরাম হাইওয়ের সমান্তরাল সিন্ধু নদী বয়ে চলেছে ঝরনার আকারে বেশ খরস্রোতা। বাসের ভিতরে প্রায় সবাই নিশ্চুপ বোধকরি সবাই একটু ভয়ে রয়েছেন। আমানুল্লাহ আমার সামনে ড্রাইভার সাত্তারের পেছনে বসা। মোবাইলে ঢাকায় তার অফিসের সঙ্গে অনবরত কথা বলে যাচ্ছেন। অপর পাশ দিয়ে খুব বেশি গাড়ি চলাচল করতে দেখিনি। তবে মাঝে মধ্যে মোটরসাইকেলগুলো আমাদের পাশ কাটিয়ে বেশ জোরে শব্দ করতে করতে যাচ্ছে। সারতাজকে জিজ্ঞাসা করলাম এসব কি মোটরসাইকেল? বললো, এরা ‘মনচেলে’। বেশির ভাগ পিণ্ডি লাহোর এমনকি করাচি হতেও দলে দলে আসে একেবারে খুনজারাবো গিরিপথ পর্যন্ত যায়। দেখবেন  এরা প্রায় সময়েই দু’জন হয়। ব্যাগে কাপড় চোপড় এবং ছোট ছোট তাঁবু নিয়ে যায় ক্যাম্পিং-এর জন্য। বেশির ভাগ সময়েই সপ্তাহান্তে প্রচুর স্থানীয় পর্যটক আসে মোটরসাইকেলে। আমি বললাম, ‘মনচেলে’? মানে কি? বললো, হয় ‘মনচেলে’ মানে এডভেঞ্চারার। যৌবন বয়সে যেমন হয়।
বাঁদিকের পাহাড়গুলো হতে বরফ গলা পানি ঝরনার আকারে সিন্ধু নদীতে পড়ে আরও বেগবান হচ্ছে। পাথুরে পাহাড়ের বুক চিড়ে ঝরনাগুলো দেখলে মনে হয় সাদা দুধের ঝরনা নামছে। বেশ ছোট ছোট বুদবুদের মতো। সারতাজ ওই সাদা দুধের মতো ঝরনা দেখিয়ে মজা করে বললো, স্যার আমাদের মৌলানা সাহেবরা এ ধরনের ঝরনা দেখে ভাবে, ‘আহা ঠিক বেহেশতের মতোই তো এখানে দুধের ঝরনা বইলে বেহেশতেও এই রকম হবে। আর এখান থেকে আইডিয়া নিয়েই মসজিদে বয়ান দেয়।’ বুঝলাম ওর রসিকতার শেষ নাই। সে-ও থেকে থেকে হাঁক দেয়, ‘মামা ক্যায়সে হো? মামা কেমন আছেন?’ আর আমাদের চালক সাত্তার কম কথা বলে। এক মনে দক্ষ হাতে এমন গিরিপথে চালিয়ে যাচ্ছে।
সারতাজকে বললাম যে আমি এই রাস্তাকে আরও মসৃণ ভেবেছিলাম। জিজ্ঞাসা করলাম চীন এ রাস্তার কোন অংশ বানিয়েছে? উত্তরে সারতাজ রসিকতা করে বললো, স্যার চীনের তৈরি রাস্তায় বাস উঠলেই টের পাবেন। কারণ কোনো ঝাকি খাবেন না, এখন যেমন মাঝে মধ্যে লাফায়। জিজ্ঞাসা করলাম এ রাস্তাতো সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়েছে?
সারতাজ বললো, ‘না’ ওটা স্কারদু হয়ে গিলগিট হয়ে আতাবাদ পর্যন্ত। তাহলে এ রাস্তা কারা বানিয়েছে? বললো স্যার রোড এন্ড হাইওয়েজ আর হাজী দ্বীন মোহাম্মদ।
হাজী দ্বীন মোহাম্মদ? সে কে? সারতাজ হাসতে হাসতে বললো স্যার পাকিস্তানি চোর ঠিকাদাররা। সব শালারা চোর কিন্তু কতোবার পবিত্র হজ পালন করেছে তার হিসাব নেই। তাই আমরা এদেরকে ‘হাজী দ্বীন মোহাম্মদ’ বলি। ‘সব কে সব চোর হ্যায়।’ আমরা সবাই হেসে উঠলাম সারতাজের বিবরণ শুনে।
দুপুরের কাছাকাছি। রাস্তাটি আঁকাবাঁকা হলেও এবার নদী থেকে একটু ভিতর দিয়ে চলছে পাহাড়গুলোর মাঝামাঝি দিয়ে। মনে হয় যেন চন্দ্রপৃষ্ঠে ভ্রমণ করছি, কারণ পাথর ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না। এখানকার উচ্চতা তেমন নয় তবে কোনো সবুজের চিহ্ন নেই।
কিছুক্ষণ পর আমরা ছোট একটা সবুজের মাঝে একটা বাজার দেখতে পেলাম। জায়গাটির নাম দাসু। বেশ দৃষ্টিনন্দন এই কারণে ঠিক সিন্ধু নদীর উপরে। গাড়ি দাঁড়ালো রাস্তার পাশেই। হাতের ডানে পাহাড়ের গায়ে কয়েকটি দোকানপাট আর অপর প্রান্তে দুটি রেস্তরাঁ না বলে ধাবা বলা যায়। বেছে নিলাম ধাবাটিকে। গাছের নিচে খোলা জায়গায় চেয়ার টেবিল পাতা। ঠিক তার নিচ দিয়ে সিন্ধু নদী বয়ে যাচ্ছে। নীল নদী তার উপরের পানির বুদবুদ ফেনার মতো। যেমন আগেই বলেছি দূর হতে মনে হয় দুধের ফেনা দেখা যায়। কিছু মৃদু বাতাস বয়ে যাচ্ছে। যদিও জায়গাটি খুব উঁচু নয়। দাসু-এর উচ্চতা ২,৭৫৯ ফুট।

 


আমরা বেশিরভাগ সময় মুরগি ডাল আর সবজি দিয়েই গরম নান খেয়ে থাকি। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে প্রচুর সালাদ খেয়ে থাকি। বিশেষ করে পাকিস্তানের পিয়াজ বেশ মিষ্টি খালিই খাওয়া যায়। আর পিয়াজের সবচাইতে বড় ভক্ত ডা. নাসরুল্লাহ। পিয়াজ পেলে সবার আগে নাসরুল্লাহ প্লেট শেষ করে। তাই কয়েকটি প্লেটই নিয়ে থাকি।
প্রায় ঘণ্টাখানেক বিরতি নিয়ে পুনরায় আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। এখানে কয়েকটি দোকানে শুকনা ফল দেখলাম কিন্তু কিনতে ইচ্ছা হলেও কিনলাম না। ভাবলাম গিলগিট হতে কেনার অপেক্ষায় রইলাম।
পেছনে রেখে আসলাম দাসু। প্রায় ঘণ্টা খানেক পর আবার ঠিক সিন্ধু নদীর অপর প্রান্তের পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে চলছি। গাড়িতে প্রায় সবাই ঝিমুচ্ছেন। এতক্ষণে বোধ হয় এই রাস্তার ভয় কেটে গিয়েছে। কিছু দূরে গিয়ে গাড়িটি থেমে গেল। সামনে ট্রাকসহ কিছু গাড়ির বহর লম্বা লাইনে দাঁড়ানো অপর পাড়েও তাই। গাড়ি থামিয়ে সারতাজ আর সাত্তার নেমে গেলেন। আমাদের কেউই শীতাতপ থেকে নামলো না। বাঁদিকে জায়গা নেই কাজেই নামার প্রশ্নই উঠে না। সরাসরি নিচে নদী আর ডান দিকে সুউচ্চ কারাকোরাম পর্বতের পাহাড়গুলো। সারতাজ এসে যে খবর দিলো তা মোটেও সুখবর নয়। জায়গাটি পাহাড়ি ধসের জায়গা। প্রায় সময় বড় ধস নামে। প্রায় দুই ঘণ্টা আগে বড় ধরনের ধস নেমেছে। হাইওয়ে কর্তৃপক্ষ রাস্তা পরিষ্কার করার কাজে নিয়োজিত হয়ে বিভিন্ন যান্ত্রিক গাড়ি এবং ‘বেক হো’ ইত্যাদি ব্যবহার করছে।
এ রাস্তার বহু জায়গায় এমন ধস নামে আর বড় বড় পাথর পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়। এই ধসের অন্যতম কারণ যখন পাহাড়ের পাথর ভেঙে এই মহাসড়ক তৈরি করার জন্য বিস্ফোরক ব্যবহার করাতে পাহাড়ে যে ফাটলের সৃষ্টি হয়েছিল তা আজও সক্রিয়। গ্রীষ্মকালে পাথর গরম হয়ে যে ক্রিয়াক্রম হয় তাতে পাথরগুলো বড় বড় আকারে ভেঙে যায়। যাক প্রায় দেড় ঘণ্টা আটকা থেকে আস্তে আস্তে গাড়ি ওই এলাকা পার হলো। দেখলাম কীভাবে ধস নেমেছিল। এই সময় নষ্ট হওয়ায় গিলগিট পৌঁছতে আমাদের প্রায় সন্ধ্যা আটটার মতো বেজে যেতে পারে। আমরা সন্ধ্যা বা অন্ধকারে এই রাস্তায় চলাচল করতে চাই না বলে আমাদের চালক ও ট্রাভেল কোম্পানিকে আগেই জানিয়েছিলাম। মাইলফলকে দেখলাম গিলগিট আরও ১২৫ কিলোমিটার। প্রমাদ গুনলাম। আমরা প্রায় দেড় ঘণ্টা রাস্তায় নষ্ট করলাম। কাজেই সন্ধ্যার আগেই কোনোভাবেই গিলগিট পৌঁছতে পারবো বলে মনে হয় না।
আমরা এখন পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে কোথাও কোথাও পাথুরে উপত্যকার মধ্যদিয়ে চলছি। আশেপাশে সবুজের কোনো বালাই নেই। চারিদিকের পাথরের উপর সূর্য্যরে তেজস্বী আলো যেন ঠিকরে চোখে লাগছে। চারিদিকে দেখে মনে হলো যেন চাঁদের পৃষ্ঠের যে ছবি দেখা যায় ঠিক যেন তেমনই মনে হচ্ছিল। ঘণ্টাখানেক পর পুনরায় পাহাড়ের কোলের রাস্তায় উঠলাম।
সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে আসছে। সূর্য উঁচু পর্বতের পেছনে চলে গিয়েছে। আমাদের বাঁপাশে সিন্ধু নদীর অন্যতম শাখা পাহাড়ি খরস্রোতা নদী গিলগিট নদী। সিন্ধুর তুলনায় চওড়ায় একটু কিন্তু যথেষ্ট খরস্রোতা। এর কারণ পর্বতগুলোর মাঝখানে প্রবাহিত ঝরনা নদীগুলোর উচ্চতাও- উত্তরদিকে উচ্চতা ক্রমবর্ধমান।
আরও প্রায় আধাঘণ্টা উৎকণ্ঠার মধ্যে চলবার পর আমরা চিলাস নামক ছোট একটি লোকালয়ে এসে পৌঁছলাম। এখান হতে একটি রাস্তা দক্ষিণ-পূর্বদিকে বাবুসার নামক হিমপ্রবাহের গিরিপথ হয়ে বিখ্যাত কাগান উপত্যকা হয়ে এবোটাবাদ ইসলামাবাদকে যুক্ত করে। বাবুসার গিরিপথের সর্বোচ্চ স্থানটি বরফে আচ্ছাদিত হিমবাহ প্রায় সাড়ে পনের হাজার ফুট। রাস্তাটি বছরে গ্রীষ্মের কয়েকমাস খোলা থাকে। তবে এ সময়েও বৃষ্টি হলে সঙ্গে তুষারপাত হয়ে প্রায়ই বন্ধ হয়ে যায়। এ রাস্তায় ইসলামাবাদ প্রায় ৩ হতে ৪ ঘণ্টা কম হয়। দূরত্বে প্রায় ৪০০ কি.মি.। অথচ আমরা ইসলামাবাদ হতে যে রাস্তায় কারাকোরাম হাইওয়ে, গিলগিট যাচ্ছি তার দূরত্ব প্রায় ৬১০ কি.মি. যা আমরা এখনো শেষ করতে পারি নি। আমরা ফিরতি পথে হয়তো চিলাসে রাত কাটিয়ে বাবুসার গিরিপথ হয়ে এবোটাবাদ যাবো তবে পথে আরেক রাত আমাদেরকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে জন্য খ্যাত কাগান উপত্যকায় থাকবো।
চিলাস-এ যাত্রা বিরতি করতে হলো। কারণ অনেক দূর বিনা বিরতিতে আসতে হয়েছে। এটাই পাকিস্তানের গিলগিট পাখতুনখোয়া প্রদেশের সীমানা। এরপর হতেই গিলগিট বালটিস্তান এলাকা যাকে পাকিস্তানের নর্দান এলাকা বলা হয় শুরু হবে।
প্রায় আধা ঘণ্টা বিরতি করতে হলো ওয়াশরুমের জন্য। সূর্য ডুবে গিয়েছে। সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমেই দিনের আলোকে গ্রাস করার পথে। রাতে এই স্বপ্নিল আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে এখনো প্রায় ৩ ঘণ্টা পথ যেতে হবে। ১৩০ কি. মি. বাকি। যত দ্রুত সম্ভব আমরা পুনরায় রওনা হলাম। আমি স্বল্পভাষী চালক সাত্তারকে জিজ্ঞাসা করলাম যে অন্ধকার নামছে আর আমরা, কখনই অন্ধকারে এমন রাস্তা দিয়ে যাইনি তাহলে কি আজ রাত চিলাস-এ কাটাবো? সাত্তার কিছু উত্তর দেবার আগেই সারতাজ হেসে বললো, স্যার আমরাও তো আপনার সঙ্গে আছি। আর আল্লাহর মর্জি হলে তো কিছু করার নেই। এখানে কদাচিৎ বড় ধরনের কিছু ঘটে তবে যা ঘটে তা দিনেই ঘটে। এখনো এক ঘণ্টা দিনের আলো থাকবে। সূর্য্য পর্বতের পেছনে তাই একটু অন্ধকার। সন্ধ্যা ৭-৩০ পর্যন্ত আলো পাবো। আমি একাই আলাদাভাবে কথা বলছিলাম কারণ অন্যরা যারা কখনই এমন রাস্তায় আসেনি- তারা অনেকেই আড়ষ্ট হয়ে আছে। চিলাস প্রায় ৪২০০ ফুট উচ্চতায়। এর মানে এরপর হতে কারাকোরাম হাইওয়ে ক্রমেই উচ্চ হতে উচ্চতর হতে যাচ্ছে।
আমরা গিলগিটের পথে। এই শহরটি বর্তমানে বিরোধপূর্ণ কাশ্মীরের পশ্চিম দিক। আগেই যেমন বলেছি গিলগিট বালটিস্তান। যা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা শাসিত, এর রাজধানী প্রায় ৪৮০০ ফুট উচ্চতায় গিলগিট এবং হুনজা নদীর সঙ্গমস্থলে। স্মরণযোগ্য যে গিলগিট নদীটি দক্ষিণে ছেড়ে আসা সিন্ধু নদীতে পড়ে। 
আমরা চিলাস শহরটি ছেড়ে এসেছি। অন্ধকার হয়ে আসছে। অপরদিক হতে কয়েকটি প্রাইভেট গাড়ির আলো জ্বালিয়ে আমাদের গাড়ি অতিক্রম করলো। ভিতরে অনেকেই কিছুটা উৎকণ্ঠিত। মুনমুন ভাবীর (মিসেস তানভীর) মুখের দিকে তাকালাম। অনেকটা ভাবলেশহীন। হাবিব ভাবী নামাজ সেরে নিচ্ছেন। ওনাকে সমস্ত পথে দেখেছি সব ওয়াক্তের নামাজ গাড়িতে সেরেছেন। পিছনে মেনু মামা চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে রয়েছেন। আর আমানুল্লাহ কিছু বাংলা কিছু হিন্দি শব্দ মিলিয়ে অদ্ভুত ভাষায় সারতাজের সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছেন। সারতাজও বেশ মাথা নাড়িয়ে তার মতো করে বলে যাচ্ছে।
হাবিব আর শামসের মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। ফারুক মোবাইলে ইয়ার ফোন লাগিয়ে হাছন রাজার গানে মশগুল আর তার পাশে ফারুক ভাবী চোখ বন্ধ করে আছেন। তানভীরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম স্বভাব বশতঃ যা করেন, মানে তন্দ্রা। 
হঠাৎ হাবিব খান হেড়ে গলায় পেছন হতে সারতাজকে ডেকে বললেন, সারতাজ আমি পাকিস্তানের আম পেলাম না কেন?
সারতাজ বললো, ‘লাহোরে তো সুযোগ পাইনি গিলগিট আর হুনজা গিয়ে আম খাওয়াবো। তা এখানে কি আম হয়?
সারতাজ বললো, ‘না, আম পাঞ্জাব হতে আসে যেমন কলা আসে সিন্ধু প্রদেশ হতে।’ আমি বললাম, ‘কলা এখানে পাওয়া যায়? এত দূরে।’
‘হ্যাঁ পাওয়া যায়। খুনজারাবোর কাছাকাছি বাজারেও পাওয়া যায়। পাশ দিয়ে দুটো মোটরসাইকেল বাতি জ্বালিয়ে উচ্চগতিতে উল্টো দিক হতে পার হয়ে গেল।
সারতাজ ‘আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দেখো মনচেলারা কীভাবে এই অন্ধকারে চালিয়ে যাচ্ছে?’
বললাম ‘এত রাতে কোথায় যায়? বললো যে এরা চিলাস পর্যন্ত যাবে, তারপরে সকালে গিরিপথ আর হিমবাহ-এর পথে এবোটাবাদ যাবে। সারতাজ চিলাস-এর ছোট ছোট ট্রাক ভর্তি বরফ দেখলাম ওগুলো কোথায় নিয়ে যায়? জিজ্ঞাসা করাতে বললো, ‘দেখেছেন যখন পুলিশ ফাঁড়িতে আমি আপনাদের কাগজপত্র আর আমাদের অনুমতির পত্র জমা দিচ্ছিলাম ওখানে ছোট ছোট অনেক ট্রাক ভর্তি বরফ ছিল।
বললাম হ্যাঁ দেখেছি। সারতাজ বললো যে এসব বরফ ছোট বাজারে, বিশেষ করে আশেপাশের গ্রাম্য বাজারে বিক্রি করে। আর এ বরফ নিয়ে আসে বাবুসার গিরিপথের উপরের হিমবাহ হতে। আমরা যদি ফিরতি পথে ওই রাস্তা খোলা পাই আর উপরে বৃষ্টি না হয় তা হলেও ওই পথে হিমবাহের মধ্যদিয়ে যাবো। বৃষ্টি হলে বরফ পড়বে তখন হয়তো গিরিপথ বন্ধ হয়ে যাবে। ফেরতো খোদা হাফিজ, মানে আরও ৩০০ কিলোমিটার এক্সট্রা।
প্রায় দুইঘণ্টা পর রাস্তার বাঁক ঘুরলেই দূরে তারার মতো বাতি দেখা যাচ্ছে। সারতাজ বললো, ওই বাতিগুলো গিলগিট উপত্যকার গিলগিট শহরের। এখনো ঘণ্টাখানেক বাকি। এখানে রাস্তাটি গিলগিট শহর থেকেও উচ্চতায়। তাই গিলগিটের বাতি নিচে দেখা যাচ্ছে।
রাত প্রায় ৮টা হতে চলেছে। সবার মুখে ক্লান্তির ছাপ। এখানে তো কেউই তরুণ নয় তথাপি তরুণের মতো আচরণ। প্রায় সবারই সঙ্গে পোটলা পোটলা ওষুধ। দু’জন তো বাস্তবিক পক্ষে গুরুতর না হলেও রোগী। বলতে গেলে সবাই প্রৌঢ়। তবে এদের দেখলে সত্যিই মনে হয় বয়স একটা সংখ্যা মাত্র।
আজকে প্রায় ষোল দিন। এর মধ্যেই আমরা প্রায় ১৮৯০ কি.মি. পথে এই গাড়ি, এই চালক নিয়ে চলছি। প্রচণ্ড গরম। আর এক হোটেল হতে আরেক হোটেল। এইভাবে সফর করা। আমার জন্য পরিচিত আর আমার মিসেস-এর জন্য একেবারে অপরিচিত নয়, কিন্তু বাকিদের জন্য এ অঞ্চল একেবারেই অপরিচিত। তবে সবাই আনন্দে রয়েছেন এই যা। এখনো আমাদের খুনজারাবো গিরিপথ পর্যন্ত আরও ১৫০ কি.মি. যেতে হবে তারপরে ফিরতি পথে আরও যোগ হবে। আমরা সফর শেষে ইসলামাবাদ হতে দেশে ফিরবো ইনশাআল্লাহ। মোট ২৭ দিনের সফর।
আমরা গিলগিট শহরের প্রায় কাছাকাছি। গিরিপথ কারাকোরাম হাইওয়ে আধুনিক বিশ্বের যোগাযোগ খাতে বিস্ময়। প্রায় সম্পূর্ণ পথটি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম পর্বতমালার বুক চিড়ে তৈরি। কারাকোরাম পর্বতমালার কোলে আর বুক চিড়ে চীন-পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগে তৈরি যেটি সরাসরি চীনকে আরব সাগর হয়ে বিশ্বের প্রধান জ্বালানি উৎপাদনের ক্ষেত্র মধ্য এশিয়ার সন্নিকটে এনে অবশেষে ভারত মহাসাগরে নিয়ে যায়। এই পথ দিয়ে প্রবাহিত হবার কথা গ্যাস ও তেলের পাইপ লাইন এবং হালে শোনা যাচ্ছে রেললাইন, সংযুক্তির কথা। অবশ্য হাসান আবদাল পর্যন্ত রেলপথ তৈরিই রয়েছে।
বলছিলাম কারাকোরাম পর্বতমালার কথা। বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চতর ও বিস্তৃত পর্বতমালার বুকাবিরে তৈরি। তবে হিমালয় পর্বতমালার মতো অত সবুজ নয়। এই পর্বতমালার সিংহভাগ শক্ত ধূসর পাথুরে পাহাড়। এই পর্বতমালা, পামির, হিন্দুকুশ এবং হিমালয়ের সঙ্গে যুক্ত। রয়েছে ১৮টি শৃঙ্গ যাদের উচ্চতা ২৪০০০ ফুটের উপরে। এর মধ্যে ৪টি ২৬০০০ ফুট এবং বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চতর শৃঙ্গ যার নাম ‘গডউইন অস্টিন’ বা কে-২ (কারাকোরাম-২) উচ্চতায় ২৮,২৫১ ফুট। হিমালয় পর্বতমালার শৃঙ্গ, এভারেষ্ট সর্বোচ্চ ২৯,০৩৫ ফুট।
কারাকোরাম পর্বতমালা ৫০০ কি.মি. বিস্তৃত। বেশ কয়েকটি বিশ্বখ্যাত হিমবাহ রয়েছে যেগুলো দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান নদীগুলোকে চলমান রেখেছে। এর মধ্যে রয়েছে কাশ্মীর উত্তর অঞ্চলে ৭৬ কি.মি. বিস্তৃত সিয়াচেন হিমবাহ (এষধপরবৎ)। যেখানে পাক-ভারত যুদ্ধে লিপ্ত, আরেকটি যার নাম ব্লাফো হিমবাহ ৬৩ কি.মি. বিস্তৃত। আরও রয়েছে অগণিত ছোট ছোট হিমবাহ যেখানে বারোমাস বরফ আচ্ছাদিত থাকে।
কারাকোরাম তুর্কিক ভাষায় নাম, যার মানে কালো পাথর (ইষধপশ এৎধাবষ)। মধ্য এশিয়ার প্রাচীনকালের বণিকরা যারা সিল্ক রুট ব্যবহার করতো তারাই নাম দিয়েছিল কারাকোরাম। তবে ভারতীয় প্রাচীন ভূগোলবিদরা এর নাম দিয়েছিলেন কৃষ্ণগানরি। কে-২ শৃঙ্গের আদি নাম ছিল গডউইন অস্টিন। নামকরণ করা হয়েছিল বৃটিশ ভৌগোলিক হেনরী গডউইন অস্টিনের নামে। কে-২ আমাদের দেশের ধূমপায়ীদের নিকট পরিচিত নামকরণ এই নামে প্রথম পাকিস্তানে পরে বাংলাদেশে এই ব্র্যান্ড সিগারেট পাওয়া যায়।
আমরা গিলগিটের প্রায় কাছাকাছি। ভিতরে নিঃশব্দ। সঙ্গত কারণে আলো নেই। গাড়ির হেডলাইট অন্ধকার রাস্তাটি আলোকিত করছে। আমাদের এ পথের বাঁয়ে পর্বত আর ডানপাশে প্রায় ৩০০০ ফুট নিচু খাড়ি। হঠাৎ কিছুর সঙ্গে ধাক্কা লাগাতে সমগ্র গাড়িটি কেঁপে উঠলো। প্রমাদ গুনলাম। আমার চালক গাড়িটিকে নিয়ন্ত্রণ করে বাঁয়ে প্রায় শিলা-পাহাড়ের গায়ে ঘেঁষে সোজা হলো। আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ‘সারতাজ কি হলো?’ সবারই একই জিজ্ঞাসা। গিলগিট শহরের মুখে আমরা! আর একটু নামলেই গিলগিটের পাহাড় উপত্যকা। সাত্তার আমাদের চালক ঠাণ্ডা গলায় বললো যে অপর পাশ হতে একটি ট্রাক অতিক্রম করবার উদ্যোগ নিয়েছিল- হঠাৎ ওই ট্রাকের পেছন হতে ট্রাক অতিক্রম করতে একটি মোটরসাইকেল বাস ঘেঁষে পার হতে সামান্য ধাক্কা লেগেছে। মানে আল্লাহ ট্রাক আর বাস দু’টিকেই বাঁচিয়েছে। নিয়ন্ত্রণ হারালে ট্রাক ৩০০০ ফুট নিচে আর আমাদের বাস পাথুড়ে পাহাড়ে লেগে হয়তো ছিটকে পড়তো।
আমরা সবাই সমস্বরে জিজ্ঞাসা করলাম, (মোটরসাইকেলের কি অবস্থা? সারতাজ ঠাণ্ডা মাথায় ভারতীয় ছায়াছবি ‘শোলে’ এর গব্বর সিং ডাকাতের ৩ সর্দারের মতো বললো, ‘বাঁচগিয়া শালা’ মনচেলে। এদের প্রাণের ভয় নেই।
এডভেঞ্চার করে। কীভাবে বেঁচে গেল? আমরা হতভম্ব। যে ভয়ে রাতে এ রাস্তায় সচরাচর যাত্রীবাহী বাহন চলে না। অবশেষে অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা গিলগিট শহরের প্রান্তে প্রবেশ করলাম।
গিলগিটে বেশ ঝলমলানো আলো। পাহাড়ি শহর হবার কারণে টিলা বা পর্বতের গায়ে প্রচুর ঘরবাড়ি। রাতের আধো ছায়ার কারণে শহরের পরিধি ইত্যাদি বুঝা যাচ্ছে না। সকালে শহর দেখলে অবশ্যই বর্ণনা দেয়া যাবে।
গিলগিট বালটিস্তানের প্রধান শহর। এর সমান্তরাল পুরাতন সিল্ক রোড এবং তারই নব্য সংস্করণ নতুন সিল্ক রোড গিলগিট হতে উত্তরে চীনের সীমান্ত হয়ে কাশগড়, চীনা শহরে যায়। এরই সন্নিকটে আফগানিস্তানের ‘ওয়াখান করিডোর’। যদিও বালটিস্তান প্রদেশ নয় তবে প্রদেশের মতোই এখানে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার রয়েছে যার মধ্যে গিলগিট বালটিস্তান শাসিত হয়ে আসছে আগেই বলেছি যে এক সময় কাশ্মীরের অংশ ছিল। ১৯৪৭ সালে কথিত আজাদ কাশ্মীরের সঙ্গে এই অংশটিও পাকিস্তানের কব্জায় চলে আসে। গিলগিট বালটিস্তানের আয়তন ৭২,৪৯৬ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ১৪,৯২,৯২৪ (২০১৭)। এখানকার অধিকাংশ অধিবাসী আগাখানি মুসলমান। এরা আগা খানের অনুসারী। শিক্ষার হার পাকিস্তানের মধ্যে সবচাইতে বেশি প্রায় ৯৫% এবং বেকারত্বের হার কল্পনার চাইতেও কম। লক্ষণীয় যে গিলগিট বালটিস্তান আজাদ কাশ্মীর হতে ছয়গুণ বড়। গিলগিট এ অঞ্চলের রাজধানী।
এই শহরের জনসংখ্যা ২,১৬,৭৬০ জন কৃষি প্রধান, ফল চাষ এবং ট্যুরিজম প্রধান অর্থ আয়ের উৎস। এ অঞ্চল কে-২ ছাড়াও আরও ৮০০০ মিটার উচ্চতার ১৪টি এবং ৫০টি ৭০০০ মিটার উচ্চতার পর্বতশৃঙ্গ দ্বারা বেষ্টিত। রয়েছে বিশ্বের ৩টি বৃহত্তম হিমবাহের অবস্থান। এই অঞ্চলেই বিশ্বের ৩টি প্রধান পর্বতমালা একত্র হয়, হিমালয়, কারাকোরাম এবং হিন্দুকুশ। এখান হতে নাঙ্গা পর্বত শৃঙ্গও দেখা যায়। দেখা যায় রাকাপোশি। বেশ কয়েকটি হ্রদ রয়েছে এই অঞ্চলে এর অন্যতম আতাবাদ হ্রদ। খরস্রোতা গিলগিট নদীই প্রধান সুপেয় পানি ও কৃষি কাজে ব্যবহার যোগ্য বরফ গলা পানির উৎস। এ অঞ্চলে বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে যার মাধ্যমে সমগ্র অঞ্চলে বিদ্যুতায়ন হয় এবং উত্তরে হুনজা শহরের কাছাকাছি আরও কয়েকটি বিদ্যুত কেন্দ্র চীনের ঈচঊঈ এর আওতায় তৈরি হচ্ছে, যার মধ্যে অন্যতম বিসাম জলবিদ্যুত প্রকল্প এক সময় বাকি অঞ্চলের মতো এ অঞ্চলও বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারীদের বাসস্থান ছিল। সমগ্র জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো। উপত্যকাটি পাথুরে পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত হলেও বেশ সবুজ ও মনোরম। আমরা রাত প্রায় ৯টার কাছাকাছি এই ছোট শহরের এক প্রান্তে আন্তর্জাতিক হোটেল সেরিনাতে এসে পৌঁছলাম। রুমে যেতে যেতে রাত প্রায় সাড়ে ৯টা। মাত্র এক রাত থাকবো। এখান থেকে বেশি দূরে নয়, গিজার নামক এক পাহাড়ি দৃষ্টিনন্দন গ্রামে গিয়ে থাকবো। এখান হতে ১৪৮ কি.মি. দূরে।
যাই হোক, রুমে গিয়ে গরম পানি দিয়ে গোসল সেরে রুম সার্ভিসেই রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। শরীর মনে হয় বেশ ক্লান্ত ছিল। তবে রিসিপশন থেকে জেনে নিলাম নাস্তার সময় ও স্থান। সকাল ৮টা হতে ১১টা পর্যন্ত এবং দোতলায় রেস্তরাঁয়। রাতের সময় বলে হোটেলের পরিবেশটা নিরূপণ করা গেল নাÑ তবে সেরিনা হোটেল সব সময়ই আন্তর্জাতিক মানের হয়ে থাকে। সকালে উঠে তৈরি হলাম। বেশ খিদে লেগেছে? একবারে বাক্স পেটরা নিয়ে বাইরে রেখে দেবো কারণ দশটার পর আমরা গিলগিট ছেড়ে গিলগিট-বালটিস্তানের একেবারে পশ্চিম প্রান্তের জেলা শহর গিজার-এ যাবো। থাকবো দু’রাত। গিজার আফগানিস্তানের অন্যতম ভূ-কৌশলগত অঞ্চল ওয়াখান করিডোর এবং চীনের সীমান্ত সংলগ্ন। সারতাজ বলেছে যে গিজার এ অঞ্চলের অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। হওয়াটাই স্বাভাবিক কারণ অঞ্চলটাইতো এমন। সে কবে থেকে হুনজা আর গিলগিটের সৌন্দযের কথা শুনে আসছি।
এ পর্যন্ত যা দেখলাম টকটকা লাল আভাযুক্ত ফর্সা টিকোলো নাক আর অনেকটা নীলাভ চোখের অধিকারী পুরুষ-মহিলা। পাহাড়ি অঞ্চল আর পরিশ্রমী মানুষ হিসাবে এদের দেহের গড়নও খুব সুন্দর। এরা সেই বিখ্যাত আদি আর্য্য এবং আলেকজান্ডারের সঙ্গে গ্রীকদের সংমিশ্রণ। প্রায় মানুষের চেহারায় গ্রীকদের ছাপ রয়েছে। এখান হতে বেশি দূরে নয় খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের চিত্রল অঞ্চলের একটি দুর্বোধ্য জায়গার এক সময়কার নাম ছিল কাফেরিস্তান, এখন কালাশ নামে পরিচিত একেবারে অকৃত্রিম প্রাকৃতিক ঐতিহাসিক গ্রাম রয়েছে- এ এলাকার মানুষের প্রাচীন জাতির বাস। কালাশ সেখানকার বাসিন্দাদের নাম। হিন্দুকুশের পাদদেশে কালাশ বা কাফেরিস্তান। এরা এখনো অগ্নি উপাসক এবং গ্রীক রীতি-নীতিতে অভ্যস্ত। বলা হয়ে থাকে আলেকজান্ডার দি গ্রেট-এর সঙ্গে আগত যেসব গ্রীক সৈনিক বিদ্রোহ করেছিল। তাদের অনেকেই এখানে রয়ে গিয়েছিল। তাদেরই বংশধর এই কালাশ উপজাতি। এরা শুধু এখানেই নয়, ওই এলাকা সংলগ্ন আফগানিস্তানের নুরিস্তান প্রদেশেও এদের বাস। মহিলারা দারুণ সুন্দরী তেমনি পুরুষরাও। মনে হয় গিলগিট অঞ্চলের লোকগুলোর প্রায় একই মিল রয়েছে। সারতাজ আর তার ভাই সত্যই সুঠাম এবং সুন্দর গড়ন ও সুন্দর চেহারার অধিকারী। শামসের ভাবী তো বলে ফেললেন এরাতো সিনেমার হিরো হতে পারে।
আমি আর আমার সহধর্মিণী সুটকেসগুলো দরজার সামনে রেখে নাস্তার জন্য নির্দেশনা মোতাবেক কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলার ডাইনিং হলের দিকে রওনা হলাম। তখনো গিলগিটের পরিবেশ দেখিনি- ওই রাতে যতটুকু দেখেছি। এমনকি হোটেলের আশেপাশে দেখবার সুযোগ হয়নি। কাঁচেঘেরা বড় হলরুমে বা ডাইনিং রুমে পৌঁছে পূর্বদিকের কাঁচের ফাঁক দিয়ে তাকাতেই মনটা দারুণভাবে ভরে উঠলো। কি অপূর্ব সে দৃশ্য। আমার দেখা সুইজারল্যান্ডের চিত্র হতেও (পড়ুন আন্দামান হতে ভেনিস) অপূর্ব দৃশ্য। এটা হোটেলের পেছন দিক। বেশ বড় সবুজ লন। লনের দু’দিকে সারি সারি সাইপ্রাস গাছ, যা এই উচ্চতায় খুব সুন্দর হয়। সাইপ্রাস গাছের ফাঁক দিয়ে পূর্বদিকে চোখ আটকে গেলে কারাকোরাম পর্বতের দু’টি পাথুড়ে ধূসর শৃঙ্গ তার মাঝখানে বরফে ঢাকা বিখ্যাত শৃঙ্গ ‘রাকাপোশি’ যার আরেক নাম ‘দুমানী’ (উঁসধহর)। তথ্য মোতাবেক রাকাপোশি পাহাড়ের চূড়া পূর্ব-পশ্চিমে ২০ কি.মি. (তথ্যে আরও পাওয়া যায় যে, এই পর্বতটি কারাকোরামের সঙ্গে যুক্ত নয় বরং একক প্রায় ২৫,৫৫১ ফুট উঁচু। একেবারে নিচ হতে উপর পর্যন্ত একক পর্বত। এটা পৃথিবীর অন্যতম এমন একক পর্বত। সকালের সূর্য ধবধবা তুষার আচ্ছাদিত শৃঙ্গে পড়ে এমন সোনালী রং ধরেছে মনে হয় যেন সম্পূর্ণ শৃঙ্গ সোনা দিয়ে মোড়ানো। অদ্ভুত আর অপূর্ব সেই দৃশ্য। হোটেলের লন যেখানে শেষ হয়েছে তার নিচে কিছুদূরে গিলগিট নদীর নীলাভ পানি আর ওপাড়ে পাহাড়ের পাদদেশে এ অঞ্চলের একটি গ্রাম। এ যেন সৃষ্টিকর্তার হাতে আঁকা এক বিশাল ক্যানভাসে চিত্র। নাস্তা নিয়ে খাচ্ছিলাম ঠিকই, কিন্তু ওই দৃশ্য থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। নাস্তা এবং হোটেলের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে গাড়িতে বের হয়ে পড়লাম। এই ছোট ভ্যালি বা পাহাড়ি শহরটি, আগেই যেমন বলেছি যে, ছোট শহরটি পর্বত দ্বারা বেষ্টিত। বেশ সবুজ। শহরের একপ্রান্তের কিছু নিচু প্রান্তর দিয়ে খরস্রোতা নীল পানির গিলগিট নদী প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে। আগেই বলেছি এসব নদী বিভিন্ন হিমবাহ হতেই প্রবাহিত। জায়গাটি ট্যুরিস্টদের জন্য স্বর্গরাজ্য। ইসলামাবাদসহ কয়েকটি শহর হতে গিলগিটে বিমান সেবা রয়েছে। ছোট আকারের বিমান চলাচল করে। স্কার্দুর সঙ্গে পাহাড়ি সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। গিলগিট নদী আরও উত্তরে গিয়ে হুনজা নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়। এখানে উর্দু, ‘বালটি’ আর ‘সিনা’ ভাষা ব্যবহার করা হয়। শহরটি ৪৯০০ ফুট উঁচুতে। শীতে বরফে ঢাকা পড়ে কিন্তু গ্রীষ্মকালে গরম পড়ে ঠিকই, তবে বেশ কোমল গরম। এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বেশ কয়েকটি কলেজ ও স্কুল রয়েছে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা সকালে উঠেই স্কুলমুখী হয়। এ অঞ্চলে আগা খান ফাউন্ডেশন শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং গ্রামের উন্নয়নসহ ছোট ছোট ব্যবসাতে সহযোগিতা করে আসছে। আগেই বলেছি ৯৫ শতাংশ শিক্ষার হার।

 


গিলগিট প্রধান বাজার যার নাম এনএলআই (ঘখও) বাজার। এনএলআই মানে নর্থ লাইট ইনফেন্ট্রি বাজার। এনএলআই এখানেই স্থিত সেনাবাহিনীর একটি রেজিমেন্ট। যাদের প্রধান সদর এখানেই। বাজারের সঙ্গেই সেনানিবাস সে কারণেই এর নামকরণ। এটাই প্রধান বাজার। বহু ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ট্যুরিস্টদের জন্য গাড়ি রয়েছে। এখানকার গাড়ির রেজিস্ট্রেশন এখানকার জন্য আলাদা। তথ্যে প্রকাশ যে, এখানকার স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি আনা হয় তবে এ অঞ্চলের বাইরে রেজিস্ট্রেশন ও বিক্রি করা একেবারেই নিষিদ্ধ।
এখানে বহু জাতের বৃক্ষ ও গুল্মরাজি রয়েছে। রয়েছে নানা ধরনের ঔষধি গুল্ম। এখানে আপেল, আখরোট, খোবানী, পিচ এবং এই সময়ে প্রচুর চেরি হয় অবশ্য হোটেলে বসে প্রচুর চেরি খেলাম। আমরা বাজারের একপ্রান্তে একটি ক্লিনিকের সামনে থামলাম। এখানে ‘মনি’ মানে হাবিব সাহেবের শালীর পায়ে ড্রেসিং হবে। সঙ্গে নামলো আমাদের ডাক্তার নাসরুল্লাহ তদারকির জন্য। মামাও নামলেন চোখের ড্রপ কিনতে। আমরা বসে চেরি খাচ্ছি আর গান শুনছি সারতাজদের বাড়ি হুনজায়, যেখানে আমরা মোট ৩ রাত থাকবো। ওখান হতে এক রাত থাকবো পাসোতে। পাসো গিলগিট আর খুনজারাবো গিরিপথের মাঝে একটি পর্বত আর হিমবাহ ঘেরা বড় গ্রাম যার মাঝখান দিয়ে কারাকোরাম হাইওয়ে বা নতুন সিল্ক রোড চলে যাচ্ছে।
প্রায় ঘণ্টাখানেক এনএলআই বাজারের একপ্রান্তে আমরা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণ পর নাসরুল্লাহ দুই রোগী নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। খুবই আহ্লাদিত। বললেন যে ডাক্তার এবং স্থানীয় লোকজন বাংলাদেশি মেহমান পেয়ে খুবই আনন্দিত। কারণ তারা এই তল্লাটে এর আগে বাংলাদেশিদের পায়নি। অবশ্য এ পর্যন্ত পাকিস্তানিদের মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে যে এক ধরনের উৎসুক্য রয়েছে বিশেষ করে ১৯৭১-এর পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তা যেখানেই গিয়েছি প্রত্যক্ষ করেছি। আর যারা প্রৌঢ় তাদের বেশির ভাগই এখন মনে করে তাদের নেতাদের দোষে ১৯৭১ সাল ঘটেছিল এবং আজ পাকিস্তানের এই অর্থনৈতিক দুর্দশা। এই উত্তরাঞ্চল নিজেরাই পাকিস্তানের সঙ্গে যেভাবে রয়েছে তাতে খুব সন্তুষ্ট নয়। এরা এদের সংস্কৃতির বন্ধন খুঁজে কাশ্মীরীদের মাঝে। এরা মনে করে কাশ্মীর স্বাধীন রাষ্ট্র হবার দাবি রাখে। এই উত্তরাঞ্চলের মানুষের নিকট ইমরান খান খুবই জনপ্রিয়। সারতাজ-এর ভাষ্য যে, উত্তরাঞ্চলে আগা খান ফাউন্ডেশনের কারণেই এ পর্যন্ত এখানকার মানুষ এই উন্নতিতে রয়েছে। সারতাজের মতে জেনারেল মোশাররফের সময়ে এখানে যথেষ্ট কাজ হয়েছে বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থায়।
এখানকার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যবহার্য বেশিরভাগ দ্রব্যাদিই চীনের তৈরি সামগ্রী এবং সস্তাতেই বিক্রি হয়। পাকিস্তানে বর্তমানে দারুণ মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনীতির করুণ দশা হলেও এ পর্যন্ত যা প্রত্যক্ষ করেছি তাতে মনে হলো যে সাধারণ খাদ্যদ্রব্য ও তৈরি খাবারের মূল্য আমাদের দেশ হতেও অনেক কম এবং সহনীয় পর্যায়ে।
আমরা গিলগিট শহরটি ছেড়ে পাহাড়ি গ্রামের মধ্যে এক রকম সরু রাস্তা দিয়ে পশ্চিম দিকে যাচ্ছি। দু’পাশে কিছু পাকা কিছু কাঁচাপাকা ঘর। নিচ দিয়ে গিলগিট নদী প্রায় ৪০০০ ফুট নিচে হবে। নীল পানি তীব্রগতিতে দক্ষিণ দিকে ছুটে চলেছে। সবুজ গাছপালায় ঘেরা বাড়িগুলো। ছোট ছোট পাহাড়ি চাষাবাদ এলাকা। বাড়িঘরগুলোর পাশে ছোট-বড় ফলের বাগান। বেশির ভাগ চেরি। পেকে মেরুন রং ধারণ করে আছে। বাড়িতে বাড়িতে চেরি ছাড়া অনেক সেতুত গাছও রয়েছে। ফলগুলো মাত্র পেকে আসছে, সেতুত মানে ‘মালবেরী’। সারতাজ আমাকে দেখালো আর কয়েকদিনের মধ্যেই সেতুতগুলো পাকবে। অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর এই ফলগুলো। আপেল গাছগুলোতে মাত্র ফুল আসা শুরু হয়েছে। অনুরূপ অবস্থায় আনার বা ডালিম। এগুলো আগামী মাসে ফল হবে আর পরিপক্ক হবে সেপ্টেম্বর মাসে। এ সময়ে চেরি পাওয়া যায় অফুরন্ত আর প্রায় পানির দামে।
গ্রামের রাস্তা দিয়ে দলে দলে ফুটফুটে ছেলে-মেয়েগুলো স্কুলের পথে রওনা হয়েছে। স্কুলে দুপুরের খাবার বিনা পয়সায় দেয়া হয়। কি সুন্দর শিশুদের গায়ের রং। সারতাজ বললো প্রায় একশত ভাগ শিশুরা স্কুলে যায়। স্কুলে না পাঠালে গ্রামের মাতব্বর খোঁজ নেয়। এসব স্কুল বেশির ভাগই আগা খান ফাউন্ডেশন চালায়।
এখানে ফারুকের পরিচিত বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা রয়েছেন যারা একসময় ব্র্যাক পাকিস্তানের হয়ে কাজ করেছেন। পরে আগা খান ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ব্র্যাক-এর আদলে তৈরি হয়েছে। এ সুবাদে ফারুক পাকিস্তানে বহুবার এসেছেন এবং এদের সঙ্গে কাজ করেছে। ফারুক প্রথমে বিশ্বব্যাংকে পরে ব্র্যাক-এ বহু বছর প্রধান নির্বাহী ছিলেন। পরিচিতদের মধ্যে এখানে যিনি প্রধান ছিলেন তিনি এখন অনেক বয়সি, নব্বইয়ের উপরে নাম শোয়েব সুলতান- যিনি পাকিস্তানের সমবায়ের এবং ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন। আর দু’জনের একজন যার বাড়ি হুনজায় তার নাম মোজাফফর। তিনি আমাদের সবাইকে হুনজার উত্তরে পাসুর নামক জায়গায়, যেখানে আমাদের এক রাত্রি বাস করবার কথা, সেখানে রাতের খাবারের আমন্ত্রণ করে রেখেছেন। ক্রমেই আমরা উঁচু পাহাড়ি সর্পিল আঁকাবাঁকা রাস্তায় উঠলাম। রাস্তাটি কথিত জাতীয় রাস্তা হলেও তেমন চওড়া আর মসৃণ নয়। গিলগিট ছেড়ে গিজার জেলার রাস্তা এটা। গিজারকে হৃদের জেলা বলা হয়। এখানে প্রায় বারোটা হ্রদ রয়েছে। সবগুলোই পাহাড়ি হ্রদ বেশ উচ্চতায়।
রাস্তাটি দেখে এবং এমন সর্পিল- যার একপাশ খাড়ি এবং পাহাড়ি গিজার নদী বয়ে যাচ্ছে দুই পর্বতের মাঝ দিয়ে তাও প্রায় ২০০০ এর বেশি ফুট নিচ দিয়ে। নীলাভ রং এবং পাশের পর্বত হতে তীব্র বেগে হিমবাহের বরফ গলা পানি দেখতে শুভ্র ফেনা তুলে গিজার নদীতে মিলছে। আসলে এটিই প্রধান নদী যেখান দিয়ে বয়ে যায় ওই জায়গার নামে নামকরণ হয়। গিজার বালটিস্তানের অন্যতম পর্যটন স্থান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে এবং নির্মল পরিবেশের জায়গা গিজার।
আমাদের চলার পথটির বর্ধিত করবার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানতে পারলাম যেটি মারি হয়ে মোজারাবাদ পর্যন্ত যাবার কথা। এখন খুব কম গাড়ি চলে খুব বড় ট্রাকের চলন নেই। রাস্তার একদিক খাড়া আর নদীর ওই পাড়ের পর্বতের গায়ে দৃশ্যটি অদ্ভুত মনোরম। ওপারের পর্বতের কোলে প্রায় ২ হতে ৪ হাজার ফুট সবুজ বনায়ন। বেশির ভাগ সুউচ্চ পাইন গাছের জঙ্গলসহ আরও অনেক রকমের বৃক্ষ। ঢালে কিছু কৃষি কাজ। বিক্ষিপ্ত বাড়িঘর। আরও সামনে রাস্তা হতে ছোট রাস্তা নেমে গিয়ে নদী পারাপারের একটি পুল রয়েছে যার উপর দিয়ে অবলীলাক্রমে ছোট গাড়ি পারাপার হতে পারে। আর একটু সামনে এগুতেই অপর পাড়ে সবুজে ঘেরা গ্রাম। তার নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নীলাভ খরস্রোতা গিজার নদী। অপূর্ব দৃশ্য। আমি জানালার পর্দা সরিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
আমরা প্রায় দু’ঘণ্টার মতো চলেছি। পৌঁছতে আরও হয়তো ঘণ্টাখানেক মানে দুপুরের পরে হোটেলে পৌঁছাবো। রাস্তার বাঁকে বেশ প্রশস্ত জায়গা নিচে বহমান নদী আর ওপারে গ্রাম এমন দৃশ্যময় জায়গা। এতক্ষণে বাঁকের এক পাশে একটা গ্রাম্য চায়ের দোকান। বিরতিরও দরকার। গাড়ি থামিয়ে নামলাম। চায়ের দোকানের কাছাকাছি। এ পাশের পাহাড়ের উপরে কয়েক ঘরের একটা গ্রাম বা বসতি। এই দোকানটি তাদের কেউ হয়তো চালায়। প্রায় সবাই নামলো। এত সুন্দর জায়গা ছবি উঠাবার লোভ সামলানো গেল না। দেখলাম গরম গরম পেয়াজু ভাজা। কয়েকজন ভিতরে ঢুকে দেখলাম বসবার জায়গা তেমন নেই। একটা চৌকির মতো পাতা। কয়েকজন বসে চায়ের কথা বলে কিছু গরম পেয়াজু ভাজতে বললাম। একজন মধ্য বয়সী স্থানীয় মানুষ। মনে হলো এতগুলো কাপও নেই। কোনোভাবে চায়ের ব্যবস্থা করতেই হিমশিম খাচ্ছিল। কারণ আমাদের চাহিদা চিনি ছাড়া লিকার, কারও চিনিসহ লিকার আবার কারও দুধ চায়ের খোঁজ। আর গরম পেয়াজু যে কয় প্লেট ছিল শেষ। নাসরুল্লাহ আরও বানাতে বললেন। এর মধ্যে বাইরে মহিলারা ছবি তুলছেন। এক্ষেত্রে ফটোগ্রাফার সারতাজ।
চা পানি পান আর পেট ভরে পেয়াজু যাকে স্থানীয়রা পাকোরা বলে খাওয়া শেষ- এবার বিল চুকাবার পালা। কতো হয়েছে বলতেই দোকানি মাথা চুলকাতে শুরু করলো। বোধহয় হিসাব মিলাতে পারছিল না। কিছুক্ষণ পর বোধকরি বাড়ি হতে হিসাব করে দিলো তার মেয়ে। মাত্র স্কুল থেকে এসেছে। বয়স আনুমানিক দশের কাছাকাছি। জিজ্ঞাসা করতেই বললো স্কুলের ক্লাস ৬-এ পড়ে। এত বিদেশি দেখে বাবার কাছে এসেছে। ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটি। স্থানীয় ভাষায় বাপ-মেয়ের কথোপকথন বুঝা গেল যে বাবা মেয়েকে হিসাব করতে বলেছে। অবশেষে দাম চুকিয়ে কিছু বাড়তি রুপি মেয়েটির হাতে আন্টিদের তরফ থেকে দিয়ে আমরা অতীব দৃষ্টিনন্দন জায়গা ছাড়লাম। দারুণ দৃশ্য নদীর বাঁকের। নদীর পাড়ে গ্রামগুলো নানা রংয়ের কানভীলা ফুলে ঢাকা। 
প্রায় ৪ ঘণ্টা লোম খাড়া করবার মতো পথের আপাতত অবসান ঘটিয়ে পাহাড়ের কোলের এক হোটেলে এসে পৌঁছলাম। জেলা গিজার ‘ব্লোসম ইনন’-এ পৌঁছলাম। এখান হতে একটা রাস্তা চিত্রলের দিকে চলে যায়। এটাই গিজার ভ্যালি। মালপত্র নামিয়ে দোতলায় গিয়ে রুমে ঠাঁই নিলাম। পেছনে খাড়া পাহাড়। দূরে চূড়াতে বরফের ছোঁয়া দেখা যায়। বেশ কয়েকটি পাকা বাড়িঘর। পেছন দিয়ে বাড়িগুলোতে উঠার জন্য গাড়ির রাস্তা রয়েছে। অবশেষে দুপুরের খাওয়া প্রায় ৪টায় খেলাম। এ বেলা আর বের হবার নয় তাই শুয়ে বসে বিশ্রাম নেয়া। আবার রাত ৯টার দিকে রাতের খাবার। পরের দিন সকালে আশে পাশে যতটুকু সম্ভব দেখা। শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখা। এখানে বিদ্যুতের সমস্যা নেই, কারণ এসব নদীর বহু জায়গায় ছোট ছোট জলবিদ্যুত প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় এবং স্থানীয় চাহিদা মেটায়।
পরের দিন সকালে নাস্তা সেরে বের হলাম আশেপাশে ঘুরে দেখবার জন্য। আমরা কোথাও তেমন না গিয়ে; কারণ লেকগুলো পাহাড়ের উপরে, এসে উপস্থিত হলাম একেবারে নদীর বরাবর। তার মানে আমাদের অনেক দূর নামতে হলো। নদীর পাড়ে ছোট উপত্যকা। অদূরেই গিজার- যেহেতু জায়গাটির নাম গুপিস তাই ‘গুপিস’ নদী বরাবর। একটি দেয়াল ঘেরা জায়গায়। রয়েছে রান্নাঘর। চেয়ার টেবিল এবং ৪টি খোলা আচ্ছাদিত বেদি। সবক’টির উপরে কার্পেট পাতা। সারতাজ বললেন যে, এটা বনভোজনের জায়গা। দুপুরে আমরা কি খেতে চাই তা যেন বলে দেই। আরও বললেন, এখানে এই নদীর অন্যতম সেরা মাছ, যা খরস্রোতা পাহাড়ি নদীতে হয়, ট্রাউট মাছ। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আপনি ট্রাউট মাছের কথা বলেছেন এখানে ভালো পাওয়া যায়। ‘তাজা’ জিজ্ঞাসা করলাম। বললো, এখন বললে হয়তো ধরবে আর না পেলে ফ্রিজে রাখাটা দেবে।
বললাম তাজা চাই। ভাজতে বা গ্রিল করতে পারবে কিনা? সারতাজ বললো, নিশ্চয়ই পারবে। আমরা সবাই নামলাম। দেয়ালের ওপারে নদী ঘেঁষে একটা বাড়ি। মনে হলো এ জায়গাটিও ওই বাড়ির মালিকের হবে।
আমরা ছাড়াও সেখানের একটা বেদিতে একটি বা দুটি পরিবার ছিল। তারা খাবার নিয়েই এসেছিল বলে পাক করতে হয়নি। আমরা ডাল, ভাত আর সঙ্গে সবজির কথা বললাম সঙ্গে ট্রাউট মাছ। কিন্তু গোল বাধল হাবিবকে নিয়ে তিনি মাছ খান না। কাজেই সবার জন্য ডিম ভুনা। অনেক পিয়াজ দিয়ে।
কে পাক করবে? যে রাঁধুনি আছে তাকে দিয়ে হয়তো হবে না। অগত্যা দায়িত্ব চাপলো শামসের আর ফারুক ভাবীর উপরে। শামসের ভাবীরই উৎসাহ বেশি ছিল এ ক্ষেত্রে। যাক তাহলে আজ বাঙালি রান্না খাবার আশায় রইলাম। আলু নেই তাই হাবিবের আলু ভর্তা রয়েই গেল।
নদীতে এত কাছে যে পানির স্রোতে ধেয়ে যাওয়া পানির আওয়াজ কানে আসছে। যেমন বলেছি ছোট উপত্যকার মতো তবে আমার বিবেচনায় নদীর চওড়া পাড়। যেহেতু দুই পর্বতের মাঝে হয়তো তাই এটা উপত্যকা। সুন্দর আবহাওয়া। পাহাড়ি ঝরনার মতো নদী যেন গুনগুন করতে করতে বয়ে যাচ্ছে। সবাই চেয়ার নিয়ে ছায়ায় বসা, চা আর পেয়াজুর অর্ডার দেয়া হলো। পাচকের সহকারী আশে পাশের বাজারে ডিম আনতে ছুটলো। দুই ভাবী পাকের ঘর আর পাক করবার বাসনপত্রের নিরীক্ষা করতে গেলেন।
আমি পেছন দেয়ালের বাইরে নদীর পাড়ে চলে আসলাম। ওপাড়ে সুউচ্চ পর্বত। কয়েক ঘরের গ্রাম। দু’পাড়ে প্রচুর গাছ বিশেষ করে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় চিনার কিন্তু এগুলোও এক জাতের পাইন গাছ। জায়গাটি ২১৭৬ মিটারের উচ্চতায়। এখানকার প্রধান জীবিকা নির্বাহের উপায় কৃষি এবং ফলের বাগান। সঙ্গে প্রচুর ভেড়ার পালন হয়। এসব ভেড়ায় প্রচুর লোম হয় বলে প্রচুর উল পাওয়া যায়। এখানে আরেক জাতের পাহাড়ি ছাগল আর ভেড়ার মাঝামাঝি প্রাণী পাওয়া যায় যার নাম মার্কোপলো শিপ। উপরে পাহাড়ের মাঝে ছোট হ্রদ যার নাম কাটাল হ্রদ। জানলাম ওই হ্রদে প্রচুর ট্রাউট মাছ পাওয়া যায়। অবশ্য মামা ট্রাউট বলতে পারে না বলে তার কাছে সহজ নাম ‘ট্রাউট মাছ’। অবশ্য আমাদের মধ্যে তিনিই মাছের পরম ভক্ত।
নদীর কাছাকাছি গিয়ে হাতে পানি উঠিয়ে মুখ ধুলাম। দারুণ ঠাণ্ডা পানি যেন মাত্র বরফ গলে পানি। হয়তো তাই। লোভ সামলাতে পারলাম না। মুখে দিয়ে পান করলাম। বেশ মিষ্টি স্বাদের পানি। নদীর ধারে কিছুক্ষণ কাটিয়ে নয়নাভিরাম দৃশ্য ছেড়ে ফিরে এসে এক বেদিতে বসে কিছুক্ষণ পর শুয়ে চোখ বন্ধ করে জায়গাটি উপভোগ করছিলাম। অন্যদের দেখলাম গাছের ছায়ায় টেবিল চেয়ার পেতে বসে চায়ের কাপে আড্ডায় মশগুল। তানভীর অন্য বেদিতে থাকা স্থানীয় পরিবারের সঙ্গে আলাপের চেষ্টা করছে। সারতাজও আড্ডায় মশগুল।
আমাকে শুয়ে থাকতে দেখে সাত্তার, আমাদের গাড়ির চালক, গাড়ি থেকে একটা বালিশের মতো কিছু এনে দিলো আর অপরপ্রান্তে সে-ও গা এলিয়ে দিলো। আর দুই ভাবী মহা-আনন্দে আমাদের দুপুরের খাবার পাক করা নিয়ে তদারকি করছেন। পাচক আর সহকারীও বেশ উপভোগ করছে এই দুই অভিজ্ঞ মহিলার তদারকি।
দুপুরের খাওয়াটা একটু দেরিতে হলেও ডিম ভুনা, ডাল আর একটা ট্রাউট মাছ স্টিম ভালোই লাগলো। বহু বছর পর ট্রাউট মাছ খেলাম। শেষবার খেয়েছিলাম সুইজারল্যান্ড থেকে ফিরবার পথে অস্ট্রিয়ার একটি হ্রদের ধারে। এবার বলতে গেলে ভূরি ভোজই হলো। মামা বোধকরি দুটো ‘ট্রাউট’ মাছ খেতে খেতে বললেন, ‘জীবনে এমন মাছ তো খাইনি! মনে থাকবে ‘ট্রাউট’ মাছ।’
দুপুরের খাওয়া শেষ। চারিদিকে সুউচ্চ কারাকোরাম পর্বত ঘেরা ছোট উপত্যকা। ক্রমেই সূর্য পর্বতের পেছনে। দূরে সুউচ্চ পর্বতগুলোর মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির উপরে সূর্যের আলোতে মনে হলো তরল সোনার প্রবাহ।
আমরা গুপিস উপত্যকা ছেড়ে আসলাম। রাস্তার পাশে এখানকার ভেড়া দেখালো সারতাজ। পাহাড়ি ভেড়া, বেশ নাদুস-নুদুস। সারতাজ বললো এর গোশত খুবই নরম আর সুস্বাদু। ভেড়ার গোশত খাবার চলন আমাদের দেশে তেমন নেই। এখানে বড় আকারের পাহাড়ি ছাগল আর ভেড়াই চোখে পড়লো। আশ্চর্য হলাম এ অঞ্চলে কোনো গরু চোখে পড়েনি। সারতাজকে জিজ্ঞাসা করলাম মার্কোপোলো শিপ যার আরেক নাম ‘মারখোর’ দেখা যায় কিনা? সারতাজ বললো, ‘হ্যাঁ এখানেও আছে তবে হুনজা এলাকার পর্বতে বেশি দেখা যায়।
এগুলো ডাক দিলেই পাহাড়ের গায়ে লেকে যে প্রতিধ্বনি হয় তখনই সহজে দেখা যায়। আরও কিছুদিন পর শিকারের মৌসুম শুরু হবে। তবে এর জন্য প্রায় ২০,০০০ রুপির সিজেন টিকিট কিনতে হয়। আরও বললো যে ওই সময়ে প্রচুর ভিনদেশি পর্যটকরা আসেন, তবে গত দুই বছর করোনার কারণে শিকার বন্ধ ছিল। পর্যটক এবং শিকারিদের আনাগোনা একেবারেই বন্ধ ছিল। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর পড়ন্ত বিকালে হোটেলে ফিরে আসলাম।
পরের দিন সকালের নাস্তা সেরে আমরা রওনা হলাম এবার গিলগিট পার হয়ে হুনজার রাজধানী বলে পরিচিত করিমাবাদ। করিমাবাদ এখান হতে প্রায় ১২৫ কি.মি.। আজকে কতোদিন হলো আমরা এই চলাচলের উপরে রয়েছি মনেও পড়ছে না। একই রাস্তা। প্রায় দু’ঘণ্টার কাছাকাছি কোথাও না থেমে আমরা গিলগিট পার হলাম। গিলগিট হতে করিমাবাদ হয়ে উত্তরে চীনের সীমান্ত পর্যন্ত রাস্তাটি নতুন কারাকোরাম হাইওয়ে হলেও সিল্ক রুট বলে পরিচিত।
বাজারের ভিতর দিয়ে আমরা গিলগিট শহরটি পার হলাম। বাজারে বেশ ভিড়। প্রচুর যানবাহন। সবই যান্ত্রিক। সামান্য বিরতি দিতে হলো কলা কিনতে সঙ্গে দুটো তরমুজও কেনা হলো। এখানে তরমুজগুলো বেশ সুস্বাদু আর রসে পূর্ণ।
কলাগুলো ছোট। অনেকটা আমাদের চম্পা কলা সাইজের। পুরানো হয়ে গেছে তবে আবহাওয়ার কারণে নষ্ট হয়নি। চেরি কিনতে চাইলে সারতাজ না করলো। বললো যে করিমাবাদ-হুনজায় গেলে প্রচুর আরও সুস্বাদু চেরি পাওয়া যাবে।
কলা একসময়ে পাকিস্তানে পাওয়া যেতো না। আসতো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে তাও বড়জোর করাচি, লাহোরের মতো বড় শহরে। আর আসতো আনারস। করাচিতে স্থানীয় কিছু কলা পাওয়া যেতো সেগুলো ছিল সবজি কলা বা কাঁচা কলাকে বিভিন্ন উপায়ে পাকিয়ে খাওয়া হতো। এখন কলা উৎপাদন হয় সিন্ধু প্রদেশে। পাকিস্তানের অন্যতম বৃহৎ কৃষির জন্য তৈরি সিন্ধু নদীর উপরে বাঁধগুলোর কারণে। ষাটের দশকে আইয়ুব খানের সময় যখন এই বাঁধগুলো নির্মাণ সম্পন্ন হয় তখন ধান উৎপাদনের জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হতে প্রায় ২৫০০ বাঙালি কৃষক পরিবারকে সিন্ধুতে জমি দিয়ে বসতি স্থাপন করতে দেয়া হয়। এদের হাত ধরেই সিন্ধুতে ধান এবং কলার চাষ চলতে থাকে। এখন পাকিস্তান চাল রপ্তানি করে এবং কলায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। চা উৎপাদন হয় তবে আনারস বোধকরি এখনো বিদেশ নির্ভর। এখান হতে আরও ঘণ্টা এক আমাদেরকে এই পাহাড়ি রাস্তায় যেতে হবে। তবে উত্তর দিকে যেমন উচ্চতা বাড়ছে তেমনি নয়নাভিরাম দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে।
নতুন সিল্ক রুটের একপ্রান্তে দুই পর্বতের মাঝে একই নদী। তবে এ জায়গায় এর নামে হুনজা নদী। এখানে উচ্চতার কারণে পানি আর খরস্রোতা। দূরের পর্বতের চূড়াগুলোতে সাদা বরফের আভাষ। পাশে ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রাম। বেশ সবুজ তার মাঝেই সর্পিল সড়ক। দু’একটি ছোট ছোট পুলও পার হতে হলো। এগুলো পাহাড়ি ঝরনার উপর। ঝরনার পানি খুব ঠাণ্ডা এবং সুপেয়। সারতাজকে বললাম যে এরপর হতে বোতলের পানি নয় আমি ঝরনার পানি পান করতে চাই। জানালো যে করিমাবাদ হোটেলে ব্যবস্থা করবে।
আরও আধা ঘণ্টা যাবার পর রাস্তার দু’পাশে বেশকিছু দোকানপাট, রেস্তরাঁ আর অনেক গাড়ি দাঁড়ানো জায়গায় আমাদের গাড়ি থামলো। আরেকটু সামনে ঘুলমাত ছোট শহর। এখানে ছোট সাইনবোর্ডে লেখা ‘রাকাপোশি’ পয়েন্ট। সামনে একটি পুল আর মাঝখান দিয়ে বড় ঝরনা বয়ে যাচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে একটু এগুতেই দেখলাম ছোট একটি জায়গায় বেশ সুন্দর একটি রেস্তরাঁ। তার সামনে হকার, বাজারের মতো স্থানীয় হস্তশিল্পের মেলা। জায়গাটি দুই পাহাড়ের মাঝে বাংলায় গিরি সংকট বলে  (মড়ৎমব)। এই রেস্তরাঁর সামনের চত্বর পার হয়ে বেশ কয়েক ধাপ নিচে নেমে চেয়ার টেবিল পাতা আচ্ছাদিত ছোট ধাবের মতো জায়গায় আসলাম। ঠিক তার উল্টো দিকেই দুই পাহাড়ের মাঝে ‘গর্জ’ এর ফাঁক দিয়ে সম্পূর্ণ বরফে ঢাকা, রোদ পড়ে সোনালী রং ধারণ করা বিশ্বের অন্যতম সুউচ্চশৃঙ্গ রাকাপোশি। রাকাপোশি সম্বন্ধে আগেই বলেছি। এ অঞ্চলে এটাই উঁচু শৃঙ্গ ২৫ হাজার ফুটেরও উপরে। গর্জ-এর মধ্যদিয়ে প্রবাহিত বেশ বড় ধরনের পাহাড়ি ঝরনা। এরই ফাঁক দিয়ে শৃঙ্গ। প্রবল বেগে আর সশব্দে নিচে নামছে। এর উৎপত্তি ‘ঘোলমুত’ হিমবাহ হতে। সে এক অবর্ণনীয় দৃশ্য। এখানে চায়ের বিরতি করলাম। কিছু ছবি তুললাম। এখান হতে উঠতে ইচ্ছা হচ্ছিল না। নিরিবিলিতে থাকলে এমন প্রাকৃতিক পরিবেশে কবি হওয়া যেতো হয়তো। প্রায় ঘণ্টা খানেক কাটিয়ে আমরা করিমাবাদে পৌঁছবার জন্যে রওয়ানা হলাম।
এতটুকু জায়গায় প্রচুর পর্যটক ছিল। কোনো একটা উৎসব হচ্ছিল কারণ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এসেছিলেন উদ্বোধন করতে। মনে পড়ে ১৯৮৯ সালে এনডিসি করবার সময়ে স্কার্দু হতে করিমাবাদ পর্যন্ত একবার এসেছিলাম। কিন্তু তখন এখানে, কিছুই ছিল না, চীনা বর্ডার পর্যন্ত রাস্তাটি সম্পূর্ণ হয়নি। মনে হলো ওই সময় রাকাপোশি অনেক কাছে মনে হয়েছিল। দৃশ্যটি ইংরেজিতে ঙংিড়সব।
ঘুলমাত হতে প্রায় দু’ঘণ্টা পর আমরা করিমাবাদ বাজার পার হয়ে পাহাড়ের কোলে নির্ধারিত হোটেলে পৌঁছলাম। এখানেও একটি ছোট বাজার। প্রধান সড়ক থেকে পাহাড়ের কোলে একটু ভিতরের দিকে। এখানে বেশ কয়েকটি হোটেল রয়েছে। একাধারে রাস্তার সঙ্গেই হোটেলটি। আর একটু উপরে হেঁটে গেলেই বেশকিছু বিপণী বিতান, রেস্তরাঁ। এসব দোকানে স্থানীয় হস্তশিল্পের সম্ভারই বেশি। জায়গাটি দেখে মনে হলো অবশ্যই পর্যকটদের জন্যে। হোটেলটির রুমে পৌঁছে মনে হলো হোটেল যেখানে শেষ ঠিক তার নিচে খাড়া পাহাড়। নিচে সবুজ উপত্যকা যা সুউচ্চ পাহাড়ে ঘেরা। রুমে প্রবেশ করে কাঁচের জানালা দিয়েই বাইরে তাকাতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। নিচে সবুজ উপত্যকা। অনেক বসতি। ঠিক তার উপরে আকাশে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে বরফে ঢাকা কয়েকটি শৃঙ্গ। সূর্য ডোবার পথে। অদ্ভুত দৃশ্য।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে আমি আর ফারুক বের হলাম কাছেই কোনো এক হ্যান্ডিক্রাফটের দোকানে। ফারুক কিছু ডলার ভাঙাবে। সারতাজ বলেছিল এরা ডলার ভাঙ্গায় কতো দেবে যে ঠিক করে বলতে পারলো না। পাহাড়ি রাস্তা উঁচু-নিচু আস্তে আস্তে হেঁটে কিছুটা উপরে উঠতে হলো। কিছু টাকা ভাঙিয়ে ফিরবার পথে ফারুকের দেখা হলো তার পুরাতন বন্ধু মোজাফফরের সঙ্গে। পরিচিত হলাম।
তিনি ফারুককে রাতের খাবারের জন্যে দাওয়াত করতে এসেছিলেন। তার খোঁজেই এদিকে আসা। আমাকে দাওয়াত করলেন। এখানেও তার বাড়ি রয়েছে তবে তার গ্রামের বাড়ি আরও উত্তরে পাসু নামক জায়গায়। পাসুতে আমরা চীন সীমান্ত খুনজারাবো গিরিপথ হতে ফেরার পথে থাকবো। শহরটির জায়গাটা নাকি বিশ্বের অন্যতম সুন্দরতম জায়গা। সুউচ্চ পাসু পর্বতমালায় ঘেরা। তিনদিকে রয়েছে ৩টি বড় বড় হিমবাহ।
মোজাফফর সাহেব আমাদের দাওয়াত করে রেখেছেন পাসু-তে রাতের ডিনার। আর এখন ফারুক দম্পতিকে তার বাড়ির কাছে একটা এলাকার বিশেষ রেস্তরাঁতে নিয়ে যাবে। রেস্তরাঁটি এখান হতে আরও হাজার ফুটের উপরে। ছোট টিলার উপরে।
করিমাবাদ বেশ পুরাতন ঐতিহাসিক শহর। উচ্চতা ৮,২০০ ফুট। এখানকার বাড়িঘরগুলো স্থানীয় পাথর ব্যবহারে তৈরি। পুরাতন নাম বালটি। এটা অবশ্য হুনজার রাজধানী বটে। বর্তমানে এখানেই হুনজার এককালের আমীর থাকতেন এখনো রয়েছে। এলাকার সবচাইতে বড় হিমপ্রবাহের নাম উলটারনালা। এখানে দেখবার অনেক কিছু থাকলেও পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে দুর্ভেদ্য বাল্টিল্ট দুর্গ। ফিরে আসলাম হোটেলে। সন্ধ্যায় জড়ো হলাম লাউঞ্জে। সবাই মিলে কিছুক্ষণ গল্প করে ডিনার করলাম। ওই একই সবজি, ডাল আর মুরগি তবে আমার অনুরোধে একটা নতুন ভাজি যোগ করলাম সেটা সাত্তার-এর বাড়ি থেকে আনা পিয়াজ ভাজা। দারুণ স্বাদ পেলাম। করিমাবাদেই সারতাজদের বাড়ি। বাড়ি থেকে অনেক চেরি নিয়ে আসলো এবং আগামী পরশু রাতের খাবার তাদের বাড়িতে খাওয়াবে বলে দাওয়াত করলো। ওর বড়ভাই সরফরাজও পিণ্ডি থেকে চলে আসবেন।
সকালে নাস্তা শেষে প্রায় ১০টার দিকে আমরা বের হলাম কারাকোরাম হাইওয়ে তথা সিল্ক রুট ধরে হুনজার উত্তরের কয়েকটি বিখ্যাত জায়গা দেখতে। ফারুক কাল রাতে মোজাফফর সাহেবের দাওয়াতে গিয়ে রেস্তরাঁর অভিজ্ঞতার কথা বললেন। পাহাড়ের চূড়ার উপর রেস্তরাঁটি যার কথা বলছিলেন। এত উপর থেকে দেখা পূর্ণিমার চাঁদের বর্ণনা দিলেন ফারুক।
আমরা হুনজার ছোট ছোট সবুজ উপত্যকাগুলো দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। সবুজ উপত্যকাগুলোর চারিদিকে সুউচ্চ পর্বত দ্বারা বেষ্টিত। অথচ পর্বতগুলো একেবারে তামাটে পাথরের তাতে সবুজের মহিমাটা সত্যই মোহনীয়ভাবে ফুটে উঠেছে।
প্রায় ৫০ কিলোমিটার আসবার পর দুই পর্বতের মাঝখান দিয়ে রাস্তার এক প্রান্তে গাড়ি দাঁড় করালো সারতাজ। আমাকে এবং আমার সঙ্গে যারা নামতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে বললো যে এখানে এমন একটি দেখার ও উপলব্ধি করবার জায়গা রয়েছে যা বিশ্বে বিরল। জায়গাটির নাম ‘বিদ্রু-খা’ আর জনমানবহীন এ উপত্যকাটির নাম ‘চালত ভ্যালি’। নামলাম। পাহাড়গুলোর পাথর তামাটে কোথাও কোথাও কালচে দারুণ শক্ত পাথর দেখলেই মনে হয় লক্ষ লক্ষ বছরের পুরাতন। সারতাজ আমরা কয়েকজন যারা নেমেছি, ফারুক, তানভীর, নাসরুল্লাহ আর আমানুল্লাহ আমাদের একটু দূরে রাস্তার পাশে একটি তথ্যবিবরণী বোর্ডের সামনে নিয়ে এসে এই বিবরণী পড়তে বলে সংক্ষেপে মুখে বললো যে এই জায়গাকে বলা হয় ‘কন্টিনেন্টাল ড্রিফট’ যেখানে দুই মহাদেশের কন্টিনেন্টাল প্লেট ধাক্কা খেয়ে এই জায়গায় যুক্ত হয়েছিল। বোর্ডে তথ্য কণিকার উপরে লেখাÑ ‘ঈড়হঃরহবহঃধষ উৎরভঃ: যিবৎব ঃড়ি ড়িৎষফং পড়ষষবফব’
তথ্য কণিকা পড়ে দেখলাম আর ২০০ মিটার হেঁটে জায়গাটা দেখা হলো। একপাশে একটি স্মৃতি স্মারক রয়েছে এখানে এই রাস্তা তৈরি করতে সেনাবাহিনীর কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্স-এর বেশকিছু সদস্য বিস্ফোরক দিয়ে পাথর ভাঙতে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন তাদের স্মরণে।
একটু হেঁটে পৃথিবীর এবং আল্লাহর সৃষ্টি পৃথিবীর অলৌকিক ঘটনার জায়গা দেখলাম। তথ্যে প্রকাশ, আনুমানিক ৫৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে এশিয়া আর ইউরেশিয়ার টেকটনিক প্লেট এখানে ধাক্কা খেয়ে জোড়া লেগেছিল। সারতাজ একটি পাহাড়ের গায়ের পাথরের দুটো রং দেখালো, একটি গাঢ় তামাটে অন্যটি প্রায় ধূসর রংয়ের। দেখলেই বুঝা যায় দুটি দুই পর্বতের জোড়া লাগা অংশ। মনে হলো বিশ্বের বিস্ময়ের জায়গা দেখলাম। এ বিষয়ে ভূগোলে পড়েছিলাম সেই কবে আজ দেখলাম।
তথ্যে আরও প্রকাশ যে, এখানেই যুক্ত হয়েছে হিমালয়ান আর তিব্বত উপত্যকার প্লেট। জানলাম যে হিমালয়ান পর্বতমালা এখনো বাড়ছে ফি বছরে প্রায় ১ সেন্টিমিটার এবং ইন্ডিয়ান প্লট এখনো উত্তরদিকে সরছে যে কারণে এ অঞ্চল দারুণ ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। তবে জায়গাটি সম্বন্ধে আগে না জানলে অথবা স্থানীয় গাইড না থাকলে হয়তো চোখেই পড়বে না। অবশ্য এখানে আবাসিক হোটেল রেস্তরাঁ খুলবার কথা রয়েছে। প্রায় আধাঘণ্টা কাটানোর পর আমাদের যাত্রা পুনরায় শুরু হলো। আমরা এখন হুসেনি রোপ ব্রিজ দেখতে যাবো। এই রোপ ব্রিজটি বিশ্বের সবচাইতে বড় রোপ বা দড়ির উপর ঝুলন্ত কাঠের তক্তা পাতা পুল। পুলটি হুনজা নদীর সবচাইতে প্রশস্ত জায়গার উপরে। রাস্তায় পড়বে আদাবাদ লেক বা হ্রদ। আতাবাদ হ্রদটি ৮,২০৪ ফুট উচ্চতায় হুনজা হতে ২৮ কি.মি. এবং হুসেনি পুল প্রায় ৩৮ কি.মি. দূরে। আঁকাবাঁকা গিরিপথ। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা হুনজা নদী।
এখানে সর্পিল রাস্তাটি কিছু কিছু জায়গায় দুই পাহাড়ের বুক চিড়ে চলছে। তবে বেশি পথ নয় কিছু দূরে গিয়ে আবার গিরিপথের আকার ধরেছে। প্রায় আধা ঘণ্টার মধ্যে আমরা আতাবাদ লেক বা হ্রদের কাছে পৌঁছলাম। লেক বা হ্রদটি রাস্তা হতে প্রায় হাজার খানেক ফুট নিচে। দারুণ অবস্থানে এ অঞ্চলের অন্যতম দর্শনীয় জায়গায়। লেকের ধারে প্রচুর কটেজ আর সেগুলোর সামনে অনেক স্পিড বোট, ইঞ্জিন বোট বাঁধা। কয়েকটি বোট বা নৌকায় বেশ কয়েকজন পর্যটক দেখলাম। আমরা নিচে নামিনি। উপরে একটি রেস্তরাঁ রয়েছে বলতে গেলে রাস্তার ধারে। অপূর্ব সুন্দর লেকটি। তিন দিকেই সুউচ্চ পর্বত। দূরের পর্বতের উপরে বরফের নদী বা হিমবাহ। তামাটে পর্বতের মাঝ দিয়ে শুভ্র মাথা তুলে দাঁড়ানো মনে হলো। লেকের গাঢ় নীল রংয়ের পানির উপরে পর্বতগুলোর- প্রতিবিম্ব দারুণ ।
আতাবাদ, লেক ছিল না। ২০১০-এ এখানে হুনজা নদীর দক্ষিণ দিকে প্রায় ৯ হাজার ফুটের উপরে পর্বতের কোলে একটি মাঝারি পাহাড়ের গ্রাম ছিল। আমরা কারাকোরাম হাইওয়ের যে জায়গায় দাঁড়ানো এই রাস্তাটি দশ বছর পূর্বে চীনের সহায়তায় নতুন করে বানানো। রাস্তার অপর পাশে পাহাড়ের গায়ে প্রতিরক্ষা দেয়াল তার গায়ে লেখাÑ খড়হম ষরাব ঢ়ধশ-পযরহধ ভৎবরহফংযরঢ়. নিচে চীনা ভাষাতেও লেখা আর দু’পাশে দু’দেশের পতাকা অঙ্কিত। তার একটু দূরে রাস্তার উপরে এ বিস্ময়কর রাস্তার অন্যতম বৃহত্তম সুড়ঙ্গ পথ প্রায় দুই কিলোমিটার। 
যেমনটা আগে বলেছি এখানেই পাহাড়ি গ্রাম ছিল আর নাম ছিল আতাবাদ। সম্পূর্ণ গ্রামটি ধস হয়ে হুনজা নদীর দক্ষিণের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তা ডুবে যায়। বর্তমানে ছোট বাঁধ দিয়ে পানির প্রবাহ ঠিক রাখা হয়। তবে অনেক গভীর হওয়াতে তেমন খরস্রোতা নয়। প্রায় ২১ কি.মি. দৈর্ঘ্যরে এই লেক অঞ্চল হতে প্রায় ৬ হাজার মানুষকে অন্যত্র সরানো সম্ভব হয়েছিল। আশেপাশের অনেক গ্রাম ভেসে গিয়েছিল। লেকের দক্ষিণ প্রান্তে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। একটি ছোট চার তারকা হোটেল তৈরি করছে। অনেকটা লেকের উপরে ঝুলন্ত।
আতাবাদ লেক ছেড়ে আমরা এবার হুসেনি ঝুলন্ত পুলের দিকে চললাম। মাত্র ১৫ কি.মি. আঁকাবাঁকা সর্পিল রাস্তা। প্রায়শই বেশকিছু মোটরসাইকেল পাশ কাটিয়ে দ্রুতগতিতে চলে যায়। প্রথম দিকে কয়েকজন এই রাস্তা দেখে আতঙ্কিত হলেও মনে হলো এ কয়েকদিনে বেশ ধাতস্ত হয়ে গিয়েছে শুধু মি. মেনু ছাড়া। তার চোখের অবস্থা এখন বেশ ভালো। দু’একদিন পর পর জিজ্ঞাসা করে সমতলে কবে যাবো? বলতে হয় এই তো কয়েকদিনের মধ্যেই।
প্রায় ২০ মিনিট পর আমরা গন্তব্যে পৌঁছলাম এখানে আগের থেকে বেশকিছু ব্যক্তিগত গাড়ি আর দু’তিনটি পর্যটক বহনকারী বাস দাঁড়ানো। জায়গাটা রাস্তার বাঁকের মতো রাস্তার ধারে কিছু জায়গা রয়েছে যাকে কেন্দ্র করে চা কফি থেকে শুরু করে পিৎজার দোকানও রয়েছে। মনে হয় বেশ চালু পর্যটন কেন্দ্র। একধারে রাস্তার নিচু অংশ বেশ গভীরে অপরদিকে একটি গ্রাম্য রাস্তা উত্তর-পূর্ব দিকে চলে গিয়েছে। রাস্তাটি নেমে গিয়েছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হুনজা নদীর ধারে। নদীটিতে এখনো তেমন পানি আসেনি কারণ হিমবাহ মাত্র গলা শুরু হয়েছে। গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রচুর পানি বহন করে আর নভেম্বর আসতেই পানি ক্রমেই বরফে পরিণত হয়। জমে যায় সমগ্র নদীটি। উপরে পর্বতে আরও বরফ জমে। চারিদিকে শুভ্র এক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এই অঞ্চলের গ্রামের মানুষ ওই সময়ে খুব একটা বের হয় না। প্রায় কয়েক মাসের পর্যাপ্ত খাবার আর গরম রাখবার জন্য ব্যবস্থা করে রাখে।
জায়গাটির উচ্চতা ৯ হাজার ফুটের কাছাকাছি আর হুনজা নদীটি আর প্রায় ৮০০ ফুট নিচে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তার মানে ব্রিজ পর্যন্ত যেতে হলে, যা এখান থেকে দেখা যায় না, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ৮০০ থেকে ৯০০ ফুট নিচে নামতে হবে। কাজেই এই অভিজ্ঞতার জন্য বেশি কাউকে পাওয়া যায়নি। তানভীর আর তানভীর ভাবী, সঙ্গে ডা. নাসরুল্লাহ, ফারুক, আমানুল্লাহ আর আমি রওয়ানা হলাম হুসেনি ব্রিজের ধার পর্যন্ত যেতে। পাকা রাস্তা ছেড়ে গ্রাম্য ও কাঁচা পথে কিছু দূর এগুলাম। পাশে দু’একটি হস্তশিল্পের দোকান। বুঝতে পারলাম যে জায়গাটি বিশ্বখ্যাত হয়ে রয়েছে পর্যটকদের জন্যই কাজেই দোকানগুলো স্থানীয় গ্রামবাসীরাই চালায়। সঙ্গে গাইড সারতাজ।
একটি ঘোড়ায় চড়ে বসেছেন মনে হলো ঘোড়াটাই বসে পড়বে। কারণ এই ওজন নয় অন্য কারণ ঘোড়ায় বসবার ধরণটাও আনাড়ির মতো ছিল কারণ তিনি তো অভ্যস্ত নন। আমি ফারুক আর আমানুল্লাহ অর্ধেক পথে উঠে চায়ের দোকানে বসলাম। এক কাপ চা আর গরম গরম পিয়াজু খেয়ে পুনরায় উপরে উঠতে শুরু করলাম। লাঠি ফেরত দিতে গিয়ে ভদ্র মহিলাকে পেলাম না তার জায়গায় এক তরুণী তার হাতে লাঠিটি দিলাম। পরে শুনলাম যে তরুণীটি ওই বৃদ্ধার নাতনি। কলেজ পড়ুয়া। এ পাশে গ্রামের মধ্যে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ছোট গেস্ট হাউস যেটা মাত্র খোলা হয়েছে পর্যটকদের সুবিধার্থে। অবশেষে উপরে উঠে আসলাম। গাড়ির কাছে এসে দেখলাম বাকিরা গাড়ি থেকে নেমে কফি শপে। আমার মিসেস একটাতে বসা। বললেন, যে কফি শপের মালিক যখন জানতে পারলো যে আমরা বাংলাদেশি তাই কফির পয়সা নিতে চাইছিল না।
যাই হোক, আমরা এবার ফেরার পথে আবার আতাবাদ হ্রদের সেই রেস্তরাঁয় এসে পৌঁছলাম। যেখানে এক মনোরম পরিবেশে প্রায় দুইঘণ্টা বসে দুপুরের খাবার খেয়ে হুনজার হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। প্রায় বিকেলের দিকে হোটেলে পৌঁছলাম। বিকেলে বাজারে বের হবো একটা বেল্ট কিনতে। আমার বেল্টটি বোধ হয় ভুলে আনিনি। সারতাজকে বললাম বাজারের কথা। সন্ধ্যার দিকে বাজারে গেলাম। বেশ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পাহাড়ি শহর। বৃষ্টিতে কিছুটা ঠাণ্ডা অনুভব করলাম। অবশ্য গায়ে একটা সুয়েটার চাপানো ছিল। আলোয় ঝলমলে বাজার। একটা মাঝারি আকারের কথিত স্টোরে গিয়ে মাপমতো একটা বেল্ট পেলাম কিনলাম। আমানুল্লাহ আর শামসের সঙ্গে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চা খেলাম। পরে হোটেলে এসে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম।
সকালে নাস্তা সেরে সারতাজ আমাদেরকে নিয়ে চললো হুনজার বিখ্যাত ঐতিহাসিক বালটিট দুর্গ দেখতে। দুর্গটি একটি পাহাড়ের চূড়ার উপর। পাদদেশে হুনজার দর্শনীয় শহরে গ্রাম বা শহরতলি বালটিট। প্রায় সবই পাকা ধাঁচের বাড়ি। অলিগলির মধ্যদিয়ে অবশেষে বালটিট দুর্গের চৌহদ্দির মধ্যে আসলাম। একেবারে চূড়ায় দুর্গটি। বেশ উপরে উঠতে হবে। এমন জায়গায় এমনভাবে তৈরি যে আক্রমণ করতে হলে প্রায় দেড় হাজার ফুট উপরে উঠতে হবে। কিছু দূরে নিচে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে হুনজা নদী। নদীর অপর পাড় দিয়ে কালো রশির মতো দেখা যায় আদি সিল্ক রুটের কিয়দংশ। গেটের দারোয়ান জানালো উপরে উঠলে এ দৃশ্যগুলো আরও পরিষ্কার দেখা যাবে।
বালটিট দুর্গ তেমন ক্লাসিক দুর্গ নয়। বাস্তবে এটি ছিল হুনজার শাসক ‘মীর’ সাহেবের পারিবারিক বাসস্থান। বেশ কয়েক শতক আগে এ জায়গা ছেড়ে হুনজায় আমাদের হোটেলের কাছাকাছি, নতুন মীর বাড়ি রয়েছে আর এ জায়গা ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে ‘ইউনেস্কো-এর এশিয়া হেরিটেজ’ হিসেবে রয়ে গেছে। এ জায়গাটা প্রায় ১১০০ বছর পুরাতন এবং এ অঞ্চলের সবচাইতে পুরাতন স্থাপনা। জায়গাটি প্রায় মোট ৮ হাজার ফুটের উপরে। চারিদিকে দারুণ দৃশ্য। নীল আসমানের মধ্যে যেন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে সুউচ্চ তামাটে পর্বত শৃঙ্গ। অদ্ভুত সে দৃশ্য। দূর্গের নিচের দিকে একটি বাগান বেশ ছায়ায় ঘেরা। সবাই গাড়ি থেকে নামেনি। আমি আর শামসের উপরে উঠিনি। বাগানের একপ্রান্তে বসে সামনে অনেক নিচে দিয়ে প্রবাহিত হুনজা নদীর দৃশ্য দেখছিলাম। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত দেখা যায় কারাকোরাম পর্বতমালার উঁচু উঁচু শৃঙ্গ। নদীর নীল পানি। দু’পাশে কোনো গাছপালা না থাকলেও এক অন্য রকম দৃশ্য। দূরে পর্বতের গায়ে চিকন কালো রেখার মতো পুরাতন সিল্ক রোডের একাংশ দেখা যাচ্ছে। প্রায় ঘণ্টা দুই ঠাঁয়ে সবুজ গাছের নিচে এ প্রান্তে বসেছিলাম। পরে সবাই ফিরলে বাজারের পথ ধরে হোটেলের দিকে রওনা হলাম দুপুরের খাবার খেতে। 
বিকেল ৫টার দিকে সবাই জমায়েত। আজ রাতের খাবারের ব্যবস্থা করেছে হুনজা বাজারের বেশকিছু নিচে ছোট উপত্যকার মতো জায়গায় ছোট গ্রাম যেখানে সদরুদ্দিনের মানে আমাদের গাইড সারতাজের বাড়িতে। আমরা বিশ্বের বহু দেশে ভ্রমণ করেছি। সঙ্গে গাইড বা ট্যুরিস্ট এজেন্সির সহায়তায়। তবে কখনো কোনো গাইডের বা এজেন্সির কর্ণধারের বাড়িতে এমন ঘটা করে খাওয়া হয়নি। যেহেতু বড় গাড়ি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় তাই আমাদের গাড়িটি বাজারে তাদের বাবা পরিচালিত একটি মনিহারি দোকানের সামনে রাখতে হবে। সেখান থেকে সদরুদ্দিনের জিপে প্রথমে মহিলাদের পরে পুরুষদের নিয়ে যাবে। অবশ্য ফারুকের সঙ্গে কয়েকজন হেঁটেই যাবে।
আমরা দোকানের সামনে নেমে ভিতরে প্রবেশ করলাম। সামনে বৃদ্ধ এক ব্যক্তি সারতাজ পরিচয় করিয়ে দিলো। তার বাবা মাকে এই দোকান করে দিয়েছে দুই ভাই মিলে। সবার ছোটভাই দুবাইতে থাকে এবং তার পরিবার শ্বশুরবাড়ি মানে এখানেই থাকে। সদরুদ্দিন ব্যবসার কারণে ইসলামাবাদ পরিবার নিয়ে থাকে বাকিরা একান্ন পরিবারেই থাকে। বাবার অনেক বয়স প্রায় ৮০-এর কাছাকাছি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিল তাই যাতে ব্যস্ত থাকে তাকে এই দোকান করে দেয়া। সারতাজ বললো বাবার কিছু করবার না থাকলে বিষণ্নতায় ভুগবে তাই সব ভাই মিলে এই দোকান করে দেয়া। দোকানের ভিতরে বসলাম। বাবা মেহমান আসবে বলে বাড়িতে। মাথার উপরে প্রিন্স আগা খানের বাঁধানো ছবি। যেমনটা আগেই বলেছি গিলগিট-বালটিস্তানের ৯৯ শতাংশ মানুষ আগা খানের অনুসারী মুসলমান।
প্রায় পনের মিনিট পর গাড়ি আমাদের কয়েকজনকে নিতে আসলো। প্রায় পাঁচ ছয় জন জিপে বসে পাহাড়ের গা ঘেঁষে মাটি পাথরের রাস্তার প্রায় হাজার খানেক ফুট নিচে নামলাম। বাড়ির গেটের সামনে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সামনে কিছু গাছ-গাছালি আর বড় বড় আকারের গোলাপের বাগান। বাগানে ডালিম আর চেরি গাছ। চেরিগুলো পেকেছে। সব মহিলারা মহা-আনন্দে গাছ থেকে চেরি পাড়ছেন আর প্রাণ ভরে খাচ্ছেন। বাসার সামনে যেতেই দেখলাম ফুটফুটে কয়েকটি শিশু পাশে সম্ভাষণ জানাতে সারতাজের বাবা-মা আর দুই বধূ। আমাদের মহিলাদের সঙ্গে সহজেই মিলে গিয়েছেন। এক পশলা ছবি তোলার পালা। কয়েকজন মহিলা চেরি গাছের আর ফল তোলার দৃশ্যে মহা-আনন্দে ছবি তুললেন।
বাড়ির ভিতরে ড্রইং রুমে আমাদের বসবার ব্যবস্থা করেছিল। ওখানেই খাবারের আয়োজন। সবাই বসলাম, কিন্তু দুই ভাই আর ওদের মা আর বাবা দাঁড়িয়ে রইলেন। অনেক বলে কয়ে বসতে বললাম। ওদের বাবা বললেন যে, বাড়িতে মেহমান আসলে তাদের ঐতিহ্যে মেহমান পরিপূর্ণভাবে আরামে না বসলে এবং না অনুরোধ করলে বসার রীতি নেই। এটাই বোধ হয় এ অঞ্চলের ঐতিহ্য। আমাদের মধ্যে শামসের ভাবী আর আমার মিসেস ভিতরে মহিলা অন্দরে গিয়ে বোধ হয় পরিবেশনায় তাদের সহযোগী হলেন ।
বাড়িতে ছোট ভাইয়ের বউ রয়েছে। স্বামী বিদেশে আর সারতাজের বিবি। দু’জনের সন্তানরা আমাদের সামনে এক গামলা তাজা চেরি আর শুকনো ফল দিলো। চেরি এমন ফল যা খেতে ইচ্ছা করবেই।
গল্প হচ্ছিল। সদরুদ্দিন আমাদের ভ্রমণের পরিকল্পনার দিনগুলোর কথা শুরু করলেন। বললেন, ব্রিগেডিয়ার সাহেব প্রথমে ফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে পাকিস্তান বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল ভ্রমণের ইচ্ছা প্রকাশ করলে আমি খুব একটা গা করিনি। আমি তখন যুক্তরাষ্ট্রে। বলেছিলাম ব্যবস্থা করবো। পরে ভাবছিলাম এ রকম বাংলাদেশি অনেক ভ্রমণ ইচ্ছুকদের সঙ্গে অতীতেও যোগাযোগ হয়েছে কিন্তু দু’একবারের পরে আর যোগাযোগ করেনি বোধ হয় আসেওনি। সদরুদ্দিন বলতে লাগলেন যে, কয়েকবার আমার তরফ হতে যোগাযোগ এবং আপনারা কোথায় কোথায় কোন পথে যাবেন যখন শুনলাম বিগ্রেডিয়ার সাহেব তখন বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিলাম। প্রায় ছয়মাসের যোগাযোগের পর এবং আমার পূর্ব পরিচিতদের কয়েকজনের মাধ্যমে সদরুদ্দিনের খোঁজ-খবর নিতে গেলে সদরুদ্দিন নিশ্চিত হলেন যে আমরা সিরিয়াস। সদরুদ্দিন বললেন, যখন তিনি (আমি) বললেন আগাম ফিস কীভাবে দেবেন? তখন আমি নিশ্চিত যে ওনারা সত্যই ভ্রমণে আসতে চাইছেন। তারপরে এই প্রোগ্রাম। আমি বলেছি এখানে থাকতে থাকতে যখন খরচ দিতে চান দেবেন। আর আপনারা তো  আমাদের নিকটজন। এ কারণেই আমার পরিবার আর আমরা আপনাদের নিজের বাড়িতে এতটুকু খাতির করতে পেরেছি। আপনারা আমাদের ভ্রমণের দল নন। আপন। ১৯৭১ সালে আমি নেহাৎই শিশু আর সারতাজ জন্মগ্রহণও করেনি। সদরুদ্দিনের সংক্ষিপ্ত বিবরণে আমরা সবাই দারুণ অভিভূত হলাম বিশেষ করে যেভাবে ভাই সারতাজ গাইড হওয়া সত্ত্বেও আমাদের সঙ্গের অসুস্থ দুই সদস্যের দেখাশুনা করেছে তা কল্পনাতীত।
খাবার পরিবেশনে আরও চমৎকৃত করলো। হাবিব খান ডাল, ভাত, আলু ভর্তা খেতে আগ্রহ করেছিলেন। তাই ছিল মেন্যুতে আর মৎস্যপ্রেমী মামার জন্যে ট্রাউট মাছ। ছিল সবজি, মুরগি আর গরুর গোশত। গরুর গোশত একটি পাথরের পাত্রসহ পরিবেশন করতে করতে সদরুদ্দিন জানালেন যে, এ পাত্রটি প্রায় ৩০০ বছর পুরানো পারিবারিক ঐতিহ্য। পাথর কেটে করা। এটাতে গোশত পাক করবার পর ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা গরম থাকে। তাই মনে হলো গোশতের উষ্ণতা, উপলব্ধি করে। আমি অবাক হলাম কীভাবে হাবিব সাহেবের পছন্দের খেয়াল করেছে। সারতাজকে জিজ্ঞাসা করলাম মুচকি হেসে বললো মিসেস শামসের দিকে তাকিয়ে, বললো, ম্যাডামকে দেখলাম হোটেলের কিচেনে গিয়ে এ রকম ভর্তা বানাতে। আমরা এদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলাম। পরে আমাদের তরফ থেকে একটা স্মারক  আর শিশুদের জন্যে কেক দিয়ে বিদায় নিলাম। আমার মনে হয় এদের এই আন্তরিকতার কথা সারা জীবন মনে  থাকবে। অবশ্য পাহাড়ের মানুষের সরলতা ও আন্তরিকতা বহু দেশে দেখেছি তবে এতখানি নয়।
আগামী সকাল হুনজা ছেড়ে আরও উত্তরে আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্যস্থল পাক-চীন বর্ডার ১৬০০০ ফুট, খুনজারাবোতে পৌঁছবো। রাস্তায় পাসু নামক জায়গায় হোটেলে মালপত্র রেখে যেতে হবে গাড়ির লোড কমাতে। পাসু তিন দিকেই গ্লেসিয়ার পর্বত। পাসুর দ্বারা ঘেরা গ্লেসিয়ারগুলো ২০,০৩৩ ফুটের উচ্চতায়-আর উপত্যকার কোলের গ্রামটি প্রায় ১০ হাজার ফুট উচ্চতায়। বিকেলে পাসু হিমবাহটি দৃশ্যমান হয়। দৃশ্যমান হয় হুনজা নদী। এখানে ফারুকের বন্ধু মোজাফফর সাহেব যিনি ব্র্যাকে-ও অনেকদিন কাজ করেছেন রাতের খাবারের দাওয়াত দিয়ে রেখেছেন। বোধকরি ইয়কের গোশত পরিবেশন করবার কথা বলেছেন।
পরের দিন সকালে সবাই বোচকা প্যাটরা নিয়ে গাড়িতে। ভয় ছিল অক্সিজেনের অভাব অবশ্য দশ হাজার ফুটে হবার কথা নয়। সারতাজ দুই প্যাকেট শুকনা খোবানীর বিজ ছাড়া অংশটি নিয়ে আসলো। বললো, পাসু থেকে উপরে উঠার পথে চাবাতে থাকতে হবে, তাতে অক্সিজেনের অভাব হবে না। হেসে বললো, এ পর্যন্ত আপনার সিনিয়র সিটিজেনরা যেভাবে এসেছেন তাতে অক্সিজেন লাগবে না। আর পাসু পর্যন্ত এভাবে পৌঁছতে পারলে আপনাদের ফুসফুসের কার্যকারিতা বুঝতে পারবেন। মামা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালেন কারণ তার হার্টে প্রায় ৪টি স্ট্যান্টিং করা। ইতিমধ্যেই আমাদের চালক সাত্তারের কম্বলটি তিনি কবজা করে গায়ে চড়িয়েছেন। প্রায় মুড়ি দেবার মতো অবস্থা। মনে হলো তিনি যেন ঘুম থেকে উঠেছেন। উচ্চতা আর অক্সিজেনের অভাবের কথা শুনে রয়েছেন ভয়ে।
আমরা এখন পাসু-এর রাস্তায়। রাস্তাটি এখানে বেশ সুন্দর, দু’পাশে লম্বা গাছগুলো সারি সারি দাঁড়ানো। মোটামুটি সবুজ। এলাকাটি মোটামুটি সমতল উপত্যকা। দু’পাশে সুউচ্চ পর্বতগুলো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বাস উপরের দিকে উঠছে তবে তেমন টের পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা ক্রমেই পাসু-এর দিকে যাচ্ছি আর চারিদিকে মনে হচ্ছে ‘কোন্’ আইসক্রিম-এর মতো পর্বত শৃঙ্গগুলো অভূতপূর্ব দৃশ্যমান। সুন্দর রংয়ের আবরণ। সকালের সূর্যের সোনালী আভা আরও মোহনীয় করে তুলেছে। আরও সামনে এগুনোর পর দৃশ্যমান হলো পাসু হিমপ্রবাহ। দিগন্তের সীমানায় দৃশ্যমান বরফের নদী। হিমবাহ থেকে প্রবহমান বরফ আরও নিচে নামতে নামতে তরল হয়ে পানিতে রূপান্তরিত হবে।
পাসু পর্যন্ত রাস্তা চীনের তৈরি। মসৃণ প্রায় দু’ঘণ্টা পর পাসু নামক জায়গাটিতে পৌঁছলাম। পাহাড়ি গ্রামটি দূরে দৃশ্যমান। একটু সরু পাহাড় রাস্তা গ্রামটির সঙ্গে যোগাযোগের পথ। দেখলে মনে হয়, গ্রামে যেতে হলে পুলসিরাত পার হয়ে যেতে হবে। এমনই শুরু রাস্তা। হয়তো একটা জীপ যেতে পারে।
আমরা নির্ধারিত হোটেলের সামনের উন্মুক্ত উদ্যানে এসে দাঁড়ালাম। প্রথম দেখায় এটাকে হোটেল না বলে সৈনিকদের বা কোনো সংগঠনের থাকবার ব্যারাক বলা যায়। দুটো ব্যারাক। পাথরের তৈরি অনেকটা ইউ-এর মতো আকারের। মাঝখানে ছোট হল এবং খাবার ঘর। বাইর হতে দেখে হোটেল বলে আমরা যেখানে এসেছি তেমন মনে হলো না। গাড়ি থেকে আমাদের মালপত্রগুলো একটি ব্যারাকের বারান্দায় আর একটা খালি রুমে রাখতে হলো। কারণ আগেই বলেছি যেহেতু এখান থেকে আর ৬ হাজার ফুট উপরে উঠতে হবে তাই গাড়িকে হালকা করতে হলো।
আমরা পুনরায় রওয়ানা হলাম এবার আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্যে খুনজারাবো গিরিপথ। এই প্রথম পাসুতে শীতের হাওয়া গায়ে লাগলো বেশ ঠাণ্ডা আবহাওয়া। প্রায় আধঘণ্টা চলার পর একটি রোড ব্যারিকেডের সামনে গাড়ি দাঁড়ালো। সামনে নোটিশ লেখা ন্যাশনাল পার্কে প্রবেশের পথ। সারতাজ বললেন, এখানে জনপ্রতি ৩০০ রুপি গুনতে হবে। আমাদের ক্যাশিয়ার শামসেরকে পাঠানো হলো কারণ আমাদের টাকাগুলো তার কাছে দেয়া আছে। প্রায় পনের মিনিট পরে শামসের ফিরলেন হাতে ১১টি টিকিট। তাহলে বাকি ৩টি কোথায়? জবাব দিলো সারতাজ। বললো যে টিকিট প্রদেতা সারতাজের পরিচিত। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল আমরা কারা? সারতাজ আমাদের পরিচয় দেয়ায় ১৪ জনের বদলে মাত্র ১১ জনের টিকিট দিলো মানে ৩ জনের কনসেশন।
আমরা এবার চূড়ান্ত গন্তব্যের দিকে রওয়ানা হলাম। ক্রমেই উপরের (উচ্চতায়) দিকে উঠছি। পথে পথে পাহাড়ের গায়ে বরফের চাদর দৃশ্যমান হতে চলছে। যতই উপরে উঠছে ততই বরফের চাদর বাড়ছে আর ছোট ছোট ঝরনার মতো বরফ গলা পানি কল কল করে নিচে নামছে। শামসেরের খুব ইচ্ছা তিনি বরফে নামতে চান। বললাম আরেকটু উপরে উঠুক নামতে পারবেন। শামসেরের বরফে নামা হলো না। এ জায়গায় আমাদেরকে ঘুরে ঘুরে উঠতে হচ্ছে তথাপি রাস্তাটি মসৃণ, কিন্তু মনে হয় আমরা যে ক্রমেই আকাশের কাছাকাছি চলে আসছি।
সারতাজ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করালো বাঁয়ে তাকালাম যা জীবনে দেখিনি, নাম শুনেছি মাত্র, এই জন্তুগুলোর নাম ইয়াক। কালো সাদা রংয়ের আবার অনেকগুলো শুধুই কালো। ঘাড়ের চারিদিকে লম্বা চুলের মতো পশম। মাথায় বড় শক্ত শিং অনেকটা আমাদের দেশের বড় মহিষের মতো। ইয়াক গরুর আরেক প্রজাতি। হিমালয়ের দিকেও দেখা যায়। এগুলো এখানে পালিত নয়, বাংলা ভাষায় জংলি। এক পাল দৌড়াদৌড়ি করছে। অল্পক্ষণের জন্যে গাড়ি থামালো সবাই দেখলাম। আমি নিশ্চিত হলাম যে আমরা শীর্ষের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। কারণ, এই ইয়াককে দেখেছি ইউটিউব-এ অনেক উচ্চতায় থাকে।
বাইরে এমন দৃশ্য মনে হচ্ছিল যে আমরা এই জুন মাসেও বরফের রাজ্যে রয়েছি। তবে গলে আসছে। হঠাৎ পেছন থেকে মিসেস শামসের আমাকে ডেকে বললেন, ‘ভাই আর কতো উপরে উঠতে হবে, মামা তো বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে মনে হয় অক্সিজেন-এর অভাব হচ্ছে।’ আমি শঙ্কিত হলাম। পেছনে ফিরে দেখি কম্বল মুড়ি দিয়ে নির্জীবের মতো শুয়ে আছেন সকলের মামা। সারতাজ বললো, আমরা প্রায় এসে গেছি উপরে না উঠে ফেরা যাবে না। মামাকে ডাক দিলাম। ক্ষীণ স্বরে আওয়াজ বের করলেন। দশ মিনিটের মধ্যে আমরা খুনজারাবো গিরিপথের সর্বোচ্চাংশে। এ জায়গার নামই খুনজারাবো। এখানে গাড়ি রাখার জায়গা রয়েছে। বাইরে তখন মাইনাস ৪০ (চার) সেলসিয়াস মানে হিমাঙ্কের নিচে। টিপটিপ বৃষ্টি আর হালকা বরফ পড়ছে। সামনে পাকিস্তান চেকপোস্ট। বর্ডার গার্ড দাঁড়ানো। চোখে পড়লো এটিএম বুথ। লেখা রয়েছে। বিশ্বের সর্বোচ্চ এটিএম (অঞগ) বুথ; ১৫,৮৪০ ফুট উপরে। একটু দূরে চীনের বর্ডার, সুন্দর চীনা স্থাপত্যের প্রতীক সীমান্ত ফটক। অনেক ষোল হুইলার গাড়ি পার্ক করা।
এরমধ্যে সবাই নামলাম। প্রচুর বাতাস তার উপর হালকা বরফের বৃষ্টি। আমাদের গায়ে তেমন গরম কাপড় নেই। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম গাড়ি থেকে সবার নামার পেছন থেকে মামা কম্বল মুড়ি দেয়া অবস্থায় লাফ মেরে নিচে নেমে আরও কাঁপতে কাঁপতে সোজা এটিএম (অঞগ) বুথের সামনে কয়েকটি ছবি নিলেন। মহিলারা সামনে দাঁড়ালেন। আমার গায়ে হালকা সুয়েটার। ভাগ্যিস একটা গরম মাফলার এনেছিলাম। কোনো রকমে মাথায় জড়িয়ে নেমে এটিএম-এর কাছাকাছি দাঁড়ালাম। বেশ কনকনে বাতাস। হাড় কাঁপছিল। একে তো হিমাঙ্কের নিচে তারপরে বাতাস আর সামান্য বরফ বৃষ্টি। সাধারণত এখানে ০ক্ক  তাপমাত্রা থাকে। এমন পরিবেশ আমাদের জন্য অবিশ্বাস্য জায়গা। এখনো চোখ বন্ধ করলে মনে হয় স্বপ্ন। আমরা এভারেস্ট শৃঙ্গের মাঝ উচ্চতা থেকে প্রায় ১০০০ ফুট উপরে।
বেশ অনেকক্ষণ দাঁড়ালাম। ছবি তুললাম। বলা হয় বিশ্বের সর্বোচ্চ পাকা রাস্তায় যা দুই দেশকে যুক্ত করছে। সীমান্ত পার হলে চীনের সিনজিয়াং রাজ্য প্রায় ৪০০ কি.মি. দূরে। সিনজিয়াং-এর অন্যতম বৃহৎ শহর কাশগড়। মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল।
অনেকক্ষণ দাঁড়ালাম। অবাক বিস্ময়ে তন্ময়। এ পর্যন্ত এসেছি। সবাই ভালো আছে। মামাসহ সবাই উপভোগ করেছেন। জীবনে আর আসা হবে না। দেখা হবে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম আশ্চর্য বিস্ময় কারাকোরাম হাইওয়ে, খুনজারাবো গিরিপথ। মনে হলো আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সবার মুখে প্রশান্তির হাসি। অর্জনের হাসি। আমাদের গড়পরতা বয়স ৭০+। আমাদের গাইড সারতাজ আর চালক সাত্তার বলে উঠলো “আপনারা এতখানি আসতে পারবেন প্রথমে বিশ্বাস করিনি। প্রায় আধা ঘণ্টা রইলাম। মনে হলো আরও দাঁড়ালে জমে যেতে হবে।
এবার ফিরবার পালা। মনে হচ্ছিল আরও অনেকক্ষণ থাকি। এ বয়সে জীবনের অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। গাড়িতে উঠে সবাই আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে হাবিব সাহেব বললেন, ‘আমি কাশ্মীরের পাস অতিক্রম করে জায়গায় যেতে হবে বলে ভয়ে যাইনি। শুনেছি উচ্চতায় শ্বাস কষ্ট হয় তাই। এখানে অবলীলায় আসলাম। আরেকবার ধন্যবাদ। মহিলারা দারুণ উচ্ছ্বসিত। আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছি পেছন থেকে মামার আওয়াজ ‘আপনাকে কি বলে ধন্যবাদ জানাবো’, বললাম কেন? বললেন, ‘আপনি না হলে এমন জায়গা জীবনে দেখা হতো না’। আমি তখনো কাঁপন অনুভব করছি।
‘শোকর আল্লাহ যে মামার শ্বাসকষ্ট হয়নি। সারতাজ বললো, ‘এবার আমি আপনাদেরকে বলতে পারি আপনাদের বয়স হলেও ধৈর্য্য, সাহসের সঙ্গে সঙ্গে দারুণ প্রত্যয় রয়েছে। আমি অনেক শঙ্কায় ছিলাম। উত্তরাঞ্চল ছাড়বার অন্যপথ মানে বাবুসার হিমবাহ পথ খোলা থাকলে যদি বৃষ্টি না হয় ওই রাস্তায় যাবো একবারে গ্লোসিয়ার মানে হিমবাহ কেটে রাস্তা। ওই রাস্তা অনেক কম পড়বে। আর আরেকটি নতুন অভিজ্ঞতা হবে।
আমরা ফিরে আসলাম পাসুতে। এখানে রাতে থাকবো। নির্ধারিত ব্যবস্থাও হোটেলে। রাতে মোজাফফর সাহেব খাওয়াবেন। আমাদের সম্মানে ছোট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করবেন। গ্রামের নাম ‘পাসুকোন’। দুপুরের খাবারের জন্য পাসু গ্রামের বাজারের রাস্তার ধারে রেস্তরাঁয় নামলাম। জায়গাটি পর্যটকদের জন্য। কয়েকটি স্থানীয় রেস্তরাঁ। রোদে বসতে ভালো লাগছিল। খাবার খেতে খেতে চারিদিকের দৃশ্য থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। কোণের মতো শৃঙ্গগুলো সবুজ না হলেও পাথুরে পর্বতের এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য হতে পারে কল্পনা করা যায় না। দূরে হিমবাহের চূড়া সাদা ধবধবে মাথা উঁচিয়ে সদর্পে দাঁড়িয়ে।
দুপুরের খাবার শেষ করে আমরা পাসুর হোটেলের পথে। রাস্তা বলতে গেলে খালি জনমানব শূন্য। তেমনি হবার কথা। কিছুদূর এসে সারতাজ গাড়ি একপাশে দাঁড় করিয়ে নামতে অনুরোধ করলো। নামলাম। হতবাক সোজা রাস্তা একপাশে বিবর্ণ কিছু গাছ অপর পাশে কিছুটা খোলা জায়গা। কিন্তু উত্তরদিকে মানে পেছনে অপরূপ দৃশ্য। সোজা রাস্তা। মাঝখানে দাঁড়া করিয়ে উত্তর দিকে দেখতে বললো। মনে হলো রাস্তাটি সামনের পর্বতের ভিতরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দৃশ্যটি এমন নয়নাভিরাম যা ভাষায় প্রকাশ করা সাহিত্যিক ছাড়া সম্ভব নয়। মনে হলো পাঁচটি কোণ পাশাপাশি লাগালাগি করে দাঁড়ানো। অদ্ভুত নয়নাভিরাম দৃশ্য। পর্বত শৃঙ্গ কোণগুলো যেন বিভিন্ন রং ধারণ করেছে। শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য। কোথাও দেখিনি অস্ট্রিয়া বা সুইজারল্যান্ডেও নয়। তানভীর আমাদের মধ্যে ছবি তুলতে শুধু পারদর্শীই নয় সুন্দর ছবিই তোলেন। আজ এ দৃশ্যের বোধকরি শত শত ছবি তুললেন। সারতাজ বললো এ দৃশ্য ভোগ, ফোর্বস এবং লাইফ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ হয়েছিল। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রায় ঘণ্টাখানেক দৃশ্য অবলোকন, যেন দেখা শেষ হয় না। বিকেল হয়ে আসছিল। অবশেষে রওয়ানা হলাম হোটেলের পথে। ফারুক বললেন যে মোজাফফর সাহেব ফোন করেছেন তিনি বারবিকিউ করবার কথা বলছিলেন হোটেলের বাইরের প্রাঙ্গণে। অবশ্য আমারই অনুরোধ ছিল।
রাস্তায় সবাই আজকের দিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। এর মধ্যে মামা বলে উঠলেন, ‘কোনায় এইলাম। কি দেখলাম’ আমি তো ছবিগুলো আমার নাতিকে পাঠিয়েছি। ও তো বিশ্বাস করে না। সবাই তার কথাবার্তা উপভোগ করলাম। আমানুল্লাহ মৌন ব্রত ভঙ্গ করে বললেন, এ জায়গা তো আমার কল্পনার বাইরে।
হোটেলে আসলাম। সারতাজ সবার রুমের চাবি দিলো রুমে নিয়ে। বাক্সগুলো বারান্দায় নিজে যাবার অপেক্ষা। একটি তরুণ সবার রুমে পৌঁছে দিচ্ছিল। বাতাস বইছে সঙ্গে কনকনে শীত। মাঝে মধ্যে কাঁপন ধরছে। বাইর থেকে টানা বারান্দা আর রুম দেখে মনে হলো সামরিক বাহিনীর সৈনিক লাইন। রুম খুলে ভিতরে ঢুকলেই অবাক হলাম। পাঁচ তারকা হোটেলের সাজ। হিটার জ্বলছে। বেশ আরামদায়ক। ওয়াশ রুম দর্শনীয়। গীজারে গরম পানি। গোসল প্রয়োজন ছিল। ক্লান্তি দূর হলো। কম্বলের নিচে বেশ আরাম লাগছিল। কিছুক্ষণ পর দরজায় আওয়াজ শুনে উঠলাম। সামনে ফারুক বললেন, বাইরে তো দারুণ ঠাণ্ডা আর বাতাস এর মধ্যে বাইরে বারবিকিউ হয়তো হবে না কারণ আরও ঠাট্টা বাড়বে। মোজাফফর ভিতরের হলেই অনুষ্ঠান আর খাবার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন। আমি বললাম, উনি ঠিকই বলেছেন। আমাদের পক্ষে বাইরে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা সম্ভব হবে না। ফারুক চলে গেলেন।
সন্ধ্যা নেমে আসল। বাইরের বারান্দায় দু’জনে বের হলাম হলরুমে যাবার জন্য তৈরি হয়ে। রাতের অন্ধকার। দূরে পাহাড়ের গায়ে পাসু গ্রাম। গ্রামের বাতিগুলো তারার মতো টিম টিম করছে। আর আশেপাশে অন্ধকার। হঠাৎ বিশাল আওয়াজ হলো। এ বিষয়টি সারতাজ আগেই বলেছিল যে রাত হলে বেশ আওয়াজ শোনা যাবে। এগুলো পাসু হিমবাহ ভাঙার শব্দ। গভীর রাতে এর সঙ্গে যোগ হবে ‘মারখোরের’ (পাহাড়ি হরিণ) আওয়াজ।
দাওয়াত খেতে হলে আসলাম। ততক্ষণে সবাই এসে গেছেন। মোজাফফর সাহেব সঙ্গে তার আরেকজন প্রাক্তন সহকর্মী আর তার দুই ভাগিনি। মোজাফফর পাসু গ্রামেই থাকেন। ছোট উপত্যকা এখানকার অর্থকরী ফসল প্রচুর ফলমূল বিশেষ করে আপেল, খোরমানী (এপ্রিকট)। আর নাশপাতি। এ সময়ে চেরি। গমের উৎপাদনও ভালো হয়।
লম্বা টেবিল পাতা খাদ্য তালিকায় কিছুই বাদ নেই। প্রচুর ড্রাই ফ্রুট রাখা। সামনে সারি সারি বসা বাদ্য আর ছোট সাংস্কৃতিক দল। গায়ে স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী পোশাক। মাথায় বিশেষ ধরনের টুপি এ অঞ্চলে যার নাম পাখোল। তবে টুপির সঙ্গে কপালের উপরে পাখির পালক লাগানো। সঙ্গে এ অঞ্চলের বিশেষ ধরনের সালওয়ার কামিজ। 
চমৎকার পরিবেশন। মুরগির ইখনি দিয়ে শুরু। প্রধান খাবারে পোলাও মুরগি তো রয়েছে। ছিল বিশেষভাবে বারবিকিউ করা ‘ইয়াক’-এর মাংস। জীবনে প্রথম এই জন্তুর মাংস খেলাম। ভেবেছিলাম শক্ত হবে তবে না বেশ নরম আর সুস্বাদু। চর্বির আধিক্য কম। ইয়াক গরুর মতো, পালাও হয়। তবে এ অঞ্চলের প্রধান গোশতের উৎস ভেড়া, দুম্বা আর পাহাড়ি ছাগল।
খাওয়ার মধ্যেই বাদকরা স্থানীয় গীত আর বাজনা বাজাচ্ছিলেন। পরে সবাই মিলে স্থানীয় কায়দায় নাচের বদলে কোমর দুলানোই হলো। সন্ধ্যাটি দারুণ উপভোগ করলাম। উপভোগ করলাম উষ্ণ আতিথেয়তা। বেশ একটি সুন্দর সন্ধ্যা কাটিয়ে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে রুমে আসলাম। এসে তিন কম্বলের নিচে। মধ্যরাতে কড়কড় আওয়াজ। বহু দূরে পাসু হিমবাহ ভাঙছে। পানির আকার ধারণ করে হুনজা নদীতে মিলছে। আগামীকাল সকালে আমরা গিলগিট বালটিস্তান ত্যাগ করবো।
অনেক সকালে ঘুম ভাঙল। বাক্স গুছিয়ে নিলাম মিসেস ঘুমাচ্ছেন তাই আর আওয়াজ দিলাম না। গিজারটা ছেড়ে এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় রাখা চেয়ারে এসে বসলাম। ফুসফুস ভরে নির্মল অক্সিজেন নিচ্ছিলাম। পরিবেশ দূষণের কোনো অবস্থাই নেই। পেছন থেকে সূর্য উঠছে। পাহাড় বেয়ে উঠতে একটু সময় লাগবে কিন্তু সামনের ২০,০৩৩ ফুট তরঙ্গায়িত হয়ে হুনজা নদীর মাথা তুলে অনেকগুলো শৃঙ্গ দাঁড়ানো তার উপরে সোনালী রংয়ের আভা আর নিচ দিয়ে নীলাভ জল বয়ে যাচ্ছে। বসে বসে ভাবছিলাম আরও বহু বছর পূর্বে এমন জায়গায় আসলে হিমবাহ দেখতে আরও দূরে গিয়ে উঁচু টিলাগুলোর উপরে উঠতাম। যেতে হতো গ্রাম পার হয়ে। এখন আমরা সে অবস্থায় নেই। ট্রেকিং স্বপ্ন হয়ে থাকবে। বিধাতার দরবারে হাজার শোকরিয়া যে এ পর্যন্ত সুস্থ এবং এ অঞ্চলে আসবার সুযোগ দিয়েছে। এতক্ষণে মিসেস উঠে গেছেন। গোসল করে প্রাতঃরাশ শেষ করে প্রায় ৯টার দিকে এবার বাবুসার গিরিপথ হয়ে এবোটাবাদ শহরে পৌঁছবার কথা। রাতে পথে সিন্ধু নদীর পাড়ে চিলাক শহরে থাকবো। শহর ঠিক নয় কারাকোরাম আর বাবুসার রাস্তার সংযোগ স্থল।
রওয়ানা হলাম। প্রায় ৭ দিন গিলগিট বালটিস্তানে কাটালাম। প্রকৃতির ধারে কাছে ছিলাম। নির্মল পরিবেশ, নির্মল বাতাস। এখন পর্যন্ত কেউ বড় ধরনের অসুস্থতার মধ্যে পড়েনি। মোটামুটি সুস্থ ছিল। মামার চোখের বড় ধরনের অভিযোগ নেই। মনির, হাবিব ভাইয়ের শ্যালিকা, পায়ের অবস্থাও উন্নতির দিকে। সময় নিয়ে উচ্চতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে ১৬ হাজার ফুট উঠতে শ্বাস কষ্ট বা অক্সিজেনের অভাব হয়নি। খোরমানির ছাল ছাড়াবার কারণে হয়তো প্রায় ঘণ্টা দুই পর আমরা হুনজা বাজারের সামনে কিছুক্ষণের জন্য থামলাম। সারতাজ-এর বাবার দোকানের সামনে। বাবা সবার সঙ্গে দেখা করবার জন্য বের হয়ে আসলেন। বাসে উঠে সবাইকে সালাম আর শুভ কামনা দিয়ে কিছু শুকনো ফল দিয়ে বিদায় নিলেন।
আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক চলার পর গিলগিট পেছনে রেখে এসেছি। কিছু দূর গিয়ে বাসটি একটি জায়গায় দাঁড়ালো। জায়গাটি অনেকটা ছোট মাঠের মতো। বেশ কয়েকটি স্থাপনা রয়েছে। সবাই নামলাম। সামনে একটি উঁচু বেদির মতো রেলিং দেয়া। উপরে উঠলাম। পশ্চিম পাশে প্রায় কয়েক হাজার ফুট নিচে হুনজা নদী বয়ে চলেছে। এখানে অনেকখানি চওড়া। পানি কম তাই দু’পাশে নুড়ি পাথর দৃশ্যমান। সারতাজ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো যে, সামনে মানে উত্তরদিকে দূরে এখান থেকে যে ৩টি পর্বতমালা দেখা যায় তা পৃথিবীর ৩টি বড় পর্বতমালা। ডানে পূর্বে হিমালয়, মাঝখানে কারাকোরাম আর পশ্চিমে আফগানিস্তান তথা মধ্য-এশিয়ার বৃহত্তম পর্বতমালা ‘হিন্দুকুশ’। সারতাজের মতে এই উপমহাদেশে এটাই একমাত্র জায়গা যেখানে দাঁড়িয়ে বিশ্বের এই ৩টি পর্বতমালা একসঙ্গে দেখা যায়। জায়গাটির নাম ৩ পর্বতের সংযোগ (Tri-Mountain Range Junction)। অনেকক্ষণ কাটিয়ে ছবি উঠিয়ে রওনা হলাম চিলা এর পথে। রাস্তায় গাছের নিচে এক ধাবাতে গরম নান আর সবজি, মুরগি দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে পুনরায় রওনা হলাম। পড়ন্ত বিকালে চিলা এসে পৌছলাম। চিলাদের প্রধান সড়ক থেকে এক ধাপ নিচে লম্বা ধরনের ব্যারাকের মতো হোটেল। রাস্তার পাশেই ঢুকতেই রিসিপশন। আরেকধাপ নিচে সারি সারি রুমগুলো। নির্ধারিত রুমে যেতে যেতে দেখলাম প্রায় হাজার ফুট নিচে দিয়ে কুল কুল করে বয়ে যাচ্ছে সিন্ধু নদী। এটাই গিলগিট বালটিস্তানের সীমানার শেষ ছোট শহর বা বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এটা একসময়ের সিল্ক রুটের উপরেই অবস্থিত। এখান থেকেই পূর্বদিকে বাবুসার গিরিপথের রাস্তা যে রাস্তা ধরে আমরা আগামীকাল এবোটাবাদের পথে রওয়ানা হবো। হোটেলের নাম ‘সাংগ্রিলা চিলাক বা চিলহান। সিন্ধু নদীর ওপরে পুরাতন সিল্ক রোড, যার অনেকাংশ আগা খান ফাউন্ডেশন রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং বিশ্ব হেরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি স্থাপনা। 

 

(মানবজমিন ঈদ সংখ্যা ২০২৪- এ প্রকাশিত)
 

ঈদ সংখ্যা ২০২৪ থেকে আরও পড়ুন

   

ঈদ সংখ্যা ২০২৪ সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status