শেষের পাতা
ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার
৫ বছরে এসেছে ২২২০ বিপদে পড়া নারী-শিশু
ফাহিমা আক্তার সুমি
২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবারদশ বছরের শিশু শান্তা। হাতিরঝিলের পাশে মধুবাগে পরিবারের সঙ্গে থাকে। তার মা গার্মেন্টে চাকরি করেন। বাবা রিকশা চালিয়ে সংসারের খরচ চালান। এই দম্পতি প্রতিদিনের মতো কাজের জন্য বাইরে যান। তখন বাসায় একা থাকেন তাদের মেয়ে। ঘরের পাশেই ভাড়া থাকে মোজাম নামে এক ব্যক্তি। তিনি প্রবেশ করেন এই দম্পতির ঘরে। শিশুটিকে একা পেয়ে ১০ টাকার প্রলোভন দেখিয়ে তার ঘরে নিয়ে যায়। এরপর তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে।
এই ঘটনায় মামলাটির তদন্তভার পায় উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন। শুধু ধর্ষণের শিকার এই শিশুটি নয়, প্রতিদিন অসংখ্য নারী-শিশুদের বিপদে সেবা দিয়ে যাচ্ছে পুলিশের এই ডিভিশনটি। পাচারের শিকার, শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকারসহ নারী-শিশুদের দিচ্ছে আইনি সহায়তা। এর পাশাপাশি ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণ, এসিড আইন, পর্নোগ্রাফিসহ নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলারও তদন্ত করছে। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠার পর হতেই সফলভাবে ভুক্তভোগীদের আইনি সহায়তা দান ও সেবা দিয়ে আসছে। ২০১১ সালে সেন্টারের অধীনে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ চালু করে ডিএমপি। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ১০টি সহযোগী এনজিও তাদের কাউন্সেলর, চিকিৎসক, আইনজীবী, মনোচিকিৎসকের মাধ্যমে প্রনোদনামূলক, আইনগত ও পুনর্বাসনের সেবা দিচ্ছে। সহিসংতার শিকার নারীদের বক্তব্য শুনে সমস্যা চিহ্নিত করা হয়। এরপর দেয়া হয় সহায়তা। ভুক্তভোগীকে চিকিৎসাকেন্দ্রে জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হয়। সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে সহায়তা দেয়া হয়।
নির্যাতনের শিকার নারী-শিশুকে তাৎক্ষণিক উদ্ধারে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এ ছাড়া কাউন্সেলিং সেবা রয়েছে এখানে। স্বাভাবিক প্রয়োজনে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে ৫ দিন থাকা যায়। পরিবারের একত্রীকরণ, পুনর্বাসনের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় পাঠানো হয় এখান থেকে। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, গত ৫ বছরে সেবা পেতে ২ হাজার ২২০ জন নারী-শিশু এসেছে। এরমধ্যে ২০১৯ সালে আগত ৬১২ জন, পরিবারের কাছে হস্তান্তর ১৪৬ জন, নিজ হেফাজত ২৩, তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট হস্তান্তর ৩৫২ জন, অন্যান্য ৯১ জন, মোট ৬১২ জন। ২০২০ সালে আগত ৫০৭ জন, পরিবারের নিকট হস্তান্তর ২১০ জন, নিজ হেফাজত ২ জন, তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট হস্তান্তর ২১৭ জন, অন্যান্য ৭৮ জন, মোট ৫০৭ জন। ২০২১ সালে আগত ৪৫১ জন, পরিবারের কাছে হস্তান্তর ১৫৪ জন, নিজ হেফাজতে ১৫ জন, তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট হস্তান্তর ২২২ জন, অন্যান্য ৬০ জন, মোট ৪৫১ জন। ২০২২ সালে আগত ৩৩০ জন, পরিবারের কাছে হস্তান্তর ১৪০ জন, নিজ হেফাজতে ৩৪ জন, তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট হস্তান্তর ১৩৯ জন, অন্যান্য ১৭ জন, মোট ৩৩০ জন। ২০২৩ সালে আগত ৩২০ জন, পরিবারের কাছে হস্তান্তর ১৪০ জন, নিজ হেফাজতে ৪৩ জন, তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট হস্তান্তর ১২৯ জন, অন্যান্য ৮ জন, মোট ৩২০ জন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট। বাংলাদেশের একমাত্র নারী পুলিশ ইউনিট এটি। এর উদ্দেশ্য নারী এবং শিশুদের সমস্যাগুলো নিয়ে খুব ভালোভাবে কাজ করা যায়। নারীরা তাদের সমস্যাগুলো কিন্তু নারীদের কাছে বলতে বেশি সাচ্ছন্দবোধ করে। শিশুদের ক্ষেত্রেও তাই। একটা ছোট বাচ্চা নির্যাতনের শিকার হলে পুরুষ পুলিশের কাছে যেমন করে বলবে আসলে সেটি কিন্তু একজন নারী পুলিশের কাছে আরেকটু বেশি বলবে। এই জিনিসগুলো মাথায় রেখে এই ডিভিশনের কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। আমরা শুধুমাত্র নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে যে অপরাধগুলো ঘটে সেই অপরাধগুলোই তদন্ত করি। পাশাপাশি মামলার বাইরে পারিবারিক যে সহিংসতা হলে কোনো নারী অভিযোগ করে আমরা সেটিও দেখছি। এটার পাশাপাশি ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় হারানো ভিক্টিম থাকে শিশু বা বয়স্ক কোনো ব্যক্তি তাদেরও আমরা সাপোর্ট সেন্টারে নিয়ে এসে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেই।
আর যাদের পরিচয় পাওয়া যায় না তাদেরকে আমরা সহযোগী সংস্থায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করি। উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ড. হুমায়রা পারভীন মানবজমিনকে বলেন, নারীরা সাধারণত দুই ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। একটা ঘরে আরেকটি বাইরে। কিন্তু এখন যেটি হয়েছে ইন্টারনেটের প্রসার ও মোবাইলের সহজলভ্যতার কারণে সাইবার স্পেসেও নারীদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে এবং নির্যাতনের সংখ্যাগুলো উল্লেখ্যযোগ্য হারে বেড়ে যাচ্ছে। অফিস, বন্ধু-বান্ধব ও পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা নিয়ে কাজ করতে হয় বেশি। নির্যাতনের ক্ষেত্রে সরকারি বা বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া আছে। তারপরও কিন্তু এই নির্যাতনের সংখ্যা উল্লেখ্যযোগ্যহারে বেশি। পারিবারিক সহিংসতার ক্ষেত্রে বিশেষ করে যারা একটু মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত এরা নির্যাতনের শিকার হলেও কিন্তু মানসম্মানের ভয়ে মামলা করতে উৎসাহী হন না।
বেশিরভাগ অভিযোগ করেন নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তদের মধ্য থেকে। এই দুই শ্রেণির হারটা বেশি। তবে উচ্চবিত্তরাও আসেন। মামলার মাধ্যমে যে অভিযোগগুলো করা হয় সেটি তো শতভাগ নিষ্পত্তি হয়। আর যারা অভিযোগ করেন তাদের ৭০-৮০ শতাংশই আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হয়ে যায়। আর বাকি ২০-৩০ শতাংশ সমাধান করা যায় না। তাদেরকে আইনি পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। তিনি বলেন, নারীদের প্রতি সহিংসতা-নির্যাতন কমাতে হলে আগে সবাইকে সচেতন হতে হবে। পারিবারিক যে মূল্যবোধ বা শিক্ষা সেক্ষেত্রে আমাদের আরেকটু স্ট্রং হতে হবে। একটা ছেলে বাচ্চা যদি ছোট বেলা থেকেই দেখে যে আমার মা প্রতিনিয়ত বাবার দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে তাহলে সেও কিন্তু এটা একটা সাধারণ বিষয় হসেবে মনের মধ্যে ধারণ করে নেবে। কারণ সে তো এসব দেখেই বড় হচ্ছে। এবং এই বিষয়গুলো তাদের বড় হলেও প্রভাব ফেলবে। সবার আগে পরিবারের মানুষকে সচেতন হতে হবে।
আইনের মাধ্যমে সামাজিক অবক্ষয় ঘটানোর পরিনতি এমনই হয়। যেমন: প্রাপ্ত বয়স্ক হাওয়ার আগে/পরে প্রেম ভালবাসার আলোকে শারীরিক সম্পর্ক বৈধ কিন্তু সরকার নির্ধারিত বয়সের আগে বিবাহ দেয়া অবৈধ। যেইদেশে বিবাহ বহির্ভুত যৌন সম্পর্ক বৈধ সেইদেশে উল্লিখিত ভিকটমের সংখ্যা বৃদ্ধি অস্বাভাবিক নয়।