প্রথম পাতা

আস্থাহীনতা, এজেন্ট পাচ্ছে না বীমা কোম্পানি

এম এম মাসুদ

৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, মঙ্গলবার, ৯:২৯ পূর্বাহ্ন

অনিয়ম, দুর্নীতি আর পলিসির মেয়াদ শেষ হলেও গ্রাহকের বীমা দাবির টাকা পরিশোধ না করায় দেশের বীমা কোম্পানিগুলোর ওপর আস্থাহীনতা চরম আকার ধারণ করেছে। ফলে গ্রাহকের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় এজেন্ট পাচ্ছেন না বীমা কোম্পানিগুলো। একই সঙ্গে দিন দিন অর্থনীতিতে কমে যাচ্ছে বীমার অবদান। বীমা খাতের আওতা বাড়ছে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), বীমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ) ও গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, আইডিআরএ’র কাছে কয়েক হাজার অভিযোগ জমা পেড়েছে। জমানো টাকা ফিরে পেতে প্রতিদিনই তারা আইডিআরএ অফিসে ভিড় করছেন। পলিসির মেয়াদ শেষ হলেও বছরের পর বছর বীমা কোম্পানিগুলো গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করছে না। সর্বশেষ হিসাবে বীমা কোম্পানিগুলোর কাছে অনিষ্পন্ন দাবির পরিমাণ ৫৭২ কোটি টাকা। জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর আর্থিক দক্ষতা নিয়ে আইডিআরএর সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এসব পলিসির বিপরীতে সুদসহ হিসাব করলে তা কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানির মালিকরা অনেক প্রভাবশালী। ফলে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া যাচ্ছে না।

সমপ্রতি জারি করা অফিস আদেশে আইডিআরএ বলেছে, বাংলাদেশের বীমা শিল্পের বিকাশের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কয়েকটি বীমা প্রতিষ্ঠানের দাবি পরিশোধের হার অত্যন্ত কম হওয়ায় এ খাতে আস্থার সংকট রয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বীমা গ্রহীতা অধিক সংখ্যায় লিখিত অভিযোগ দাখিল করছেন এবং মৌখিকভাবে কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের অবহিত করছেন। এ অভিযোগসমূহ নিষ্পত্তিতে বীমাকারী দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নিচ্ছে এবং জবাবদিহির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।

ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চিফ মার্কেটিং অফিসার (সিএমও) বিনীত আগরওয়াল বলেন, জীবন বীমার গ্রাহকরা সঠিকভাবে দাবির টাকা না পাওয়ায় এই খাতে একধরনের ইমেজ সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে প্রয়োজনীয় এজেন্ট পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন এজেন্ট না আসায় নতুন ব্যবসাও আসছে না। ইমেজ সঙ্কট কাটানো গেলে অবশ্যই বীমা খাতের আওতা বাড়বে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বীমা কোম্পানিগুলো বছরে যে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে তার ৭৩.৫ শতাংশই জীবন বীমা কোম্পানির। বাকি ২৬.৫ শতাংশ সাধারণ বীমা কোম্পানির। সুতরাং বীমা ব্যবসার সিংহভাগই জীবন বীমা কোম্পানির দখলে। তিনি বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে জিডিপিতে বীমা খাতের অবদান সব থেকে কম বাংলাদেশে। অথচ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সব থেকে বেশি বেড়েছে। ২০০৯ সালে দেশের জিডিপিতে বীমা খাতের অবদান ছিল ১ শতাংশের বেশি। বর্তমানে তা কমে ০.৫৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে আগরওয়াল বলেন, আমরা প্রতি বছর ৫০০ কোটি টাকার ওপরে দাবি পরিশোধের পরও নিয়মিত আমাদের লাইফ ফান্ড বাড়ছে। কারণ, ডেল্টা লাইফ আইডিআরএ সব নিয়মনীতি মেনে ব্যবসা করে।

আইডিআরএর সর্বশেষ ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্য রয়েছে। তাতে দেশের জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর অনিষ্পন্ন দাবিতে ৫৭২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা আটকে আছে। ২ লাখ ৭১ হাজার ২৪০টি পলিসির দাবি অনিষ্পন্ন রয়েছে। এর মধ্যে মৃত্যু দাবি, মেয়াদোত্তীর্ণ দাবি, সারেন্ডার বা মেয়াদ পুর্তির আগে বীমা ভেঙে ফেলা, সার্ভাইবেল বেনিফিট এবং গোষ্ঠী ও স্বাস্থ্য বীমার দাবি রয়েছে। এছাড়া সেপ্টেম্বর শেষে ১৪ লাখ ৭২ হাজার ৯৬৩টি পলিসি তামাদি অবস্থায় রয়েছে। এসব পলিসির গ্রাহকদের মধ্যে যাদের নিয়ম অনুযায়ী অর্থ ফেরত পাওয়ার কথা, তাদের অনেকেই অর্থ পাচ্ছেন না।

আইডিআরএ এক কর্মকর্তা বলেন, কয়েকটি কোম্পানি গ্রাহককে পলিসির টাকা দিচ্ছে না। এ নিয়ে আমাদের অনেক অভিযোগ জমা পড়েছে। কোম্পানিগুলো টাকা না দিয়ে বিভিন্ন ভাবে গ্রাহককে হয়রানি করছে। কারণ গ্রামের গরিব মানুষ খুব কষ্ট করে টাকা জমা দিয়েছে। মেয়াদ শেষ হলেও কোম্পানিগুলো তাদের টাকা দিচ্ছে না। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে আমরা প্রতিটি কোম্পানির সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করে কঠোর বার্তা দিয়েছি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা না দিলে বাধ্য হয়েই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সরজমিন দেখা গেছে, দীর্ঘদিন কোম্পানির কাছে ধরনা দিয়ে শেষ পর্যন্ত উপায় না পেয়ে আইডিআরএ’র কাছে আসছেন গ্রাহকরা। পলিসির টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য প্রতিদিনই আইডিআরএ’র সামনে গ্রাহকের দীর্ঘ লাইন লক্ষ্য করা গেছে। অনেকে গ্রাহক কান্নায় ভেঙে পড়ছে।

তারিকুল ইসলাম। তিনি একটি কোম্পানিতে ১৯৯৪ সালের নভেম্বরে বীমা করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর ২০১৫ সালের আগস্টে প্রায় দুই লাখ ৭৫ হাজার টাকা দাবি উত্থাপন করা হয়। আইন অনুযায়ী, উত্থাপনের পর ৯০ দিনের মধ্যেই ওই দাবি পরিশোধ করার কথা। কিন্তু চার বছরেও ওই দাবি পরিশোধ করেনি ওই জীবন বীমা প্রতিষ্ঠানটি। চার বছরেও দাবি পরিশোধ করতে না পারার বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দেয়া ব্যাখ্যায় ‘দাবি ফরম দাখিল করা নেই’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

নিয়ম অনুসারে একজন গ্রাহক জীবন বীমায় কিস্তিতে টাকা জমা রাখে। এই কিস্তি মাসিক, তিন মাস অথবা ছয় মাসের করে হয়ে থাকে। এসব পলিসির মেয়াদ ৫ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত। জীবনের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য এই দীর্ঘ সময় তারা স্বল্প আয় থেকে একটু একটু করে টাকা জমা রাখে। বীমা আইন অনুসারে, পলিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিশ্রুত টাকা দিতে হয়। আর ৯০ দিনের বেশি হলে বাকি দিনগুলোর সুদসহ টাকা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু কোম্পানিগুলো টাকা পরিশোধ না করে গ্রাহককে বছরের পর বছর হয়রানি করছে। এরা পলিসির টাকা আত্মসাৎ করেছে। ফলে বছরের পর বছর ধরে বীমা দাবি অনিষ্পন্ন থেকে যাচ্ছে। দাবি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর এই শৈথিল্য ও অনিয়ম দূর করতে আইডিআরএ কঠোর হয়েও কিছু করতে পারছে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করছে না, এ ধরনের কোম্পানির সংখ্যা বেশি নয়। তবে কয়েকটি কোম্পানি এ খাতের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এ খাতের আস্থা অর্জনের জন্য সবার আগে গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করতে হবে।

আইডিআরএর সদস্য গোকুল চাঁদ দাস বলেন, মোট জীবন বীমার প্রায় ৮০ ভাগ দাবি সময়মতো নিষ্পত্তি হয়। কিন্তু কিছু কোম্পানি রয়েছে তাদের পলিসির বড় অংশ অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে। যে কারণে পুরো খাতে এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। আইডিআরএ চাচ্ছে এসব কোম্পানির দাবিগুলো দ্রুত নিষ্পন্ন করতে।

বীমা দাবি নিয়ে কালক্ষেপণের অভিযোগ এলে কৌশলে তার দায় বীমা গ্রাহকের ওপরই চাপানোর চেষ্টা করে সিংহভাগ কোম্পানি।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, কোনো কোম্পানিকে এগিয়ে নিতে হলে গ্রাহকের স্বার্থ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার দিকেই সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হয়। তা না হলে গ্রাহক হয়রানির কারণে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এ অবস্থায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বীমা দাবি পরিশোধের বিকল্প নেই। আমি মনে করি, বীমা দাবি পরিশোধে কালক্ষেপণ হলে তার দায় শুধু কোম্পানির নয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status