এক্সক্লুসিভ

ঋণের টাকায় কেনা বিআরটিসির ট্রাক পড়ে আছে সড়কে

স্টাফ রিপোর্টার

৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, মঙ্গলবার, ৭:৫৪ পূর্বাহ্ন

ঋণের টাকায় কেনা বিআরটিসির বাস-ট্রাকের দৈন্যদশা অবস্থা। নতুন কেনা বাসের ছাদ চুইয়ে পড়ছে পানি। ঢাকা ডিপোর ৫০টিরও বেশি ট্রাক কয়েক মাস ধরে ডিপোর সামনের সড়কে পড়ে আছে। দেখা দিয়েছে নানা ত্রুটি। নতুন ট্রাক এনে সড়কে ফেলে রাখা কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন। অন্যদিকে গাবতলী ডিপোতে দুই দফায় বরাদ্দ পাওয়া ৮টি বাসের সবকটিতেই ত্রুটি দেখা দিয়েছে। এগুলোর মধ্য থেকে একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নেয়া হলেও বাকীগুলো ত্রুটি নিয়েই চলছে সড়কে। তথ্য বলছে ভারতীয় ঋণে (এলওসি) দেশটি থেকে বিআরটিসির জন্য মাত্র দুই মাস আগে এসব বাস-ট্রাক দেশে আনা হয়। যা ভারতীয় কোম্পানি টাটার তৈরি। এসব বাসের বডিতে নিম্ন মানের সরঞ্জামাদি ব্যবহার করা হয়েছে। একারণে ছাদের শিট ফুটো হয়ে পানি পড়ছে। বাস দেশে আনার আগে দফায় দফায় ক্রয়-পূর্ব পরিদর্শন করেছিলেন বিআরটিসি ও সংশ্লিষ্ট মহলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বিআরটিসি যে মানের বাস চেয়েছিল সে মান ঠিক আছে কিনা তা দেখতেই তারা ভারতে গিয়ে যাচাই করে আসেন। পরিদর্শনের সময় এসব বাসে সমস্যা ধরা পড়েছিল। কিন্তু সমস্যা জেনেও বাসগুলো আনা হয়।
সূত্রমতে, ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে দ্বিতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় বাংলাদেশকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে চুক্তি হয়। এ চুক্তিতে ৫৮১ কোটি টাকায় ৬০০ বাস এবং ২১৭ কোটি টাকায় ৫০০ ট্রাক কেনা হয় ভারত থেকে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর থেকে বাস-ট্রাক ঢাকায় আসা শুরু করে। আর সব বাস-ট্রাক ২০১৯ এর জুলাই মাস নাগাদ আসা শেষ হয়। এগুলোর প্রায় সবই বিআরটিসি তাদের ডিপোতে বরাদ্দ দেয়াও শেষ করছে।
ঋণের চুক্তি অনুযায়ী ভারতের অশোকলিল্যান্ডের ৩০০ দ্বিতল, ২০০ একতলা এসি বাস কেনা হয়। এছাড়া টাটা মটর থেকে ১০০ নন-এসি বাস কেনা হয়। বিআরটিসির সর্বশেষ ২৭শে আগষ্টের বরাদ্দের তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন ডিপো, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ২৭১টি বাস বরাদ্দ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এরমধ্যে টাটা থেকে কেনা নন এসি ১০০টি বাসের ৭৮টি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এখনো বরাদ্দের অপেক্ষায় রয়েছে ২২৮টি বাস। পরিদর্শনের অপেক্ষায় আছে ৪৯টি বাস। এছাড়া ৫০০ ট্রাকের মধ্যে আইচারের ৩৫০টি এবং টাটার ১৫০টি। এর থেকে ঢাকা ডিপোকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৯৩টি ট্রাক। চট্টগ্রাম ডিপোকে বরাদ্ধ দেয়া হয় ২৮৫টি। এছাড়া ১৭টি ট্রেনিং ইনিস্টিটিউটকে দেয়া হয়েছে ১৮টি ট্রাক। রেজিস্ট্রেশনের অপেক্ষায় ১৮টি এবং বরাদ্দ বাকি রয়েছে ৪টি ট্রাক।
সরেজমিনে দেখা যায়, তেজাগাঁও শিল্প অঞ্চল এলাকায় ঢাকা ট্রাক ডিপোর সামনে নতুন বরাদ্দের টাটা ও আইচারের একাধিক নতুন ট্রাক সড়কের উপরে পড়ে আছে। এগুলো এখনো চালানো না হলেও ময়লা আবর্জনা পড়ে আছে। কোনো রকম ঢেকেও রাখা হয়নি। স্থানীয়রা গত তিন মাস ধরেই এ ট্রাকগুলোকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখছেন। কোন রকম চালানো হচ্ছে না। উপস্থিত ট্রাক চালক, সহকারীরা বলছে এসব ট্রাকে নানা ত্রুটি রয়েছে। নতুন আসা ট্রাকে টুলবক্সসহ অনেক কিছুই নেই। এছাড়া উপড়ে ছাদের উপরে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে উচু কোন মালামাল পরিবহন না করার জন্য। বিআরটিসির ঢাকা ট্রাক ডিপোর ম্যানেজার মো. শাহরিয়ার বুলবুল মানবজমিনকে বলেন, নতুন আসা ভারতীয় ট্রাকের মধ্যে ১৯৩টি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ৫০টি ট্রাকের চালক, সহকারী নিয়োগের জন্য এখনো ব্যবহার করা শুরু হয়নি। বাকী ট্রাকগুলো পণ্য পরিবহনে ব্যবহার হচ্ছে।
ত্রুটি ধরা পড়া ভারতীয় ১০০টি টাটা নন এসি বাসের ৮টি পায় গাবতলী ডিপো। এর মধ্যে এখন একটি পরীক্ষার জন্য হেড অফিস নিয়ে গেলেও বাকী গুলো ত্রুটি নিয়েই সড়কে চলছে। এগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠার পড়েও কেনো চালাচ্ছেন জানতে চাইলে গাবতলী ডিপোর ম্যানেজার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ওই বাসগুলো গুলিস্তান-নাগরপুর রুটে চলছে। স্থানীয় সংসদ সদস্যের চাওয়ায় তা চলছে। এছাড়া এখন বৃষ্টি নেই তাই তেমন কোনো সমস্য হচ্ছে না। মনিরুজ্জামান বলেন, বাসগুলো বরাদ্ধ পেয়ে রাস্তায় নামালে ত্রুটি দেখা দেয়। এরপরে গত ১৫ই জুন বিআরটিসি চেয়ারম্যানের কাছে সমস্যার কথা জানিয়ে তিনি চিঠি দেন। ওই চিঠিতে তিনি বলেন, বাসের ছাদ দিয়ে বৃষ্টির সময় ভেতরে পানি পড়তে দেখা যায়। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, বাসের ছাদে যে এমএস শিট দেয়া হয়েছে, তা অতিমাত্রায় পাতলা। শিট ছিঁড়ে ভেতরের রিভিট বের হয়ে এসেছে। যার কারণে রিভিটের ছিদ্র দিয়ে পানি ঢুকে সিলিং বেয়ে পানি ভেতরে পড়ছে। এছাড়া এমএস শিট রিভিট থেকে আলগা হওয়ায় গাড়ি চলার সময় বিরক্তিকর শব্দ সৃষ্টি হয়। এরপরেই বিআরটিসিসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মিটিংয়ে বসে। তিনি বলেন, আমি যতটুকু জানি দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পরে এখন চারটি বাস পরীক্ষা শেষে রাস্তায় চলছে।
বাসগুলোর ইঞ্জিন তৈরি করেছে টাটা। তবে বডি এসিজিএল গোয়া নামের একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে। তাদের সঙ্গে চুক্তিতে দুই বছরের বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদানের কথা রয়েছে বলে জানান কারিগরি শাখার এক ঊর্ধতন কর্মকর্তা। ত্রুটির পরেই উভয় কোম্পানির লোকজনকে ডাকা হয়েছে। তারা এসে বিভিন্ন ডিপো থেকে চারটি বাস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। এই কর্মকর্তা বলেন, ভারত থেকে কেনা বাসগুলোর আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছে ২০ বছর। কিন্তু আনার পরপরই সমস্য দেখা গেছে। মন্ত্রণালয়ও এটাকে গুরুত্বসহকারে দেখার নির্দেশ দিয়েছে। তারা চারটি গাড়িকে পরীক্ষামূলক নিয়েছে। তারা দু’টি পদ্ধতির কথা বলেছে। এরমধ্যে একটি হচ্ছে বাসের সমস্ত ছাদ পরিবর্তন করে পুনরায় তৈরি করে দিবে। আর অন্য পদ্ধতিটা হচ্ছে, ফাইবার দিয়ে বাসের ছাদে প্রলপ দেয়া যাতে কোনো ধরণের প্রশ্ন না থাকে। এ পদ্ধতি দুইটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যাচাইবাচাই করে দেখবে। এরপরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
বিআরটিসির সাবেক চেয়ারম্যান ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এসএম সালেহ উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, বিআরটিসি নতুন বাস আনার কিছুদিন পরেই পানি পড়া এবং ট্রাক ডিপোর সামনে পড়ে থাকার দায়-দায়িত্ব তাদেরকেই নিতে হবে। আমি গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে দোষ দিবো না। সীমান্তে যারা এসব গাড়ী গ্রহণ করেছে তাদেরকেই তো এর ত্রুটি দেখার কথা ছিল। ত্রুটি নিয়ে গাড়ি কিভাবে ঢুকলো। কর্তৃপক্ষ তা দেখেননি। এছাড়া আপনি ট্রাক-বাস আনবেন তার আগেই তো জনবল নিয়োগ দেয়ার কথা। তা না দিয়ে এখন রাষ্ট্রীয় সম্পদ, জনগণের টাকার মাল এনে রাস্তায় ফেলে রেখেছেন। এ দায় বিআরটিসিকে ছাড়া কে নিবে প্রশ্ন তার।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status