ঢাকা, ১৭ মে ২০২৪, শুক্রবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

নিঃস্ব হয়ে ফিরছেন হাজার হাজার শ্রমিক

ফাহিমা আক্তার সুমি
৩ মে ২০২৪, শুক্রবার

ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে ফ্রি ভিসায় ওমানে যান দিপঙ্কর। দেশের মাটিতে নিজের স্বপ্ন পূরণে বারবার ব্যর্থ হন তিনি। নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিক্রি ও জায়গা-জমি বন্ধক রাখেন। একইসঙ্গে কাঁধে তুলেন বড় অঙ্কের ঋণের বোঝা। দালালের মাধ্যমে বিদেশে পাড়ি দিয়ে পড়েন বেকায়দায়। এক বছরে তাকে দেয়া হয়নি কোনো কাজ। কখনো কখনো না খেয়ে দিনযাপন করতেন তিনি। বিদেশের মাটিতে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও প্রতারণার শিকার হয়ে জীবন নিয়ে ফিরে আসেন দেশে। পড়েন পাওনাদারদের চাপের মুখে। সর্বস্ব হারিয়ে দিশাহারা হয়ে দেশে এসে ঋণের টাকা পরিশোধে শেষ সম্বল বাড়ির ভিটাটুকু হারানোর ভয়ে আছেন এখন। 

শুধু দিপঙ্কর নয়, প্রতিবছর লাখ লাখ শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজের উদ্দেশ্যে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে খালি হাতে ফিরছেন।

বিজ্ঞাপন
ভাগ্যবদল ও স্বপ্ন পূরণের আশায় হারাচ্ছেন সর্বস্ব। দেশে ফিরে টানতে হচ্ছে দেনা পরিশোধের ঘানি। গমনকৃত দেশে নির্যাতনের বঞ্চনা, আর্থিক ক্ষতি, কর্ম ও মজুরি প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফিরছেন। নারী শ্রমিকদের মধ্যে কেউ কেউ যৌন নিপীড়ন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছেন। ভাগ্য ফেরাতে বিদেশে গিয়ে অনেকে উল্টো ভাগ্য বিড়ম্বনায় পড়েন। কাঙ্ক্ষিত চাকরি না পাওয়া, বেতন কম, আকামা নবায়ন না হওয়া, অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে শ্রমিকেরা ফিরে আসেন। 

দিপঙ্কর মানবজমিনকে বলেন, পিরোজপুরের বানিয়ারিতে বাড়ি। ২০২২ সালে এক পরিচিতের মাধ্যমে দালালের সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়। সর্বস্ব হারিয়ে বিদেশ গেলেও প্রতারণার শিকার হয়ে ২০২৩ সালে দেশে ফিরে আসি। দেশে আমি অটো মেকানিকের কাজ করতাম একটা গ্যারেজও ছিল আমার। তা দিয়ে মোটামুটি টেনেটুনে সংসার চলতো। বিদেশে গিয়ে আমি সবকিছু হারিয়েছি। আমি এখন নিঃস্ব। 

১৯ মাস আগে দুবাই যান হবিগঞ্জের সাইদুর রহমান। বাবা কৃষিকাজ করে সংসারের খরচ চালাতেন। বয়সের কারণে বর্তমানে কিছুই করতে পারেন না। পরিবারের অভাব ঘোচাতে বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। তিনি বলেন, দেশে কিছু করতে না পেরে বিদেশ গিয়েছিলাম পরিবারের অভাব  ঘোচাতে কিন্তু মানসিক যন্ত্রণা ও অর্থকষ্ট নিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। বিদেশ যাওয়ার পর প্রিন্টিংয়ে কাজ করা শুরু করি। যে দালাল আমাকে নিয়েছিল সে ৩-৪ টাকা  (স্থানীয়) ঘণ্টায় দেয়। পরে কোম্পানির মাধ্যমে জানতে পারি তারা ঘণ্টায় ১৭ টাকা আমার বেতন ধরেছে। আমি এত পরিশ্রম করে কাজ করি আর টাকা সেই দালাল নেন আমার কিছুই থাকে না। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি যে আমার সঙ্গে এমন প্রতারণা হচ্ছে। সেখানে ৬ মাস কাজ করি এরপর অনেক ঝামেলা করার পর ক্যান্সেল দিয়েছে। সহজে ক্যান্সেল দিতে চাইনি তারা আমাকে খুব মারধর করেছে। এই বিদেশ যাওয়ায় আমার মোট সাড়ে চার লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছিলাম আরও কিছু ধার-দেনা করে টাকা জোগাড় করেছি। এরপর আরেকটি চাকরি হয় জাহাজে। সেখানে ঠিকমতো বেতন দেয়নি। তারপর অনেক কষ্ট করে টাকা জোগাড় করে দেশে চলে আসি। 

৪-৫ মাস আগে ফ্রি ভিসায় কাতার গিয়েছিলেন চাঁদপুরের শরিফ। তিনি বলেন, রোজার আগে দেশে চলে এসেছি। ফ্রি ভিসায় গিয়েছিলাম। সেখানে যাওয়ার পর তিনমাস বসে ছিলাম কোনো কাজ আমাকে দেয়নি। সেখানে নিজেও চলতে পারি না আবার পরিবারকেও কিছু দিতে পারি না। খুব একটা অসহনীয় জীবন গেছে। পরে কোনো উপায় না  পেয়ে দেশ থেকে আবার টাকা ধারদেনা করে কোনোমতে টিকিটের টাকা জোগাড় করে দেশে চলে আসি। 

রেশমা বেগম। মুন্সীগঞ্জে তার বাড়ি। বর্তমানে মোহাম্মদপুরে বাসা-বাড়িতে কাজ করেন। দশ বছর আগে বিয়ে হয় তার। বিয়ের কয়েক বছর মধ্যেই ছাড়াছাড়ি হয়। তার একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। অভাবের সংসার ও সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরিচয় হয় এক দালালের সঙ্গে। তিন-চার লাখ টাকার মাধ্যমে বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখান তিনি। এরপর শুরু হয় রেশমার টাকা জোগাড়ের দৌড়ঝাঁপ। রেশমা বলেন, দুই মাসের মধ্যে কিছু জমানো টাকা ও বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে ধারদেনা করে দালালকে টাকা দেই। কয়েক মাস পরে বিদেশ যাওয়ার কথা বলে। আমাকে সৌদিতে ছোট বাসা-বাড়িতে কাজ দেয়ার কথা বলে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে কয়েক মাস কাজ ছাড়া থেকে একটি বড় বাড়িতে কাজ দেয়। সেই পরিবারে ১৬-১৭ জন লোক সবসময় থাকতো। বিদেশ যাওয়ার আগে থেকেই আমি একটু অসুস্থ ছিলাম। দালালকে বলেছিলাম ছোটখাটো কাজ দেয়ার জন্য। কিন্তু দিন-রাত সবসময় আমার কাজ করতে হতো। একদিন প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ি। দালালের সঙ্গে কোনোমতে কথা বলতে পারি। আমার সমস্যাগুলো জানাই তাকে। কিন্তু সে তারপর থেকে আর আমার কোনো খোঁজ রাখেনি। পরে ধারদেনা করে পাঁচমাস আগে দেশে চলে আসি। 
সম্প্রতি কাতার থেকে দেশে ফিরেছেন মো. সুমন মিয়া। তিনি পাঁচ মাস আগে পাড়ি জমান কাতারে। তিনিও কাজ না পেয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। চোখে মুখে চিন্তার ভাঁজ। ত্রিশ বছরের এই যুবক হযরত শাহ জালাল বিমানবন্দরের  টার্মিন্যাল-২ এর সামনে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, জমি বিক্রি করে দুই লাখ টাকা পাই, মামার কাছ থেকে ধার নিই এক লাখ বিশ হাজার টাকা, বাকি টাকা মা কিস্তি তুলে দেয়। এই সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়ে কাতারে যাই। কতো স্বপ্ন ছিল, এখন উল্টো বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে বিমান ভাড়া দিয়ে দেশে ফিরতে হলো। 

কাতার থেকে দুই বছর পর দেশে ফিরেছেন আরিফুর রহমান। তিনিও পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে স্ত্রী ও তিন বছরের মেয়েকে রেখে কিশোরগঞ্জ থেকে কাতার গিয়েছিলেন। কিন্তু কাজ না পাওয়ায় ছয় মাসের মাথায় তাকেও দেশে ফেরত চলে আসতে হয়েছে। বিমানবন্দরে কথা হয় তার সঙ্গে। বলেন, কাতার একটা ছোট দেশ। বিশ্বকাপ খেলার আগে কাজ ছিল ঠিকই কিন্তু এখন আর সেখানে কাজ করার মতো তেমন কিছু এখন নেই। আমাদের মতো যারা বাংলাদেশি সেখানে কাজের জন্য গিয়েছেন তারা খুব কষ্টে আছেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল?্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, বাংলাদেশে নিজের ভাগ্য ও অবস্থার পরিবর্তন করতে না পেরে অনেকে  কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে বিদেশে গমন করে। বিদেশ গমনের ক্ষেত্রে নিজের সর্বস্ব আর্থিক সক্ষমতা বিনিয়োগ করতে হয়। নারী শ্রমিকদের মধ্যে কেউ কেউ যৌন নিপীড়ন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি অন্যতম চালিকাশক্তি হলেও প্রবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রের যত্নশীল ও যৌক্তিক প্রবাসনীতির বাস্তবায়ন যথেষ্ট প্রশ্নের সৃষ্টি করে। প্রবাসীদের একটি বড় অংশ গমনকৃত দেশে নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার যেমন হয় আবার দেশে ফিরে পরিবার ও সমাজকর্তৃক নিগৃহীত হয়। এরূপ বাস্তবতা প্রকাশ করে যে, প্রবাসীদের অধিকারের প্রতি রাষ্ট্রের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় গৃহীত নীতিমালা প্রয়োগে কিছু অগ্রগতি থাকলেও মোটাদাগে প্রান্তিক অবস্থা বিরাজ করছে। প্রবাসীদের অধিকার ও জীবনমানের নিশ্চয়তা নিরূপণে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা অপরিহার্য।
 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status