প্রথম পাতা
জামিনের পর দু’দফা জেলগেট থেকে গ্রেপ্তার
নিরবের বিরুদ্ধে ৪৫৪ মামলা
কিরণ শেখ
৩০ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবারবাবার মুক্তির আশায় বুক বেঁধেছিলেন ৩ কন্যা। সাধ্যমতো সাজিয়েছিলেন বাড়িঘরসহ সবকিছু। প্রায় ১৪ মাস পর ফিরবেন বাবা রাজপথের প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপি’র যুব সংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব। কিন্তু না, আদালতের আদেশে মুক্তি পেলেও কারাফটক পার হতে পারেননি তিনি! নতুন একটি মামলায় তাকে আটক দেখিয়ে ফের কারাগারে পাঠানো হয়। হৃদয় ভাঙা ঘটনাটি গত ২৩শে এপ্রিলের। এটি নিরবের মুক্তি চেষ্টার দ্বিতীয় ঘটনা। তার ঠিক এক মাস দু’দিন আগে প্রথম দফায় তার মুক্তি আদেশ হয়েছিল। সে মতে ২০শে মার্চ, ২০২৪ তাকে গ্রহণে কেন্দ্রীয় কারাগারের বাইরে জড়ো হয়েছিলেন পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা। এমন সময় আচমকা খবর আসে মুক্তি হচ্ছে না। একটি প্যান্ডিং মামলায় তাকে ফের আটক দেখানো হয়েছে।
নিম্ন আদালত থেকে হাইকোর্ট, থানা থেকে কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগার- স্বজনকে মুক্ত করতে বিরামহীম ছুটছেন তারা। রাজনীতির মাঠে উত্তাপ না থাকলেও প্রায় প্রতিদিনই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের আটকের ঘটনা ঘটছে। পুরনো-প্যান্ডিং মামলা, নতুন অভিযোগ- গায়েবি অপরাধে সম্পৃক্ততার তথ্য হাজির করা হচ্ছে। মামলা জট তথা বিচারিক প্রক্রিয়া প্রলম্বিত হওয়ায় অপরাধ প্রমাণের আগেই তাদের কারাবাস করতে হচ্ছে! বিরোধী মতের লোকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ যাই হোক না কেন আদালতে আত্মসমর্পণে জামিন পেয়েছেন এমন সৌভাগ্যবানের সংখ্যা হাতে গোনা। বেশিরভাগের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। জামিন পেয়েও মুক্তি না পাওয়ার উদাহরণ তো ভুড়িভুড়ি। যুবদল নেতা নিরবের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে মানবজমিন। কীভাবে স্বামীকে মুক্ত করবেন, কার কাছে যাবেন? দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন সাইফুল আলম নিরবের স্ত্রী মাহাবুবা খানম। দিগ্বিদিক ছুটছেন তিনি এবং তার স্বজনেরা। নিরবের বাড়ি গিয়ে দেখা যায় তার দরজার ওপরে এখনো লেখা রয়েছে ‘ওয়েলকাম বাবা’। কন্যারা অপেক্ষায় রয়েছেন বাবা ফিরবেন। তাদের ঘরে আনন্দও ফিরবে। সেদিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে মাহাবুবা খানম বলেছিলেন, বাবার মুক্তির খবর পাওয়ার পর আমার তিন মেয়ের খুশির সীমা ছিল না। মেয়েদের সেই খুশি বেশিক্ষণ দেখতে পারিনি। কিছুক্ষণ পরেই আমরা খবর পাই যে, তাকে (সাইফুল আলম নিরব) আবার আটক করা হয়েছে। এখন প্রায় সময়ই মেয়েরা জিজ্ঞাসা করে বাবা মুক্তি পাবে তো মা? বাবাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তাদের। কিন্তু দুর্ভাগ্য। আমার কাছে মেয়েদের জিজ্ঞাসার এখনো কোনো জবাব নেই। কী বলবো তাদের? আমি তো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। মাহাবুবা খানম বলেন, দেড় বছর হতে চললো আমার স্বামী কারাগারে। তার কি অপরাধ? বলতে গেলে বিনা অপরাধে আমার স্বামীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। আমার স্বামী দেশের জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছেন। এটা কী এমন রাজনীতিবিদের অপরাধ হতে পারে? রাজনীতি করা তো অপরাধ নয়। তাকে কারাগারে বন্দি করে রেখে কেন আমাদের জীবনকে ধ্বংস করা হচ্ছে? ২০২৩ সালের ৩রা মার্চ কাওরান বাজারের রেলগেট থেকে সাইফুল আলম নিরবকে আটক করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। আটকের পর বিভিন্ন মামলায় সাজা দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এ সময়ে ৪ দফায় তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। আর ৭টি মামলায় আদালত সাইফুল আলম নিরবকে সাড়ে ২১ বছরের সাজা দেন বলে মানবজমিনকে জানিয়েছেন তার আইনজীবী ইনজামুল হক সুমন। এরপর চলতি বছরের ২০শে মার্চ জামিন পান নিরব। কিন্তু তিনি মুক্তি পাননি, পরিবারের কাছে ফিরতে পারেননি। কারা ফটক থেকে নতুন মামলায় আটক করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
জামিনে মুক্তির পর কারাফটক থেকে আটক প্রসঙ্গে সাইফুল আলম নিরবের আইনজীবী ইনজামুল হক সুমন বলেন, কোনো আসামি জামিন পাওয়ার পর তাকে দ্রুত মুক্তি দেয়া আইন। জামিনের কাগজ কারাগারে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক মুহূর্তও সেই আসামিকে আটক করে রাখা যাবে না। কিন্তু শুধুমাত্র হয়রানি করার জন্য মুক্তি পাওয়ার পর নতুন আরেকটি মামলায় কারাফটক থেকে আটক করা হয়।
জানা গেছে, সাইফুল আলম নিরবের নামে এখন মামলা রয়েছে ৪৫৪টি। এরমধ্যে ৮০% মামলায় তিনি জামিনে আছেন। এপ্রসঙ্গে তার আইনজীবী ইনজামুল হক সুমন বলেন, ২০১৭ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া মামলায় হাজিরা দিতে আদালতে যেতেন। ওই সময় কোনো ঘটনা ঘটুক কিংবা না ঘটুক- রমনা এবং শাহবাগ থানায় মামলা হতোই। যারা ওই সময় শীর্ষ পদে ছিলেন তাদের নামে এসব মামলা করা হতো। ওই সময় যুবদলের সভাপতি ছিলেন সাইফুল আলম নিরব। সেজন্য তার নামেও মামলা দেয়া হয়েছে। এরপরে ২০১৮ সালে শুরু হলো গায়েবি মামলা দেয়া। শুধুমাত্র তেজগাঁও থানাতেই সাইফুল আলম নিরবের নামে ৩২টি মামলা দেয়া হয়। অন্য থানাতে মামলা তো ছিলই। এখন এসব মামলায় সাজা দেয়া হচ্ছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেপ্রণোতিভাবে সাইফুল আলম নিরবের নামে এসব মামলা দেয়া হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠী গোটা দেশকেই এখন ভয়াবহ জুলুমের নগরীতে পরিণত করেছে, পুরো দেশকেই বৃহৎ কারাগারে রূপান্তরিত করেছে। কেবল সাইফুল আলম নিরবই নন, তার মতো হাজার হাজার নেতাকর্মীকে জামিন লাভের পরও কারাফটক থেকে নিত্যনতুন ভুয়া মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারান্তরীণ করা হচ্ছে। সরকার এখন দেশ-বিদেশে ধিকৃত ও সমালোচিত হলেও কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা না করে জনগণসহ বিরোধী দল ও মতের নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার-উৎপীড়ন অব্যাহত রেখেছে।
বিএনপি বলছে, ২৮শে অক্টোবর থেকে দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১ হাজার ৬৪৫টির বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় ২৫ হাজার ৭১১ জনকে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার নেতা-কর্মীরা নির্বাচনের পর জামিন পেতে শুরু করলেও এখনো অনেকে কারাগারে আছেন।
আইন মন্ত্রণালয়ের জন্য গিনিস রেকর্ডের চেষ্টা করা যেতে পারে।
জুলুম নির্যাতনের চূড়ান্ত রুপ। অমানবিকতার চরম বহিঃপ্রকাশ! শুধু সাইফুল আলম নীরব ই নন,সকল বিরোধী রাজনৈতিক নেতা কর্মীদেরই সেই একই দশা। আল্লাহ আপনি রহম করুন।