বিশ্বজমিন

নির্বাচনে অনিয়ম তদন্তে নিরপেক্ষ, পক্ষপাতিত্বহীন কমিশন গঠনের আহ্বান হিউম্যান রাইটস ওয়াচের

মানবজমিন ডেস্ক

৩ জানুয়ারি ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১০:১৮ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মারাত্মক সব অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, এসব অনিয়মের মধ্যে রয়েছে নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের দিনে বিরোধীদলীয় সদস্যদের ওপর হামলা। ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন। ভোট জালিয়াতি। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পক্ষপাতমূলক আচরণ।
দীর্ঘ এক বিবৃতিতে তারা আরো বলেছে, সহিংসতা, বিরোধীদের গণগ্রেপ্তার ও স্বাধীন মত প্রকাশের বিরুদ্ধে দমনপীড়নের পরে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছে ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এর মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় এলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ নির্বাচনে পার্লামেন্টের ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয়ী হয়েছে তার দল। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচন হয়েছে অবাধ ও সুষ্ঠু। তবে, বিরোধীরা এ নির্বাচনকে হাস্যকর বলে অভিহিত করেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্রাড এডামস বলেছেন, নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়টা ছিল বিরোধীদের ওপর সহিংসতা ও ভীতি প্রদর্শন, বিরোধীদের প্রচারণা অনুষ্ঠানে হামলা হয়েছে। স্বাধীন মত প্রকাশকে সীমিত রাখতে আইনের অপব্যবহার করা হয়েছে।  নির্বাচনের দিনে ব্যালটভর্তি করা, ভোটারদের ভীতি প্রদর্শন, ভোটকেন্দ্র ক্ষমতাসীনদের দখলে থাকার অর্থ হলো নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন ও পক্ষপাতিত্বহীন কমিশন গঠন করা উচিত।
ওই বিবৃতিতে আরো বলা হয়, নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার ও সহিংসতার ভয়ে সাংবাদিকরা তাদের রিপোর্ট সেন্সর করেছেন বলে বর্ণনা করেছেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক কমিশন (বিটিআরসি) টেলিযোগাযোগ বিষয়ক সব অপারেটরকে থ্রিজি ও ফোর জি ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করতে নির্দেশ দেয়। এতে যোগাযোগ ও তথ্য শেয়ার ব্যাহত হয়। নির্বাচনের দিনে সহিংসতায় কমপক্ষে ১৭ জন নিহত হয়েছেন।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়Ñ বিরোধী দলগুলো, সাংবাদিক ও ভোটাররা অনিয়মের গুরুতর সব অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে ব্যালটভর্তি করা, ভোটারদেরকে ভোটকেন্দ্রে যেতে না দেয়া, ক্ষমতাসীনদের ভোটকেন্দ্র দখলে রাখা ও ভোটারের ভোট দিয়ে দেয়া, নির্বাচনী কর্মকর্তা ও পুলিশ দলীয় আচরণ করেছে, ভয়াবহ এক ভীতিকর পরিবেশে ভোটারের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে লঙ্ঘন অন্যতম। বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি বলেছে, ২২১টি সংসদীয় আসনে তাদের কোনো পোলিং এজেন্ট দিতে দেয়া হয় নি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা নির্বাচনের দিনে নিয়ম লঙ্ঘনের ঘটনাকে বিক্ষিপ্ত ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে, পুলিশ প্রধান জাভেদ পাটোয়ারি পরিবেশকে শান্তিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেছেন।  
এমন ‘ডিস্টার্বিং’ অভিযোগ অব্যাহতভাবে বেরিয়ে আসছে। বিরোধী দলকে ভোট দেয়ার অপরাধে নোয়াখালীতে চার সন্তানের এক মাকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। এ অভিযোগে ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ২৯শে ডিসেম্বর ঢাকায় সাদা পোশাকের নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া চার শিক্ষার্থীকে আটক করে। তারপর তারা যেন নিরাপদে ফিরে যেতে পারেন এমন দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে তাদের পরিবারের সদস্যরা। অবশেষে তাদেরকে ২রা জানুয়ারি আদালতে হাজির করা হয়েছে।
বিবৃতিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরো বলেছে, অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের পরিবর্তে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ রিপোর্ট করার জন্য সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করেছে। ১লা জানুয়ারি সাদা পোশাকের পুলিশ ঢাকা ট্রিবিউন, বাংলা ট্রিবিউন ও প্রবাহ পত্রিকার খুলনাভিত্তিক সাংবাদিক হেদায়েত হোসেন মোল্লাকে গ্রেপ্তার করেছে। তিনি রিপোর্ট করেছিলেন যে, খুলনা-১ আসনে মোট বৈধ ভোটারের চেয়ে বেশি ভোটার ভোট দিয়েছেন। এ মামলায় আরেক সাংবাদিক রাশিদুল ইসলামের নাম রয়েছে। এ দু’সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযোগ আনা হয়েছে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা  ভোটারদের ভীতি প্রদর্শনের প্রমাণ্যচিত্রের ভিডিও মুছে ফেলতে বাধ্য করেছে সাংবাদিকদের। দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার রিপোর্টার কাফি কামাল বলেছেন, একটি ভোটকেন্দ্রের বাইরে ভোটারদের ওপর হামলার দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করার সময় তাকে প্রহার করা হয়েছে। তিনি হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, ওই ঘটনার ফুটেজ যখন ধারণ করছিলাম তখন তারা সাংবাদিকের উপস্থিতি টের পায় এবং আমার ওপর হামলা চালায়। আমার সারা শরীরে আঘাত করে। আমার বাম চোখে চারটি সেলাই দেয়া হয়েছে। শরীরের পশ্চাতে রয়েছে অসহনীয় ব্যথা।
এতে আরো বলা হয়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাম্প্রতিক ‘ক্রিয়েটিং প্যানিক: বাংলাদেশ ইলেকশন ক্রাকডাউন অন পলিটিক্যাল অপোনেন্টস অ্যান্ড ক্রিটিকস’ শীর্ষক একটি রিপোর্টে নির্বাচনের আগের কয়েক মাসে বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে সরকার ও রাষ্ট্রীয় শক্তি কিভাবে নির্যাতন করেছে তা তুলে ধরা হয়েছে। বিরোধীদলীয় জোট ঐক্যফ্রন্ট রিপোর্ট করেছে যে, তাদের ৮ হাজার ২ শতাধিক সদস্য ও সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৩০০ জন। এর মধ্যে রয়েছেন কয়েক ডজন প্রার্থী। প্রচারণাকালে তাদের ওপর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থকরা হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। বিরোধী নেতারা বলেছেন, কর্তৃপক্ষ, দলীয় আচরণকারী হিসেবে এসব অভিযোগ ব্যাপকভাবে অবজ্ঞা করেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরো বলেছে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃত নির্বাচনী পর্যবেক্ষক ও বিদেশি সাংবাদিকদের বৃহত্তর অর্থে বাংলাদেশে আসতে বাধা দেয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও বিবিসির একজন সাংবাদিক চট্টগ্রামে ব্যালটভর্তি বাক্স ভোটকেন্দ্রের ভেতরে নেয়ার দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করেছেন। অন্য মিডিয়াগুলো রিপোর্ট করেছে যে, অনেক সংসদীয় আসনের ভোটকেন্দ্রে মধ্যাহ্নভোজের জন্য ভোটগ্রহণ বিরত রাখা হয়েছিল, যা ভোট বেশি পড়াকে দমিয়ে রাখা বলে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মিডিয়ার কাছে ভোটাররা বলেছেন, তাদেরকে কর্মকর্তারা ফিরিয়ে দিয়েছেন অথবা বুথের ভেতরে তাদেরকে যোগ দিতে হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীর সঙ্গে, যারা তার পক্ষে ভোট দিয়ে দিয়েছে। সারা দেশ থেকে একই রকম বিপুল সংখ্যক রিপোর্ট করেছেন সাংবাদিক ও অন্য প্রত্যক্ষদর্শীরা।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিবৃতিতে বলেছে, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার পুরোটা সময় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে, যা নির্বাচনী প্রচারণা ও ভোটকে কলঙ্কিত করেছে। তারা একই সঙ্গে অনিয়মের অভিযোগের যথাযথ তদন্ত দাবি জানিয়েছে।
বৃটিশ সরকার এক বিবৃতিতে বলেছে, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে তারা অবহিত। এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছে গ্রেপ্তার, যার ফলে বিরোধী দলগুলোর ওপর চাপ পড়ে এবং তাদের প্রচারণা বাধাগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া নির্বাচনের দিনে অনিয়ম হয়েছে। তাই বৃটিশ সরকার সব অভিযোগের পূর্ণাঙ্গ, বিশ্বাসযোগ্য ও স্বচ্ছ সমাধান চায়।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতিতে নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে হয়রানি, ভীতি প্রদর্শন ও সহিংসতার বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্টের কথা তুলে ধরেছে। বলা হয়েছে, এর ফলে বহু বিরোধীদলীয় প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের সভা, র‌্যালি এমন কি নির্বিঘেœ প্রচারণা চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া নির্বাচনের দিনে যেসব অনিয়ম হয়েছে তা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যে আস্থা আছে তাকে খর্ব করেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরো লিখেছে, ইন্টারন্যাশনাল কোভ্যানেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসের (আইসিসিপিআর) একটি সদস্য দেশ বাংলাদেশ। এর অনুচ্ছেদ ২৫ বলছে, নির্বাচনে ভোট দেয়ার এবং একটি খাঁটি সময়ে নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রতিটি নাগরিকের অধিকার ও সুযোগ আছে। এটা সার্বজনীন এবং সবার সমান সুযোগ। এ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে হবে গোপন ব্যালটে, যেখানে প্রার্থীকে বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে মুক্ত মত প্রকাশের গ্যারান্টি থাকবে।
ব্রাড এডামস বলেন, আন্তর্জাতিক দাতারা, জাতিসংঘ ও বাংলাদেশের বন্ধুদের স্মরণ রাখা উচিত যে নির্বাচন হলো ভোটারের অধিকার, যারা ক্ষমতায় তাদের নয়। উচ্চ মাত্রায় বিভক্ত একটি দেশ, যেখানে একটি দল শতকরা ৯৬ ভাগের বেশি আসনে বিজয়ী হয় সেখানে তাৎক্ষণিক প্রশ্ন উঠা উচিত।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status