প্রথম পাতা

১৮০ কোটি টাকা পাচ্ছে না চট্টগ্রাম বন্দর

ফারমার্স ব্যাংকে রাখা অর্থ ফেরত মিলছে না

দীন ইসলাম, ঢাকা ও ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম

২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ১০:০৪ পূর্বাহ্ন

দেশের কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংকে টাকা রেখেও ফেরত পাচ্ছেন না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ডিপোজিট রেখে এখন ঝামেলায় পড়েছেন প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝারি সারির কর্মকর্তারা। ওই সব কর্মকর্তা দেন-দরবার করেও টাকা ফেরত আনতে পারছেন না। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের ডিপোজিটকৃত ১৮০ কোটি টাকা ফেরত চেয়েও পাচ্ছেন না। এছাড়া জলবায়ু ফান্ডের পাঁচ হাজার পাঁচশ’ ৮০ কোটি টাকা দিতে পারছে না ফারমার্স ব্যাংক। অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিতাস গ্যাস, রাজউক, ডেসা, ডেসকো, ওয়াসা ও ডিপিডিসিসহ কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অনেকটা জোর করে ডিপোজিট নিয়েছে ফারমার্স ব্যাংক। এজন্য ব্যাংকটির পদত্যাগী চেয়ারম্যান ও সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর প্রভাব খাটিয়েছেন। রাজউক সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়ার সময়ে ফারমার্স ব্যাংকে দুইশ’ কোটি টাকা ডিপোজিট দিতে ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করা হয়। বিনা অজুহাতে ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বসিয়ে রাখা হতো। গালমন্দ দিতেও ছাড়তেন না কমিটির চেয়ারম্যান। রাজউকের হিসাব শাখার এক কর্মকর্তা জানান, সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক থেকে রাজউকে ফেরত আসার পর সিনিয়র স্যারদের ফ্যাকাশে মুখ দেখতে খারাপ লাগতো। একদিন প্রতিষ্ঠানের সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, ফারমার্স ব্যাংকে ২০০ কোটি টাকা ডিপোজিট দেয়ার ফাইল প্রসেস করো। শেষ বয়সে চাকরি খোয়াতে পারবো না। ওই সময় অনেকটা বাধ্য হয়ে ফারমার্স ব্যাংকে ১০ কোটি টাকা ডিপোজিট দেয় রাজউক। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, সার্ভিস সেক্টরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ যারা নিয়মিত সরকারের রাজস্ব আদায় করেন ওই সব প্রতিষ্ঠান প্রধানকে মাঝে মধ্যেই চিঠি দেয়া হতো। ওই চিঠিতে সশরীরে হাজির হওয়ার নির্দেশনা থাকতো। এরপর নানা কায়দায় নাজেহাল করা হতো প্রতিষ্ঠান প্রধানকে। অনেক সময় বিভিন্ন উদ্ভট কাগজপত্র চেয়ে পাঠানো হতো। পর পর কয়েকবার নাজেহাল করার পর ফারমার্স ব্যাংকে ডিপোজিট দিতে অনেকটা বাধ্য করা হতো। ডিপোজিট না দিলে সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে হাজিরা থেকে নিষ্কৃতি মিলতো না। নানা ছুতো তৈরি করে হাজির হতে বলা হতো। এরপর ডিপোজিট দিতে অনেকটা বাধ্য করা হতো।
এদিকে ফারমার্স ব্যাংকে রাখা ১৮০ কোটি টাকা ফেরত চেয়েও পাচ্ছে না চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। টাকা চেয়ে হালের দৈন্যদশাকবলিত এ ব্যাংকের কাছে বার বার চিঠি দিলেও তাতে কোনো সুরাহা মিলছে না।
টাকার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেও একাধিক চিঠি দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। তাতেও ক্লান্ত হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের হিসাব বিভাগের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ফখরুল ইসলাম।
তিনি জানান, চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন খাত থেকে অর্জিত টাকা নীতিমালা অনুসারে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকসমূহে জমা করা হয়। এরমধ্যে ফারমার্স ব্যাংকের সুদের হার ছিল বেশ আকর্ষণীয়। এ কারণে সেখানে প্রায় ১৮০ কোটি টাকা জমা রাখা হয়।
তিনি বলেন, একসঙ্গে নয়, দফায় দফায় বিভিন্ন মেয়াদে ফারমার্স ব্যাংকের চট্টগ্রাম খাতুনগঞ্জ শাখায় তাদের অর্থ জমা করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকটির তারল্য সংকট নিয়ে হৈ চৈ শুরু হলে মেয়াদপূর্ণ ৫ কোটি টাকা ফেরত চেয়ে চাহিদা পাঠানো হয়। ব্যাংক তাদেরকে এই টাকার পে-অর্ডারও প্রদান করে। কিন্তু তা নগদায়ন হয়নি।
এরপর মেয়াদপূর্ণ ৩০ কোটি টাকা এবং পর্যায়ক্রমে অবশিষ্ট সব টাকা ফেরত চেয়ে ফারমার্স ব্যাংকের কাছে চিঠি দেয়া হয়। এই পর্যায়ে ফারমার্স ব্যাংক থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষকে তাদের টাকা আরো ৬ মাসের জন্য পুনরায় বিনিয়োগের অনুরোধ জানানো হয়।
এই সময়ের মধ্যে তারল্য সংকট কেটে যাবে এবং সমুদয় জমা টাকা ফেরত দেয়া সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ তাতে সন্তুষ্ট নয়। তাই তাদের জমা অর্থ ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে বিরাজমান সংকটের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হয়। তাতে কোনো সাড়া না পাওয়ায় এবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনা পরিষদের সদস্য (প্রশাসন ও যোগাযোগ) মো. জাফর আলম বলেন, ফারমার্স ব্যাংকে জমা রাখা ১৮০ কোটি টাকা বার বার ফেরত চেয়েও পাওয়া যায়নি। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ ও একাধিক পত্রও দেয়া হয়েছে। তাতেও কোনো সুরাহা মেলেনি। ফলে টাকা ফেরতের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের সহায়তা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
চট্টগ্রাম বন্দরের হিসাব বিভাগ সূত্র জানায়, বন্দরের রিজার্ভ, ক্যাপিটাল রিজার্ভ, পেনশন, প্রভিডেন্ড ফান্ডসহ বিভিন্ন খাতে টাকা রয়েছে। ব্যাংকে তাদের অর্থ রাখার ব্যাপারে নির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করা হয়। মোট টাকার ৭৫ ভাগ সরকারি ব্যাংকে এবং ২৫ ভাগ বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখার নীতিমালা রয়েছে।
সরকারি ব্যাংকে জমার জন্য নির্ধারিত অর্থের ৭৫ ভাগের ৭৫ শতাংশ সোনালী ও জনতা ব্যাংকে এবং ২৫ শতাংশ সরকারি অন্যান্য ব্যাংকে জমা রাখা হয়। আর বেসরকারি ব্যাংকে জমার ক্ষেত্রে কেমেল রেটসহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয়।
সে হিসাবে ২০১৩ সালে ফারমার্স ব্যাংক যাত্রার শুরু থেকে সুদের হার বেশি ছিল। যা বিবেচনায় নিয়ে দফায় দফায় বিভিন্ন মেয়াদে বন্দরের ১৮০ কোটি টাকা জমা রাখা হয়। কিন্তু নতুন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে গত কয়েক বছর খুব খারাপ অবস্থা হয়েছে ব্যাংকটির। সাইনবোর্ড সর্বস্ব এবং অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদানসহ নানা অনিয়ম ও কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে ব্যাংকটি।
তাদের খেলাপি ঋণের হার বেশি। ঋণ আদায়ের হার একেবারে কম। তাতে বড় ধরনের তারল্য সংকটের সম্মুখীন হয় ফারমার্স ব্যাংক। এতে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয় ব্যাংকটি। এই প্রেক্ষাপটে ব্যাংকের চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীরসহ তিন পরিচালক পদত্যাগ করেন।
চট্টগ্রাম বন্দরে রাখা বিপুল পরিমাণ টাকা ফেরত দেয়া নিয়ে কথা বলার জন্য গতকাল সকাল থেকে ফারমার্স ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায় ল্যান্ডফোনে একাধিকবার ফোন করলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। প্রতিবার রিং বাজলেও কেউ ফোন ধরেনি। এদিকে জলবায়ু ফান্ডের পাঁচ হাজার পাঁচশ’ ৮০ কোটি টাকা দিতে পারছে না ফারমার্স ব্যাংক। আর্থিক সংকটে কবে নাগাদ এ টাকা পরিশোধ করতে পারবে তাও বলতে পারছে না।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status