শেষের পাতা

অবশেষে স্কুল-কলেজের এসকেলেটর প্রকল্প বাতিল

নূর মোহাম্মদ

২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:২৩ পূর্বাহ্ন

তুমুল সমালোচনার মুখে স্কুল-কলেজে এসকেলেটর (চলন্ত সিঁড়ি) প্রকল্প বাতিল করা হচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তির মুখে বিলাসী এ প্রকল্প থেকে সরে এসেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১০তলা ভবনের পরিবর্তে ৬তলা ভবন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে এসকেলেটর বাদ দিয়ে প্রয়োজন হলে লিফট বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। মাধ্যমিক ও সরকারি কলেজ উন্নয়ন প্রকল্প থেকে এসকেলেটর বাদ দিয়ে নতুন প্রস্তাবনা তৈরি করেছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত বছর সারা দেশে মাধ্যমিক স্কুলে ৩২৩টি সরকারি স্কুল এবং ২০০ সরকারি কলেজ উন্নয়ন প্রকল্পে ১০তলা ভবন করে এসকেলেটর নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। একনেকে পাস হওয়ার পর দু’টি প্রকল্পে এসকেলেটর বসানোর জন্য নতুন প্রস্তাবনা দেয়া হয়। এতে সারা দেশে মাধ্যমিকে ১৬৩টি প্রতিষ্ঠানে এসকেলেটর বসানোর জন্য ১১১৬ কোটি টাকা, ২০০ সরকারি কলেজে উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে ৬৭টি কলেজে এসকেলেটর বসানোর জন্য বরাদ্দ রাখা হয় ৪৫৪ কোটি টাকা। দু’টি প্রকল্পে এসকেলেটরের জন্য বরাদ্দ রাখা হয় ১৫৭০ কোটি টাকা। দুটি প্রকল্পের এসকেলেটর নিয়ে প্রশ্ন তুলে পরিকল্পনা কমিশন বলেছে, দুটি প্রকল্পই মূলত শিক্ষার অবকাঠামো ও বিজ্ঞান শিক্ষার সমপ্রসারণের জন্য। বিলাসিতার মতো এখানে এসকেলেটর আনার কী প্রয়োজন। এ ছাড়াও এ প্রকল্পের স্বাস্থ্যগত দিক নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। এটা নিয়ে সারা দেশে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার পর বিলাসী এ প্রকল্প থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর আগে পরিকল্পনা কমিশনের লিখিত আপত্তির জবাব না দিয়ে মৌখিকভাবে প্রকল্পের সমাধান করার চেষ্টা করে মন্ত্রণালয়। কিন্তু পরিকল্পনা মন্ত্রীসহ কমিশনের অন্য সদস্যরা এ প্রকল্পের ব্যাপারে সায় দেননি। অপারগ হয়ে এসকেলেটর প্রকল্প থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত হয়। দুই প্রকল্পে এসকেলেটর না রাখার সিদ্ধান্তের বিষয়টি পরিকল্পনা কমিশনকে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে পরিকল্পনা কমিশনের শিক্ষা উইং-এর উপ-প্রধান মোস্তফা কামাল মানবজমিনকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তর এসকেলেটর বাদ দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা আমাদের লিখিতভাবে জানিয়েছেন। একই সঙ্গে ১০তলা ভবনের পরিবর্তে ৬তলা ভবন নির্মাণের কথাও জানিয়েছেন। তিনি বলেন, পরিকল্পনা কমিশনসহ সরকারি নীতিনির্ধারণী মহল বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। দু’টি প্রকল্প বাস্তবায়নে এখন কোনো বাধা রইল না। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাবনা জমা দিলেই সরকারি অর্ডার (জিও) জারি করা হবে।
আর মাউশির পরিকল্পনা শাখার পরিচালক প্রফেসর মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এসকেলেটর বসানোর কোনো সিদ্ধান্ত আমাদের ছিল না। প্রথম ডিপিপিতে এটা উল্লেখ ছিল না। হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন এমন তথ্য দিয়ে এসকেলেটর বসানোর বিষয়টি আনা হয়। এখন সেটি বাদ দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। তাই বাদ দেয়া হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, সারা দেশে ৩৩৫টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩২৩টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ৪ হাজার ৬৪০ কোটির টাকার একটি  প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এর মধ্যে ১৬৩টি বিদ্যালয়ের ভবনে এসকেলেটর স্থাপনের জন্য ১১১৬ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়। একনেকে পাস হওয়ার পর ছয় মাসের ব্যবধানে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়ায় ৬ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা। এরপর এ প্রকল্পের নতুন করে প্রকল্প মূল্যায়ণ কমিটিতে পরিকল্পনা কমিশন এসকেলেটরের ব্যাপারে ব্যাপক আপত্তি তোলা হয়। দেশের সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের অভ্যন্তরে খালি জায়গার সংকট রয়েছে। সেই বিবেচনায় ১০তলা ভবনের পরিবর্তে সম-আয়তনের ৫ থেকে ৬তলা ভবন করলে একদিকে শিক্ষার্থীদের সুস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। অন্যদিকে এসকেলেটর স্থাপনের জন্য অনেক জায়গা প্রয়োজন। এসকেলেটর স্থাপন করতে গেলে প্রতিটি ভবনের মাঝের ও নিচের ফ্লোর ভাঙতে হবে, যা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ। এগুলো করতে গেলে একটি বড় সময়ের জন্য স্কুল বন্ধ দিতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ক্ষতি হবে। তা ছাড়া স্কুল শুরু ও ছুটির সময় শ’ শ’ শিক্ষার্থী একসঙ্গে ওঠানামা করতে গেলে তা সময়সাপেক্ষ হবে। এসকেলেটর বা লিফট স্থাপনের পর রক্ষণাবেক্ষণে যে অর্থের প্রয়োজন হবে তা স্কুল যথাসময়ে সংকুলান করতে পারবে কি না, এগুলো সচল রাখার জন্য সার্বক্ষণিক নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত কি না, এগুলো চালু হওয়ার পর কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে তা গণপূর্ত অধিদপ্তর বা সরকারি সংস্থার মাধ্যমে দ্রুত মেরামতের ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে কি না? এ ছাড়া আর্থিক সংশ্লেষ ও মফস্বল শহরে এর ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য পেশাদার দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন। এ ছাড়াও মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের চলাফেরার জন্য এসকেলেটর ব্যবহার কারিগরি দিক দিয়ে উপযোগ্য কি না তা খতিয়ে দেখতে বলা হয়। কেননা শিক্ষার্থীদের চলাফেরার জন্য এসকেলেটর ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এসকেলেটর ব্যবহারের সুবিধা থাকলেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাথমিকভাবে কিছুটা উত্তেজনা কাজ করতে পারে। ফলে তারা যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে এসকেলেটরে ওঠানামা করার বিষয়টি মেনে চলতে না পারলে বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হবে।
সরকারি বিজ্ঞান কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সমপ্রসারণ প্রকল্প গত বছর মার্চে একনেকে পাস হওয়ার সময় এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৮০৫ কোটি টাকা। হঠাৎ করে ১০তলা ভবনে এসকেলেটর বসানো, ভবনের নকশা পরিবর্তনসহ আরো কিছু পরিবর্তন করে প্রকল্পের ব্যয় দ্বিগুণের চেয়ে বেশি অর্থাৎ ১১০ ভাগ বেড়ে তা দাঁড়ায় ৩৭৯২ কোটি টাকায়। এত ব্যয় বাড়ার কারণ জানতে চায় পরিকল্পনা কমিশন। বাস্তবায়নকারী সংস্থা জানান, ২০০ কলেজের মধ্যে সারা দেশে ৬৭টি কলেজে এসকেলেটর বসানোর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৫৪ কোটি টাকা। এজন্য প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে গেছে। কমিশন মাধ্যমিক স্কুলে এসকেলেটর প্রকল্পের মতো নতুন এই প্রকল্প নিয়েও প্রশ্ন তুলে পরিকল্পনা কমিশন বলে, পুরো প্রকল্পটি মূলত বিজ্ঞান শিক্ষার সমপ্রসারণের জন্য। বিলাসিতার মতো এখানে এসকেলেটর আনার কী প্রয়োজন। তবে শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা কমিশন ১০ তলা ভবনগুলোতে এসকেলেটর না দিয়ে প্রথম তিন তলা এবং উপরের তিন তলা বাদে বাকি ৪ তলায় এসকেলেটর বসাতে কী পরিমাণ অর্থ খরচ হবে তা জানতে চেয়েছে। এরপর বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা হবে। তারপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় একবারে এসকেলেটর বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status