শেষের পাতা

কাশিমপুর কারাগারে অর্থ লুটপাটের অভিযোগ

স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর থেকে

২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, মঙ্গলবার, ৯:২২ পূর্বাহ্ন

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নিয়ন্ত্রণাধীন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে খাদ্য সরবরাহের নানা অনিয়ম করে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কারা অনুবিভাগ) ও কারা অধিদপ্তরের মহাকারাপরিদর্শকের দপ্তরে আলাদা অভিযোগ দেয়া হয়েছে। অবশ্য দরপত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারা কর্তৃপক্ষ বলছেন, একটি সিন্ডিকেট তাদের অনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে না পেরে মিথ্যা অভিযোগ তুলে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে।

অভিযোগে জানা যায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এই বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে বন্দিদের জন্য মুসুর ডাল সরবরাহের উদ্দেশ্যে গত মার্চ মাসে দরপত্র অনুষ্ঠিত হয়। এই দরপত্রে এস এম এন্টারপ্রাইজ প্রতি কেজি মুসুর ডাল মাত্র ৪৬ টাকা ২৪ পয়সা দর প্রস্তাব করে। যা থেকে আয়কর, পরিবহন, ভ্যাট, অন্যান্য খরচ বাবদ ১৫ শতাংশ খরচ বাদ দিলে প্রকৃত মূল্য দাঁড়ায় মাত্র ৩৯ টাকা ৩৮ পয়সা। যেখানে বর্তমানে প্রতি কেজি মুসুর ডালের পাইকারি দর ৬০ থেকে ৭০ টাকা। এই সময়ে বন্দিদের মোট চাহিদা মতে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৪০০ কেজি মুসুর ডাল সরবরাহ বাবদ ঠিকাদার মোট বিল গ্রহণ করবে ১ কোটি ২৭ লাখ ৬০ হাজার ১০৮ টাকা। বাজার দর থেকে অনেক কম দর দেখিয়ে প্রকৃতপক্ষে এখানে বন্দিদের প্রাপ্য ডাল থেকে বঞ্চিত করে নামমাত্র ডাল সরবরাহ করে পুরো বিলের টাকা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ভাগ-বাটোয়ারা করার উদ্দেশ্যেই ঠিকাদার নিম্নদর প্রস্তাব করেছে। এ বিষয়টি তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন জানানো হয়েছে। অপর একটি অভিযোগে বলা হয়েছে, ঢাকার চকবাজারের পিতা আইয়ুব খানের মালিকানাধীন আইয়ুব আলী ট্রেডার্স, ছেলে ইয়াহিয়া খানের মালিকানাধীন ইয়াহিয়া এন্টারপ্রাইজ, অপর ছেলে সোলায়মান (ভুট্টো) মালিকানাধীন এস এম এন্টারপ্রাইজ, আইয়ুব খানের শ্যালক ঢাকার রাজ নারায়াণ ধর রোডের আলমগীর হোসেনের মালিকানাধীন রাজ ট্রেডিং মেডিসিন কর্নার ও ঢাকার চকবাজার এলাকার জামাতা আনোয়ার হাজীর মালিকানাধীন দিল এন্টারপ্রাইজ একই পরিবারভুক্ত একটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে কারাগারে কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের দরপত্রে দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের অর্থ লুটপাট হয়েছে। এই ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন দরদাতাদের কাজ না দিয়ে ওই সিন্ডিকেটকে উচ্চ দরে কাজ দেয়া হয়েছে। চক্রটি বিভিন্নভাবে কারাগারে ভুয়া বিলের মাধ্যমে ভাগ-ভাটোয়ারা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বর্ণিত টেন্ডারসমূহ  পুনঃনিরীক্ষার জন্য আবেদন জানানো হয়। এই আবেদন দু’টিতে নিরাপত্তাজনিত কারণে অভিযোগকারীর নাম গোপন রাখার জন্য বিশেষ অনুরোধ করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত টেন্ডার কার্যক্রমে অংশ নিয়ে ডাল সরবরাহের ক্ষেত্রে কার্যাদেশ প্রাপ্তির পর যথাসময়ে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান চুক্তিবদ্ধ না হয়ে কালক্ষেপণ করার মাধ্যমে দুর্যোগপূর্ণ সময় খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়। এতে কারা কর্তৃপক্ষ সরকারি অর্থের ক্ষতিসাধনপূর্বক উচ্চ মূল্যে ক্রয় করে। তদুপরি ওই সিন্ডিকেট সদস্যগণের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, অধিকন্তু আলোচ্য টেন্ডারে তাদেরকে সুবিধা প্রদান করা হয়। যা নিঃসন্দেহে অনৈতিক কার্যক্রমের অংশ। তবে একজন ঠিকাদারের অপর একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে গাজীপুর জেলার কাশিমপুর কারা ক্যাম্পাসে অবস্থিত কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার ১, ২, মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার ও হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে চলতি বছরের জুলাই থেকে বিভিন্ন প্রকার খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ টেন্ডার কার্যক্রমে দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়। এর প্রেক্ষিতে সরকারের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ সিপিটিইউ’র রিভিউ প্যানেল-২ এর পর্যালোচনায় দেখা যায়, অভিযোগের বিবাদী দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি তাদের কাজটি সুষ্ঠুভাবে করতে পারেনি। দরপত্র উন্মুক্তকরণের সময় মাত্র একজন দরদাতা উপস্থিত ছিলেন, যা দরপত্রদাতাদের পক্ষ থেকে ক্রয়কারী কর্তৃপক্ষের প্রতি অনাস্থারই বহিঃপ্রকাশ। অতি তুচ্ছ কারণে কয়েকজন দরদাতাকে নন রেস্পন্সিভ ঘোষণা করেছেন। মূল্যায়ন কমিটি স্বচ্ছতা ও পক্ষপাতহীনভাবে দরপত্র মূল্যায়ন করেছেন বলে মনে হয় না। তারা কারিগরি মূল্যায়ন এবং বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক মূল্যায়নকে একই সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে যে তুলনামূলক তালিকা প্রস্তুত করেছেন সেখানে ক্ষেত্রবিশেষে কোনো বিষয়কে মুখ্য বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেছেন। মোট ১১ জনের মধ্যে ৯ জনকে নন রেস্পন্সিভ করে তারা প্রতিযোগিতা সীমিত করতে সহায়তা করেছেন। তাছাড়া যে দুইজনকে রেস্পন্সিভ দরদাতা ঘোষণা করা হয়েছে তারা পরস্পর পিতা ও পুত্র। তাদের বাজার দর ক্ষেত্রবিশেষে গত জুনে দেয়া দর অপেক্ষা অনেক বেশি দেখা যায়। দরপত্র আহ্বানের সময় বাজার দর সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন তারা আমলে নেননি। বাদীকে কারিগরি মূল্যায়নের নন রেস্পন্সিভ করা হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি তুলনামূলক বিবরণীতে তারা তুলে ধরেননি। কাজেই তাদের মূল্যায়ন পক্ষপাত দোষে দুষ্ট বলে প্রতীয়মান হয়। অপরদিকে বাদী যথাসময়ে আবেদন করতে সমর্থ হয়নি। তাই কোনোক্রমেই তার আবেদন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। পর্যালোচনায় আরো উল্লেখ করা হয়, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির দরপত্র প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও পক্ষপাতহীনভাবে মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়নি বলে বর্তমান অভিযোগের সূত্রপাত ঘটেছে বলে অত্র প্যানেল মনে করে। কারাবন্দিদের খাদ্য সরবরাহ অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল এবং দৈনন্দিন খাদ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে কারাবন্দিদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে বিধায় কারা কর্তৃপক্ষকে ভবিষ্যতে অত্যন্ত সতর্ক ভাবে কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়ন সম্পন্ন করার নির্দেশ দেয়া যায়। এই দীর্ঘ পর্যালোচনা শেষে রিভিউ প্যানেল তিনটি আদেশ দেয়। যেগুলো হলো- বাদীর আবেদন নামঞ্জুর করা হয়। ক্রয়কারী কর্তৃপক্ষ ও ক্ষয়কারী অফিস প্রধানকে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, সম আচরণ ও পক্ষপাতহীন ভাবে পরবর্তীতে বর্তমান দরপত্রের মেয়াদান্তে এক ধাপ ২ খামবিশিষ্ট পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বানের নির্দেশনা প্রদান করা হলো। বাদীর নিরাপত্তা জামানতের টাকা যা সিপিটিইউ’র নিকট জমা আছে, তা উঠিয়ে নিতে পারবেন। এই পর্যালোচনায় ও আদেশে রিভিউ প্যানেল-২ এর চেয়ারম্যানসহ আরো দু’জন সদস্যের স্বাক্ষর রয়েছে।

এদিকে দরপত্রে নানা অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ক্রয় কমিটির সভাপতি কারা উপ-মহাপরিদর্শক তৌহিদুল ইসলাম জানান, কোনো ধরনের অনিয়ম বা ভাগ-বাটোয়ারার অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা। কারাগারে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের বিষয়ে একটি সিন্ডিকেট অনৈতিকভাবে টেন্ডার কার্যক্রমে সুবিধা নিতে না পেরে এ ধরনের মিথ্যা অভিযোগ তুলছে। বরং ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা অতীতে বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে সুবিধা নিয়েছে এবং নেয়ার চেষ্টা করছে। তাদের কাগজপত্রের ত্রুটি ও নানা কারণেই দরপত্র মূল্যায়নে যোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। শুধুমাত্র সর্বনিম্ন দরদাতা দরপত্রের শর্ত নয়। অনেকগুলো শর্ত পূরণের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়। ওই শর্তগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়া চক্র কারা বিভাগের মান ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। যা মোটেও কাম্য নয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status