শেষের পাতা

সিলেট এমসি কলেজ ঐতিহ্য হাইজ্যাকের পর ধর্ষকের আস্তানা

শামীমুল হক

২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, সোমবার, ৯:৩৭ পূর্বাহ্ন

আফসোস। এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের ঐতিহ্য হাইজ্যাক হয়েছে বহু আগেই। আর শুক্রবার রাতে ক্যাম্পাস হলো কলঙ্কিত। ধর্ষিতার রক্তে রঞ্জিত। আর ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজকে কলঙ্কিত করে রেকর্ড গড়লো ধর্ষকের দল। একদিকে গৃহবধূর ওপর গণধর্ষণ চলে, অন্যদিকে চলে ধর্ষকদের উল্লাস। ওরা বুভুক্ষু শকুনের দল। ওদের মাধ্যমেই শতবর্ষী এ কলেজে এই প্রথম গণধর্ষণের ঘটনা ঘটলো। গৃহবধূকে শখ করে তার স্বামী নিয়ে গিয়েছিলেন প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা ক্যাম্পাস দেখাতে। সৌন্দর্য দেখতে গিয়ে ফিরে এলেন কলঙ্কের দাগ নিয়ে। যে দাগ তাকে বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন। ধর্ষকরা তার স্বামীকে বেঁধে রেখে তার সামনেই যে গাড়ি নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলেন দম্পতি, সেই গাড়িতেই ধর্ষণ করে। শকুনদের উল্লাসে গৃহবধূর চিৎকার হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজ। সংক্ষেপে এমসি কলেজ। এ নামেই পরিচিত দেশজুড়ে। এ ছাত্রাবাসের অনেক ঐতিহ্য ছিল। যার অন্যতম ছিল সম্পূর্ণভাবে মেধার ভিত্তিতে আবাসিক শিক্ষার্থী নির্বাচন। কিন্তু আজ তা স্মৃতির অতীত। আজ মেধাবীদের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে ধর্ষকরা। ঐতিহ্য তো হাইজ্যাক হয়েছে সেদিনই। ২০১২ সালের ৮ই জুলাই। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সেদিন ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাসের ৪২টি কক্ষ দাউ দাউ কওে আগুনে পুড়েছিল। এর সঙ্গে পুড়ে ছাই হয় ছাত্রাবাসের ধারাবাহিক সুনাম-নিয়ম, কানুন সবই। সেদিন থেকেই জেঁকে বসে অশুভ ছায়া। এরপর ২০১৬ সালের ৪ঠা অক্টোবর ঘটে নির্মম আরেক ঘটনা। এক তরফা প্রেমে সাড়া না দেয়ায় ছাত্রলীগ নেতা বদরুল এই কলেজেরই শিক্ষার্থী খাদিজাকে প্রকাশ্যে দিবালোকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে ক্যাম্পাস। আর শুক্রবার রাতে লাগে কলঙ্কের দাগ।
ইতিহাস কী বলে একটু দেখে আসা যাক। যুগের পর যুগ ধরে দুই ক্যাটাগরিতে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে শিক্ষার্থী ভর্তি হতো। প্রথমত, একাদশে। দ্বিতীয়ত, অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মেধাবীরা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কলেজটিতে ভর্তির অধিকার পেতেন। আর ছাত্রাবাসে বোর্ডার নির্বাচনের বিষয়টি বরাবরই স্বতন্ত্র ছিল। ছাত্রাবাসের আবাসিক শিক্ষার্থী হতে আবেদনকারী প্রত্যেককে ব্লক সুপার বা তত্ত্বাবধায়কের নেতৃত্বাধীন একটি ভাইভা বোর্ডের মুখোমুখি হতে হতো। ওই সাক্ষাৎকারে মূলত আবেদনকারীকে ফিজিক্যালি দেখা হতো। তার এসএসসি’র নম্বরপত্রের কপি ভাইভাকালে প্রদর্শন করতে হতো। এসএসসি’র রেজাল্ট এবং কলেজে ভর্তির পর থেকে ক্লাসে উপস্থিতি, আচার-ব্যবহারের বিষয়টি ভর্তির ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হতো। অনার্স প্রথমবর্ষের ফল প্রকাশের পরপরই ছাত্রাবাসে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনার্স থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত নির্ধারিত সেশনের কয়েক বছরের জন্য ভর্তির আবেদন চাওয়া হতো। সে ক্ষেত্রে এসএসসি, এইচএসসি এবং অনার্স প্রথমবর্ষের রেজাল্ট বিবেচনায় সিট বরাদ্দ হতো। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো মেধাবী শিক্ষার্থীদের কাছে টানতে। বিশেষ করে ছাত্রাবাসের ভর্তি পরীক্ষায় কারা আবেদন করেছে, কারা কোন ব্লকের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে যাচ্ছে- সেদিকে নজর রাখতো দলগুলো। শুধু তা-ই নয়, ছাত্রাবাস পরিচালনা বিশেষত শৃঙ্খলা রক্ষা এবং ক্যান্টিন ব্যবস্থাপনায় ছাত্রাবাসের ৬টি ব্লকে ৬ জন প্রিফিক্স মানে ছাত্রাধিনায়ক মনোনীত করতো কলেজ প্রশাসন। বোর্ডারদের দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ, বোঝাপড়া ছিল তাদের দায়িত্ব। মর্যাদাপূর্ণ ওই পদধারীর জন্য এয়ার মার্কড সিঙ্গেল রুমটি ছিল বরাদ্দ। রুমের সামনে প্রশাসনের খরচে নেমপ্লেট লাগানো হতো ওই শিক্ষার্থীর। প্রিফেক্ট হিসেবে অনার বোর্ডেও তার নামটি স্থান পেতো। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে প্রিফেক্টশিপ পেতে প্রতিযোগিতা হতো। ধরা যাক, প্রথম ব্লকে অনার্সে ৪ জন মেধাবী ভর্তির সুযোগ পেলেন। একজন ইংরেজি, একজন গণিত, একজন রসায়ন এবং একজন অর্থনীতিতে পড়ছেন। এসএসসি, এইচএসসি এবং অনার্স প্রথমবর্ষ ৩টি পরীক্ষায় তাদের প্রাপ্ত নম্বর প্রায় কাছাকাছি। চারজনই অনার্স ফাইনালে ভালো করলেন। মাস্টার্সে ভর্তির পর তাদের মধ্য থেকে একজন প্রিফেক্ট হবেন। তাদের নম্বরপত্র বিবেচনায় ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক বিষয়টি চূড়ান্ত করবেন। এসএসসি, এইচএসসি এবং অনার্স মিলে যার প্রাপ্ত নম্বর সর্বোচ্চ, তিনিই প্রিফেক্ট হবেন, অর্থাৎ প্রশাসন নোটিশ দিয়ে তাকে ছাত্রাধিনায়ক ঘোষণা করবে। এ ক্ষেত্রেও মেধা বা একাডেমিক পরীক্ষার রেজাল্টই প্রাধান্য পেতো। এ ঐতিহ্য এখন হাইজ্যাক হয়ে গেছে। এখন রাজনৈতিক তদবিরে হচ্ছে সবকিছু। কলেজ প্রশাসন, বিশেষ করে ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়কদের দাবি তারা নাকি অসহায়। মেধাবীর বদলে এখন ধর্ষকের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে ছাত্রাবাস। এর প্রমাণ শুক্রবার রাতের গণধর্ষণের ঘটনাই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বুভুক্ষু শকুনের দলের নিয়ন্ত্রণ থেকে ছাত্রাবাসগুলো উদ্ধার করে আগের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনলে হয়তো ওদের হাত থেকে নিস্তার সম্ভব।
এমসি কলেজের শতবর্ষী ছাত্রাবাস আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার পর সরকারের তরফ থেকে উপহারস্বরূপ দেয়া হয়েছিল নতুন এই ছাত্রাবাস। এর অবস্থান ছাত্রাবাসের একেবারে পেছনে। নির্জন টিলাময় ভূমি। টিলার পাদদেশেই নির্মাণ করা হয়েছে চার তলার ভবন। সন্ধ্যা নামলেই নির্জন হয়ে পড়ে ওই হোস্টেল এলাকা। আলো নেই আশেপাশেও। ফলে অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকে এলাকা। আর এই হোস্টেলের সামনেই এমসি কলেজের কলঙ্কময় ইতিহাস রচিত হলো। এমন ঘটনা কখনোই এমসি কলেজে ঘটেনি। পাহাড়, টিলার আবরণে বেষ্টিত এমসির ক্যাম্পাস। সেই বৃটিশ আমলের কলেজ। অনেক স্মৃতি এই কলেজের। এ কারণে বিকাল হলেই ক্যাম্পাসে ঘুরতে যান অনেকেই। এর মধ্যে বেশির ভাগই যান প্রাক্তন শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাসে ঘুরে স্মৃতি রোমন্থন করেন তারা। নব দম্পতিও গিয়েছিল অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে। করোনায় কলেজ বন্ধ। হোস্টেলও বন্ধ। কিন্তু ছাত্রাবাস বন্ধ করা হলেও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কেউ কেউ হোস্টেল ছাড়েনি। এই ছাত্রাবাসের নিয়ন্ত্রক ছিল ছাত্রলীগ নেতা সাইফুর ও রনি। বন্ধ হোস্টেলের বিভিন্ন রুম দখল করে রেখেছিল তারা। সন্ধ্যা নামলেই আসতো বহিরাগতরা। তারা সবাই গিয়ে একত্রিত হতো নতুন ভবনের ২০৫ নম্বর কক্ষে। কখনো কখনো তারা হোস্টেলের বাইরের নির্জন জায়গায় অবস্থান নিতো।
মধ্যরাত পর্যন্ত চলতো তাদের আড্ডা, মস্তি। আসতো নারীও। সাইফুর, রনি ছাড়াও রবিউল, অর্জুন, তারেকুল, মাসুমও ছিল আড্ডার মধ্যমণি। তারা হোস্টেলকে মাদকের আখড়ায় পরিণত করেছে। এর মধ্যে রনির পুরো নাম শাহ মাহবুবুর রহমান রনি। সে এখন এমসি কলেজের ছাত্র নয়। মাস্টার্স পাস করেছে গত বছর। এরপরও সে এমসি কলেজের নতুন বিল্ডিংয়ের ২০৫ নম্বর কক্ষটি দখলে রেখেছে। তার কক্ষে বসেই মাদকের আসর বসাতো বহিরাগত ছাত্রলীগ কর্মীরা। করোনাকালে নারীদের যাতায়াত ছিল এই রুমে। পুরাতন ছাত্রাবাসের ৪ নম্বর ব্লকে একটি শিক্ষক বাংলো ছিল। ওই বাংলো সাইফুর রহমানের দখলে। সাইফুর অনার্স পাস করেছে এমসি কলেজ থেকেই। শুক্রবার রাতে ধর্ষণের ঘটনাটি তারই নেতৃত্বে ঘটেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। প্রথমেই জোরপূর্বক ওই বধূকে নিয়ে সাইফুরই ধর্ষণ করে। সাইফুরের কক্ষ থেকে পুলিশ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র পেয়েছে। ধর্ষক মাহফুজুর রহমান মাহফুজও এমসি কলেজের শিক্ষার্থী। সে হোস্টেলে থাকতো। রবিউল আগে শিক্ষার্থী ছিল। এখন সে হল দখল করে আছে। অর্জুন ও তারেক বহিরাগত। এমসি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর সালেহ উদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, হোস্টেল থেকে ওদের বার বার তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আবার হোস্টেলেই বসবাস শুরু করে। তার এ কথায় অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। তিনি জানান, ‘ধর্ষণের ঘটনার পর আমরা এখন ওই হোস্টেলটিকে সিলগালা করে দেবো। কাউকে সেখানে বসবাস করতে কিংবা ঢুকতে দেয়া হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এখন সিলগালা করে লাভ কি? কলেজ হোস্টেল বন্ধ থাকার পরও তারা কীভাবে সেখানে থাকতে পারে? এখানে কলেজ প্রশাসন এতো উদার কেন হলো? তাদের উদারতায় কলঙ্কিত হলো এমসি কলেজ ক্যাম্পাস। কলঙ্কের দাগ নিয়ে ফিরে গেল ওই গৃহবধূ। তার স্বামী নিজ চোখে দেখলো স্ত্রীকে ধর্ষণের দৃশ্য। এসব কিছুই হয়তো হতো না। যদি আগের সেই ঐতিহ্য অনুযায়ী ছাত্রাবাসে বোর্ডার নেয়া হতো। প্রিফেক্ট বানানো হতো। এসব বুভুক্ষু শকুনের দলের নিয়ন্ত্রণ থেকে ছাত্রাবাসগুলো উদ্ধার করে আগের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনলে হয়তো ওদের হাত থেকে নিস্তার সম্ভব।

শুক্রবারের ন্যক্কারজনক ঘটনার পর জালালাবাদ এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি সিএম তোফায়েল সামী তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ৬০ বছর পূর্বে আমি এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের ছাত্র। আমি লজ্জিত। আমি জোড় হাতে প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করছি আপনারা কঠোর হয়ে এদের ধরেন। আমি আইন বহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে। কিন্তু এই ব্যাপারে এদের ঢ-ভরৎব দিলে দেশবাসীর সমর্থন এবং ভালোবাসা আপনারা পাবেন। এরা আমার ঐতিহ্যবাহী কলেজকে কলঙ্কিত করেছে। সিলেটকে কলুষিত করেছে।
কয়েক বছর পূর্বে এদের বড় ভাইরা কলেজের ১নং ছাত্রাবাস  পুড়িয়ে দিয়েছিল। আমরা ৪৯ জন প্রাক্তন ছাত্র বিবৃতি দিয়ে এদের শাস্তি দাবি করেছিলাম। এর মধ্যে জনাব এমবি চৌধুরী সাহেবও ছিলেন। আমি নিজে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী জনাব এএমএ মুহিত ও তৎকালীন  শিক্ষামন্ত্রী জনাব নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। নাহিদ সাহেব ও মুহিত ভাই অনেক চেষ্টা করলেও  প্রকৃত আসামিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই সমাজ বিরোধীদের হাত অনেক লম্বা। আমাদের সমাজে দিন দিন করোনার মতো ধর্ষণ বেড়ে গেছে। টেলিভিশন খুললেই দেখি- ধর্ষণ,  হত্যা, খুনোখুনি, অবৈধ সম্পদ, দুর্নীতি এই সব। আমরা যারা জীবনের পড়ন্ত বেলায় আছি আমরা কি দেখে যেতে পারবো না একটা সুন্দর বাংলাদেশ। আমরা কি রেখে যাচ্ছি আমাদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিদের জন্য।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status