শেষের পাতা

গার্ডিয়ানে শেখ হাসিনার নিবন্ধ

বিশ্বকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান

মানবজমিন ডেস্ক

২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৯:২৪ পূর্বাহ্ন

গত মাসে আমার দেশের এক-তৃতীয়াংশ পানির নিচে ছিল। শুরু হয়েছিল প্রায় এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভারি বর্ষণ, যা এখনো কমেনি। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ১৫ লাখের বেশি বাংলাদেশি; ভেসে গেছে হাজার হাজার হেক্টর ধানের জমি। চলতি বছর আমার লাখো দেশবাসীর খাদ্য ত্রাণ প্রয়োজন। আফসোস, দুর্যোগ কখনো একা আঘাত করে না। মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের বিস্তৃত ধ্বংসযজ্ঞের সময় আঘাত হানা বন্যা দেশে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ কঠিন করে তুলেছে। ২৪ লাখের বেশি মানুষকে, কোভিড-১৯ এর অধিকতর ঝুঁকির মুখে না ফেলে, আম্ফানের ধ্বংসাত্মক পথ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সংক্রমণ ও মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণে আনার পরও, একটি অব্যর্থ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে। অর্থনৈতিক লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের পোশাক শিল্প। আমাদের লাখ লাখ প্রবাসী শ্রমিকদের দেশে ফিরতে বাধ্য করেছে। তাদের বেশির ভাগই এখন বেকার অবস্থায় আছে।
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা অন্যান্য বহু দেশের মতো বাংলাদেশও জীবন বাঁচানোর, স্বাস্থসেবা উন্নত করার এবং আর্থিক ধস এড়িয়ে লাখো মানুষের জন্য অর্থনৈতিক আঘাত কমানোর চেষ্টা করছে।

কিন্তু এটা কোনো সাহায্যের আবেদন নয়, এটা সতর্কতা। কারণ, অন্যান্য অনেক দেশ জলবায়ু সংকটের কম ঝুঁকিতে থাকলেও, তারা এর বিধ্বংসী শক্তি বেশিদিন এড়িয়ে যেতে পারবে না। আমার দেশের চেয়ে বেশি ভাগ্যবান দেশগুলোর ভালো করে দেখা উচিত আমরা কিসের সঙ্গে লড়ছি। গবেষণা অনুসারে, এই শতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বাড়তে থাকা সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা লাখ লাখ মানুষকে নিচু উপকূলীয় শহরগুলো ছেড়ে যেতে বাধ্য করবে। বৈশ্বিক সম্প্রদায় কি এই বিপর্যয় এড়ানোর জন্য যথাসময়ে পদক্ষেপ নেবে?

আমাদের জলবায়ু সংকট ও কোভিড-১৯ বৈশ্বিক হুমকি। উভয়ই অননুমেয়, আর আমরা এগুলোর ঝুঁকি কমাতে আরো অনেক কিছু করতে পারতাম- করা উচিত ছিল। কিন্তু এখন সংকটগুলো আমাদের ধরে বসেছে। এখন এগুলো মোকাবিলায় আমাদের সবচেয়ে ভালো উপায়, নিশ্চিতভাবেই সমন্বিত আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে।
জলবায়ু সংকট ও করোনা মহামারি উভয়েই অনেক শাখা-প্রশাখা সংবলিত জটিল সমস্যা। সামগ্রিকভাবে এগুলোর না করলে, একেবারেই করা হবে না। করোনা মহামারি অন্যত্র বাড়তে দিয়ে, কেবল এক দেশের জন্য শত শত কোটি ডলার খরচ করে কোভিড-১৯ এর টিকা নিশ্চিত করা অহেতুক হবে। একইভাবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ তাদের কার্বন নির্গমন কমালে ও আরো টেকসই অর্থনীতি গড়লেও কোনো লাভ হবে না, যদি বিশ্বের বড় কার্বন নির্গমনকারীরাও একই পদক্ষেপ না নেয়।
বৈশ্বিক গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমনের ৮০ শতাংশের জন্য দায়ী জি-২০ সদস্য দেশগুলো। অন্যদিকে নিচের দিকের ১০০ দেশগুলো থেকে নির্গমন হয় মাত্র ৩.৫ শতাংশ গ্যাস। সকলের একত্রিত পদক্ষেপ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন সফলভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।

বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ ও এর সবচেয়ে অনিষ্টকর প্রভাব সীমিত করার ক্ষেত্রে এখনো আমাদের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা হচ্ছে ২০১৫ প্যারিস জলবায়ু চুক্তি। এখন অবধি ১৮৯টি দেশ এই চুক্তির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে কম রাখতে, শিল্প-পূর্ববর্তী পর্যায়ে নিতে ও সম্ভব হলে ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে রাখার চেষ্টা করতে সামগ্রিকভাবে কার্বন নির্গমন কমানোর অঙ্গীকার করেছে। সর্বশেষ, আরো উচ্চাকাঙ্ক্ষী একটি লক্ষ্যের প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ)-বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে বাংলাদেশসহ এমন ৪৮টি দেশের একটি সংস্থা, যেটির সভাপতি আমি। সিভিএফ সদস্য দেশগুলো জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ও জলবায়ু পরিবর্তনের একেবারে সম্মুখভাগে রয়েছে। দেশগুলো ঘূর্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে শক্তিশালী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি থেকে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে ম্যানগ্রোভ বনায়নের মতো পদক্ষেপের প্রচারণা চালাচ্ছে। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে এসব পদক্ষেপ ছড়িয়ে দিতে চলতি মাসে ঢাকায় একটি কার্যালয় খুলতে যাচ্ছে গ্লোবাল সেন্টার অন এডাপশন।

বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র ও জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো আমাদের পক্ষের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০২০ অনুসারে, আফ্রিকার ৪৩টি এবং এশিয়া ও লাতিন আমেরিকাজুড়ে আরো অনেক দেশ আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় স্থাপিত লক্ষ্য অর্জন করেছে। ধনী বিশ্ব তা করেনি। জলবায়ু অভিযোজনের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, আন্তর্জাতিক অর্থায়নের পরিমাণ তার চেয়ে অনেক কম। এ ছাড়া, আরো বড় নেতৃত্ব, বিশ্বসেরা প্রযুক্তি, অগ্রণী গবেষণা, যেগুলো আজ অবধি বহু চমৎকার সমাধান দিয়েছে, সেগুলো ব্যতিত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নতুন, আরো উচ্চাকাঙ্ক্ষী পদক্ষেপ সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম।

আমরা যদি আমাদের প্রয়াস না বাড়াই, তাহলে আমরা সবাই হেরে যাবো। বিশ্বের যথাসম্ভব দেশ ও প্রতিষ্ঠানের উচিত নিম্ন-কার্বন সমাধান ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমানোর প্রতিশ্রুতি করা। আরো টেকসই, কার্যকরী ও প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি গড়ার সেরা উপায় এটি। নিম্ন-কার্বন স্থিতিস্থাপক কোনো বিশ্বের বাণিজ্যিক সহযোগীর মাধ্যমে আমরা সবাই লাভবান হবো। নিশ্চিতভাবেই এর বিকল্প কেউ চায় না- ভঙ্গুর একটি বৈশ্বিক শৃঙ্খলা, যেখানে ধনী দেশগুলোও জলবায়ু পরিবর্তনের ধ্বংসাত্মক শক্তি দিয়ে জীর্ণ হয়ে পড়বে।
জলবায়ু সংকট, কোভিড-১৯ ও এর অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব ও সহযোগিতা অপরিহার্য। এমন সময়ে বিশ্বের কোনো দেশেরই বাকি দেশগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া উচিত নয়। পরবর্তী ‘ইউএন ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস’-এ দেশগুলোকে তাদের জাতীয় পরিসরে নির্ধারিত পদক্ষেপ বৃদ্ধির অঙ্গীকার করতে হবে এবং চূড়ান্তভাবে, আমাদের সামগ্রিক অস্তিত্বকে প্রভাবিত করে এমন অন্যান্য সকল সমস্যা মোকাবিলায় আশা জাগাতে হবে।
(২২শে সেপ্টেম্বর দ্য গার্ডিয়ানের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত নিবন্ধের ভাবানুবাদ)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status