অনলাইন

ব্রুনাইয়ে জিম্মিদশা থেকে যেভাবে ফিরে এলো কাউসার

লালমাই (কুমিল্লা) প্রতিনিধি

২১ সেপ্টেম্বর ২০২০, সোমবার, ১০:১১ পূর্বাহ্ন

‘ব্রুনাইয়ে বাংলাদেশী মানবপাচারকারীরা আমাকে জিম্মি করে নির্যাতন করেছে। তারা আমার পাসপোর্ট নিয়ে গেছে। আমার পরিবার থেকে তাদের পরিবারের লোকজন অতিরিক্ত টাকা নিয়েছে। ব্রুনাইয়ে আমার আপন বলতে কেউ ছিল না। অনেকদিন না খেয়ে ছিলাম। দেশে ফিরতে পারব বলে মনে হয়নি। শুধুমাত্র লালমাই থানার ওসি মোহাম্মদ আইয়ুব স্যারের পরামর্শ, সহায়তা ও পদক্ষেপেই ব্রুনাই দূতাবাসের মাধ্যমে আমি আইনি প্রক্রিয়ায় দেশে ফিরতে পেরেছি। প্রাণে বেঁচে যেহেতু পরিবারের কাছে ফিরতে পেরেছি আমি আইনিভাবে মানবপাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে লড়ে যাব। আর যেন কেউ আমার মত প্রবাসে গিয়ে জিম্মি না হয়।’
সোমবার সকালে মানবজমিন কে এসব কথা বলেন ব্রুনাইয়ের মানবপাচারকারী চক্রের জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে আসা লালমাই উপজেলার পেরুল দক্ষিণ ইউনিয়নের খলিলপুর গ্রামের আকতার হোসেনের ছেলে মো: আবু কাউসার ।
জানা যায়, লালমাই উপজেলার পেরুল দক্ষিণ ইউনিয়নের সমেষপুর গ্রামের সামছুল হকের ছেলে ব্রুনাই প্রবাসী সাইফুদ্দিন টুটুল (৩০) তার স্কুল জীবনের বন্ধু  খলিলপুর গ্রামের ব্যবসায়ী আকতার হোসেনের ছেলে মো: আবু কাউসার (৩০) কে গত বছরের মাঝামাঝি ৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকায় ব্রুনাই যাওয়ার প্রস্তাব দেয় এবং ভাল চাকরি ও মাসিক ৫০ হাজার টাকা বেতনের প্রলোভন দেখায়। লোভনীয় প্রস্তাবে কাউসারের পরিবার একমত হয়ে টুটুলের পরিবারকে ২০১৯ সালের ২২ জুলাই ডাচ বাংলা ব্যাংকের মাধ্যমে ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা, ২২ আগস্ট ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা ও পরবর্তীতে সরাসরি নগদ ১০ হাজার টাকা দেয়।
ব্রুনাইয়ের উদ্দেশ্যে গতবছরের ১০ নভেম্বর সকালে শাহ জালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দর থেকে ব্যর্থ হয়ে টুটুলের সিদ্ধান্তে কাউসারকে ভারতের কলকাতা পাঠানো হয়। সেখান থেকেও ব্যর্থ হয়ে সর্বশেষ রাজস্থানের জয়পুর বিমানবন্দরের মাধ্যমে কাউসার ব্রুনাই দারুসসালাম পৌঁছে। ব্রুনাই পৌঁছানোর পর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী দালাল টুটুল কাউসারের পাসপোর্ট কেড়ে নেয়। কয়েকদিন পর ভাল চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বাড়ী থেকে আরো ২ লক্ষ টাকা নিয়ে দেওয়ার জন্য কাউসারকে চাপ সৃষ্টি করে। ছেলের ভাল চাকরির আশায় কাউসারের পিতা আকতার হোসেন এবছরের ১২ ফেব্রুয়ারি টুটুলের মাতা আকলিমা বেগমকে নগদ ১ লক্ষ টাকা, ২০ ফেব্রুয়ারি টুটুলের পিতাকে নগদ ১ লক্ষ টাকা দেন। বাড়তি টাকা দেওয়ার পরও কাউসারকে পাসপোর্ট ফিরিয়ে দেয়নি টুটুল। কোন চাকরিও ঠিক করে দেয়নি । বরং ২ লক্ষ টাকা ফেরত চাওয়ায় টুটুল তার ছোট ভাই শিহাব, বন্ধু স্বপন ও রাকিবকে দিয়ে কাউসারকে নির্যাতন করে। পরবর্তীতে কাউসার ব্রুনাইয়ে অবস্থানরত অন্যান্য বাংলাদেশীদের পরামর্শে বাংলাদেশী হাই কমিশনের শ্রম উইং-এ টুটুলের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও মানবপাচারের ঘটনায় লিখিত অভিযোগ করেন। এরই প্রেক্ষিতে হাই কমিশনের প্রথম সচিব (শ্রম) জিলাল হোসেন তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পান এবং তখন টুটুলও হাই কমিশনে উপস্থিত হয়ে সকল অভিযোগ স্বীকার করেন। কমিশন টুটুলকে কাউসারের পাসপোর্ট ও ২ লক্ষ টাকা ফিরিয়ে দিতে নির্দেশনা দিলেও টুটুল কিছুদিন দিবো-দিচ্ছি বলে আর দেয়নি। পরে কমিশনের কর্মকর্তারা কাউসারকে পরিবারের মাধ্যমে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিষয়টি জানাতে ও আইনগত ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী কাউসারের পিতা আকতার হোসেন বাদী হয়ে লালমাই থানায় গত ১৮ আগস্ট সাইফুদ্দিন টুটুল, ব্রুনাই অবস্থানরত তার ভাই সিহাব (২৫), বন্ধু লাকসামের কুন্দ্রা গ্রামের মৃত শফিউল্যাহ’র ছেলে স্বপন, টুটুলের মাতা আকলিমা বেগম ও পিতা সামছুল হকের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের ৬(২)/৭/৮(২) ধারায় একটি মামলা ( নং ০৬, তাং ১৮/০৮/২০২০ইং) দায়ের করেন।

তাৎক্ষনিক কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম বিপিএম (বার) পিপিএম মহোদয়ের নির্দেশে লালমাই থানার অফিচার্জ মোহাম্মদ আইয়ুব মামলার কপি ব্রুনাই দূতাবাসে প্রেরণ করেন এবং মামলার তদন্তভার সিআইডিতে ন্যস্ত করতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। মামলার কপি পেয়ে দূতাবাসের কর্মকর্তারা কাউসারকে পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিতে টুটুলদের উপর চাপ সৃষ্টি করেন।  

এছাড়া গতমাসে কাউসারের মামলায় টুটুলের বাবা সামছুল হক কুমিল্লার আদালতে হাজির হলে বিচারক তাকে জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন। খবর পেয়ে টুটুল মামলা নিষ্পত্তির আশায় কাউসারের সাথে যোগাযোগ করে এবং গত ১৬ সেপ্টেম্বর দূতাবাসের মাধ্যমে কাউসারকে পাসপোর্ট ফেরত দেয়। ১৯ সেপ্টেম্বর দুপুরে কাউসার ব্রুনাই থেকে দেশে ফিরে আসে। দীর্ঘ ১০ মাসের জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়ী ফিরে আসলে কাউসার কে বুকে জড়িয়ে ধরেন তার বাবা আকতার হোসেন।

ওই সময় আকতার হোসেন প্রতিজ্ঞা করে বলেন, অবৈধভাবে আর কখনো সন্তানকে বিদেশে পাঠাবো না। ছেলে আমার বুকে ফিরতে পারবে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। লালমাই থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ আইয়ুব স্যার আমার ছেলেকে দেশে ফিরাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। ওসি স্যারসহ পুলিশ প্রশাসনের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

লালমাই থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ আইয়ুব বলেন, ভিকটিম নিরাপদে দেশে ফিরেছে এটা মামলার প্রথম সফলতা। আজ (২১ সেপ্টেম্বর) ভিকটিম আদালতে হাজির হয়ে কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিবেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status