অনলাইন
লেবাননের বিভক্তি চায় ইসরাইল!
ড. মাহফুজ পারভেজ
২০ সেপ্টেম্বর ২০২০, রবিবার, ৬:০৫ পূর্বাহ্ন
আরব-বিশ্বের একটি অংশের সঙ্গে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের মৈত্রীর ফলে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত লেবাননের ভাগ্যাকাশে নেমে এসেছে কালো ছায়া। ইসরাইল তার পাশের লেবাননের ভূমি বারবার দখল করেছে। আবার নিজ দেশ থেকে লাখ লাখ আরব মুসলিমকে ঠেলে দিয়েছে লেবাননে। আর একমাত্র লেবানন থেকেই ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়ারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। ফলে লেবাননকে শায়েস্তা করতে ইসরাইল এবার ভিন্নপথে এগুচ্ছে। নানা মত ও গ্রুপে বিভক্ত লেবাননকে ভাগভাগি করার ফর্মুলা দিচ্ছে ইসরাইলপন্থি বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিবাদী কবি কাহলিল জিবরানের মাধ্যমে পরিচিত হলেও লেবানন হলো এমন এক প্রাচীন জনপদ, যার কথা ৭১ বার ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বর্তমানে যে খণ্ডিত দেশটি লেবানন নামে পরিচিত, তার জন্ম ১৯২০ সালে ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তির তত্ত্বাবধানে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমা শক্তিগুলো বিজয়ীর আসনে এসে বিশ্বের বহু দেশ ও জনপদকে খণ্ড-বিখণ্ড ও ভাগাভাগি করে নেয়।
এশিয়া, আফ্রিকার বহু দেশ এভাবে ইউরোপের নানা দেশের দখলে আসে। কিন্তু গত ১০০ বছরে লেবানন ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতার মুখ দেখলেও শান্তি ও স্থিতিশীলতার দেখা পায়নি। পুরো দেশ তো বটেই, রাজধানী বৈরুত পরিণত হয়েছে সংঘাতময়, রক্তাক্ত ও জ্বলন্ত শহরে। ইসরাইলি হামলা ও দখলদারিত্ব এবং নিজেদের মধ্যে লড়াই ও আন্তঃকলহ দেশটিকে বিশ্বের সবচেয়ে নাজুক, ভঙ্গুর, অস্থিতিশীল ও বিপজ্জনক স্থানে পরিণত করেছে।
লেবাননের অনেকটা ভূমিই ইসরাইলের জবরদখলে। বাকিটা খ্রিষ্টান, দ্রুজ, সুন্নি ও শিয়া মুসলিম গ্রুপগুলোর মধ্যে বিভক্ত। সবাইকে নিয়ে ফেডারেল ধরনের সরকার চালানোর বহু চেষ্টা করা হয়েছে লেবাননে। খ্রিষ্টান ও মুসলিমদের মধ্যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ভাগাভাগিও করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট খ্রিষ্টান হলে প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছে সুন্নি মুসলিম কাউকে আর স্পিকার শিয়া। অলিখিতভাবে এসব করেও শান্তি, স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্য রক্ষিত হয়নি দেশটিতে। নিজেদের বিভেদের কারণে ইহুদি আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধের একাট্টা হয়ে রাজনৈতিক বা সামরিক লড়াই করাও সম্ভব হয়নি লেবাননের পক্ষে। সম্ভব হয়নি অর্থনীতিকে বাঁচানো। ফলে লেবানন পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি উদ্বাস্ত, গৃহহীন, দরিদ্র ও আক্রান্ত মানুষের দেশে।
আর এই সুযোগটিই নিতে চাচ্ছে ইসরাইল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আরবের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশকে পাশে পাওয়ায় ইসরাইলের বিশেষজ্ঞরা লেবাননকে ভাগ করার ফর্মুলা দিচ্ছে। এতে কয়েকভাগে বিভক্ত লেবানন আরো শক্তিহীন হবে এবং ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আর কিছুই করতে পারবে না।
১৮ সেপ্টেম্বর (২০২০) যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা জার্নাল ‘ফরেন পলিসি’তে জোসেফ কেচিয়ান এক প্রবন্ধে লেবাননের
সমস্যা সমাধানের জন্য ‘পার্টিশান ইস ওনলি সলিউশান’ বলে যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। লেবাননের দীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনা করে এই গবেষক, যিনি প্রত্যক্ষভাবেই পশ্চিমা জোট ও ইসরাইলের প্রতি সহানুভূতিশীল, ভাগাভাগির যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন। বলেছেন, বিভিন্ন ধর্ম ও জাতি গোষ্ঠীর পক্ষে
লেবাননে একসঙ্গে থাকা অসম্ভব। ফলে সংকট উত্তরণ ও শান্তির জন্য লেবাননকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে দেয়াই ভালো, যাতে বিভিন্ন গ্রুপ ও গোষ্ঠী নিজেদেরকে শাসন ও পরিচালনা করতে পারে।
পাশ্চাত্যের পণ্ডিতদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত ভাগাভাগির এমন ফর্মুলা মোটেও নতুন নয়। অতীতে বারবার ভাগ-বাটোয়ারা করে নানা দেশ ও জাতিকে খণ্ড-বিখণ্ড করা হয়েছে। এতে শান্তি তো আসেইনি, বরং সংঘাত ও সংকট আরো বেড়েছে। ভারত উপমহাদেশ ভাগ করার ঘটনাটি একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। গত ৭৩ বছরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তির চেয়ে সংঘাতের অভিজ্ঞতাই বেশি। পূর্ব ইউরোপের বলকান রাষ্ট্রগুলো কিংবা আফ্রিকার দেশগুলোকে ভাগ করার পরিণাম এখনো বিভিন্ন ধরনের আন্তঃসম্প্রদায়, জাতিগত ও নৃতাত্ত্বিক সশস্ত্র লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে দেখতে পাওয়া যায়।
ঐতিহাসিকভাবেই ১৯৪৮ সাল থেকে ইসরাইল স্থানীয় আরবদের জায়গা দখল করে মধ্যপ্রাচ্যে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে বিভেদ ও সংঘাতের বীজ রূপে কাজ করছে, যা এখনো চলমান। মার্কিন ছত্রছায়ায় এবং মার্কিনপন্থি আরব রাষ্ট্রগুলোর মাধ্যমে ইসরাইলের সঙ্গে যে মৈত্রী ও শান্তির কথা বলা হচ্ছে, তার প্রকৃত স্বরূপ এখনো অজানা। ইসরাইল যদি আরবের নব্য-বন্ধুদের কাঁধে বন্দুক রেখে লেবানন ও অন্যদের শায়েস্তা করতে বা বিভক্ত করতে কাজ করে এবং মার্কিনিরা অস্ত্র বিক্রি বাড়ানোর কাজটি করে, তাহলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নয়, মধ্যপ্রাচ্যে আরো অশান্তি, সংষর্ষ, যুদ্ধাবস্থা ও রক্তপাতই ফিরে হবে।
[লেখক: ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।]
প্রতিবাদী কবি কাহলিল জিবরানের মাধ্যমে পরিচিত হলেও লেবানন হলো এমন এক প্রাচীন জনপদ, যার কথা ৭১ বার ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বর্তমানে যে খণ্ডিত দেশটি লেবানন নামে পরিচিত, তার জন্ম ১৯২০ সালে ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তির তত্ত্বাবধানে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমা শক্তিগুলো বিজয়ীর আসনে এসে বিশ্বের বহু দেশ ও জনপদকে খণ্ড-বিখণ্ড ও ভাগাভাগি করে নেয়।
এশিয়া, আফ্রিকার বহু দেশ এভাবে ইউরোপের নানা দেশের দখলে আসে। কিন্তু গত ১০০ বছরে লেবানন ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতার মুখ দেখলেও শান্তি ও স্থিতিশীলতার দেখা পায়নি। পুরো দেশ তো বটেই, রাজধানী বৈরুত পরিণত হয়েছে সংঘাতময়, রক্তাক্ত ও জ্বলন্ত শহরে। ইসরাইলি হামলা ও দখলদারিত্ব এবং নিজেদের মধ্যে লড়াই ও আন্তঃকলহ দেশটিকে বিশ্বের সবচেয়ে নাজুক, ভঙ্গুর, অস্থিতিশীল ও বিপজ্জনক স্থানে পরিণত করেছে।
লেবাননের অনেকটা ভূমিই ইসরাইলের জবরদখলে। বাকিটা খ্রিষ্টান, দ্রুজ, সুন্নি ও শিয়া মুসলিম গ্রুপগুলোর মধ্যে বিভক্ত। সবাইকে নিয়ে ফেডারেল ধরনের সরকার চালানোর বহু চেষ্টা করা হয়েছে লেবাননে। খ্রিষ্টান ও মুসলিমদের মধ্যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ভাগাভাগিও করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট খ্রিষ্টান হলে প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছে সুন্নি মুসলিম কাউকে আর স্পিকার শিয়া। অলিখিতভাবে এসব করেও শান্তি, স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্য রক্ষিত হয়নি দেশটিতে। নিজেদের বিভেদের কারণে ইহুদি আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধের একাট্টা হয়ে রাজনৈতিক বা সামরিক লড়াই করাও সম্ভব হয়নি লেবাননের পক্ষে। সম্ভব হয়নি অর্থনীতিকে বাঁচানো। ফলে লেবানন পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি উদ্বাস্ত, গৃহহীন, দরিদ্র ও আক্রান্ত মানুষের দেশে।
আর এই সুযোগটিই নিতে চাচ্ছে ইসরাইল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আরবের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশকে পাশে পাওয়ায় ইসরাইলের বিশেষজ্ঞরা লেবাননকে ভাগ করার ফর্মুলা দিচ্ছে। এতে কয়েকভাগে বিভক্ত লেবানন আরো শক্তিহীন হবে এবং ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আর কিছুই করতে পারবে না।
১৮ সেপ্টেম্বর (২০২০) যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা জার্নাল ‘ফরেন পলিসি’তে জোসেফ কেচিয়ান এক প্রবন্ধে লেবাননের
সমস্যা সমাধানের জন্য ‘পার্টিশান ইস ওনলি সলিউশান’ বলে যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। লেবাননের দীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনা করে এই গবেষক, যিনি প্রত্যক্ষভাবেই পশ্চিমা জোট ও ইসরাইলের প্রতি সহানুভূতিশীল, ভাগাভাগির যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন। বলেছেন, বিভিন্ন ধর্ম ও জাতি গোষ্ঠীর পক্ষে
লেবাননে একসঙ্গে থাকা অসম্ভব। ফলে সংকট উত্তরণ ও শান্তির জন্য লেবাননকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে দেয়াই ভালো, যাতে বিভিন্ন গ্রুপ ও গোষ্ঠী নিজেদেরকে শাসন ও পরিচালনা করতে পারে।
পাশ্চাত্যের পণ্ডিতদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত ভাগাভাগির এমন ফর্মুলা মোটেও নতুন নয়। অতীতে বারবার ভাগ-বাটোয়ারা করে নানা দেশ ও জাতিকে খণ্ড-বিখণ্ড করা হয়েছে। এতে শান্তি তো আসেইনি, বরং সংঘাত ও সংকট আরো বেড়েছে। ভারত উপমহাদেশ ভাগ করার ঘটনাটি একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। গত ৭৩ বছরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তির চেয়ে সংঘাতের অভিজ্ঞতাই বেশি। পূর্ব ইউরোপের বলকান রাষ্ট্রগুলো কিংবা আফ্রিকার দেশগুলোকে ভাগ করার পরিণাম এখনো বিভিন্ন ধরনের আন্তঃসম্প্রদায়, জাতিগত ও নৃতাত্ত্বিক সশস্ত্র লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে দেখতে পাওয়া যায়।
ঐতিহাসিকভাবেই ১৯৪৮ সাল থেকে ইসরাইল স্থানীয় আরবদের জায়গা দখল করে মধ্যপ্রাচ্যে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে বিভেদ ও সংঘাতের বীজ রূপে কাজ করছে, যা এখনো চলমান। মার্কিন ছত্রছায়ায় এবং মার্কিনপন্থি আরব রাষ্ট্রগুলোর মাধ্যমে ইসরাইলের সঙ্গে যে মৈত্রী ও শান্তির কথা বলা হচ্ছে, তার প্রকৃত স্বরূপ এখনো অজানা। ইসরাইল যদি আরবের নব্য-বন্ধুদের কাঁধে বন্দুক রেখে লেবানন ও অন্যদের শায়েস্তা করতে বা বিভক্ত করতে কাজ করে এবং মার্কিনিরা অস্ত্র বিক্রি বাড়ানোর কাজটি করে, তাহলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নয়, মধ্যপ্রাচ্যে আরো অশান্তি, সংষর্ষ, যুদ্ধাবস্থা ও রক্তপাতই ফিরে হবে।
[লেখক: ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।]