অনলাইন
করোনার কারণে বেড়ে যাওয়া অন্য রোগে মৃত্যু ঠেকাতে হবে
ডা. জিয়াউদ্দিন হায়দার
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, বুধবার, ৮:৪৩ পূর্বাহ্ন
বিশ্বের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ সংস্থার হিসাব অনুযায়ী এ বছরের শেষ নাগাদ পৃথিবীব্যাপী দশ লাখেরও অধিক মানুষের মৃত্যুর কারণ হবে COVID-১৯ তথা করোনাভাইরাস। এর চেয়েও দুর্ভাগ্য আর ভয়াবহ ব্যাপার হলো করোনার ফলে সৃষ্ট স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের অরাজকতার ফলে এই একই সময়ে বিশ্বজুড়ে প্রায় ছয় কোটি মানুষ করোনা ভিন্ন অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে, যেটা মহামারির আগমনের আগে হলে ঠেকানো সম্ভব ছিল।
সরকারি তথ্য মতে, করোনা এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ৪৮২৩টি তাজা প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চরম বিপর্যয়ের কারণে চিকিৎসার অভাবে অন্য রোগে ভুগে কতটি বাড়তি মৃত্যু হয়েছে তা আমাদের কারোরই জানা নেই। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য-তথ্য ব্যবস্থার চরম দুর্বলতার কারণে মৃত্যুর এই সংখ্যা হয়তো কোনদিনই জানা যাবে না। কেউ হারিয়েছে মা, কেউ বাবা, কেউ সন্তান, কেউবা অন্য কোনো আপনজন। সকালে ঘুম থেকে উঠলেই শুনতে হয় মৃত্যুর খবর!
আগে রাতে ঘুমাতে যাবার আগে ফোনের রিংটোন বন্ধ করে দিতাম। কিন্তু এখন তা করি না। কি জানি, কখন দেশ থেকে কেউ ফোন করবে, আরো একটি অনাকাক্সিক্ষত দুঃসংবাদ নিয়ে। কেউ হয়তো চাইবে জরুরি কোনো খবর দিতে, দুই-একটা উপদেশ পেতে অথবা সান্ত¡নার কথা শুনতে। এতো দূর থেকে কারো কোনো কাজেই তো আসি না। এখনো মহামারিটির আতঙ্কে কাটাচ্ছে বাংলাদেশের লাখ লাখ পরিবার। প্রতিদিনই লম্বা হচ্ছে মৃতের তালিকা।
বাড়তি মৃত্যু ঠেকাতে আমাদের অবশ্যই অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে, দল ও মতের ঊর্ধ্বে উঠে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যেহেতু আমরা শতাব্দীর ভয়াবহতম একটি অধ্যায় পার করছি। তা নাহলে ব্যক্তিগত ও জাতিগতভাবে যে চরম মূল্য দিতে হবে তা শোধ করার ক্ষমতা অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের অথবা ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও থাকবে না।
করোনা এবং অন্যান্য রোগ-সৃষ্ট বাড়তি মৃত্যু ঠেকাতে হলে অবশ্যই সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা থাকতে হবে এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে কয়েকটি কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে হবে। এই কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো:
১) দেশের সকল মৃত ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ করতে হবে এবং মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিদিন কতজন ব্যক্তি দেশের কোন অঞ্চলে কি কারণে মারা গেলেন সেই তথ্য সম্ভব হলে দৈনিক ভিত্তিতে সংগ্রহ করে তা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বিশ্লেষণ করতে হবে এবং বিশ্লেষণকৃত তথ্যের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষ সেলের মাধ্যমে দেশের সকল হাসপাতাল এবং উপজেলায় করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা পাঠাতে হবে। করোনা ছাড়া অন্য রোগে ভুগে মৃতের সংখ্যা বাড়লে তা প্রতিরোধের জন্য অতি জরুরি ব্যবস্থা আঞ্চলিক ভিত্তিতে গ্রহণ করতে হবে।
২) দেশের সকল হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্সসহ সকল স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সক্রিয় রাখতে হবে। করোনার কারণে বাংলাদেশের হাজার হাজার স্বাস্থ্যকর্মী মৃত্যুবরণসহ কোনো না কোনো সমস্যায় ভুগেছেন যার বেশির ভাগই প্রতিরোধ করা যেত। কিন্তু সীমাহীন দুর্নীতি, সমম্বয়হীনতা এবং অদক্ষতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের অনেক দেশ প্রমাণ করেছে, স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে করোনা ছাড়াও অন্য রোগের মৃত্যুর হার একেবারেই কমিয়ে আনা সম্ভব। তাই দরকার স্বাস্থ্যকর্মীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো এবং সেটা সম্ভব তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে।
৩) সকল রোগের চিকিৎসা নিশ্চিত করার মাধ্যমে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ধরে রাখতে হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশসহ অনেক দেশে অন্য রোগে ভুগে করোনার চেয়েও অনেক বেশিসংখ্যক মানুষ মারা গেছে। আর এই বিপর্যয়ের প্রধান কারণ ছিল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থা আর অবিশ্বাস। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় নিউ ইয়র্ক শহরে এ বছরের এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে করোনা ছাড়া অন্য রোগে ভুগে চার হাজারের মতো অতিরিক্ত মানুষ মারা গিয়েছিল এবং এর মূলে ছিল হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের ভয় ও অনীহা। আমাদের দেশে এই দৃশ্য এখনো প্রায় সকল হাসপাতালেই বিদ্যমান। কিন্তু জীবন বাঁচাতে হলে এই অবস্থা থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে।
৪) বয়স্কসহ সকল স্পর্শকাতর জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার ব্যবস্থায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়াও যাদের ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ অন্য কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি আছে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এ ব্যাপারে পরিবারের সদস্যদের বিশেষ ভূমিকা থাকতে হবে। যেকোনো বয়স্ক সদস্যের সামান্য সর্দি-কাশিকেও হাল্কাভাবে নেয়া যাবে না। এ ধরনের অতি সাধারণ লক্ষণগুলোকেও গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে। মহামারি শেষ না হওয়া পর্যন্ত পরিবারের সব বয়স্ক সদস্যের নিরাপদ দূরত্বে মাস্ক পরিয়ে রাখাই সমীচীন।
৫) জীবনের সঙ্গে জীবিকার সুষ্ঠু সমন্বয় করতে হবে। জীবন এবং জীবিকার তুলনামূলক আলোচনা সঠিক নয়। জীবিকা না থাকলে যেমন খাবার জোটে না তেমনি স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে কাজ করা যায় না। জীবন এবং জীবিকা দুটোই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু জীবন না বাঁচলে জীবিকা দিয়ে কি হবে! তাই প্রথমেই দরকার মৃত্যু প্রতিহত করা। আমরা বাঁচতে চাইÑ জীবন অনেক বেশি সুন্দর।
[লেখক: বিশ্ব ব্যাংকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মকর্তা।]
সরকারি তথ্য মতে, করোনা এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ৪৮২৩টি তাজা প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চরম বিপর্যয়ের কারণে চিকিৎসার অভাবে অন্য রোগে ভুগে কতটি বাড়তি মৃত্যু হয়েছে তা আমাদের কারোরই জানা নেই। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য-তথ্য ব্যবস্থার চরম দুর্বলতার কারণে মৃত্যুর এই সংখ্যা হয়তো কোনদিনই জানা যাবে না। কেউ হারিয়েছে মা, কেউ বাবা, কেউ সন্তান, কেউবা অন্য কোনো আপনজন। সকালে ঘুম থেকে উঠলেই শুনতে হয় মৃত্যুর খবর!
আগে রাতে ঘুমাতে যাবার আগে ফোনের রিংটোন বন্ধ করে দিতাম। কিন্তু এখন তা করি না। কি জানি, কখন দেশ থেকে কেউ ফোন করবে, আরো একটি অনাকাক্সিক্ষত দুঃসংবাদ নিয়ে। কেউ হয়তো চাইবে জরুরি কোনো খবর দিতে, দুই-একটা উপদেশ পেতে অথবা সান্ত¡নার কথা শুনতে। এতো দূর থেকে কারো কোনো কাজেই তো আসি না। এখনো মহামারিটির আতঙ্কে কাটাচ্ছে বাংলাদেশের লাখ লাখ পরিবার। প্রতিদিনই লম্বা হচ্ছে মৃতের তালিকা।
বাড়তি মৃত্যু ঠেকাতে আমাদের অবশ্যই অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে, দল ও মতের ঊর্ধ্বে উঠে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যেহেতু আমরা শতাব্দীর ভয়াবহতম একটি অধ্যায় পার করছি। তা নাহলে ব্যক্তিগত ও জাতিগতভাবে যে চরম মূল্য দিতে হবে তা শোধ করার ক্ষমতা অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের অথবা ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও থাকবে না।
করোনা এবং অন্যান্য রোগ-সৃষ্ট বাড়তি মৃত্যু ঠেকাতে হলে অবশ্যই সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা থাকতে হবে এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে কয়েকটি কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে হবে। এই কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো:
১) দেশের সকল মৃত ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ করতে হবে এবং মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিদিন কতজন ব্যক্তি দেশের কোন অঞ্চলে কি কারণে মারা গেলেন সেই তথ্য সম্ভব হলে দৈনিক ভিত্তিতে সংগ্রহ করে তা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বিশ্লেষণ করতে হবে এবং বিশ্লেষণকৃত তথ্যের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষ সেলের মাধ্যমে দেশের সকল হাসপাতাল এবং উপজেলায় করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা পাঠাতে হবে। করোনা ছাড়া অন্য রোগে ভুগে মৃতের সংখ্যা বাড়লে তা প্রতিরোধের জন্য অতি জরুরি ব্যবস্থা আঞ্চলিক ভিত্তিতে গ্রহণ করতে হবে।
২) দেশের সকল হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্সসহ সকল স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সক্রিয় রাখতে হবে। করোনার কারণে বাংলাদেশের হাজার হাজার স্বাস্থ্যকর্মী মৃত্যুবরণসহ কোনো না কোনো সমস্যায় ভুগেছেন যার বেশির ভাগই প্রতিরোধ করা যেত। কিন্তু সীমাহীন দুর্নীতি, সমম্বয়হীনতা এবং অদক্ষতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের অনেক দেশ প্রমাণ করেছে, স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে করোনা ছাড়াও অন্য রোগের মৃত্যুর হার একেবারেই কমিয়ে আনা সম্ভব। তাই দরকার স্বাস্থ্যকর্মীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো এবং সেটা সম্ভব তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে।
৩) সকল রোগের চিকিৎসা নিশ্চিত করার মাধ্যমে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ধরে রাখতে হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশসহ অনেক দেশে অন্য রোগে ভুগে করোনার চেয়েও অনেক বেশিসংখ্যক মানুষ মারা গেছে। আর এই বিপর্যয়ের প্রধান কারণ ছিল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থা আর অবিশ্বাস। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় নিউ ইয়র্ক শহরে এ বছরের এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে করোনা ছাড়া অন্য রোগে ভুগে চার হাজারের মতো অতিরিক্ত মানুষ মারা গিয়েছিল এবং এর মূলে ছিল হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের ভয় ও অনীহা। আমাদের দেশে এই দৃশ্য এখনো প্রায় সকল হাসপাতালেই বিদ্যমান। কিন্তু জীবন বাঁচাতে হলে এই অবস্থা থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে।
৪) বয়স্কসহ সকল স্পর্শকাতর জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার ব্যবস্থায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়াও যাদের ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ অন্য কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি আছে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এ ব্যাপারে পরিবারের সদস্যদের বিশেষ ভূমিকা থাকতে হবে। যেকোনো বয়স্ক সদস্যের সামান্য সর্দি-কাশিকেও হাল্কাভাবে নেয়া যাবে না। এ ধরনের অতি সাধারণ লক্ষণগুলোকেও গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে। মহামারি শেষ না হওয়া পর্যন্ত পরিবারের সব বয়স্ক সদস্যের নিরাপদ দূরত্বে মাস্ক পরিয়ে রাখাই সমীচীন।
৫) জীবনের সঙ্গে জীবিকার সুষ্ঠু সমন্বয় করতে হবে। জীবন এবং জীবিকার তুলনামূলক আলোচনা সঠিক নয়। জীবিকা না থাকলে যেমন খাবার জোটে না তেমনি স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে কাজ করা যায় না। জীবন এবং জীবিকা দুটোই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু জীবন না বাঁচলে জীবিকা দিয়ে কি হবে! তাই প্রথমেই দরকার মৃত্যু প্রতিহত করা। আমরা বাঁচতে চাইÑ জীবন অনেক বেশি সুন্দর।
[লেখক: বিশ্ব ব্যাংকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মকর্তা।]