বাংলারজমিন

কুয়াকাটায় ৭০ বছরেও স্বীকৃতি পায়নি বন প্রজারা

কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি

১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৮:৪১ পূর্বাহ্ন

কুয়াকাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ৭০ বছর ধরে বিনা বেতনে কাজ করার পরও স্বীকৃতি দেয়া হয়নি বন প্রজাদের। সহজ-সরল অল্প শিক্ষিত গা-খাটুনিতে সারা বছর শ্রম দিয়ে ৭০টি বছর কেটে গেলেও আজও তার শ্রমের মূল্য দেয়া হয়নি। উল্টো অবৈধ দখলদার আখ্যা দিয়ে ভোগদখলীয় জমি ও বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদে নোটিশ দিয়েছে বনবিভাগ ও ভূমি প্রশাসন। পাকিস্তান আমলে ৩৩ বন প্রজাকে ৪ একর করে জমি বরাদ্দ দিলেও সত্তর বছর পর বনবিভাগ এসব বন প্রজার বাড়িঘর ও ভোগদখলীয় জমি থেকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র করছে বলে বন প্রজাদের অভিযোগ। এ নিয়ে বনবিভাগ ও ভূমি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বন প্রজাদের বিরোধ চলছে। এমন পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগী বন প্রজারা বৈধতা পেতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
কুয়াকাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বসবাসকারী বন প্রজা সূত্রে জানা গেছে, ১৯৪৫ ও ১৯৫০ সালের দিকে পাকিস্তান সরকার আমলে কুয়াকাটা সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার বিরাণভূমিতে বাগান সৃজন করার লক্ষ্যে কক্সবাজারের মহেষখালীর সোনাদিয়ায় সমুদ্র ভাঙনে সহায় সম্বলহীন ২৩ পরিবার ও বরগুনার কাকচিরা এলাকার ১০টি পরিবারকে বন সৃজন করার শর্তে ৪ একর করে জমি বরাদ্দ দেয় তৎকালীন মহিপুর বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা গোলাম কাদের সিকদার। এরপর থেকে এসব বন প্রজারা বাড়িঘর নির্মাণ করে বসবাস এবং চাষাবাদের মাধ্যমে ভোগদখল করে আসছে এসব বরাদ্দকৃত জমি। বনবিভাগের শর্তানুযায়ী বন প্রজারা পটুয়াখালী জেলা ও বরগুনা জেলার কুয়াকাটা, লেম্বুর চর, গঙ্গামতির চর, কাউয়ার চর, চর মৌডুবী, চর মোন্তাজ, সোনার চর, ফাতরার বনসহ বিভিন্ন স্থানে বনবিভাগের নির্দেশে কাকড়া চারা, গোলগাছ, কেওড়া, কড়াই, রেইনট্রি, নারিকেলসহ বিভিন্ন প্রজাতির চারা রোপণ করে আসছেন। এ কাজের জন্য বন প্রজাদের কোনো পারিশ্রমিক দেয়া হয় না। বন প্রজাদের সৃজনকৃত বনের বয়স প্রায় ৬০-৬৫ বছর হয়ে গেছে। সৃজনকৃত এসব বনের অধিকাংশই সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেছে। ৩৩ বন প্রজা থেকে সন্তান ও নাতিসহ এখন ৬৭ পরিবার হয়ে গেছে। বরাদ্দকৃত ৩৩ বন প্রজার মধ্যে বেশির ভাগই মারা গেছেন। দু’য়েকজন বেঁচে থাকলেও তারা বয়সের ভারে এখন আর চলাফেরা করতে পারছেন না। বন প্রজারা হিংস্র জীবজন্তুর সঙ্গে লড়াই করে বিনা বেতনে বন পাহারা, বাগান সৃজন করার মাধ্যমে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনবিভাগের নিয়ম মেনে প্রায় সত্তর বছর ধরে স্ত্রী-সন্তান ও পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করে আসছেন। ১৯৬৫ ও ১৯৭০ সালের জলোচ্ছ্বাসে এসব পরিবারের অনেকেই মারা গেছেন। আবার কেউ কেউ বাগান সৃজন করতে গিয়ে বাঘের থাবায়ও মারা গেছেন। জীবনযুদ্ধে লড়াই করা বন প্রজারা পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে শান্তিতেই বসবাস করে আসছিলেন। এত বছর পর হঠাৎ করেই বনবিভাগ এসব বন প্রজাদের অবৈধ উল্লেখ করে বাড়িঘর ও চাষাবাদের জমি ছেড়ে দেয়ার জন্য বলে। বন প্রজারা কাগজ-কলমে বৈধতা পেতে জনপ্রতিনিধি, বনবিভাগ, জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরে তাদের অবস্থান তুলে ধরে। দেশের বৈধ নাগরিক হিসেবে নিজেদের মৌলিক অধিকার আদায়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে আবেদনও করে বন প্রজারা।
কুয়াকাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বসবাসরত বন প্রজারা অবৈধভাবে বন দখল ও বন উজাড় করছে উল্লেখ করে তাদেরকে উচ্ছেদে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গত ৩রা মার্চ ২০২০ইং প্রতিবেদন চেয়ে একটি চিঠি দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় কলাপাড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জগদ্বন্ধু ম-ল গত ৬ই আগস্ট ২০ জনের নাম উল্লেখ করে তাদের ভোগদখলীয় জমির স্বপক্ষীয় কাগজপত্র ও সাক্ষী প্রমাণসহ ৩রা সেপ্টেম্বর সরজমিনে তদন্তকালে উপস্থিত থাকার জন্য প্রত্যেককে নোটিশ প্রদান করে। স্থানীয় ভূমি প্রশাসন তদন্তও করেন।
বন প্রজাদের হেডম্যান আ. কাদের, বন প্রজা আ. সোবাহান, গণেশ চন্দ্র মিস্ত্রী, মৌলভী মো. জবেদ আলী, মো. মতিউর রহমান, নজীর মাঝিসহ একাধিক বন প্রজা অভিযোগ করেন, তৎকালীন সময়ে খুলনা বনবিভাগের আওতাধীন মহীপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. গোলাম কাদের সিকদার অবৈতনিক বন প্রজা হিসেবে ৩৩ জনকে নিয়োগ দেন। এ সময় বন সৃজন করার শর্তে বাড়িঘর নির্মাণ ও চাষাবাদ করার জন্য প্রত্যেক পরিবারকে ৪ একর করে জমি প্রদান করেন। বন সৃজন ও পাহারার পাশাপাশি প্রায় ৭০ বছর ধরে বসবাস করে আসছে তারা। ওই সময়ে বনবিভাগ থেকে তাদেরকে একটি টোকেন দেয়া হলেও ১৯৬৫ ও ৭০ সালের জলোচ্ছ্বাসে তা হারিয়ে যায়। বন প্রজারা বলেন, এতো বছর পর বনবিভাগ তাদেরকে অবৈধ দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করে ভোগদখলীয় জমি ও বাড়িঘর ছেড়ে দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। বন প্রজাদের অভিযোগ একদিকে তারা তাদেরকে অবৈধ দখলদার বলছে অপরদিকে বনবিভাগ তাদেরকে বন প্রজা হিসেবে উল্লেখ করে বন সৃজনের জন্য চিঠি দেয়া হচ্ছে। বন প্রজারাও এখনো বন সৃজন করে আসছেন। কাগজ-কলমে তাদেরকে বৈধতার দাবিতে একাধিকবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে। এ সময় বৈধতা দেয়ার কথা বলে সাবেক রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশিদসহ একাধিক কর্মকর্তারা দফায় দফায় মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। তার পরও বৈধতা দেয়া হয়নি তাদের। এ সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন ভুক্তভোগী বন প্রজারা।
এ বিষয়ে কথা হয় মাঠ পর্যায়ের তদন্ত কর্মকর্তা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জগদ্বন্ধু ম-লের সঙ্গে। তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সরজমিনে তদন্তে দেখা গেছে বন প্রজারা দীর্ঘ বছর ধরে এখানে বসবাস করে আসছেন। বনবিভাগের বৈধ কোনো কাগজপত্র দেখাতে না পারলেও নিজেদের বন প্রজা হিসেবে দাবি করেছে তারা। তাদের দাবিনামা সম্মিলিত তদন্ত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে পটুয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, বন প্রজারা দীর্ঘ বছর বসবাস করে এলেও তাদের স্বপক্ষে কোনো কাগজপত্র নেই। আইন অনুযায়ী তারা অবৈধভাবে বসবাস করছে। তিনি আরো বলেন, বন প্রজারা জেলা প্রশাসক, বনবিভাগ ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বৈধতার জন্য আবেদন করেছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন।

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status