প্রথম পাতা

করোনায় হার মানলেন মুর্তজা বশীর

স্টাফ রিপোর্টার

১৬ আগস্ট ২০২০, রবিবার, ৯:০৯ পূর্বাহ্ন

না ফেরার দেশে চলে গেলেন খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর। করোনায় আক্রান্ত হয়ে গতকাল সকালে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন তিনি (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী মুর্তজা বশীর দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুস, কিডনি ও হৃদরোগের জটিলতায়ও ভুগছিলেন। বৃহস্পতিবার রাতে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। তিনি সেখানে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। শুক্রবার তার করোনা পরীক্ষা করা হলে ফলাফল পজেটিভ আসে। গতকাল সকালে তার মৃত্যু হয়। বিকালে তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। মুর্তজা বশীরের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
চিত্রকলায় বিশেষ অবদানের জন্য দেশবরেণ্য এই চিত্রশিল্পী ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পদক, ১৯৮০ সালে একুশে পদক, ১৯৭৫ সালে শিল্পকলা একাডেমি পদক পেয়েছেন। মুর্তজা বশীর উপমহাদেশের  প্রখ্যাত ভাষাবিদ ও জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র কনিষ্ঠ সন্তান। ১৯৩২ সালের ১৭ই আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউশনে তার শিক্ষা জীবন শুরু হয়। বগুড়ার করোনেশন ইনস্টিটিউশন, ঢাকা গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ), কলকাতা আশুতোষ মিউজিয়ামে পড়াশুনা করেন তিনি। চিত্রকলা ও ফ্রেস্কো বিষয়ে অধ্যয়ন করেন ইতালির ফ্লোরেন্স একাডেমি দেল্লে বেল্লে আরতিতে। পরে প্যারিসের ইকোলে ন্যাশিওনাল সুপিরিয়র দ্য বোজার্ট এবং একাডেমি গোয়েৎসে মোজাইক ও ছাপচিত্রে পড়াশুনা করেন। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর সদ্য বিকাশমান এই অঞ্চলের দ্বিধাগ্রস্ত শিল্পকলাকে যারা পর্যাপ্ত আস্থা ও উপাদান জুগিয়েছেন, তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। শুধু তাই নয়, মুর্তজা বশীর একাধারে চিত্রশিল্পী, ভাষা সংগ্রামী, গবেষক ও ঔপন্যাসিক। তার গল্প, উপন্যাস, এমনকি তার কবিতাও মূলত আত্মজৈবনিক। ১৯৫০ সালে কমিউনিস্ট পার্টি আহূত ময়মনসিংহের হাজং, ভারতের তেলেঙ্গানা ও পশ্চিমবঙ্গে দক্ষিণ ২৪ পরগণার কাকদ্বীপে মুক্ত এলাকা দিবস এই প্রচার অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার হন মুর্তজা বশীর। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঁচ মাস জেল খাটেন তিনি। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ভাষা আন্দোলনে শহীদ আবুল বরকতকে রক্তাক্ত অবস্থায় অন্যদের সঙ্গে তিনি হাসপাতালে নিয়ে যান। ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের ছাদে কালো পতাকা উত্তোলনকারীদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি ঘটনার ওপর ‘রক্তাক্ত ২১শে’ শিরোনামে ১৯৫২ সালে তিনি লিনোকোটে চিত্রটি আঁকেন। যা হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ শীর্ষক সংকলনে প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকায় ভাষা আন্দোলনের ওপর ‘পারবে না’ শিরোনামে তার কবিতা ছাপা হয়।
১৯৫৫ সালে ঢাকার নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে অধ্যাপক হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন। ‘দেয়াল’, ‘শহীদ শিরোনাম’, ‘পাখা’ ‘কালেমা তাইয়্যেবা’, শিরোনামের চিত্রকর্মগুলো শিল্পী মুর্তজা বশীরের আঁকা উল্লেখযোগ্য সিরিজ। তিনি ‘বিমূর্ত বাস্তবতা’ নামে একটি শিল্পধারার প্রবর্তক। ফিগারেটিভ কাজে পূর্ব-পশ্চিমের মেলবন্ধনে তিনি স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার প্রকাশিত গল্প গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ‘কাঁচের পাখির গান’, ‘গল্প সমগ্র’। কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘ত্রসরেণু’, ‘তোমাকেই শুধু’, ‘এসো ফিরে অনুসূয়া’, ‘সাদায় এলিজি’। উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘আল্ট্রামেরিন’, ‘মিতার সঙ্গে চার সন্ধ্যে’, ‘অমিত্রাক্ষর’।  নির্বাচিত রচনার মধ্যে রয়েছে ‘মূর্ত ও বিমূর্ত’, ‘আমার জীবন ও অন্যান্য’। গবেষণাগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ’। মুর্তজা বশীর ১৯৬২ সালে আমিনা বশীরকে বিয়ে করেন। ২০১৭ সালে স্ত্রী আমিনা বশীরকে হারানোর পর তিনি আমিনা বশীর স্মৃতি ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেন।  তিনি ১৯৬৩ সালে উর্দু চলচ্চিত্র ‘কারোয়াঁ’র কাহিনী ও চিত্রনাট্য রচনা করেন। ১৯৬৪ সালে হুমায়ূন কবীর রচিত ‘নদী ও নারীর’ চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক ও প্রধান সহকারী পরিচালক ছিলেন। ১৯৬৫ সালে উর্দু চলচ্চিত্র ‘ক্যায়সে কাহু’র শিল্প নির্দেশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও ভারতের বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জার্নাল অব দ্য নিউম্যাসটেকি সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার’ প্রাক মুঘল যুগের মুদ্রার ওপর বেশ কয়েকটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। মুর্তজা বশীর বাংলা একাডেমি ও এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের আজীবন সদস্য। জাপানের ফুকুওকা এশিয়ান কালচারাল প্রাইজ কমিটির নমিনেটর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কলা ও মানবিক গবেষণা মূল্যায়ন কমিটি ও কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নির্বাচন কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status