শেষের পাতা

তূর্ণা রিমান্ডে বাইরে সক্রিয় প্রতারক চক্র

রুদ্র মিজান

১৪ আগস্ট ২০২০, শুক্রবার, ৯:১৮ পূর্বাহ্ন

অ্যান হেস্টার। নিজেকে আমেরিকান আর্মি পরিচয় দেয়। প্রোফাইলের ছবিতে আর্মির পোশাক পরিহিত ছবি। সুন্দরী নারী। ফেসবুকেই তার সঙ্গে পরিচয় প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরিরত মাসুদ হাসানের। দ্রুতই এগিয়ে যায় তাদের বন্ধুত্ব। অ্যান হেস্টার জানায়, যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকে আছে। অনেক টাকা রয়েছে তার কাছে। তা নিরাপদে রাখতে চায়। আপাতত রেডক্রসের এক এজেন্টের কাছে রয়েছে। কিন্তু সেটা নিরাপদ না। ২.৭ মিলিয়ন ডলার মাসুদের কাছে রাখতে চায় অ্যান। লোভনীয় প্রস্তাব। এরকম প্রস্তাব দিয়েই প্রতারণার জাল বুনে অ্যান, তূর্ণারা। প্রতারক চক্রের হোতা তূর্ণা আহসান ওরফে রাহাত আরা খানম তূর্ণাসহ ছয়জন এখন রিমান্ডে। সিআইডি’র জিজ্ঞাসাবাদে এ বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে এই তরুণী। তূর্ণা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে থাকলেও থেমে নেই এই চক্রের প্রতারণা। বারিধারা, গুলশানসহ অভিজাত এলাকায় বাসা নিয়ে প্রতারক চক্রের সদস্যরা প্রতিনিয়ত অনলাইনে অপকর্ম করে যাচ্ছে। হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। প্রতারক চক্রের কবলে পড়েছেন এমন বেশ কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এই চক্রের প্রতারণার নানা কৌশল। ঢাকায় এই চক্রের কয়েক শ’ সদস্য রয়েছে বলে ধারণা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

শুরুতেই অ্যান হেস্টার ফেসবুক আইডি থেকে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হয় মাসুদকে। ‘তোমার সঙ্গে পরিচয় হয়ে ভালো লাগলো। আমি খুশি হবো, যদি তুমি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করো।’ ই-মেইল এড্রেস দিয়ে জানানো হয় যোগাযোগ করলে নিজের ছবি পাঠাবে। মাসুদ আগ্রহী হয়ে উঠেন। যোগাযোগ হয়। মেইলে ছবি পাঠায় অ্যান হেস্টার। নানা আকর্ষণীয় এঙ্গেলে নিজের বিভিন্ন ছবি। নিজের নাম, ছবি সংবলিত আমেরিকান আর্মির একটি আইডি কার্ডও পাঠায়। সঙ্গে একটি দীর্ঘ ই-মেইল। ইংরেজি লেখা ই-মেইলে সে উল্লেখ করেছে, ‘আমি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। আশা করি তুমি এবং তোমার সঙ্গের সবাই ভালো আছে। আমি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরাকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কাজ করছি। আমি এখানে ২.৭ মিলিয়ন ডলার আয় করেছি। জাতিসংঘের আইনের কারণে আমি এই অর্থ রেডক্রসের এজেন্টের কাছে জমা দিয়েছি। আমি চাই তহবিলটি পাওয়ার জন্য তুমি আমাকে সহযোগিতা করবে। আমি রেডক্রস এজেন্টকে বিশ্বাস করি না। আমি চাই তুমি আমাকে সাহায্য করো এবং এই টাকা তোমার অ্যাকাউন্টে সংরক্ষণ করো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, আমি তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবো। সহায়তা করার জন্য আমি মোট অর্থের ৫০ ভাগ তোমাকে দেবো। তুমি আমার সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী হলে জানাও।’

তারপর জানানো হয়, ডলারের বাক্স পাঠানো হয়েছে তাকে। প্রমাণ হিসেবে বুকিং রশিদও দেয়া হয় ই- মেইলে। যথাসময়ে কল করা হয় মাসুদকে। কাস্টমস কর্মকর্তা কামরুল আহসান পরিচয় দিয়ে ফোন করে মাসুদকে জানানো হয় তার একটি পার্সেল এসেছে ঢাকার শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দরে। সেই সঙ্গে দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের ট্যাক্স। ট্যাক্স না দিলে মামলায় ফেঁসে যাবেন বলে জানানো হয় মাসুদকে।

মাসুদের মতো অনেকেই অভিযোগ করেছেন, এভাবে প্রলোভনে পড়ে টাকা দেয়ার পরই তাদের ফোন, আইডি বন্ধ পাওয়া যায়। হদিস মিলে না গিফট বক্সের। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে প্রতারণা করে যাচ্ছে এই চক্রের সদস্যরা। বিভিন্ন আইডি হ্যাক করে, ফেইক ছবি ও পরিচয় দিয়ে অপকর্ম করে চক্রটি। এক্ষেত্রে নানা অজুহাতে অডিও ও ভিডিও কলে যায় না চক্রের সদস্যরা। গত ২১শে জুলাই তূর্ণাসহ এই চক্রের ১৩ প্রতারককে মিরপুর থেকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। একইভাবে ২২শে জুলাই বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে নূপুর খাতুন নামে এক তরুণী সহ দুই নাইজেরিয়ানকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি’র সাইবার অপরাধ তদন্ত বিভাগ। জানা গেছে, এসব চক্রের বাংলাদেশি সদস্যরা মূলত কাস্টমস অফিসার সেজে কথা বলে। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ব্যবস্থা করে। এক্ষেত্রে শিক্ষিত ও শুদ্ধ উচ্চারণের পারদর্শী বাংলাদেশিদের দলে টানে নাইজেরিয়ানরা। গত বুধবার তূর্ণাসহ ছয়জনকে রিমান্ডে নিয়েছে সিআইডি। সিআইডি’র জিজ্ঞাসাবাদে তূর্ণা জানিয়েছে, তার মতো আরো অনেকে রয়েছে চক্রে। তার চক্রেই কাজ করে এমন আরো এক নারী সম্পর্কেও তথ্য দিয়েছে তূর্ণা। ভদ্রবেশী এই নারী আড়ালে ভয়ঙ্কর প্রতারক। নাইজেরিয়ানদের সঙ্গে মিশে এই চক্রের সদস্যরা প্রতিনিয়ত মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রতি গ্রুপে ১৫-২০ জনে ভাগ হয়ে চক্রের সদস্যরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে আছে। অন্তত কয়েক শ’ সদস্য রয়েছে এসব চক্রের। সুন্দর, শুদ্ধ উচ্চারণের জন্যই তূর্ণাকে অগ্রাধিকার দিতো নাইজেরিয়ানরা। তাছাড়া ইংরেজিতেও দক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১১-২০১২ সেশনের এই ছাত্রী। এ বিষয়ে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার শামসুন নাহার মানবজমিনকে বলেন, প্রতারক চক্র বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ভুক্তভোগী অনেক। কিন্তু স্বামীর অগোচরে স্ত্রী, স্ত্রীর অগোচরে স্বামী চ্যাট করে বন্ধুতায় জড়িয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। যে কারণে অনেকেই প্রকাশ্যে আসছেন না। চক্রটি টাকা কোথাও পাচার করেছে কিনা, এসব বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে তাদের যাতায়াত ছিল। তাছাড়া জড়িত অন্যদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status