অনলাইন

বাংলাদেশে চীনের প্রভাব অতিরঞ্জিত

অ্যাডাম পিটম্যান

১০ আগস্ট ২০২০, সোমবার, ৯:৫৪ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক ফের শিরোনামে। সীমান্ত গোলযোগের কারণে চীন-ভারত সম্পর্কের অবনতি ঘটার পর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও থিংকট্যাংক চীন ও বাংলাদেশের একটি নতুন বাণিজ্য চুক্তির দিকে লক্ষ্য নিবদ্ধ করে। কেউ একে আখ্যা দেয় ‘খয়রাতি’ হিসেবে, কেউ আবার বলেন ‘ঘাটতি ও ঋণের দ্বিমুখী ফাঁদ’। আরেক জায়গায় বলা হলো এটি চীনের এক বড় কূটনৈতিক অর্জন।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসবের কোনোটিই নতুন কিছু নয়। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের সমালোচকরা প্রায়ই চীন থেকে আসা বিনিয়োগ ও বাণিজ্য নিয়ে বাংলাদেশের সমালোচনায় লিপ্ত হন। কিন্তু সমস্যা হলো সমালোচকরা এই সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা ও বাংলাদেশের সামর্থ্যকে এড়িয়ে যান। এক ধরনের পরনির্ভরশিলতার এসব বয়ান বাংলাদেশ সম্পর্কে সেকেলে ধ্যানধারণায় ঘেরা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের যেই মডেলে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ, তাকেই অগ্রাহ্য করে এই ধ্যানধারণা। এই ধরনের বক্তব্য কতটা বাস্তবতা-বিবর্জিত, তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ সাম্প্রতিক এই বাণিজ্য চুক্তি।

১লা জুলাই চীন দেশটিতে বিনাশুল্কে বাংলাদেশের রপ্তানিযোগে পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। আগে ৬০ শতাংশ পণ্য এই সুবিধা পেতো, এখন সেই হার ৯৭ শতাংশে চলে এসেছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে চীনের দেয়া বিশেষ অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পের আওতায় চীন বাংলাদেশকে এই ছাড় দিয়েছে। এই প্রকল্প ২০০২ সালে চালু হয়েছে। বর্তমানে আরও ৪০টি দেশকে চীন এই সুবিধা দিয়ে থাকে। এতদিন কেন এসব পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পায়নি, তার কারণ হলো বাংলাদেশ এশিয়া প্যাসিফিক ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট বা আপটা চুক্তি অনুযায়ী শুল্ক হ্রাসের সুবিধা বেছে নিয়েছিল। ওই চুক্তির আওতায় অবশ্য এলডিসি প্রকল্পের মতো শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার না পেলেও, নিয়মনীতিতে অনেক ছাড় মিলেছিল বাংলাদেশের।

খয়রাত বা ফাঁদ বা একতরফা বিজয় নয়, বরং বাংলাদেশ যে এখন এলডিসি প্রকল্প বেছে নিয়েছে তার কারণ হলো বাংলাদেশ এখন রপ্তানি বহুমুখীতে আগ্রহী। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের যেই বর্তমান বাণিজ্য ঘাটতি তা থেকে যে এই শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কারণে খুব উপকার পাওয়া যাবে, তা নয়। কিন্তু এই ধরনের সুবিধা পেলে তো ক্ষতি নেই। এছাড়া যেসব কোম্পানি চীন থেকে তাদের সাপ্লাই চেইন সরিয়ে ফেলতে চায়, কিন্তু চীনের বাজারে প্রবেশাধিকার হারাতে চায় না, সেসব কোম্পানির বিনিয়োগও বাংলাদেশ এখন আকৃষ্ট করতে পারে।
শুধু বাণিজ্য নয়, চীন থেকে আসা বিনিয়োগের কারণেও বাংলাদেশকে কটু কথা শুনতে হয়।
২০১৬ সালে চীন বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিকল্পনার ঘোষণা দেয়। চীন ও বাংলাদেশ ২৭টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে, যার সম্মিলিত মূল্য প্রায় ২৪০০ কোটি ডলার। এছাড়া সাইডলাইনে বাংলাদেশ ও চীনে কোম্পানিগুলো ১৩টি জয়েন্ট ভেঞ্চারে উপনীত হয়, যেগুলোর প্রাক্বলিত পরিমাণ হিসাব করা হয়েছে ১৩৬০ কোটি ডলার।
ওই সময়টায় চীন এই অঞ্চলে এমনিতেই কিছুটা ব্যস্তই ছিল। ২০১৫ সালের এপ্রিলে পাকিস্তানে ৪৬০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয় দেশটি। ভারতে ২০১৫ সালের মে মাসে চীনের ২২০০ কোটি ডলারের ঘোষণা আসে। তারপরও কিছু বিদেশী পর্যবেক্ষক বাংলাদেশের চুক্তিকেই সম্ভাব্য ঋণের ফাঁদ বা বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি হিসেবে তুলে ধরছেন।

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের আওতায় (যেখানে বাংলাদেশও সদস্য) যেসব চুক্তি হয়েছে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। কিন্তু ২০১৬ সালে চীনের সাথে বাংলাদেশের যেসব সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, তার মাত্র ৫টি ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ বাস্তবায়িত হয়েছে।
এছাড়া বাংলাদেশ একটি প্রকল্প বাদ দিয়েছে। ১৬০ কোটি ডলার ব্যায়ে নির্মিতব্য ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক বাদ দেয়ার আগে চুক্তি বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান চায়না হার্বার অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (সিএইচইসি)-কে ঘুষ দেয়ার অভিযোগে কালোতালিকাভুক্ত করে বাংলাদেশ। এই সিএইচইসিই আবার শ্রীলংকার হাম্বানটোটা বন্দর নির্মাণ করেছিল। এই বন্দরকেই বিশ্লেষকরা চীনের ঋণ ফাঁদের উদাহরণ হিসেবে প্রায়ই তুলে ধরেন। কারণ, এই বন্দর নির্মানে নেয়া ঋণের খরচ বহন করতে শ্রীলংকা চীনকেই ওই বন্দর ৯৯ বছরের জন্য পরিচালনা করার লিজ দেয়।

অপরদিকে ২০১৯ সালের জুলাই নাগাদ চীন প্রতিশ্রুতির ২৪০০ কোটি ডলারের মধ্যে মাত্র ৯৮.১ কোটি ডলার ছেড়েছে। বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা মিডিয়াকে বলেছেন যে, দর কষাকষি, চীনের এক্সিম ব্যাংকের সীমিত সামর্থ্য ও বিভিন্ন চীনা প্রতিষ্ঠানের লবিং-এর কারণে ঋণ ছাড়তে বিলম্ব হচ্ছে।
যদি প্রকল্পগুলো নিয়ে পুনরায় সমঝোতায় না আসা যায়, তাহলে ২০১৬ সালে যেই অর্থায়নের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল, তা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কম। মূল চুক্তিগুলোর মেয়াদ ২০২০ সালেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।
তবে এসব বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়।

আন্তর্জাতিক সাহায্য বা ঋণ পরিচালনার কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা রয়েছে বাংলাদেশের। বিভিন্ন ধরণের দ্বিপক্ষীয় ও বহুজাতীয় অর্থায়নকারীর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে দেশটির। আর্থিক ক্ষেত্রে এই বিচক্ষণতা ও ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে এই সতর্কতার কারণেই ইকোনমিস্ট ইন্টিলিজেন্স ইউনিট সঠিকভাবে ৪ বছর আগে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে ২০১৬ সালে চীনের সাথে বাংলাদেশের স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোর মধ্যে অল্প ক’টিই বাস্তবায়িত হবে।

ফলে বাংলাদেশ ২০৩৫ সালের মধ্যে চীন থেকে ৫০০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ পাবে বলে যেই ধারণা করা হচ্ছে, তা কল্পনা করা এই প্রেক্ষপটে কঠিন ঠেকছে। ঋণ নেয়ারই যেখানে এই অবস্থা, সেখানে ঋণের ফাঁদে আটকে যাওয়া বা চীনের কাছে অবকাঠামো প্রকল্প লিজ দেয়া তো আরও দূরের কথা।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ ঋণ বহুজাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া। কভিড-১৯ মহামারির অর্থনৈতিক ধ্বস সত্ত্বেও, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের নেয়া ঋণকে ‘টেকসই’ বলে আখ্যা দিয়েছে। দেশটির বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ১৪.৭ শতাংশ, যা ব্যবস্থাপনাযোগ্য বলেই ধরে নেয়া হয়েছে।

তাই বাংলাদেশ ঋণের জালে কতটুকু আবদ্ধ হয়ে পড়ছে—তার চেয়ে বরং চীনের এই বিনিয়োগ বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে, তার ওপর নজর দেয়াই সম্ভবত যৌক্তিক হবে।
বাংলাদেশে ব্যবসা করা অত্যান্ত কঠিন ও কষ্টসাধ্য। বাংলাদেশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে অর্থায়ন না পাওয়া, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে চিহ্নিত করে। অপরদিকে চীনের কোম্পানিগুলো বিশ্বের সবচেয়ে অস্বচ্ছ বলে বিবেচিত হয়। বিভিন্ন পশ্চিমা কোম্পানিগুলোকে বিদেশে ব্যবসা করতে হলেও নিজ দেশের দুর্নীতি-বিরোধী আইন মেনে চলতে হয়। চীনা কোম্পানিগুলো তেমন কোনো আইন মানতে বাধ্য নয়।

বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য বিষয়টি সুখকর নয়। তারা আশংকা করছেন, অসম সুবিধা পেয়ে লোভনীয় সব চুক্তি সব পেয়ে যাবে চীনা কোম্পানিগুলো কিংবা বাজার দখলে নেবে তারা।
অনেকে অভিযোগ করেন, চীনা কোম্পানিগুলো দরপত্রে অংশ নেয় অল্প দর প্রস্তাব করে। কিন্তু পরবর্তীতে প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে বা ঋণের শর্ত পরিবর্তন করে ফেলে। একটি জরিপে দেখা গেছে, চীনের বহিঃবিনিয়োগের এক চতুর্থাংশই ব্যর্থ হয় এসব কারণে। জরিপের ৪০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছেন যে, ব্যর্থ হওয়ার জন্য এই ব্যয় বৃদ্ধি ভূমিকা রেখেছে। ২৭ শতাংশ বলছেন নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের তদন্তের আশঙ্কা বিনিয়োগ ভেস্তে দিয়েছে।

এই দু’টি ইস্যুই বাংলাদেশে সিএইচইসি’র কালোতালিকাভুক্তিতে ভূমিকা রেখেছে। ২০০৭ সালের পর থেকেই নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ সিএইচইসি’র দিকে নজর রাখছিল। ২০১৮ সালে সিএইচইসি’র কালোতালিকাভুক্তির জন্য যেই ঘুষ প্রস্তাবের অভিযোগ উঠে, তা এমন সময়ে ঘটেছিল যখন কিনা প্রতিষ্ঠানটি প্রকল্পের প্রাথমিক প্রাক্বলিত ব্যায় দ্বিগুণ করার চেষ্টা করছিল। এরপর দ্বিপক্ষীয় আলোচনা থেকে পিছু হটে চীনা কর্মকর্তারা।
সম্পর্কের পরবর্তী টানাপোড়েন দেখা যেতে পারে জ্বালানী ও আর্থিক সেবা খাতে। টেক্সটাইলের পাশাপাশি এই দুই খাতেই চীনা বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি।
গত বছরে বাংলাদেশের জ্বালানী নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ সরকারকে নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন বাতিল করার সুপারিশ করেছিল। বিদ্যমান বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুৎ দিয়েই ২০৩০ সাল পর্যন্ত চাহিদা মেটানো যাবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এছাড়া অভারক্যাপাসিটির জন্য যেই অর্থ এখন ব্যয় হচ্ছে, তা অযৌক্তিক বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এটি চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য সমস্যা বয়ে আনতে পারে। তারা ১৫টি প্রকল্পে ইতিমধ্যেই ইকুইটি বিনিয়োগ করে ফেলেছে। এগুলো ৭৬ শতাংশই ২০১৯ সাল নাগাদ পরিকল্পনার পর্যায়ে ছিল।
বাংলাদেশ সম্প্রতি একটি প্রকল্প বাদ দিয়েছে। এটি হলো গজারিয়ায় পরিকল্পিত ৪৩ কোটি ডলার ব্যায়ের ৩৫০ মেগাওয়াট শক্তিসম্পন্ন কয়লাচালিত তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটিও ২০১৬ সালের সমঝোতা স্মারকগুলোর একটি। এরপর বিভিন্ন প্রতিবেদনে এসেছে যে বাংলাদেশ প্রতি মাসে ১.৯ কোটি ডলার পরিশোধ করছে শুধু পায়রার কয়লা-চালিত ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট হিসেবে। জয়েন্ট ভেঞ্চার এই প্রকল্পে গত বছর চীনা ও বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রাণঘাতী সংঘাত বেধেছিল।
আর্থিক সেবাখাতে ক্রমেই প্রতিযোগিতা বাড়ছে, যা হতে পারে অস্থিরতার আরেকটি উৎস। চীন এই খাতের সবচেয়ে বৃহৎ বিদেশী বিনিয়োগকারী। ২০১৮ সালে চীনের আলিপে (এখন অ্যান্ট ফাইন্যান্সিয়াল) বিকাশ-এর ২০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। এই মোবাইল অর্থ লেনদেনের কোম্পানিতে শেয়ার আছে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন ও বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনেরও।
তবে বিদেশী অর্থায়নের প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে রাষ্ট্র-সমর্থিত আর্থিক প্রযুক্তি খাতের জন্য অসম সুবিধা দেয়া নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। উদাহরনস্বরূপ, রাষ্ট্রীয় পোস্টাল সেবা কর্তৃপক্ষ সমর্থিত মোবাইলে অর্থ লেনদেনের কোম্পানি নগদের তুলনায় বিকাশের লেনদেনের সীমা অবশ্যই কম রাখতে হচ্ছে, আবার গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ উত্তোলনের চার্জ বেশি রাখতে হচ্ছে। এছাড়াও বিকাশকে ‘নো ইয়োর কাস্টমার’ নামে বিশেষ বিধান মেনে চলতে হচ্ছে।
এমনকি দুই কোম্পানি দুইভাবে নিবন্ধিত। বিকাশ একটি ‘ডিজিটাল আর্থিক সেবা’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অপরদিকে নগদ একটি ‘মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সেবা’ প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত হয় পোস্টাল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। পোস্ট ও টেলিকমিনিউকেশন মন্ত্রী পার্থক্য বোঝাতে বলেছিলেন যে, নগদ জনসাধারণের আর্থিক অংশগ্রহণকে অগ্রাধিকার দেয়।
এসব বক্তব্য চীনা প্রযুক্তি খাতের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বেশ পরিচিতই শোনাবে, কেননা তারাও চীনে একই ধরনের সুবিধা ভোগ করে। তারপরও এটি দেখার বিষয় ভবিষ্যতে এ নিয়ে তাদের লবিস্টরা বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কীভাবে দরকষাকষি করে।
কিন্তু এসব থেকে এ-ও বোঝা যায় যে, বাংলাদেশ চীনের আর্থিক প্রভাব বলয়ের বাইরে থেকেই স্বাধীন অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। বাংলাদেশের যেই প্রবৃদ্ধির গল্প, তার শক্তিমত্তাকেই অগ্রাহ্য করা হবে অন্যথায়।
গত কয়েক বছর ধরে এশিয়ার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল দেশের একটি বাংলাদেশ। গত এক দশকে দেশটির প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল প্রায় ৭ শতাংশ। ২০১৯ সালে এই হার ছিল ৮.১ শতাংশ। মাথাপিছু আয় গত বছর প্রায় ২ হাজার ডলারে এসেছে পৌঁছেছে, যা ২০০৬ সালের চেয়ে তিন গুণ।
কভিড-১৯ মহামারির কারণে দেশটির অগ্রগতি কিছুটা থমকে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে, তবে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) পূর্বাভাস দিয়েছে ২০২০ সালে বাংলাদেশ হবে এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল দেশগুলোর একটি। এরপর ২০২১ সালে দেশটি ভি-শেপ (খাড়া পতনের পর খাড়া অগ্রগতি) পুনর্লাভের দিকে যাবে। অন্যান্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে এই পূর্বাভাস কিছুটা বেশিই আশাবাদী, তবে সরকারের ঠিক করা উচ্চাকাঙ্খী প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কিছুটা কম।
বিদেশি ঋণ, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহায়ক ছিল, তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির স্থিতিস্থাপকতার অন্যতম কারণ হলো সামাজিক উন্নয়ন। বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাস, বিদ্যালয়ে লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাস, শ্রমশক্তিতে নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনীতিকে আরও অংশগ্রহণমূলক করতে চেয়েছে। এ কারণেই বছরের পর বছর ধরে দেশটি বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে।
বাংলাদেশের এখনও অনেক দূর যাওয়া বাকি। তবে যেদিন ইউ অ্যালেক্সিস জনসন ও হেনরি কিসিঞ্জার দেশটিকে ‘বাস্কেট কেইস’ বলেছিলেন, সেইদিনের তুলনায় আজ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার অনেক কাছে চলে এসেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সম্পর্কে আরও ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ধারণের সময় এসেছে। চীনা বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও প্রভাব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যেমন রয়ে গেছে, তেমনি কঠোরতম সমালোচনায় কেবল নিজ-স্বার্থে কাজ করার যেই সামর্থ্য বাংলাদেশের রয়েছে, তাকেই অগ্রাহ্য করা হয়।
আরও খারাপ বিষয় হলো, এসব সমালোচনা সেই পরনির্ভরশীলতার ভুল ধারণাকেই উস্কে দেয়, যার সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক সামান্যই। পর্যবেক্ষকরা যখন চীনের সকল কার্যক্রমকে হুমকি হিসেবে দেখেন আর বাংলাদেশ এক ধরণের ভিকটিমতত্বে জর্জরিত থাকে, তখন তারা একটি সম্পর্কের মধ্যে যেই স্বার্থ থাকে তার পূর্ণ মাত্রা উপলব্ধি করতেই ব্যর্থ হন।
চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভিন্ন একটি বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দেয় যে বাংলাদেশ তাদের পরবর্তী প্রবৃদ্ধির গন্তব্যে এগিয়ে যেতে হিসাবি ঝুঁকি নিয়েছে। এই বিশ্লেষণ আরও নজর পাওয়ার দাবি রাখে। শুধু তাই নয়। যদি এই সম্পর্ক সফল হয়, তাহলে চীনের সঙ্গে কীভাবে দায়িত্বপূর্ণ উপায়ে লেনদেন করতে হয়—উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তার একটি ছবক হয়ে থাকবে বাংলাদেশ।

(অ্যাডাম পিটম্যান একজন বিশ্লেষক ও সম্পাদক। তার এই নিবন্ধ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন-ভিত্তিক এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলমুখী ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে।)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status