বাংলারজমিন

সাড়ে ৩ ঘণ্টায় হাওরে বিলীন সরাইল-অরূয়াইল সড়ক

সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি

২৮ জুলাই ২০২০, মঙ্গলবার, ৯:০৬ পূর্বাহ্ন

শেষ রক্ষা হল না সরাইল-অরূয়াইল সড়কের। মাত্র সাড়ে ৩ ঘণ্টায় হাওরে বিলীন হয়ে গেল স্বপ্নের সরাইল-অরূয়াইল সড়কটি। একবারেই বন্ধ হয়ে গেল যান চলাচল। সোমবার বিকেলে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ এস এম মোসা। এত দ্রুততম সময়ে সড়কটি বিলীন হয়ে যাওয়ায় আশ্চর্য্য হয়েছেন অনেকে। তবে ইউএনও বলছেন যা ধারণা করেছিলাম, তাহাই সত্যে পরিণত হয়েছে। স্থানীয়রা জানায়, বন্যার পানির বৃদ্ধির শুরুতেই ঢেউয়ের আঘাতে সদ্য সংস্কার হওয়া এ সড়কের বিভিন্ন জায়গায় ভাঙন দেখা দিয়েছিল। উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এরপর এলজিইডি এগিয়ে এসেছে। বালির বন্তা ও বাঁশের খুঁটি দিয়ে চেষ্টা করেছেন সড়ক রক্ষার। ভাটি এলাকার লোকজনের মনে কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু তাদের সকল স্বপ্ন ও আশা ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল। সোমবারের বৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে তাদের সড়কের সুখ। নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, লোপাড়ার ছোট ব্রিজ থেকে বড় ব্রিজের (কুড়) মাঝামাঝি স্থানটি। দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটে সড়কের ওই জায়গাটির উপর আমার গাড়িটি স্বাচ্ছন্দে চলে গেল। ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে সুন্দরভাবে সড়কের উপর থেকে নৌকায় করে অরূয়াইল গেলাম। দুই ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ শেষ করে রওনা দিলাম। তখন খুব বৃষ্টি পড়ছিল। হওরে প্রচণ্ড ঢেউ ছিল। মনে মনে ভেবেছিলাম এমন ঢেউ অব্যাহত থাকলে সড়কের এ জায়গাটুকু ঠিকবে না। বিকাল ৫ টায় এসে আর সড়কের ওই জায়গা চিনতে পারছি না। বুঝতে আর বাকি রইল না। মূল বিষয় হচ্ছে সাড়ে ৩ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে হাওর গিয়ে ফেলেছে সড়কটি। সড়কের এ জায়গাটি দিয়ে আর কোন গাড়ি চলছে না। এর পরের অংশ তলিয়ে গেছে বন্যার পানিতে। সড়কটি বিলীনের খবর জায়গায় দাঁড়িয়েই আমি জেলা প্রশাসক ও জেলা এলজিইডির’র নির্বাহী প্রকৌশলীকে অবহিত করেছি। সেখানকার একাধিক লোক বলেন, গত ২-৩ সপ্তাহ ধরে এ সড়কের ভাঙ্গন রোধে কাজ হচ্ছে। অনেকেই পরিদর্শন করতে আসছেন। কিন্তু এই এলাকার বাসিন্দা স্থানীয় সংসদ সদস্য উকিল আব্দুস সাত্তার ভূঁইয়া একবার এসে চুপিও দেননি। অথচ এক সময় এই সড়কের কোথাও সামান্য ভাঙন দেখা দিলেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছবিসহ গরম হয়ে যেত। লেখা হত- ‘সড়কটি ভেঙ্গে যাচ্ছে দেখার কেউ নেই।’ সাত্তার সাহেব না আসলেও ওইসব কথা এখন আর কেউ লিখেন না।
এদিকে গত কয়েকদিনের অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পানির কারণে প্লাবিত হয়েছে সরাইল। ঈদুল আজহার আনন্দ হারিয়ে গেছে সহস্রাধিক পরিবারের। বানের পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচার চিন্তায় কাবু তারা। গতকাল পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে গেছে গোটা উপজেলায় ৩ শতাধিক বসতবাড়ি। ডুবু ডুবুু অবস্থায় রয়েছে আরো ৪-৫ শতাধিক বাড়ি। অরূয়াইলে খোলা হয়েছে একটি আশ্রয়কেন্দ্র। সরাইল-অরূয়াইল সড়কটির ওপর এখন এক ফুট পানি। মলাইশ-শাহাজাদাপুর সড়কটিও আছে ঝুঁকিতে। উভয় সড়কেই বিচ্ছিন্ন এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা। সরজমিন ঘুরে জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় লোকজন সূত্র জানায়, সরাইলের ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে অরূয়াইল, পাকশিমুল, শাহাজাদাপুর ও চুন্টা ইউনিয়নের অনেক বসতবাড়ি এখন পানির নিচে। এ ছাড়া সরাইল সদর, নোয়াগাঁও, কালিকচ্ছ, শাহবাজপুর ও পানিশ্বর ইউনিয়নের কিছু বাড়িতে উঠেছে বন্যার পানি। ফলে বাড়ি থেকে গরু ছাগল, হাঁস মোরগসহ অন্যান্য মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে। কেউ আশ্রয় নিচ্ছে স্বজনদের বাড়িতে। আবার অনেকে কষ্ট করে নিজ বাড়িতেই খাট চকি উঁচু করে বসবাস করছেন। অরূয়াইলের ষোলাকান্দি মাহিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গত বৃহস্পতিবারই খোলা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র। সেখানে বর্তমানে বসবাস করছে ১০টি পরিবার। আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা না হওয়ায় আরো ১৪টি পরিবারকে আশপাশের উঁচু বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওই আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনো খাবার দিচ্ছেন। এ ছাড়া রানিদিয়া, রাজাপুর, কাকরিয়া, ষোলাকান্দি, ধামাউড়ার আদিরচড়, মিরহারবনসহ গোটা ইউনিয়নের প্রায় দেড় শতাধিক বসতবাড়িতে পানি উঠেছে। বানের পানির সঙ্গে যুদ্ধ করেই বসবাস করছেন তারা। পাকশিমুল ইউনিয়নের লম্বাহাটি গ্রামে ২০-২২টি বাড়িতে পানি উঠেছে অনেক আগে। সম্প্রতি গোটা ইউনিয়নের প্রায় অর্ধশতাধিক বাড়িতেই পানি।
শাহাজাদাপুর ইউনিয়নের দেওড়া, গাজিপুর, মলাইশ, শাহজাদাপুর ও নিয়ামতপুর গ্রামের ৬৬টি বাড়িতে এখন পানি। আর ধাউরিয়া গ্রামের ২ শতাধিক বাড়ি ডুবুডুবু অবস্থায়। আর সামান্য পানি বৃদ্ধি পেলেই তলিয়ে যাবে ওই বাড়িগুলো। চুন্টা ইউনিয়নের চুন্টা বড়বুল্লা সড়কের পাশে ২০-২২টি বসতঘরের মেঝেতে পানি। এ ছাড়াও অন্যান্য গ্রামগুলো তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সরাইল সদর ইউনিয়নের নোয়াহাটি এলাকার বেশকিছু বসতবাড়িতে এখন পানি রয়েছে। নোয়াগাঁও ইউনিয়নের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে বাড়িউড়া নামক স্থানে ২০-২৫টি বসতবাড়িতে হাঁটু পানি। বাড়িঘর ছেলে লোকজন আশ্রয় নিয়েছেন অন্যত্র। কালিকচ্ছের চানপুর, গলানিয়ার অবস্থা ভয়াবহ। অন্যান্য নিচু গ্রামসহ ৫০-৬০টি বসতবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। শাহবাজপুর ও পানিশ্বরের বেশকিছু বাড়িও পানিতে তলিয়ে গেছে। অরূয়াইল, পাকশিমুল ও শাহাজাদাপুরের অনেক গ্রাম এখন যাতায়াতের জন্য নৌকা ও কলা গাছের তৈরি ভেলা (ভুরা) নির্ভর হয়ে পড়েছে। করোনার প্রভাবে গত চার মাস ধরে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা বেহাল। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজনের জীবন চলছে খুবই কষ্টে। এরমধ্যে আকস্মিক এ বন্যা মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। সীমাহীন দুঃখ কষ্টের মধ্যে পড়েছে উপজেলার অনেক পরিবার। গতকাল দুপুরের পর অরূয়াইল আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে হাজির হন নির্বাহী কর্মকর্তা এ এস এম মোসা। তিনি নৌকায় ঘুরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অনেক পরিবারের হাতে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি সকলকে বন্যার সময়ে করোনার কথা ভুলে যেতে নিষেধ করেছেন। স্ব স্ব অবস্থানে যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় চলার পরামর্শ দিয়েছেন। নির্বাহী কর্মকর্তা এ এস এম মোসা করোনার আতঙ্কের মধ্যেই বন্যার থাবার কথা স্বীকার করে বলেন, আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে। সরকার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সহায়তা করতে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। বিপদ থাকবে না। আমরা আপনাদের পাশে আছি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিপদগ্রস্ত মানুষগুলোর দিকে খেয়াল রাখার নির্দেশ দিয়েছেন ইউএনও।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status