শেষের পাতা

ট্যানারি মালিকদের শঙ্কা

আলতাফ হোসাইন

১১ জুলাই ২০২০, শনিবার, ৯:০৯ পূর্বাহ্ন

প্রতিবছর ঈদুল আজহায় দেশে ১ কোটিরও বেশি পশু কোরবানি করা হয়। এ সময়টাতেই ট্যানারিগুলো সবচেয়ে বেশি চামড়া সংগ্রহ করে। তারা মোট চামড়ার ৫০ শতাংশই সংগ্রহ করে ঈদুল আজহায়। তাই কোরবানি উপলক্ষে চামড়া ব্যবসায়ীদের থাকে বাড়তি প্রস্তুতি। কিন্তু এবার করোনায় আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকায় ইতিমধ্যেই ট্যানারিগুলোতে কাঁচা চামড়ার স্তূপ জমেছে। পচে নষ্ট হয়েছে লাখ লাখ টাকার চামড়া। রপ্তানি বন্ধ থাকায় কোটি কোটি টাকার চামড়া মজুত রয়েছে। এ ছাড়া পুরান ঢাকা থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরসহ নানা জটিলতায় ইতিমধ্যেই ধস নেমেছে দেশের দ্বিতীয় সম্ভাবনাময় এই রপ্তানি খাতে। এ অবস্থায় পুঁজি হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে চামড়া ব্যবসায়ীরা। ন্যায্য দাম না পাওয়ায় গত বছর চামড়া ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে প্রান্তিক বিক্রেতারা মুনাফা হারিয়েছিলেন। এবারও ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চামড়া খাতে অর্থায়ন না করা হলে এই শিল্পের সংকট আরো বেড়ে যাবে। এ অবস্থায় চামড়া শিল্পকে বাঁচাতে এবার ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে চামড়া ব্যবসায়ীদের বাড়তি সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে খেলাপি গ্রাহকরা নতুন করে ঋণ পাবেন। তবে এতেও সন্তুষ্ট হতে পারছেন না ট্যানারি মালিকরা। তারা বলছেন, এই ঋণ সুবিধা চামড়া শিল্পের জন্য কোন সুফল বয়ে আনবে না। তারা আরো কিছু দাবি তুলে ধরেছেন। দেশে কাঁচা চামড়া রপ্তানি বন্ধ থাকলেও পঁচে যাওয়া ঠেকাতে এবছর নূন্যনতম দাম নির্ধারণ করে রপ্তানি খুলে দেয়ার সুপারিশ করেছে ট্যারিফ কমিশন।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, করোনায় রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ট্যানারিগুলোতে বর্তমানে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার চামড়া জমা আছে। প্রচুর কাঁচা চামড়া নষ্ট হয়েছে। এ অবস্থায় পুনঃঅর্থায়ন করা না হলে চামড়া শিল্প আবারও ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের জন্য যে ঋণ সহায়তার কথা বলা হচ্ছে তাতে চামড়া ক্রয়ের জন্য কিছু ব্যবসায়ী সাময়িকভাবে উপকৃত হবে। কিন্তু এতে চামড়া খাতের জন্য কোনো কাজে আসবে না। গত বছর যেমন ট্যানারিতে চামড়া পঁচে নষ্ট হয়েছে, এবারও তেমনটাই হবে। কারণ ব্যাংকগুলো শুধু নিয়মিত গ্রাহকদের টাকা দিচ্ছে। স্বল্পমেয়াদি এসব ঋণ অনেকেই পরিশোধ করতে পারেননি। ফলে তারা এবারও ঋণ পাবেন না। এ জন্য আমরা এই খাতের জন্য ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকা ঋণ সহায়তার কথা বলছি। প্রতিবছর ১ থেকে দেড়শ কোটি টাকা দেয়া হয় যা একেবারেই অপ্রতুল। এই ঋণ সুবিধার পাশাপাশি গত তিন বছরের ব্যাংক ঋণ মওকুফ করে, ব্লক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরসহ মোরাটরিয়াম সুবিধা দিতে হবে। তবেই এই শিল্পে সুদিনে ফিরে বলে মনে করনে তিনি।
চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুরান ঢাকা থেকে চামড়া শিল্প এলাকা সাভারে স্থানান্তরের পর থেকে চামড়া খাতে নানা জটিলত সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও এখনো কয়েকটি ইউনিটে অবকাঠামো তৈরি হয়নি। এই স্থানান্তরপ্রক্রিয়ার মধ্যে প্রায় ২২৫টি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এরমধ্যে কিছু কারখানা চালু হলেও এখনো প্রায় দেড় শতাধিক ট্যানারি বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ২২টি ট্যানারির ২১টিই একে একে বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর করোনা সংক্রমণ শুরু হলে আরেক দফা হুমকির মুখে পড়ে দেশের চামড়া শিল্প। রপ্তানি বন্ধ থাকা, কাঁচা চামড়া পঁচে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কোটি কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়ে এ শিল্প। ফলে রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা এই সম্ভাবনাময় খাত নেমে এসেছে চতুর্থস্থানে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৪১ শতাংশ কমে গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সেইসঙ্গে করোনার কারণে অনেক কারখানা বন্ধ রয়েছে। করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই চীনের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকায় মুখ থুবড়ে পড়ে চামড়া রপ্তানি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে এমনিতেই সংকটে পড়েছে দেশের চামড়া শিল্প। অনেক ট্যানারি এখনো বন্ধ রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে কেউ কেউ চামড়া কেনার প্রস্তুতি নিলেও অনেকে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। ঋণখেলাপির ফলে মালিকরা ব্যবসায় ফিরছেন না। তবে বিশেষ ঋণ সুবিধার ঘোষণায় কেউ কেউ এতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। তবে অনেকই ঋণ মওকুফের দাবির সঙ্গে একমত প্রকাশ করছেন। ফলে এবছর অনেক ট্যানারি মালিকরা চামড়া ক্রয় থেকে বিরত খাকতে পারে। এতে চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছেন প্রান্তিক পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, ট্যানারি মালিকদের আগে শিল্পের সার্বিক অবস্থার হিসেব দেবে। কত টাকার চামড়া নষ্ট হলো কত টাকার চামড়া মজুদ আছে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ট্যানারি মালিকদের গাফিলতি রয়েছে। অন্যদিকে তারা মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অল্প দামে চামড়া কিনে বেশি দামে বিক্রি করার জন্য মজুদ করে। কিন্তু ব্যাংকের টাকা ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের যত আপত্তি। এ অবস্থায় তারা ঋণ মওকুফ চায়, মোরাটরিয়াম সুবিধা চায়। কিন্তু ব্যবসায়ীদের জন্য যে বিশেষ ঋণ সুবিধা দেয়া হচ্ছে এর সুষ্ঠু ব্যবহার আগে তাদের করতে হবে। এই ঋণ থেকে যারা যে পরিমান অর্থ সহায়তা পাবে তা দিয়ে যদি সংকট মোকাবিলা করা না যায় তাহলে বিকল্প অবশ্যই ভাবতে হবে। তবে তার আগে তাদের হিসেব দিতে হবে যে কী পরিমান চামড়া তাদের ট্যানারিগুলোতে জমা আছে এবং ক্ষতির পরিমাণ কতো? এটা সত্য যে আগের বছরই ট্যানারিগুলোতে অনেক চামড়া জমা রয়েছে। এরমধ্যে আবার কোরবানি চলে আসছে। সেজন্য চামড়া যাতে নষ্ট না হয়ে যায় সেজন্য তাদের সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status