প্রথম পাতা

প্রতারক প্রতিষ্ঠান কীভাবে চিকিৎসা সেবার দায়িত্ব পায়?

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

৮ জুলাই ২০২০, বুধবার, ৯:৩৭ পূর্বাহ্ন

করোনার সুযোগ নিয়ে বাণিজ্য। আর্তমানবতার সেবার বদলে অর্থ আদায়। করোনার চিকিৎসার নামে তারা দেশে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে। এতে সুযোগ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা। করোনা নিয়ে একের পর এক প্রতারণার ঘটনায় এখন সর্বত্রই প্রশ্ন। প্রতারক প্রতিষ্ঠান কিভাবে করোনা চিকিৎসার সুযোগ পায়?
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এমএ ফয়েজ মানবজমিনকে বলেন, যারা করোনার সুযোগ নিয়ে প্রতারণা করছে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের কঠোর হতে হবে। প্রচলিত আইন তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। রেজিস্ট্রেশনবিহীন তারা কিভাবে কার্যকম চালায়। কারা সুয়োগ করে দিয়েছে। করোনাকালে দায়িত্বশীলও মানবিক আচরণ করার আহবান জানান তিনি।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া যায় রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে। নানা অনিয়মের অভিযোগে রিজেন্টের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় সোমবার অভিযান চালায় র‌্যাব। অভিযানে কোভিড পরীক্ষার ভুয়া সনদসহ নানা অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়। ইতিমধ্যে হাসপাতালকে সিলগালা করে দিয়েছে প্রশাসন। করোনা চিকিৎসার অনুমতি পাওয়া রিজেন্ট হাসপাতাল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এর আগে ২৩শে জুন করোনা নমুনা সংগ্রহকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জেকেজি হেলথ কেয়ারও প্রতাণা করে ধরা খেয়েছে। শুরু থেকেই বিতর্কিত ছিল জেকেজি হেলথ কেয়ার। করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগে ওঠেছে তাদের বিরুদ্ধেও। ফলে কোভিড-১৯ সন্দেহভাজন রোগীর নমুনা সংগ্রহ, কেন্দ্র স্থাপন ও প্রশিক্ষণ দেয়ার বিষয়ে জেকেজি হেলথ কেয়ারের অনুমোদন বাতিল করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) নমুনা পরীক্ষার জন্য অনুমতি পায় জেকেজি হেলথ কেয়ার। জেকেজি বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহের জন্য ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পৃথক ছয়টি স্থানে ৪৪টি বুথ স্থাপন করেছিল। এসব এলাকা থেকে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৩৫০ জনের নমুনা সংগ্রহ করতো জেকেজি। শর্ত ছিল সরকার নির্ধারিত করোনা শনাক্তকরণ ল্যাবরেটরিতে নমুনা পাঠাতে হবে। জেকেজি হেলথ কেয়ার ওভাল গ্রুপের একটি অঙ্গসংগঠন। তবে ২৩শে জুন করোনার উপসর্গ থাকা রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া রিপোর্ট প্রদানকারী প্রতারকচক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে তেজগাঁও থানা পুলিশ।  গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ছিলেন আরিফুল চৌধুরী জেকেজির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। এই প্রতারকচক্র সাধারণ মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে প্রতারণা করে আসছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে।
এদিকে সম্প্রতি দেশে দেখা দেয় কিট সঙ্কট। আগে থেকেই বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন বেশি বেশি ল্যাব স্থাপন করে বেশি মানুষকে পরীক্ষার আওতায় আনতে।  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও একই পরামর্শ  দেয়। শুরু থেকেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলে আসছে দেশে পর্যাপ্ত কিট রয়েছে। ধীরে ধীরে ল্যাব বাড়লেও কিট সরবরাহ কমে যায়। এখন প্রতিদিন পরীক্ষাও কম হচ্ছে। শনাক্তও মিলছে কম। এমন অবস্থার মধ্যেই সরকার দলীয় সংসদ সদস্য ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী ভয়াবহ তথ্য প্রকাশ করেন গত সপ্তাহে। তিনি জানিয়েছে, কিট সংকটের পেছনে একটি সিন্ডিকেট দায়ী। কিছু ব্যবসায়ীর হাতে কিট থাকলেও এ সিন্ডিকেট তা বাজারে আনতে দিচ্ছে না। এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তিনি আহবান জানিয়েছেন। এই সংসদ সদস্য একজন ঠিকাদারের নাম প্রকাশ করেছেন। তিনি মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। গত কয়েক বছর ধরেই মিঠু সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি পুরো স্বাস্থ্য খাত। এনিয়ে নানা আলোচনা হয়েছে। কিন্তু মিঠু সিন্ডিকেট ভাঙার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আলোচনা রয়েছে বিদেশে থেকেই মিঠু তার সম্রাজ্য পরিচালনা করছেন। স্বাস্থ্যের সব ধরণের ঠিকাদারি তার নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। করোনাকালেও সক্রিয় এই সিন্ডিকেট। অত্যন্ত প্রভাবশালী এই সিন্ডিকেটের হাতেই জিম্মি হয়ে আছে পুরো স্বাস্থ্য খাত। আর এই সিন্ডিকেটের নেপথ্য নায়ক এই খাতের মাফিয়া ডন হিসেবে পরিচিত মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু।
করোনার সুযোগে মাস্ক নিয়েও প্রতারণা হয় দেশে। করোনা বাড়তে থাকায় চাহিদা বৃদ্ধি পায় মাস্কের। দেখা দেয় মানসম্পন্ন মাস্কের সংকট। এই সুযোগ নেয় এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী। দুর্নীতি হয় স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঝে সরবরাহ করা মাস্ক নিয়েও। এন-৯৫ মাস্ক জাতিয়াতির ঘটনায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জেএমআই’র কর্ণধার আবদুর রাজ্জাকসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, তদন্ত নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি প্রভাব বিস্তারও। তাই অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। জানা গেছে, যাদের নাম প্রতিবেদনে এসেছে, তারা এন-৯৫ মাস্কের চালান গ্রহণ করেন। এছাড়া উচ্চ পর্যায়ের কাউকে এই তদন্তের আওতায় আনা বা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়নি।
তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত সচিব সাইদুর রহমান এ বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। এখন এটি বাস্তবায়ন করার কথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাসপাতাল অনুবিভাগের। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে হাসপাতাল অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মুহিবুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, এ বিষয়ে তারা জানা নেই। দুই সপ্তাহ আগে তিনি এখানে এসেছেন। তবে প্রতিবেদনের আলোকে কিছু না কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
অন্যদিকে মাস্ক, পিপিইসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীর ক্রয় ও সরবরাহে দুর্নীতি-অনিয়মের বেশ কয়েকটি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গত মাসের গোড়ার দিকে অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব দুর্নীতিতে জড়িত সন্দেহে ‘প্রভাবশালী’ প্রায় এক ডজন ব্যক্তির একটি তালিকা তৈরি করেছে দুদক। যাদের মধ্যে আছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উচ্চপর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা এবং তাদের আত্মীয়-স্বজন। তবে দুদক কর্মকর্তারা অনুসন্ধানের স্বার্থে ওইসব কর্মকর্তার নাম প্রকাশ করেননি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status