মত-মতান্তর

একজন উপাচার্যের জানাযা

এ এম এম নাসির উদ্দিন

৬ জুন ২০২০, শনিবার, ৮:২৭ পূর্বাহ্ন

কোভিড-১৯ এর প্রেক্ষাপটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী লক্ষ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন।এর মধ্যে কওমী মাদ্রাসাগুলোর জন্যে সাড়ে আট কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। আজ সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক এ বরাদ্দ নিয়ে এক টিভি টক শোতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং এ বরাদ্দের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তার দাবি, এরা স্বাধীনতা বিরোধী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেনা। অতএব, প্রণোদনার হকদার নহে। তিনি আরো বলেন, এ টাকা বরং বাস মালিকদের সাবসিডি হিসেবে দিলে বাস ভাড়া বাড়ানোর প্রয়োজন হতোনা। চমৎকার যুক্তি।এ অধ্যাপকের সাথে আমার পরিচয় নেই। তাঁকে প্রায়শই বিভিন্ন টিভি টক শোতে দেখা যায়। দূর থেকে তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি এবং তিনি অন্য অনেকের মত নির্লজ্জ চাটুকার নহেন বলে আমার ধারণা। শত বছরের পুরানো কওমী ধারার মাদ্রাসাগুলোর বর্তমান ছাত্রদের সবার জন্ম বাংলাদেশ আমলে এবং শিক্ষকদের অধিকাংশও বাংলাদেশ প্রজন্মের। ছাত্র শিক্ষক মিলিয়ে এক কোটির বেশি লোক কওমী মাদ্রাসার সাথে জড়িত।

যারা দেশ চালান তারা বুঝেন কওমী ধারার মানুষগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ। হাজার হাজার কোটি প্রণোদনার টাকা বিভিন্ন খাতে চলে গেল। কিন্তু অধ্যাপক সাহেব শুধুমাত্র কওমী মাদ্রাসার সাড়ে আট কোটি টাকাকেই অযথা মনে করলেন। আসলে আমাদের কিছু সুশীল সমাজের সদস্য বা বুদ্ধিজীবী আছেন, আলেম ওলামা কিংবা ইসলাম ধর্মের পক্ষের কোন বিষয় দেখলে তাদের গা-জ্বালা করে।সুশীল সমাজে টিকে থাকার জন্যে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে বা আকার ইংগিতে হলেও ইসলাম বা ধর্মীয় শিক্ষার বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়। এটা না করলে সভা সেমিনার বা টক শোতে দাওয়াত পাওয়া দুষ্কর। বুদ্ধিজীবীর তালিকায় স্থান নিচে চলে যায়।

আর ইসলাম বা ধর্মীয় শিক্ষার পক্ষে কথা বললে নির্ঘাত মৌলবাদী বা সাম্প্রদায়িকতার তকমা কপালে জুটবে এবং সুশীল সমাজ থেকে নির্বাসিত হবার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে। অন্য কোন ধর্মের পক্ষে কথা বললে অবশ্য এ ভয় নেই। অধ্যাপক সাহেব সুশীল সমাজে তাঁর অবস্থান ধরে রাখা বা  আরো মজবুত করার জন্যেই হয়তোবা কওমী মাদ্রাসার প্রণোদনার বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন।করোনা এদেশের বহু গুণীজনের প্রাণ সংহার করেছে।কখন কার মৃত্যুর পালা আসে ঠিক নেই। এখনো আমরা সংকীর্ণতার উর্দ্ধে উঠতে পারছিনা।পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক ঘোষণা দিয়েছেন আমি কিছু লোকের হৃদয়ে মোহর মেরে দিয়েছি,এরা অন্ধ, বধির। এপ্রসঙ্গে আমার দেখা একটা ঘটনার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক মনে করছি। ১৯৭৩ সাল। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক মিলাদ মাহফিল। প্রধান অতিথি উপাচার্য অধ্যাপক মরহুম আবুল ফজল। শ্বেত শুভ্র চুল ও শশ্রুমন্ডিত সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরিহিত প্রধান অতিথি র অবয়ব প্রথম দর্শনেই সবার শ্রদ্ধা জাগানিয়া। উনি ছিলেন আমাদের পিতৃতুল্য ও পরম শ্রদ্ধেয়। উনার পিতা মরহুম মৌলানা ফজলুর রহমান ছিলেন চট্টগ্রাম জুমা মসজিদের ইমাম। লেখাপড়া শেষে আবুল ফজল সাহেব ও ইমাম হিসেবেই চাকুরি শুরু করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা করেন।

তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজেও শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। প্রধান বক্তা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মসজিদের ইমাম জনাব মৌলানা হাবিবুর রহমান। সুশিক্ষিত ইংরেজি, আরবি, বাংলায় সমান দখল তাঁর। অত্যন্ত ভালো বক্তা। বক্তৃতার এক পর্যায়ে প্রধান অতিথিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মাননীয় উপাচার্য আপনি মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে অনেক লেখালেখি করেছেন। মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাশিম(অন্ধ হাশিম হিসেবেও পরিচিত ছিলেন)ইন্তেকাল করলে পল্টন ময়দানে একজন মৌলানার অভাবে যখন উনার মত এত বড় নেতার জানাযা পড়ানো যচ্ছিলনা তখন আপনারা কোন ইংরেজি শিক্ষিত লোক তো এগিয়ে গিয়ে জানাযাটা পড়াতে পারেননি! আপনি নিজেও তথায় উপস্হিত ছিলেন। মৌলানা খুঁজে এনে অনেক বিলম্বে জানাযা পড়াতে হয়েছে। আল্লাহ না করুন আপনার ভাগ্যে যে এমনটা ঘটবেনা তার গ্যারান্টি কোথায়? ঠিক দশ বছর পর ১৯৮৩ সাল।আমি চট্টগ্রামে কর্মরত। সম্ভবত মে মাস।

খবর পেলাম আবুল ফজল সাহেব ইন্তেকাল করেছেন। ছুটে গেলাম তাঁর কাজীর দেওড়ির বাসায়। বিকেলে সার্কিট হাউজ মাঠে জানাযা। কাতারে আমার ডানে নোবেল জয়ী ডঃ মুহম্মদ ইউনুস ও বামে আমার সাবেক সহকর্মী ও সাবেক মন্ত্রী জনাব আরিফ মইন উদ্দিন। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ। জানাযা আর শুরু হয়না। জানাযা পড়ানোর জন্যে কোন মৌলানা পাওয়া যায়নি। ধর্ম নিয়ে আবুল ফজল সাহেবের কথিত অবস্থানের কারণে কোন মৌলানা তাঁর জানাযা পড়াতে রাজি নয়। লাশ সামনে নিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে উনার নিজের পাড়া কাজীর দেওড়ি মসজিদের ইমাম সাহেবকে এনে অবশেষে জানাযা পড়াতে হয়েছিল। জানাযার কাতারে অপেক্ষমান অবস্থায় আমার কানে বার বার বাজছিলো ১৯৭৩ সালে মৌলানা হাবিবুর রহমানের সে বক্তব্য। আমাদের যে কারো কপালে এটা ঘটতে পারে। আসুন সংকীর্ণতার উর্ধে উঠে এ মহামারীর সময়ে সবার জন্যে ক্ষমা ও রহমত চেয়ে পরম করুণাময়ের কাছে ফরিয়াদ করি। অযথা ইসলাম ও ধর্মীয় শিক্ষার বিরোধিতা থেকে এবং বিতর্ক সৃষ্টি থেকে বিরত থাকি।

 লেখক - সাবেক সচিব
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status