প্রথম পাতা

সিলেটে ৪ হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেলেন ইকবাল

ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে

৬ জুন ২০২০, শনিবার, ৮:৩০ পূর্বাহ্ন

‘আব্বুকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। কিন্তু চার হাসপাতাল ঘুরেও বাঁচাতে পারলাম না। এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে’।- কথাগুলো বলেই কেঁদে ফেলেন সিলেটে ব্যবসায়ী পুত্র তিয়াম। পিতার মৃত্যুর পর থেকে অঝোরে কাঁদছেন তিনি। কথা বলার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছেন। সিলেটের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন খোকার ছেলে নাসিব লতিফ তিয়াম। খোকা নিজ নামেই শহরের পরিচিত। নগরীর বন্দরবাজারের আরএল ইলেক্ট্রনিক শপের স্বত্বাধিকারী তিনি। সবার পরিচিত। ‘খোকা ভাই’ নামে সবার কাছে পরিচিত। বয়স প্রায় ৫৫ বছর। এই খোকাকে নিয়ে গতকাল সকালে চার হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসা পেলেন না ছেলে তিয়াম। কোনো কোনো হাসপাতাল গেইটই খুলেনি। পরিবারের অভিযোগ- বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন খোকা। অক্সিজেন সাপোর্ট পেলে হয়তো বাচানো যেতো খোকাকে। ছেলে তিয়ামের আবেগপূর্ণ বক্তব্য গতকাল সকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাসতে থাকে। যারাই এ বক্তব্য শুনেছেন চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। সিলেটের খোকার মৃত্যুই প্রথম নয়। এর আগেও করোনা সন্দেহ একাধিক রোগীকে ভর্তি করেনি সিলেটের বেসরকারি, সরকারি হাসপাতালগুলো। চিকিৎসার অপেক্ষায় থাকা রোগীরা মারা গেছে এম্বুলেন্সেই। মারা যাওয়া ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন খোকার ছেলে নাসিম লতিফ তিয়াম জানিয়েছেন- তার পিতা কয়েক দিন কিছুটা অসুস্থ অনুভব করেন। এ কারণে তাকে সুবহানীঘাট এলাকার অত্যাধুনিক আল হারমাইন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রায় ৪ দিন আগে করোনা টেস্টের জন্য নমুনা দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু এখনো নমুনার ফলাফল জানানো হয়নি। শুক্রবার ভোররাতে হঠাৎ করে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিছুটা শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। এ কারণে তিনি ফোন দেন সুবহানীঘাটের একটি হাসপাতালে। ওই হাসপাতালের কাছে তিনি একটি এম্বুলেন্স চান। এম্বুলেন্স পাঠানো হয়। সেই এম্বুলেন্সে অক্সিজেন ব্যবস্থা স্বাভাবিক ছিলো না। এরপরও এম্বুলেন্স আসার পর তিনি পিতা খোকাকে এম্বুলেন্সে তোলে নিয়ে যান ওই হাসপাতালে। সেখানে নেয়ার পর ডাক্তার তাকে ভর্তি করেননি। করোনা সন্দেহে তার পিতাকে ভর্তি করা হচ্ছে না। এ সময় তিনি ওই হাসপাতালের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের কাছে অক্সিজেন চান। বলেন- ‘অন্তত একটি অক্সিজেন দিয়ে সহযোগিতা করুন।’ এরপরও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে অক্সিজেন দিয়েও সহযোগিতা করেনি। এ সময় হাসপাতালের ডাক্তাররা রোগীকে নদীর দক্ষিণ পাড়ের নর্থইষ্ট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য রেফার করেন। বলেন- নর্থইষ্টে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা চিকিৎসা দিতে পারে। সুবহানীঘাটের ওই হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা না পেয়ে তিনি গাড়িতে থাকা অসুস্থ পিতাকে নিয়ে যান নর্থইষ্ট হাসপাতালে। ওখানে যাওয়ার পর ডাক্তাররা রোগীর কথা শুনেই বলেন- ‘সিট খালি নেই। এই রোগী এখানে রাখা সম্ভব নয়।’ এতে করে অসহায় হয়ে পড়েন তিয়াম। ওদিকে- গাড়িতে থাকা অসুস্থ পিতার ছটফট করছেন। কিছুই বুঝতে পারছেন না কী করবেন। এমন সময় তিনি তার এক পরিচিত ডাক্তারকে ফোন দেন। ঘটনা বলেন। সব শুনে ডাক্তার পরামর্শ দেন- দ্রুত সিলেটের করোনা আইসোলেশন সেন্টার শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে নিয়ে যেতে। ওই ডাক্তারের পরামর্শে তিনি তার পিতাকে নিয়ে আসেন শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে। হাসপাতালের সব বন্ধ। প্রধান ফটক খোলা থাকলেও ভেতরে ঢুকার সব কলাপসিবল গেইট বন্ধ। গেইটে দাঁড়িয়ে ডাক দেন। গেইটে থাপড়ান। ১০ মিনিট পর হাসপাতালের এক কর্মচারী বেরিয়ে আসেন। এ সময় গেইট খোলার জন্য অনুনয় করে তিয়াম। কিন্তু ওই কর্মচারী গেইট খুলেনি। বলে- ‘ডাক্তাররা ঘুমে। এখন খোলা যাবে না। আপনারা ওসমানীতে নিয়ে যান।’ তিয়াম জানান- ‘অনেক করে বললেও হাসপাতালের ওই কর্মচারী তার আর্তনাদ শুনেনি।’ এদিকে- শামসুদ্দিন হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে তিনি তার অসুস্থ পিতাকে নিয়ে যান ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। সেখানে নেয়ার পর জরুরি বিভাগের ডাক্তাররা তার পিতাকে দেখেন। জরুরি বিভাগে ইসিজি করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মেশিন কাজ না করায় পাঠিয়ে দেন সিসিইউ বিভাগে। সেখানে নেয়ার পর ডাক্তাররা প্রথমে তার পিতাকে বারান্দায়ই রাখেন। পরে তারা ইসিজি মেশিন নিয়ে এসে পরীক্ষা করেন। এ সময় সিসিইউতে কর্মরত ডাক্তার তার পিতাকে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। কথা মতো জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন খোকাকে। সেখানে নিয়ে আসার পর ডাক্তার পরীক্ষা করে তার পিতাকে মৃত ঘোষনা করেন। এমন ঘটনায় মর্মাহত সিলেটের ব্যবসায়ী পুত্র। কেঁদে কেঁেদ বলছিলেন- হাসপাতালগুলোর ডাক্তাররা তার পিতাকে ভালোভাবে পরীক্ষাই করেননি। সবাই তাড়িয়ে দিয়েছে। আপ্রাণ চেষ্টা করে পিতাকে বাঁচাতে পারলাম না। এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে।’ এদিকে- সকালে ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন খোকার মরদেহ তার কুমারপাড়াস্থ ৫৮ ইকবাল মঞ্জিলে নিয়ে আসেন। জুম্মার পর লাশ হযরত মানিকপীর (রহ.) মাজারস্থ টিলায় দাফন করা হয়। ইকবাল হোসেন খোকার ভাই নাজিব মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ‘বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর পরিবারের নমুনার সঙ্গে তার ভাই ইকবালের করোনা টেস্টেও নমুনা হয়েছিলো। মেয়রের স্ত্রীর রিপোর্ট এলেও তার ভাইয়ের রিপোর্ট আসেনি। সবাই বলছে- করোনা নেগেটিভ এলে রিপোর্ট আসে না। এরপরও কোনো হাসপাতালই তার ভাইকে গ্রহণ করলো না।’
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status