প্রথম পাতা

‘নম্বরটি কোথায় গিয়ে ঠেকবে প্রেডিকশন করা যাচ্ছে না’

কাজল ঘোষ

৫ জুন ২০২০, শুক্রবার, ৮:২০ পূর্বাহ্ন

আমাদের ব্যবস্থাপনার বড় দুর্বলতা রয়ে গেছে। এখানে কে যে কোথায় কি করছেন আমরা তাই বলতে পারছি না। আমাদের এখানে প্রথম থেকেই কোন কিছুই সঠিক পরিকল্পনা মাফিক হয়নি। আমরা শর্ত পূরণ না করেই লকডাউন তুলে দিয়েছি। এখন আক্রান্তের হার যেভাবে বাড়ছে সেই নম্বর কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা-ও প্রেডিকশন করা যাচ্ছে না। মানবজিমনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সরকারের কোভিড-১৯ নিয়ে গঠিত ট্রিটমেন্ট সাব-কমিটির সদস্য ও ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ রিসার্স সেন্টারের প্রধান অধ্যাপক ডা. রিদওয়ান উর রহমান এ কথা বলেন। তিন আগামী দশ দিনে আক্রান্তের  হার বাড়বে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
লকডাউন শেষের তৃতীয় দিন সর্বোচ্চ শনাক্ত হয়েছে ২,৯১১ জন। বাড়ছে মৃত্যু। প্রায় প্রতিদিনই করোনার গ্রাফ রেকর্ড ভাঙছে, আপনি কীভাবে দেখছেন?
ডা. রিদওয়ান বলেন, আমাদের এখানে রোগী এখন বাড়ার দিকেই আছে। পেছনের তিনদিন যে পরিমাণ রোগী আমরা বাড়তে দেখেছি তারা সংক্রমিত হয়েছেন ঈদের আগের দিন, ঈদের দিন ও তারপর দিন। যারা এ দিনগুলোতে সংক্রমিত হয়েছেন তারাই আজকে রোগী হচ্ছেন। যারা আজকে মারা যাচ্ছেন তারা রোজার শেষদিকে আক্রান্ত হয়েছেন। এখন যে লকডাউন খুলে দেয়া হলো এর কারণে কি প্রভাব পড়বে তা আমরা দেখতে পাব আরও পাঁচ-সাত দিন পর। এটার কারণে যে মৃত্যুর হার দাঁড়াবে তা-ও টের পাওয়া যাবে আরও দশ দিন পরে। আমরা এ কয়দিন যে মৃত্যু বা নতুন রোগী দেখছি তারা আক্রান্ত হয়েছেন ঈদের সময় যে চলাচল হয়েছে সে সময়টাতেই।
বাংলাদেশ আক্রান্তের কোন পর্যায়ে আছে? বিশ্বের অনেক দেশেই কমছে কিন্তু আমাদের এখানে এ সূচক ঊর্ধ্বমুখী?
আমরা তো রোগ নির্ণয় করতেই পরছিনা। আমাদের এখানে টেস্ট বাড়ছে, রোগীও বাড়ছে। টেস্ট যদি এক লাখ হতো তাহলে রোগীও এর দশগুণ হতো। দেশব্যাপী করলে পুরোদেশের চিত্র পাওয়া যেত। আমাদের সীমিত সংখ্যক জায়গায় টেস্ট হচ্ছে। এই সীমিত সংখ্যক স্থানে যারা কষ্ট করে টেস্ট করাতে পারছেন সেই ডাটাটাই আমরা পাচ্ছি। বর্তমান হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ১২,০০০ টেস্টের মধ্যে প্রায় তিন হাজার রোগী কোভিড শনাক্ত হচ্ছে। অর্থাৎ সংখ্যাটা প্রায় পঁচিশ ভাগ।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ভাষ্য মতে, যত বেশি রোগী বাড়ছে এর অর্থ দাঁড়ায় অনেক রোগীকে এখনও চিহ্নিত করা যায়নি বা আনডিটেকটেড রয়ে গেছে। হু বলে থাকে, রোগীর হার যদি ৯ ভাগের কম হয় তাহলে ধরে নিতে হবে সমপরিমাণ রোগী আনডিটেকটেড রয়ে গেছে। আমাদের এখানে এ হার ইতিমধ্যে পঁচিশ ভাগ। কোনো কোনো জায়গায় তা পঞ্চাশ ভাগও হয়েছে। যেমন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পরীক্ষায় দেখা গেছে সেখানে যা পরীক্ষা হয়েছে তার পঞ্চাশ ভাগ রোগী। এটাতে বোঝা যায়, আমরা একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক রোগী শনাক্ত করতে পেরেছি। এর চেয়ে অনেক বেশি রোগী আওতার বাইরে রয়ে গেছে। বর্তমানে যা দেখছি, এটাও প্রকৃত সংখ্যা নয়। এই সংখ্যাটা বিরাট। বর্তমানে যে মৃত্যুর হার আছে তাও অনেক বেশি। যে রোগী আছে তাও ঠিক নয়, এর সংখ্যা আরো অনেক বেশি। এটা কোথায় যাবে তা এখনও বলা যাচ্ছে না। দুনিয়াতে এমন কোনো ঘনবসতি দেশ নেই, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা নেই যেখানে মহামারী এসেছে অথচ কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা মানতে পারেনি। এমন জায়গায় কি পরিস্থিতি দাঁড়াবে বলা মুশকিল। আমরাই দুনিয়াতে এমন পরিস্থিতির দেশ হিসেবে উদাহরণ হতে যাচ্ছি।
অনেকেই সন্দেহ করেন, আমাদের রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। এটা কয়েক লাখের বেশি হতে পারে। এর সঙ্গে আছেন যারা সিম্পটম ছাড়া। ঢাকায় একটি জরিপ করে দেখা যেতে পারে সব মিলে এ মুহূর্তে এখানে রোগীর সংখ্যা কত? এটা স্পেন, ইতালি, নিউ ইয়র্ক, সুইডেনে যে উদাহরণ আছে সেসব স্থানে মাত্র ৯ ভাগ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, ফ্রান্সে মাত্র ৫ ভাগ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এসব স্থানে ৫ ভাগ মানুষ আক্রান্ত হয়ে ত্রিশ হাজার মানুষ মারা গেছে। এটা যদি সত্তর ভাগ হয় তাহলে কত লোক মারা যেতে পারে? বলা হয়ে থাকে, যত আক্রান্ত হবেন তার অন্তত এক ভাগ মারা যাবেন। যারা হাসপাতালে ভর্তি হবেন তাদের মধ্যে ৫ ভাগ মারা যাবেন। এই নম্বরটি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা প্রেডিকশন করা যাচ্ছে না। তবে এ মাসের শেষদিকে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
দেশের বিভিন্ন এলাকাকে তিনটি জোনে ভাগ করা হয়েছে, এর ফলাফল কি হবে?
আমরা সবকিছুই দেরিতে করছি। এই যে তিনটি জোনে ভাগ করা হলো তা রমজানের মাঝামাঝি থেকে করা দরকার ছিল। যেগুলো রেড আছে সে গুলোতে সেভাবে অ্যাকশনে যাওয়া। যেমন- ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর সিটি। সবগুলোই রেড জোনের মধ্যে। কিন্তু এই সিটিগুলোতে আমরা সব কার্যক্রম খুলে দিয়েছি। আমরা একেবারে নীতিমালার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছি। কথা হচ্ছে লকডাউন কখন প্রত্যাহার করা যাবে? তিনটি শর্ত মেনে লকডাউন খুলে দেয়া যাবে। টানা দুই সপ্তাহ ধারাবাহিক ভাবে রোগের সংক্রমণ হার কমতে হবে, হাসপাতালে রোগীর পরিমাণ কমতে হবে, মৃত্যুর হারও কমতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। যে চাইবে তাকেই পরীক্ষার সুযোগ করে দিতে হবে। হাসপাতালে পর্যাপ্ত সেবা নিশ্চিত করতে হবে। লকডাউন তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে যে তিনটি পূর্ব শর্ত তা পূরণ না করেই আমরা লকডাউন তুলে দিয়েছি। আমরা এখন ভাবতেই পারছি না, রোগীর পরিমাণ কি হবে?
আক্রান্তের যে হার তাতে হাসপাতালে ভর্তির অবস্থা নেই? সাধারণ রোগীদেরও ভর্তি নেয়া হচ্ছে না? সংক্রমণ আরো বাড়তে থাকলে কি পরিস্থিতি দাঁড়াবে?
খুব খারাপ অবস্থায় আছি আমরা। গত ৮ই মার্চ আমরা প্রথম রোগী শনাক্ত করেছি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমরা ধারণা করতে পারিনি কী পরিমাণ রোগী হতে পারে, এই রোগীদের কোন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হবে? আমরা প্রথম থেকেই বিষয়গুলো নিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করিনি। এখন হাসপাতালে কোনো জায়গা নেই। কোন হাসপাতালে গেলে মানুষ চিকিৎসা পাবে তাও নিশ্চিত নয়। প্রতিদিন যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্রিফিং হচ্ছে সেখানেই বলা উচিত ছিল,  কোন হাসপাতালগুলো কোভিডের জন্য বা কোন কোন হাসপাতালে এখন সিট খালি আছে। এটি হলে মানুষ নিশ্চিত হয়ে একদিকে দৌড়াতো। কিন্তু এখন মানুষ একটার পর একটা হাসপাতাল বদলাতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় কি?
বড় বড় হাসপাতালগুলোর বেশির ভাগ অংশ কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য বরাদ্দ রাখা। বিশেষ করে যে সকল স্থানে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন আছে সেগুলোকে কোভিডের জন্য বরাদ্দ করা। সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ খুবই সীমিত। বড় বড় বেসরকারি হাসপাতাল যেখানে আইসিইউ আছে সেগুলো সরকারের নিয়ে নেয়া দরকার। সেখানে কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেয়া শুরু করা জরুরি। সমস্যা হচ্ছে, বেসরকারি সব হাসপাতালে রোগীদের ভর্তি নেয়া যাচ্ছে না। কারণ, রোগী ভর্তি নেয়ার পর একটি ওয়ার্ডে যদি দশজন রোগীর মধ্যে একজনের কোভিড শনাক্ত হয় তাহলে বাকিদের কোথায় সরিয়ে নেয়া হবে এ নিয়ে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। একজনের জন্য বাকি নয়জন রোগী হাসপাতালে থাকতে চাইছে না। কাজেই এমন একটি ডাইলেমা তৈরি হচ্ছে আমরা কোনোভাবেই মিক্সড করতে পারছি না। নীতিগতভাবে এটি ঠিকও নয়। যে রোগী কোভিড নিয়ে আসেনি সে যেন হাসপাতাল ছাড়ার সময় কোভিড নিয়ে বাড়ি না ফেরে তা নিশ্চিত করা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।   
তাহলে কীভাবে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে?
আমাদের এখন যে ওপরের দিকে গ্রাফ উঠছে তা চট করে নামবে না। আমাদের এখানে জরুরি ভিত্তিতে রেপিড টেস্ট করা দরকার। এটা করা দরকার ছিল দু’মাস আগ থেকেই। রেপিড টেস্ট ছাড়া কোনো উপায় নেই। এই যে রোগী হাসাপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরছে তাদের তাহলে ভোগান্তি হতো না। এদেরকে যদি পরীক্ষা করে বলে দিত যে তুমি কোভিড না সুতরাং তুমি হাসপাতালে ভর্তি হতে পার অথবা তোমার কোভিড সুতরাং তুমি কোভিড হাসপাতালে যাও। এখন বলা হচ্ছে আমরা হাসপাতালে ভর্তি করতে পারবো না তুমি টেস্ট কর। এখন টেস্ট করতেই চারদিন পাঁচদিন থেকে অনেক ক্ষেত্রে সাতদিন লেগে যাচ্ছে। ওদিকে রোগীর অবস্থা দিনদিন খারাপ হচ্ছে। এই হচ্ছে অবস্থা।
কীভাবে একটি মহামারি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে তার পরিকল্পনাই আমরা করতে পারিনি। এই রোগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকেই বিকেন্দ্রিকরণ করতে হবে, প্রতিটি জেলায় জেলায় পৃথক ইউনিট স্থাপন করতে হবে। জেলাগুলোতে পরীক্ষা করার দায়িত্ব দিতে হবে। গুরুতর দুর্বলতা রয়েছে আমাদের এখানে। আমরা এখন পিকে উঠছি। এই পিক থেকে আর নামবো না। কেন নামবো না? পিক থেকে নামার জন্য আমাদের ব্যাপক হারে পরীক্ষা করতে হবে। যারা শনাক্ত হবেন তাদের আইসোলেট করতে হবে। এই কাজটিই আমরা করতে পারছি না। তাছাড়া যারা শনাক্ত হচ্ছেন তাদের আশপাশের লোকদেরও কোয়ারেন্টিন করতে হবে আমরা তাও করতে পারছি না। এটা একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। যখন শনাক্তের পরিমাণ কম ছিল অর্থাৎ দু’মাস আগে যখন আক্রান্তের হার কম ছিল তখন যদি আমরা এ কাজগুলো করতাম তখন সহজ ছিল। এখন আমরা দশ থেকে বারো হাজার রোগী পরীক্ষা করছি। এটা যদি এক মাস আগে করতে পারতাম আজকে আমাদের এ অবস্থা হতো না। আমরা সে অবস্থাতেই রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হতাম। এখন যা হচ্ছে তা লকডাউনের শুরুতে তা হওয়া দরকার ছিল। এখন যে পরিস্থিতিতে আছি তাতে স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন, হাসপাতালের ধারণ ক্ষমতা কমে আসছে। টেকনিক্যাল কমিটিতে আমরা বারবার এ কথাগুলো বলেছি। কিনু্ত কাজ হচ্ছে না। কে যে কোথায় কি করছে, এটা আমরাও বুঝতে পারছি না। বলা হলো, ঈদের সময় কেউ বাড়ি যাবে না, আবার বলা হলো যেতে পারবে। ঈদের সময় যে আমরা ছেড়ে দিয়েছি তার ফলাফল দেখছি এখন। এ থেকেও যদি শিক্ষা না হয় তাহলে আমরা যে লকডাউন খুলে দিয়েছি তার ফলাফল দেখতে পাবো আগামী দশদিন পরে। আক্রান্তের হার আরও বাড়বে। আমরা এর জন্যই প্রস্তুত হচ্ছি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status