দেশ বিদেশ

সাঁওতাল পল্লীতে দুর্বিষহ জীবন

পিয়াস সরকার, রংপুর (মিঠাপুকুর) থেকে

২৯ মে ২০২০, শুক্রবার, ৬:০২ পূর্বাহ্ন

একবেলা চারটা ভাত পাচিতো আরেকবেলা নাই। কেমনে দিনট্যা কাটে। ভুগা প্যাটোত থাকলে দিনট্যাও যাবার চায় না। রাইতোত নিন্দও ধরে না। কাকো কিচু কবারো পারো না বাহে। মুই বুড়া মানুষ। কায়ো কিচু দিলে খাও। বেটি কয়টা ট্যাকা পাটাচিল, সেই ট্যাকা দিয়াই খায়া না খায়া দিন কাটাচো। এভাবেই দুঃখের কথা বলছিলেন, প্রায় ৮০ বছর বয়স্কা সুমুতি এক্কা।
রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার দুলাহাপুর গ্রাম। দারিদ্রপীড়িত এলাকাটিতে ৮০টি সাঁওতাল পরিবারের বাস। যাদের মাঝে সনাতন ধর্মাবলম্বী ৬০টি পরিবার ও খ্রীস্টান পরিবার ২০টি। দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে কোনরকম টিকে আছে পরিবারগুলো। কিন্তু করোনার ছোবলে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন তারা।

ভবেশ কুজুর জানান, করোনা যখন শুরু হলো সবাই বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোর বিপত্তি বেড়ে গেলো। এমনিতেই তখন চারদিকে কাজের অভাব। তার ওপরে টুকটাক কাজ বন্ধ। আশেপাশে কোনরকম জমি থেকে শাক লতা পাতা খেয়ে বেঁচে ছিলেন তারা।

তার স্ত্রী লিমা কুজুর জানান, এমনি অবস্থা দিনে তারা একবার ভাত খেলে আরেকবেলা না খেয়ে থাকতেন। আর পরদিন যে আরেক মুঠো ভাত পাবেন তার কোন নিশ্চয়তা ছিলো না।

দরিদ্র পল্লীটি প্রায় ২ মাস যেন এক দুঃস্বপ্নের মাঝে ছিলো। ধান পাকার পর একটু স্বস্তি ফিরেছে পল্লীটিতে। ধান কাটার কাজ পাচ্ছেন তারা এখন নিয়মিত। আবেশ মার্ডি বাড়ির উঠানে ধান শুকানোর কাজ করছিলেন। তিনি জানান, মেয়েরা দৈনিক ধান কেটে পান ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ টাকা। পুরুষরা পান ৪শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ টাকা। কাজ করতে হয় সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। মাঝে দুপুরে একটু খাবারের জন্য বিশ্রাম পান। আর খাবার সরবরাহ করেন জমির মালিকরাই।

বৃদ্ধ অর্জুন মর্ম ও তার বোন সুর বালা বাঁশের কাজ করছিলেন বাড়ির উঠানে। তাদের কাছে যাবার আগে থেকেই আলোচনা ছিলো করোনার কালে আয় হারানো নিয়ে। তারা বাঁশ দিয়ে ডালি, কুলা, পাটি, বেড়া, ছাদ ইত্যাদি তৈরি করেন। অর্জুন মর্ম জানান, আগে প্রতি হাটে (সপ্তাহে দুদিন হাটবার) ৫ থেকে ৭ হাজার টাকার জিনিস তৈরি করে বিক্রির অর্ডার পেতেন। যা থেকে এক হাটে লাভ হতো ১২শ’ থেকে ১৫শ’ টাকা। কিন্তু করোনা আসার পর থেকে প্রতি হাটে হাজার টাকার মালামাল তৈরির অর্ডারো মিলছে না।

উঠানে বসেছিলেন প্যারালাইজড মোডি মার্ডি। একটি ভাঙ্গাচুড়া চেয়ারে বসা। অভাবের চিত্র চেয়ার ও পোশাকে স্পষ্ট। কাদো কাদো কণ্ঠে জানান, এই অভাবে বেঁচে থাকাটাই দায় হয়ে দঁাঁড়িয়েছে। ক্ষুধা পেটে কাটে সবসময়। ক্ষুধা লাগলেও বলতে পারেন না পরিবারের লোকজনদের। বলেন, শরীলত এমন বিষ (ব্যথা) উঠে বাহে। দমটা আটকে যায়। তাও কাকো কওনা। খাবার জোটে না কোটে থাকি ওষুদ আনি দেবে?

পাশেই ছোট বাচ্চাকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছিলেন তাপসী কৃষ পাল। পাতে একটু সাদা ভাত ও পাট শাক। বলেন, এই ভাতটুকু পাওচি এলা এটাই ভাগ্য। আগোত একনাও পাও নাই। খাবার শেষে ছেলেকে গামছায় পিঠে বেঁধে পল শুকানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি জানান, বিভিন্ন ধানের জমি থেকে এই পলগুলো সংগ্রহ করেছেন। এগুলো শুকানোর পর গরুর খাবারের জন্য সংগ্রহ করবেন। কদিন পর জমিতে ফের ধান রোপন করা হলে গুরুর খাদ্য সংকট থেকে বাঁচানোর জন্যই এতো কষ্ট।

পল্লীটির লোকেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনার সময়ে এই দরিদ্র গ্রামটিতে সহযোগিতা পেয়েছেন অল্প কিছু মানুষ। পুতুল মাহালী তিনি এই পল্লীর মুখ্য। তিনি বলেন, কিছু কিছু সাহায্য এসেছে। কিন্তু তা যথেষ্ট না। করোনার সময় সাহায্য পেয়েছেন আনুমানিক ১০ পরিবার। এছাড়াও ১০ টাকা কেজির সাহায্যেও চাল পেয়েছেন অনেকে। তবে শেষ কথা এই সাহায্য যথেষ্ট নয়। আমাদের কোন রকম টিকে থাকার জন্য হলেও এর কয়েকগুণ সাহায্য প্রয়োজন। আর এই অবস্থায় ধানকাটার সময় না আসলে না খেয়েই মারা যেতো অনেকে।

পল্লীর ঘরগুলো ছোট ছোট। বলা যায়, কোন রকম মাথা গোজার ঠাঁই। পরিবারের সদস্য অনেক। অধিকাংশরই লেখাপড়া প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত। তবে এই পল্লীর নয়ন মার্ডি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে অধ্যয়নরত। তিনি বলেন, আমাদের এখানের প্রধান সমস্যা দারিদ্রতা। প্রত্যেকেই সন্তানকে লেখাপড়া শেখাতে চান কিন্তু পেটে ক্ষুধা থাকলেতো আর লেখাপড়া হয়না।
তিনি আরও বলেন, আমরা পল্লীতে প্রায় ১শ’ বছর ধরে আছি। এখানে বাঙালীদের সঙ্গে একত্রে শান্তিতেই আছি। তবে তারা দারিদ্রতাকে দুর করে এগিয়ে যাচ্ছে আমরা পারছি না। এই দারিদ্রতা এতোটাই জেঁকে বসেছে আমরা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিটুকুও ধরে রাখতে পারছি না। একটু খেয়ে পরে বাঁচাটাই যেন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status