প্রথম পাতা

লোমহর্ষক

কূটনৈতিক রিপোর্টার

৩০ মে ২০২০, শনিবার, ১২:০১ অপরাহ্ন

যুদ্ধকবলিত লিবিয়ায় মিলিশিয়া ও পাচারকারীদের যৌথ হামলায়, এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত ২৬ বাংলাদেশির পরিচয় মিলেছে। জীবিত ১২ জনের মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ সাতজনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং ত্রিপোলিস্থ জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিনিধিদের মূল্যায়নে এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে, মুক্তিপণ আদায়ের জন্যই তাদের জিম্মি করা হয়েছিল। মরুভূমির টর্চার সেলে তাদের ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন হয়, যা থেকে প্রাণে বাঁচতে তারা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু এতে ফায়দা হয়নি বরং বাছ-বিচারহীন ও লোমহর্ষক একটি হামলায় তাদের নির্মমভাবে তাদের প্রাণ দিতে হয়েছে।

ত্রিপলিস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের রিপোর্টের বরাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনও বলেছেন, ইতালি পাঠানোর জন্য প্রত্যেকে দালালকে ১০০০ ডলার করে দিয়েছে। ওই চুক্তিতে অর্থ পরিশোধ করার পর কমপক্ষে তিন মাস আগে তাদের লিবিয়ায় নেয়া হয়। কিন্তু বাড়তি অর্থের জন্য অস্ত্রধারী চক্রটি তাদের জিম্মি করে। জিম্মিদশায় বচসার জেরে তাদের হত্যা করা হয়।

বাংলাদেশ মিশন মানবজমিনকে জানিয়েছে, ঘটনাটি মরুভূমির প্রায় নো-ম্যান্স ল্যান্ডে ঘটেছে, যেখানে না ত্রিপোলি সরকারের পুরোপুরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছে না মিলিশিয়াদের। তাই হতাহতদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। তারপরও বিভিন্ন সূত্রে দূতাবাস প্রাথমিক যে তথ্য পেয়েছে তাতে নিহত ২৬ জনের মধ্যে ২৩ জনের পরিচয় মোটামুটিভাব নিশ্চিত হওয়া গেছে। যার মধ্যে ১১ জনই মাদারীপুরের বাসিন্দা। ৭ জন কিশোরগঞ্জের, দু'জন গোপালগঞ্জের এবং যশোর, মাগুরা ও ঢাকার ১ জন করে বাসিন্দা রয়েছেন। বাকী ৩ জনের বিষয়ে অসংলগ্ন তথ্য আসায় তাদের পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেনি বাংলাদেশ মিশন।

ঢাকায় পাঠানো দূতাবাসের রিপোর্ট মতে, মর্মস্পর্শী ওই ঘটনায় গুরুতর আহত ১১ এবং আগেই আত্মরক্ষার্থে পালিয়ে আত্মগোপনে যাওয়া একমাত্র বাংলাদেশির নাম-পরিচয়ের বিস্তারিত মিলেছে। বেঁচে যাওয়া মোট ১২ জনের মধ্যে ৪ জন মাদারীপুরের, ৩ জন কিশোরগঞ্জের, দু'জন চুয়াডাঙ্গার, একজন ফরিদপুরের, একজন গোপালগঞ্জের এবং একজন মাগুরা জেলার বাসিন্দা রয়েছেন।

হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়া যা বলেছে-

বৃহস্পতিবার রাতে লিবিয়ার মিজদা শহরে এক পাচারকারীর পরিবারের হাতে ২৬ বাংলাদেশি নিহত হওয়ার খবর প্রকাশ করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। তাতে বলা হয়, এক পাচারকারীকে হত্যার প্রতিশোধে তার পরিবার ২৬ বাংলাদেশিসহ মোট ৩০ জন অভিবাসীকে হত্যা করেছে। নিহতদের মধ্যে বাকি চারজন আফ্রিকান। এ ঘটনায় আহত আরো ১১ জন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদিকে, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) লিবিয়া কার্যালয়ের মুখপাত্র সাফা মেহলি তাৎক্ষণিক জানান, এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তার টিম মাঠে নেমেছে, আহতদের সহায়তা দেয়া হচ্ছে।




পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য


এদিকে লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যার পেছনে থাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিষয়ে বাংলাদেশ কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। তিনি বলেন, এ ঘটনায় দুঃখজনকভাবে ২৬ জন নিহত, ১১ জন আহত হয়েছেন। পাচারকারীরা ত্রিপোলি থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে তাদের হত্যা করেছে। ধারণা করা হচ্ছে অন্য কোনো দেশে তাদের পাচার করা হচ্ছিল। পথিমধ্যে তাদের সঙ্গে কোনো ঝামেলা হওয়ায় পাচারকারীরা তাদের মেরে ফেলেছে।
দূতাবাসের পক্ষ থেকে আহতদের নিরাপত্তা ও উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিতে তাদের ত্রিপোলিতে সরিয়ের আনা হয়েছে বলেও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

এদিকে জাতিসংঘ সমর্থিত ত্রিপলি সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এসব অভিবাসী মিজদা শহরের এক মানব পাচারকারী চক্রের কাছে জিম্মি ছিলেন। কোনোভাবে ওই পাচারকারী চক্রের মূল হোতা আগের রাতে অভিবাসীদের হাতে খুন হন। পরে খুন হওয়া পাচারকারীর সহযোগী এবং আত্মীয়স্বজনরা জিম্মি অভিবাসীদের ক্যাম্পে নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে তারা মারা যান। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, বাংলাদেশিসহ ওই অভিবাসীদের মিজদা শহরের একটি জায়গায় অর্থের জন্য জিম্মি করে রেখেছিল মানব পাচারকারী চক্র। এ নিয়ে একপর্যায়ে ওই চক্রের সঙ্গে মারধরের ঘটনা ঘটে অভিবাসী শ্রমিকদের। এতে এক পাচারকারী মারা যায়। তারই প্রতিশোধ হিসেবে সেই মানবপাচারকারীর পরিবারের লোকজন এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এ বিষয়ে লিবিয়ার পশ্চিমা-সমর্থিত জাতীয় সরকার (জিএনএ) জানিয়েছে, মানবপাচারকারী চক্র ও অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে যে বিরোধ চলে আসছিল, তার জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

সরকারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঘটনার বিস্তারিত-


এদিকে লিবিয়ায় ২৬ জন বাংলাদেশির মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের তরফে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বৃহস্পতিবার লিবিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর মিজদাহতে (ত্রিপোলি থেকে ১৮০ কি.মি. দক্ষিণে) কমপক্ষে ২৬ জন বাংলাদেশিকে মিলিশিয়ারা গুলি করে হত্যা করার তথ্য পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে দূতাবাস অনুসন্ধান শুরু করে। জানা যায়, লিবিয়ার মিলিশিয়া বাহিনী অপহরণকৃত বাংলাদেশিদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালালে ঘটনাস্থলেই তারা নিহত হন। সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান এক বাংলাদেশি। তিনি দূতাবাসকে জানান, ঘটনা থেকে পালিয়ে তিনি একজন লিবিয়ানের আশ্রয়ে আত্মগোপনে আছেন। তিনি তাৎক্ষণিক আরো জানান যে, ১৫ দিন পূর্বে বেনগাজী থেকে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে মানবপাচারকারীরা তাদের ত্রিপোলিতে নিয়ে আসছিল। পথে তিনিসহ মোট ৩৮ জন বাংলাদেশি মিজদাহ শহরে নিকট লিবিয়ান মিলিশিয়া বাহিনীর একদল দুষ্কৃতকারীর হাতে জিম্মি হন। মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্যে জিম্মিকারী কর্তৃক অমানবিক নির্যাতনের একপর্যায়ে অপহৃত ব্যক্তিবর্গ দ্বারা মূল অপহরণকারী লিবিয়ান নিহত হয়। এর প্রতিশোধ নিতে লিবিয়ান মিলিশিয়া বাহিনী তাদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে। এতে আনুমানিক ২৬ জন বাংলাদেশি নিহত হয় এবং আরো ১১ জন বাংলাদেশি হাতে-পায়ে, বুকে-পিঠে গুলিবিদ্ধ হন।


এ সংবাদ প্রাপ্তির পরে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাগণ মিজদাহ হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এছাড়া, লাশগুলো মিজদাহ হাসপাতালের মর্গে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। আহতদের পরবর্তীতে দূতাবাসের সহায়তায় উন্নততর চিকিৎসার জন্য ত্রিপোলির বিভিন্ন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। গুরুতর আহত তিনজনের শরীর থেকে গুলি বের করতে অস্ত্রোপচার করা হয়। তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতে বাংলাদেশ দূতাবাস লিবিয়ার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং আইওএম লিবিয়ার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখছে এবং তারা আহত ব্যক্তিদের জন্য সম্ভাব্য সহায়তা প্রদান করছেন। মিশনের কর্মকর্তাগণ আহতদের কাছ থেকে ঘটনার বিশদ বিবরণসহ নিহতদের বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছেন। মর্মান্তিক ওই ঘটনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতকরণে দূতাবাসকে ইতিমধ্যে নির্দেশনা প্রদান করেছেন বলেও সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।

ঘটনার বিচার ও ক্ষতিপূরণ চায় ঢাকা

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সেগুনবাগিচা জানায়, ইতিমধ্যে দূতাবাস লিবিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুরো ঘটনার তদন্তসহ জড়িতদের গ্রেপ্তার, দোষীদের যথাযথ শাস্তি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। এর প্রেক্ষিতে, লিবিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিজদাহের সুরক্ষা বিভাগকে অপরাধীদের গ্রেপ্তার এবং তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে। বাংলাদেশ দূতাবাস দ্রুততম সময়ে আহতদের চিকিৎসা ব্যবস্থা, মানবপাচারে জড়িতদের বিবরণ এবং লিবিয়ান সরকার কর্তৃক এ বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপের বিস্তারিত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

উল্লেখ্য যে, মিজদাহ শহরে এখন যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান। এ অঞ্চলটি এখন দু'টি শক্তিশালী পক্ষের যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে। কিছুদিন আগে ত্রিপোলি ভিত্তিক জাতিসংঘ সমর্থিত জিএনএ সরকার অঞ্চলটি দখল করে নিলেও জেনারেল হাফতারের নেতৃত্বাধীন পূর্ব ভিত্তিক সরকারি বাহিনী দু’দিন আগেও শহরটিতে বোমাবর্ষণ করে তাদের অস্তিত্বের জানান দেয়। ত্রিপোলি ভিত্তিক সরকারের এ অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল বা আছে খুব সামান্যই। এমনকি ত্রিপোলি শহরেও বিরোধীপক্ষ মাঝেমাঝে বোমাবর্ষণ করে থাকে। দু’টি শক্তিশালী পক্ষ যুদ্ধরত থাকায় ত্রিপলির জীবনযাত্রা মোটেও স্বাভাবিক নয়। এ কারণে অধিকাংশ দেশ তাদের দূতাবাস তিউনিসিয়াতে স্থানান্তর করলেও বাংলাদেশসহ মাত্র তিনটি দেশ তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এ প্রতিকূল অবস্থাতেও বাংলাদেশ দূতাবাস প্রবাসী বাংলাদেশিদের সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার সকল প্রকার মানবপাচারের বিরোধী এবং মানবপাচার রোধে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্নমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যার ফলে বাংলাদেশ থেকে মানবপাচারের পরিমাণ বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। এ সমস্যাকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূলে জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের একসঙ্গে কাজ করা জরুরি বলেও সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status