শেষের পাতা

ঘূর্ণিঝড় কেড়ে নিয়েছে মৌলুদার সুখ

পিয়াস সরকার

২১ মে ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৮ পূর্বাহ্ন

ফাইল ছবি

চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে লাশ। দলবেধে গ্রামের দিকে যতই ছুটছি ততই আঁতকে উঠছি। লণ্ডবণ্ড পুরো গ্রাম। রাস্তায় পড়ে আছে বড় বড় গাছ।  বাড়ি-ঘর লন্ডভন্ড। রাস্তা থেকে একটি লাশ সরিয়ে যেতে হলো বাড়ির দিকে। আমার কোলে ৮ মাসের সন্তান। সঙ্গে ওর বাবা। এভাবেই বলছিলেন, অবসরপ্রাপ্ত প্রাইমারি শিক্ষক মৌলুদা রহমান। ১৯৯১ সাল। সেবার বাংলাদেশে আঘাত হানলো প্রথম সুপার সাইক্লোন। এতে মৃত্যু হয়েছিলো ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের। ২৯শে এপ্রিল আঘাত হানে সুপার সাইক্লোনটি। ৩০শে এপ্রিল আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বাড়িতে ফিরছিলেন স্কুল শিক্ষক মৌলুদা রহমান। তাদের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলায়। তিনি বলেন, ঝড় আসার আগে টেলিভিশনে ঝড়ের পূর্বাভাস প্রচার করা হচ্ছিল। গ্রামে অধিকাংশ স্থানে নেই বিদ্যুৎ। তবে রেডিও ব্যবহার করতেন অনেকেই। ঝড়ের খবরটি সবার কাছে পৌঁছায়নি। যাদের কাছে গেছে তারাও ততটা গুরুত্ব দেয়নি। অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে গেলেন, অধিকাংশই যাননি।

তিনি বলেন, আমার শাশুড়ি বাড়ি ছেড়ে কোনভাবেই আশ্রয়কেন্দ্রে যাবেন না। তার কথা, বাড়িতে অনেক মালামাল আছে। ভয়, চুরি হয়ে যাবে। আমার স্বামী অনেক বুঝিয়েও তাকে নিয়ে যেতে পারেননি। শুধু মা নয় অনেকেই যাননি আশ্রয়কেন্দ্রে। মা, চাচা, চাচীসহ আমাদের পরিবারেরই প্রয় ৬ থেকে ৭ জন বাড়িতে ছিলেন। কিন্তু আমার ছোট বাচ্চা কোলে। তাই মা নিজে বাড়িতে থাকলেও আমাদের আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠান। আমার শশুর আমার বিয়ের আগেই মারা গেছেন।

আশ্রয় কেন্দ্র ছিলো স্কুল। সেই স্কুলেরই আমি শিক্ষক ছিলাম। বাড়ি থেকে ৬ কিলোমিটার দুরে। কিন্তু এই ৬ কিলোমিটার মনে হচ্ছিল যেনো ৬০ কিলোমিটার রাস্তা। চিন্তুা শুধু মাকে নিয়ে। বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই আমাকে পিছন থেকে একজন মহিলা জানালেন, মা মারা গেছেন। কিন্তুবলার সাহস পেলাম না ওর বাবাকে। বাড়িতে গিয়ে দেখি, লন্ডভন্ড বাড়ি। গাছপালা পড়ে আছে। এরই মাঝে এক কোণে পরিষ্কার করে ছোট একটা স্থানে চৌকির ওপর সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা লাশ। মায়ের লাশ খুলতেই দেখি মাথা থেতলানো। জানতে পারি বাড়ির পিছনের বড় গাছ ঘরের উপর পড়ে। আর এতে মা চাপা পড়ে মারা যান।

সেদিনের ঝড়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, যখন ঝড় এলো প্রথমে স্বাভাবিক ছিলো সব। এরপর হঠাৎ ঝড় বৃদ্ধি পেলো। শুরু হয়ে গেলো ছোট বাচ্চাদের কান্নার শব্দ। সবাই আল্লাহ আল্লাহ করছেন। নদী প্রায় ৮ কিলোমিটার দুরে। আমাদের আশ্রয় কেন্দ্র দোতলা হলেও তিন তলার সমান। আশ্রয় নেয়া রুমের নিচে পর্যন্ত পানি ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। আরেকটু উপরে উঠলেই রুমে পানি ঢুকে যেতো। পানি না ঢুকলেও ছিটা এসেই পানি দিয়ে ভরে গিয়েছিলো রুম। সেখানেই হার্ট এ্যাটাক করে মারা গিয়েছিলেন এক মহিলা। আমি শুধু আল্লাহর কাছে চাইছিলাম ছেলেটা যেনো বেঁচে থাকে।

এই ঝড়ের পরে দীর্ঘ কয়েকমাস চরম অভাবের মধ্যে দিন কাটে সবার। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর কোনরকম স্বাভাবিক অবস্থায় আনতেও সময় লেগেছিলো প্রায় ১ বছর। স্কুলে উপস্থিতি নেমে গিয়েছিলো প্রায় অর্ধেকে।
কেটে গেছে দীর্ঘদিন। তাদের কোলজুড়ে আসে আরেকটি মেয়ে। তারা মির্জাগঞ্জ ছেড়ে পটুয়াখালী শহরের কলাতলী এলাকায় বাড়ি করেন। ২০০৭ সালের শুরুতে পটুয়াখালীতে চলে আসেন। আর সেই বছরের নভেম্বরে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিডর। এবার আর আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে হয়নি। পাকা বাড়ি করেছেন তারা। ছেলে সৈকত রহমান তখন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ঝড়ের রাতে (১৫ই নভেম্বর) হঠাৎ সৈকতের বাবার বুকে ব্যথা শুরু হয়। হাসাপাতালেও নিতে পারিনি ঝড়ের কারণে। ব্যথা শুরু হবার ২ থেকে ৩ ঘণ্টার মাথায় মৃত্যু হয় তার।
এরপর আঘাত হেনেছে বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়। ২০০৯ সালে আইলা, ২০১৩ সালে মহাসেন, ২০১৭ সালে মোরা। অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষক বলেন, ঝড় এলেই স্বামী ও শ্বাশুড়ির স্মৃতি ভেসে আসে চোখের সামনে। ফেলেন দীর্ঘশ্বাস। বলেন, ১৯৯১ সালে আমার কোলে ছিলো সৈকত। আজ সৈকতের স্ত্রীর কোলে ৪ মাসের বাচ্চা। আল্লাহর কাছে যে চাওয়াটা ছিলো ১৯৯১ সালে, ছেলেটা সুস্থ থাক। আজকেও সেই দোয়া করি ছেলে, বৌমা আর নাতিটা সুখে থাক।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status