মত-মতান্তর

করোনায় আমরা কি অমানবিক হতে যাচ্ছি!

প্রতীক ওমর

২৭ এপ্রিল ২০২০, সোমবার, ১:২০ পূর্বাহ্ন

বিশ্বজুড়েই করোনা আঘাত হেনেছে। কেবলমাত্র মানুষই টার্গেট। এখন পর্যন্ত ভালো কোন সংবাদ আমাদের জানা নেই। তবে বিশ্ব বসে নেই। চেষ্টা চলছে মোকাবেলার। আপাতত কৌশলে নিজেদের আড়াল করার মাধ্যমে এর হাত থেকে কিছুটা বাঁচার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এই ভরসাতেই দেশে দেশে এখন লকডাউন চলছে। দিন যাচ্ছে এর রুপ রঙ ধরণ পরিবর্তন হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের অনেকই বলছেন এই ভাইরাসটি একেক দেশে একেক রকম শক্তিতে প্রভাব বিস্তার করছে। এজন্যই এর ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে হিমশিম খাচ্ছেন গবেষকগণ। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতির বন্ধ হয়ে যাওয়া চাকা আবার ঘোরানোর জন্য মোড়ল রাষ্ট্রগুলোর কেউ কেউ কারখানা খুলে ব্যবসা চালুর কথা ভাবছেন। সেই ভাবনার প্রেক্ষিতে আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করজোড়ে অনুরোধ করে বলেছেন, আমাদের প্রতি বিশ্বাস রাখুন। লকডাউন খুললে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। তারা খুব জোর দিয়েই এই কথা বলেছে। এসব বিবেচনা করেই বলা যায় এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যেই আছে পুরো বিশ্ব । পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সব দেশই নিজ নিজ পরিকল্পনা মতই চলছে।
বিশ্ব পরিস্থিতির সাথে বাংলাদেশও এই অদৃশ্য শত্রুর মুখোমুখি হয়েছে। দিন যাচ্ছে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরীক্ষার সংখ্যাও বাড়ছে। প্রথমে শুধু ঢাকায় টেস্ট হলেও এখন দেশের বিভিন্ন জেলায় মোট ২১ হাসপাতালে টেস্টিং চলছে। ফলে আক্রান্তের সংখ্যাও আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা।
আমরা যদি বিশ্বের অন্যান্য দেশের দিকে তাকাই। তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা, সেবার মান সব কিছুই গ্রহণযোগ্য। তার উল্টো চিত্র দেখছি আমাদের দেশে। চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে এতে বেশি প্রশ্ন উঠেছে, প্রতিনিয়ই উঠছে ফলে আক্রান্তরা হতাশায় পড়ে যাচ্ছেন। করোনা রোগীর চিকিৎসার জন্য ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতাল আস্থা অর্জন করেছিলো মানুষের মাঝে। কিন্তু সাম্প্রতি ওই হাসপাতালের কয়েকটি ঘটনা হতাশ করেছে সবাইকে।
নিউ ইয়র্ক থেকে একজন চিকিৎসক সজল আশফাক তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন গত ২০ এপ্রিল কুর্মিটোলা হাসপাতালে তার এক নিকট আত্নীয়র করুন মৃত্যুর কাহিনী। তিনি লিখেছেন, ‘ ১. গত ২/৩ দিন ধরে উনি বাসায় ছিলেন সামান্য জ্বর আর কাশি নিয়ে। বাসায় শুধু একমাত্র ছেলে আর স্বামী। ফোনে ফোনে আমাদের পরামর্শমত চিকিৎসা নিয়েছেন। কারণ ঢাকায় কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না করোনায় আক্রান্ত রোগীকে উপদেশ দেয়ার মত। অবস্থা খারাপ হলে, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, উনি নিস্তেজ হয়ে পড়েন। তখন বাসার কাছে আসগর আলী হাসপাতালে যান। বলতে হবে, সেই হাসপাতাল ভাল কাজ করেছে। রোগীর এক্সরে করেছে, ইসিজি করেছে, অন্যান্য টেস্ট করেছে। অন্যান্য প্যারামিটার চেক করেছে। তখন ইসিজিতে সামান্য পুরনো সমস্যা এবং এক্স-রে থেকে দেখা গেল নিউমোনিয়া। ক্লিনিক্যালি এই হাসপাতাল তাকে কোভিড-১৯ এর রোগী হিসাবে সন্দেহ করে লিখিত পরামর্শ দিলেন কোভিড-১৯ এর জন্য নির্ধারিত তিনটি হাসপাতালের কোথাও ভর্তি হতে। কুর্মিটোলা হাসপাতালে যাওয়ার জন্য এম্বুলেন্স ডাকা হলো। কিন্তু যখনই ড্রাইভাররা শোনে কুর্মিটোলা তখনই তারা ফিরে যায়, আসে না। ফোনও ধরে না। তারপর অনেক টাকা দিয়ে একটি এম্বুলেন্স জুটলো। সেনাবাহিনীতে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব যারা ছিলেন সবাইকে ফোন করলাম। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এলো, রোগী ভর্তি হল আইসোলেশন ওয়ার্ডে। লোকবলহীন এই হাসপাতালে রোগী নিজেই নিজের ভরসা। তখন ১৯ এপ্রিল বেলা ৯টার মত। রোগীর তখন জ্ঞান আছে কী নেই বোঝা দায়। তারমধ্যে রোগী তার ছেলের কাছে অস্ফুট কন্ঠে নিথর চোখে তাকিয়ে কিছু খাবে বলে ইশারা করলো। কিন্তু কোথাও খাবার পেল না ছেলেটা। ঢাকা থেকে নিউ ইয়র্কে আমাদেরকে জানালো আশেপাশে কেউ আছে কী না যে একটু খাবার পৌঁছে দিতে পারে। খাবারের খোঁজে পাগল প্রায় ২০/২২ বছরের ছেলেটা মায়ের কাছে ফিরে দেখে, মুখের ওপর দেয়া অক্সিজেন মাস্ক পাশে পড়ে আছে। রোগী নিজের শক্তি নেই সেটিকে তোলে। মাস্কের ইলাস্টিকের ফিতেটা বেজায় ঢিলে, জায়গামত থাকছে না। রোগীকে দেখার মত কেউ নেই, কিন্তু কাউকে সেখানে থাকতেও দিবে না হাসপাতাল। হাসপাতালের এটাই নিয়ম। ছেলেটা নিচে অসহায় দাঁড়িয়ে আমেরিকায় থাকা বোনের কাছে চরম বিষাদপূর্ণ সময়ে জানতে চাইলো, কী করবে সে। ওপরে ৬ তলায় তার মা, অনেক রোগীর সঙ্গে একা পড়ে আছে লাশের মত।’ লাশ হয়ে যান তিনি। এমন অমানবিক মৃত্যু আমরা আশা করিনি কখনো। দেশের অন্যান্য জায়গার হাসপাতালগুলোর দৃশ্য আরো কত যে ভয়াবহ তা হয়তো ভুক্তভূগিরা ছাড়া অন্য কারো পক্ষে কল্পনাও করা যাবে না।
আমি এবার আসল পয়েন্টে আসি। আগেই বলেছি এই ভাইরাস গোটা বিশ্বব্যপি ছড়িয়েছে। অমানবিক রাষ্ট্রগুলো পরিস্থিতি সামাল দিতে এখন মানবিক হয়েছে। অর্থ সম্পদ সব কিছু বিলিয়ে দিচ্ছে এই ভেবে যে, টাকাই সব কিছু না। সম্পদ দিয়ে কি হবে যদি মানুষ বাঁচতেই না পারে। অথচ আমাদের দেশে করোনা শুরুর পর থেকে একের পর অমানবিকতার খবর পাচ্ছি। শুরুটা স্বাস্থ্য বিভাগ দিয়ে। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার মেরুদণ্ডহীন করে তুলেছে বিভাগটি। চিকিৎসকদের যথেষ্ট নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে এই বিভাগ। ফলে চিকিৎসকগণ এই সুযোগ গ্রহণ করেছেন কা-পুরুষের মত। এখনো অনেক চিকিৎসক নিজেদের হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখার জন্য অজানা গুহায় কোয়ারেন্টিনে আছেন। চাকরি যাওয়ার ভয়ে যারা নাম মাত্র ডিউটি করছেন তারা রোগীর ধারে কাছেও যাচ্ছেন না বেশির ভাগই। ব্যতিক্রম কিছু চিকিৎসক আছেন তারা কাজ করছেন। পরিমাণ হাতে গোনা। তাদের স্যালুট। এখন প্রতিনিয়তই চিকিৎসকদের অবহেলার কারণে অন্যান্য রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। এ হাসপাতাল থেকে সে হাসপাতাল যাতায়াত করেও চিকিৎসা পাচ্ছে না অনেক রোগী। এমন খবর এখন হরহামেশাই পাওয়া যাচ্ছে। খোদ চিকিৎসক চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যু বরণ করেছে। পুলিশ পরিবার, সাংবাদিক পরিবারের মানুষও বিনা চিকিৎসায় সাম্প্রতি মৃত্যু বরণ করার খবর এসেছে। সাধারণ মানুষের কি অবস্থা হচ্ছে এ থেকেই অনুমেয়।
এমন পরিস্থিতিতে আমরা দিন দিন ভয়ঙ্কর হতে দেখছি সাধারণ মানুষকেও। করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হওয়া নিজেদের পরশিদের কবর দিতে বাঁধা দেয়ার খবরগুলো প্রতিনিয়তই মর্মাহত করে তুলছে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জোর দিয়েই বলেছে, মারা যাওয়া ব্যক্তির শরীর থেকে করোনা ভাইরাস অন্য কারো শরীরে সংক্রমণ করেনা। এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে মৃতদেহ সৎকারের সময় হাতের সুরক্ষা ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছে সংস্থাটি। তবুও আমরা কিছু এলাকায় বড় করে সাইনবোর্ড লেখা দেখেছি এই এলাকায় করোনা রোগীর কবর দেয়া যাবে না।
এছাড়াও কেউ সর্দি জ্বরে আক্রান্ত হলেও কোন মানুষ তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে না। আরো ভয়ঙ্কর খবর আমরা দেখলাম বৃদ্ধ মা বাবাকে করোনা আক্রান্ত সন্দেহে রাস্তায় ফেলে দিলো সন্তানরা। এদিকে এখন নতুন করে শুরু হয়েছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ফেরতদের গ্রামে প্রবেশ করতে না দেয়ার ঘটনা। কয়েক দিন আগে বগুড়ার গাবতলীতে ঢাকা থেকে একটি যুবক তার গ্রামে আসলে গ্রামবাসী তাকে তাড়িয়ে দেয়। গোপনে সে অন্য আরেকটি গ্রামে তার ফুফুর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেই গ্রামের লোকজনও পরের দিন তাকে অনেকটা টেনে হেঁচড়ে গ্রাম থেকে বের করে দেয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ওই ছেলেটি কোথায় যাবে? তার নিজের বাড়িতে থাকার অধিকার কি সে হারিয়ে ফেলেছে? ধরেই নিলাম তার করোনা হয়েছে। তাকে প্রথমে একটি আলাদা ঘরে থাকার জন্য বলা হোক। সে যদি তা না করে তখন প্রশাসনকে খবর দিয়ে তাদের হাতে ছেড়ে দিতে পারেন। কিন্তু এমনটি না করে প্রকাশ্যে এমন মানুষদের প্রতি অমানবিক আচরণ কেন করা হচ্ছে বোধে আসেনা।
কিছু বাড়ির মালিকদের অমানবিক হতে দেখা গেলো এই কঠিন পরিস্থিতিতে। যে চিকিৎসক হাসপাতালে ডিউটি করবেন তাদের ভাড়া বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার নোটিশ দেয়া হলো। পুলিশ এবং সংবাদকর্মীর ক্ষেত্রেও এমন আচরণের খবর আমাদের শুনতে হয়েছে।
এমন অমানবিক ঘটনাগুলোর আলোকে গত ১৬ এপ্রিল এক ভিডিও কনফারেন্সে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, 'মানুষ আতঙ্কগ্রস্থ হলে অমানুষে পরিণত হয়। একজন মা জ্বরে আক্রান্ত হলে তার সন্তান-স্বামী তাকে জঙ্গলে রেখে আসে। কতোটা অমানুষ হলে এটা করতে পারে? বাংলাদেশে এরকম আচরণ কেন ঘটবে? করোনা সন্দেহ হলে পরীক্ষা করান, চিকিৎসা করান, যত্ন নিন। জীবন আল্লাহর হাতে। যে কেউ যেকোন সময় মারা যেতে পারেন। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে কারো অমানবিক হওয়ার বা আচরণের যৌক্তিকতা নেই।' সত্যিতো। আমরা কি আসলেই এই করোনা পরিস্থিতিতে অমানবিক হয়ে যাচ্ছি?
(লেখক: কবি ও সাংবাদিক) [email protected]
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status