মত-মতান্তর

বিজ্ঞান পারে, ধর্ম পারেনা?

ড. আসিফ নজরুল

২৩ এপ্রিল ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৬:২০ পূর্বাহ্ন

‘করোনা থেকে বেঁচে গেলে বিজ্ঞানের কারণে বাঁচবো, মসজিদ মন্দিরের কারণে না’ এমন একটা প্রচারণা চলছে ফেসবুকে। এধরনের অতিসরলীকৃত ও উস্কানিমূলক বক্তব্যর জবাব দেয়ার প্রয়োজন ছিল না। তবে এমন কেউ কেউ এটা শেয়ার করছেন যে মনে হয় কিছু বিষয় তুলে ধরা উচিত।

প্রথমত: বিশ্বে এখনো করোনা আক্রান্ত ব্যাক্তির সংখ্যা ২৭ লাখের মতো। শেষ পর্যন্ত যদি এর দশগুন ( প্রায় ৩ কোটি) লোকেরও করোনা হয়, তার মানে হবে ৯৯.৫ শতাংশ ব্যক্তি আক্রান্ত হবেনা। এ সাড়ে ৯৯ শতাংশ ব্যাক্তির করোনা আক্রান্ত না হওয়া বিজ্ঞানের অবদান না। এটা হবে কিছুটা তাদের ভাগ্যগুনে (ধর্মপ্রাণ মানুষের মতে আল্লাহ্ বা স্রষ্টার অনুগ্রহে) আর কিছুটা সতকর্তার কারণে। আক্রান্তদের মধ্যে আবার কমপক্ষে ৯০ শতাংশ সুস্থ হচ্ছে শরীরের এন্টিবডির জন্য। এন্টিবডি হিসেবে শরীরে যেটি সেল ও বি সেল নামে দুটো সেল কাজ করে তা বিজ্ঞানের সৃষ্টি নয়, এগুলো এমনিতে থাকে মানুষের শরীরে।

দ্বিতীয়ত: করোনার প্রতিষেধক আবিস্কৃত হলে করোনায় মৃত্যুর হার অনেক কমে যাবে। এই প্রতিষেধকও একা কিছু করতে পারবেনা যদি আপনার ইম্যুনিটি সিস্টেম কাজ না করে, এই সিস্টেম বিজ্ঞানের তৈরী না। আর প্রতিষেধক হিসেবে যে এন্টিবডি বা জেনেটিক মেটেরিয়াল ব্যবহার করা হবে তাও বিজ্ঞানের সৃষ্টি না, বিজ্ঞান শুধুমাত্র এটি প্রতিষেধকে রূপান্তরিত করবে। ধর্মপ্রাণ মানুষ বিশ্বাস করে এসব মেটেরিয়ালস্ ও বৈজ্ঞানিকের বুদ্ধি সবটাই আল্লাহ্/স্রষ্টার দান।
সত্য বা সমস্যাটা এখানে।এন্টিবডি বা ভাগ্যোর কারণে যারা বাঁচবে, ধর্মপ্রাণ মানুষ বিশ্বাস করবে এটা স্রষ্টার দান। বিজ্ঞান যাদেরকে বাঁচাতে পারবে ধর্মপ্রাণ মানুষ বিশ্বাস করবে সেটাও স্রষ্টার দান। কাজেই করোনা বিষয়ে বিজ্ঞানের তুলনায় ধর্মকে হেয় করে ধর্মপ্রাণ মানুষকে হয়তো অপমান করা যাবে, কিন্তু তার ধর্ম্ বিশ্বাসে চিড় ধরানো যাবে না।এই অপমান করার কোন যুক্তি নেই।কারণ ধর্ম-র প্রকৃত বাণীর চেয়ে সুন্দর ও মঙ্গলকর কিছু নেই কোথাও।
আমাদের এটাও বুঝতে হবে ধর্ম আর বিজ্ঞানের ব্যাপ্তির কোন তুলনা হয়না। বিজ্ঞান মানুষের সৃষ্টি, ধর্মমতে এই মানুষ স্রষ্টার সৃষ্টি, স্রষ্টার অনন্ত ও অসীম সৃষ্টিজগতের একটি অতি ক্ষুদ্র বালিকনায় (পৃথিবী) এর কিছু মানুষ বিজ্ঞান চর্চা করেন। এই চর্চা অতি প্রয়োজনীয় ও মনোমুদ্ধকর কিছু আবিষ্কার করেছে। কিন্তু এটাও আবিস্কার করেছে যে মহাবিশ্বের ৯৫ শতাংশ সম্পর্কে (ডার্ক এনার্জী) বিজ্ঞান কোনদিন কিছু জানতে পারবেনা, বাকী ৫ শতাংশ সম্পর্কেও তার জ্ঞান খুব কম ও নিয়ত পরিবতর্নশীল। অন্যদিকে ধর্ম এ ৯৫ শতাংশ ও বাকী ৫ শতাংশের সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী।
ধর্ম’র কাজ মানুষের নৈতিকতা, আত্নিক পরিশুদ্ধি নিয়ে। এসব বিজ্ঞানের বিষয় নয়। বিজ্ঞান যুক্তি ও জ্ঞান নির্ভর, ধর্ম বিশ্বাস ও উপলদ্ধি নির্ভর । বিজ্ঞানের কাছে ইহজগত সব, ধর্ম’র কাছে ইহজগত তুচ্ছ, এটা বরং পরজগতের জন্য এক পলকের পরীক্ষা মাত্র।
ধর্ম আর বিজ্ঞান এতো ভিন্ন যে করোনা নিয়ে এদের তুলনা হাস্যকর ও চরম অজ্ঞতাপ্রসূত। আমরা কি বলি করোনা থেকে যদি বেঁচে যাও, যেন ডাক্তার বাঁচাবে, তোমার বাবা মা না। এটা বলে কি আমরা আশা করি ডাক্তারকে শুধু ভালোবাসাব উচিত আমার, পিতা মাতা বা অন্য কাউকেও না। আমরা কি কখনো বলি সাকিব কি সুন্দর ক্রিকেট খেলে, মেসি তো ক্রিকেট খেলতেই পারেনা। ধর্ম ও বিজ্ঞানের তুলনা এসবের চেয়ে বহুগুনে হাস্যকর ও অবান্তর।
ধর্ম ও বিজ্ঞান দুটোই প্রয়োজনীয়। ধর্ম বিশ্বাস করলে বিজ্ঞানকে অবজ্ঞা করতে হবে কেন? বিজ্ঞানমনস্ক হয়েছেন বলে ধর্মকে অবজ্ঞা করেন কেন? পৃথিবীতে বহু বড় বিজ্ঞানী ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন। অনেকে আবার ছিলেনও না। কিন্তু এজন্য তারা ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে উপহাস করেছেন বলে শুনিনি।
ধর্মান্ধতা আর ধর্মবিদ্বেষ দুটোই পরিত্যাজ্য। ‘বেঁচে গেলে বিজ্ঞানের কারণে বাঁচবো, মসজিদ মন্দিরের কারণে না- এমন অদ্ভূত কথা সম্ভবত ধর্মবিদ্বেষ থেকে প্রচারিত।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status