অনলাইন

করোনায় অবরুদ্ধ প্রবাসীরা, ১৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন রেমিটেন্স

এম এম মাসুদ

৩ এপ্রিল ২০২০, শুক্রবার, ১০:৪৬ পূর্বাহ্ন

সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের কারণে এখন পুরো বিশ্ব অবরুদ্ধ। বন্ধ হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। ঘর থেকে বের হতে পারছে না মানুষ। রেমিট্যান্স আহরণের দেশগুলোর অচলাবস্থায় বেকার হয়ে পড়ছেন প্রবাসীরা। রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছেন না তারা। ফলে দেশের অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে আশা জাগানো প্রবাসী আয়ে ধাক্কা লেগেছে। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে প্রবাসী আয় কমেছে ১ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। যা গত ১৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। সামনের দিনগুলো প্রবাসীদের জন্য কঠিন হওয়ার পাশাপাশি অব্যাহত থাকবে রেমিট্যান্সের নেতিবাচক ধারা বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্নিষ্টরা।

তাদের মতে, রেমিট্যান্স কমে গেলে অর্থনীতিতে আরো চাপ তৈরি হবে। কেননা, গত কয়েক মাস ধরে রপ্তানি কমে গেছে। আমদানির পরিমাণও বেশ কিছুদিন ধরে কমছে। এমন পরিস্থিতিতে আশা জাগাচ্ছিল প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বিশেষ করে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা ঘোষণার ফলে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি ছিল ২০ শতাংশের বেশি। তবে বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় সে সূচকেও পতন শুরু হয়েছে।

পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মাত্র এক মাসের ব্যবধানে প্রবাসী আয় কমেছে ১ হাজার ৪১১ কোটি টাকা, যা গত ১৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণার পর ১৪০ কোটি ডলারের কম রেমিট্যান্স আসেনি কোনো মাসে। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসেও প্রবাসী আয়ের অংকটা ছিল ১৪৫ কোটি ডলার। তবে মার্চে প্রবাসীদের পাঠানো মোট রেমিট্যান্সের পরিমাণ ১২৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার। বিশ্বব্যাপী করোনার আঘাতে প্রবাসী আয় কমে এসেছে এবং এর প্রভাব আগামীতে আরও থাকবে বলে আশঙ্কা সংশ্নিষ্টদের।

এদিকে বেশিরভাগ দেশে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছেন না। কিছু কিছু দেশ থেকে অনলাইনে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ থাকলেও দক্ষতার অভাবে তা কাজে লাগাতে পারছে না। এতে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রেমিট্যান্স পাঠানো প্রায় বন্ধ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের পুরো মার্চজুড়ে ১৪৫ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ দেশে পাঠান প্রবাসীরা। এবার ১২ই মার্চ পর্যন্ত প্রথম দুই সপ্তাহে প্রবাসীরা পাঠান ৮০ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। তবে মার্চ শেষে এর পরিমাণ ১২৮ কোটি ডলারে থেমেছে।

ব্যাংককাররা জানান, বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় অনেক দেশে লকডাউন চলছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আহরণে শীর্ষে থাকা সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, কুয়েত, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, ওমান, কাতার, ইতালি, বাহরাইনসহ অধিকাংশ দেশে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। বেশিরভাগ দেশে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকায় হাতে টাকা থাকলেও অনেকে পাঠাতে পারছেন না। আবার অনেকে ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবিলার জন্য সঞ্চয় করছেন।

এছাড়া বিদেশে যারা অ্যাপভিত্তিক ভাড়া গাড়ি বা ট্যাক্সি চালিয়ে জীবন নির্বাহ করেন, অস্থায়ীভাবে দৈনিক মজুরিভিত্তিতে হোটেল, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন কাজ করেন, তারা নিজেরা অনিশ্চয়তায় জীবন পার করছেন। এর বাইরে করোনা আতঙ্কে অনেক প্রবাসী এরই মধ্যে দেশে ফিরেছেন। অনেকেই পরিস্থিতির উন্নতি হলে দেশে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পরও অনেকে যে কর্মহীন হয়ে পড়বেন, সে আভাস মিলছে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে। ফলে আগামীতে রেমিট্যান্স আরো কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, দেশ স্বাধীনের পর থেকে সাধারণত কখনও রেমিট্যান্সে ধারাবাহিকভাবে পতন দেখা যায়নি। তবে ২০১৫ সাল থেকে টানা তিন বছর রেমিট্যান্স কমে। বিশেষ করে বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো অর্থ মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে সহজে সুবিধাভোগীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগের ফলে অনেকেই এ পথ বেছে নিচ্ছিলেন। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার। তখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন কমানোসহ নিয়ন্ত্রণমূলক নানা উদ্যোগের ফলে বাড়তে শুরু করে। রেমিট্যান্সে আরো গতি এনে দেয় ২ শতাংশ হারে প্রণোদনার ঘোষণা।

গত বছরের জুলাই থেকে রেমিট্যান্সের ওপর ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। প্রণোদনার অর্থ পরিশোধের জন্য চলতি অর্থবছরের বাজেটে তিন হাজার ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ফলে আগে অন্য উপায়ে অর্থ পাঠাতেন এ রকম অনেকেই ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছিলেন। ফলে বৈদেশিক আয়ের অন্যতম আরেক খাত রপ্তানি কমলেও রেমিট্যান্স বাড়ছিল।

চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত দুই হাজার ৬২৪ কোটি ডলারের রপ্তানি হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ কম। এর মধ্যে মার্চে প্রায় চারশ’ কোটি ডলারের রপ্তানি আদেশ বাতিল হওয়ার খবর মিলেছে। অন্যদিকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত আমদানি কমেছে ৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে আমদানি আরও কমেছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসীরা ফেসবুকে স্টাটাস দিয়ে বলেছেন মার্চের শুরু থেকেই অনেক দেশ অবরুদ্ধ। সব মানুষ ঘরে বন্দি। দোকান-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলছে না। কাজ নেই, আয়ের পথও বন্ধ। এভাবে আর কিছুদিন চলতে থাকলে নিজেদের খরচ মেটানোই দায় হয়ে যাবে।

সৌদি আারব প্রবাসী বগুড়ার মাসুদ রানা বলেন, মক্কা নগরীর একটি ডায়িং কারখানায় কাজ করেন। ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই কাজ কম। মার্চে ওমরা বন্ধ করায় কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। তিন সপ্তাহ ধরে বেকার। ঘর থেকে বের হতে পারেন না। আগের কিছু পাওনা অর্থ কারখানার মালিক দিয়েছিল, তা দিয়েই ২০ দিন চলছে।

মালয়েশিয়া থেকে রমজার আলী বলে, গত ১৮ই মার্চ থেকে মালয়েশিয়ায় সবকিছু বন্ধ। এ অবস্থা চলবে আগামী ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত। কেউ বাইরে বের হতে পারছেন না, কাজ নেই। এখন প্রবাসীদের নিজের খরচ চালানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকসহ মানি এক্সচেঞ্জগুলো বন্ধ থাকায় অনেকে চাইলেও রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছেন না।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমলে দু’টি জায়গায় সরাসরি আঘাত হানবে একটি হলো নিম্নবিত্তদের অবস্থা করুণ হবে আর দেশের সার্বিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রেমিট্যান্সপ্রবাহের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। ১১.৫ শতাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে আসে ১২.৩৫ শতাংশ। দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ বিদেশে অবস্থান করছেন। এদের বড় একটি অংশ মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন। ইতালিতে বৈধ-অবৈধভাবে থাকেন প্রায় আড়াই লাখ। কিন্তু করোনায় কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন বেশির ভাগ মানুষ। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।

বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে পুরা বিশ্বই এখন অচল। এসময় রেমিট্যান্স কমাটাই স্বাভাবিক। আমাদের রেমিট্যান্স আহরণ এর প্রধান প্রধান যেমন সৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্য, ইতালি, জার্মানিসহ ইউরোপ, আমেরিকার মতো দেশগুলোও কঠিন অবস্থা পার করছে। সেখানে অনেক প্রবাসীর চাকরি চলে যাচ্ছে, ফলে ইনকাম নেই বললেই চলে। এমন অবস্থায় প্রবাসীরা দেশে অর্থ পাঠাবে দূরের কথা তাদের নিজেদের খরচ মেটানোও এখন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স আহরণে রেকর্ড হয়। ওই সময়ে প্রবাসীরা ১ হাজার ৬৪২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা অর্থবছর হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ।

এর ধারা অব্যাহত রাখতে গত অর্থবছরের বাজেটে রেমিট্যান্সের ওপর ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনাসহ প্রবাসীরা যেন অর্থ সহজে পঠাতে পারেন এ জন্য বেশ কিছু শর্ত শিথিল করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status