ফেসবুক ডায়েরি

দিল্লীতে হিংসার আগুন

‘আমি থেঁতলে যাওয়া লাশটা বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম’

অনলাইন ডেস্ক

২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৭:৩৭ পূর্বাহ্ন

ভারতের নাগরিক অর্ক ভাদুরী। কলকাতার এই বাসিন্দা লিখেছেন দিল্লির হিংসার আগুন নিয়ে। তার দেয়া স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো-

আমি দিল্লিতে নেই। এই মূহুর্তে আমি বসে আছি হায়দ্রাবাদের একটা ছোট্ট কাফেতে। আমার চারপাশে মুসলিম মানুষজনের ভিড়। তাঁরা হাসছেন, গল্প করছেন, ঝগড়া করছেন, সারাদিনের পরিশ্রমের পর চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছেন কেউ। আমি, পূর্ববঙ্গের নাটোর থেকে তাড়া খেয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসা এক রিফিউজি পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম। তাঁদের দেখছি, শুনছি, কফি খাচ্ছি। বিশ্বাস করুন, আমার অসুবিধা হচ্ছে। আমার অস্বস্তি হচ্ছে। আমি এভাবে লিখি না কখনও, কিন্তু আজ খুব বেশি করে অসুবিধা হচ্ছে আমার, লজ্জা করছে, অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে। আমি আমার হিন্দু নাম আর পদবী নিয়ে এখানে বসে থাকতে পারছি না। আমি উঠে যেতেও পারছি না। আমি জানি না আমি কী করতে পারি, আমার কী করা উচিত, আমি জানি না।

একটু আগে আমি হাঁটছিলাম চারমিনার চত্বরে। একা। আচমকা আজান শুরু হল। সকলেই জানেন, হায়দ্রাবাদে প্রচুর মসজিদ, চারমিনারের কাছে তো মসজিদের ছড়াছড়ি। একটা মসজিদের আজান আরেকটা মসজিদে মিশে যাচ্ছিল, ওভারল্যাপ করছিল, একটা সুরের গায়ে আরেকটা সুর উঠে পড়ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, একটা জায়গা থেকে আরেকটা জায়গায় নয়, আমি একটা আজান থেকে আরেকটা আজানে হেঁটে যাচ্ছি। একটা সুর থেকে হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়ছি আরেকটা সুরে। আমি দেখছিলাম, চারমিনারের গায়ে অসংখ্য পায়রা বাসা বেঁধেছে। পায়রাগুলো ঝটপট করছে, ডাকছে। দেখছিলাম, চারমিনারের নীচে কত আলো, কত রং! কত রকমের জিনিসপত্রের পশরা নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। সস্তার জিনিস সব। তাঁদের ঘিরে ভিড় জমিয়েছেন সস্তা, কমদামী মানুষ। কারও চোখে সুরমা, কেউ বোরখা বা হিজাবে, কারও মাথায় লেপ্টে আছে সিঁদুর। আমি আমার দেশকে দেখতে দেখতে হাঁটছিলাম আর একটা আজান থেকে ঢুকে পড়ছিলাম আরেকটা আজানে, সেখান থেকে আরও একটা আজানে.... মক্কা মসজিদের গম্বুজ থেকে উড়ে যাচ্ছিল পাখির দল, ফুচকা বিক্রেতার সঙ্গে ঝগড়া করছিল বোরখা পরা তরুণী, নিবিড় যত্নে পায়রাদের জন্য খাবার বিছিয়ে রাখছিলেন এক তেলেগু প্রবীন...

আমি এইসব দেখছিলাম আর হাঁটছিলাম। আমি মাসের অধিকাংশ সময়ই তাই করি। দেখি, হাঁটি, মানুষের সঙ্গে কথা বলি। রাজ্যে রাজ্যে, জেলায় জেলায়। তারপর যা দেখলাম, জানলাম, শুনলাম, সেসব লিখে ফেলি। সেই লেখার জন্য পয়সা পাই। এটাই আমার পেশা। ফেসবুক ব্যক্তিগত কথা বলার জায়গা নয়। কিন্তু বলে রাখি, আমি সহজে আপসেট হই না। আমার বয়স খুব বেশি নয়, কিন্তু সামান্য হলেও কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। দাঙ্গা দেখেছি, রাজনৈতিক হিংসা দেখেছি, অসংখ্য ধর্ষিতার সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে আমায়। আমি কথা বলেছি খুনি এবং ধর্ষকদের সঙ্গেও। এই সব অভিজ্ঞতা আমায় সহজে আপসেট হতে দেয় না, হয়তো ঈষৎ অনুভূতিহীন হয়ে গেছি, জানি না। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আজ, ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির শেষ বিকেলে একটা বর্ণহিন্দু নাম নিয়ে চারমিনার চত্বরে হাঁটতে হাঁটতে আমার বমি পাচ্ছিল, কান্না পাচ্ছিল। আমার দু’পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন অসংখ্য মুসলিম, আমি তাঁদের চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না।

আমি হাঁটছিলাম আর আমার মোবাইলে একটানা চলছিল একটা ভিডিও। আমি দেখছিলাম একদল লোক দিল্লিতে একটা মসজিদের উপর চড়াও হয়েছে, মসজিদের দেওয়াল বেয়ে উঠছে একজন, পিছনে আরও একজন, তার হাতে গেরুয়া পতাকা। প্রথম লোকটা একসময় মসজিদের ছাদে উঠে পড়ল আর যে মাইকটা থেকে আজানের আওয়াজ বেরিয়ে আসে, সেটাকে মুচড়ে ভেঙে ফেলল। তারপর মসজিদের দেওয়াল ভাঙতে শুরু করল। আমাদের পুরনো বাড়িতে একটা বিড়াল ছিল, সাদা, তুলতুলে। একটা লরি ওকে চাপা দিয়ে চলে গেছিল। আমি থেঁতলে যাওয়া লাশটা বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম। ঘিলুফিলু সব চটকে গিয়েছিল ওর। আমি হাঁটছিলাম আর দেখছিলাম, আরও একদল লোক মসজিদের নীচে জড়ো হয়েছে। একজনের হাতে জাতীয় পতাকা। সে মসজিদ বেয়ে উঠতে শুরু করল। পতাকাটাকে ডানহাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে। লোকটা মসজিদ বেয়ে উঠছে, সঙ্গে পতাকাটাও। পতাকাটা কুঁচকে যাচ্ছে, কুঁকড়ে যাচ্ছে। আমার এক রিসার্চতুতো দিদিকে গ্রামের বাড়ি থেকে টানতে টানতে নিয়ে গেছিল পার্টির ছেলেরা। আমি দেখিনি, কাজের সূত্রে বয়ান রেকর্ড করতে গিয়ে শুনেছি ওর মুখ থেকে। ও নির্লিপ্তের মতো মতো বলে যেত, আমাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিল ওরা.. আমি আটকাতে চেষ্টা করছিলাম.. পারছিলাম না.. মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিলাম, ওরা ঘেঁষটে ঘেঁষটে নিয়ে যাচ্ছিল...

আমি নির্বিকার মুখে, অভ্যস্ত কানে শুনেছি, রেকর্ড করেছি। আমি চারমিনার পেরিয়ে ডানদিকে বেঁকে হাঁটছিলাম আর দেখছিলাম জাতীয় পতাকা হাতে লোকটা মসজিদে চড়ে বসেছে... আরেকটা লোক তখন পিটিয়ে পিটিয়ে চাঁদ-তারাগুলো ভাঙছে.. বিকেলের আলো মরে আসছে আর আমার মাথার মধ্যে ভিড় করে আসছে তেইশে জানুয়ারি, ছাব্বিশে জানুয়ারি, পনেরোই আগস্টের অলৌকিক সকাল... জিলিপি, শিঙাড়া.. একটা পতাকা ক্রমশ উপরে দিকে উঠছে, উঠছে.. তারপর সেখান থেকে ঝরে পড়ছে একরাশ ফুল.. আমি দেখছিলাম আমার বৃদ্ধা, অসুস্থ, মৃত্যুপথযাত্রী মাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে একদল লোক.. মা আটকাতে চেষ্টা করছে, ঝটপট করছে, পারছে না...

আমি একজন তৃতীয় প্রজন্মের রিফিউজি, একজন নন-বিলিভার, কিন্তু সাংস্কৃতিক ভাবে হিন্দু বাঙালি, আমার লজ্জা করছে। আমার তীব্র অস্বস্তি হচ্ছে, বন্ধুরা। আমরা নাটোরে থাকতাম। আমাদের একটা ওষুধের দোকান ছিল। আমরা তাড়া খেয়ে একবস্ত্রে চলে এসেছিলাম এই বাংলায়। অভাবে, হতাশায় আমার ঠাকুর্দার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। গুম মেরে গিয়েছিলেন। কথা বলতেন না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। কেবল ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের খেলা থাকলে গিয়ে বসতেন পয়সাওয়ালা পড়শির বাড়িতে, রেডিওর পাশে। ইস্টবেঙ্গল গোল করলে, আমেদ খান গোল করলে আমার পাগল হয়ে যাওয়া ঠাকুর্দা লাফিয়ে উঠতেন আনন্দে। আমার মন্দিরের নাম ইস্টবেঙ্গল, আমার ঈশ্বরের নাম আমেদ খান। আমি, এই ভারতবর্ষের একজন নাগরিক, একজন রিফিউজির নাতি, আমার হাতে সংখ্যালঘুর রক্ত লেগে যাচ্ছে, আমার পতাকায় সংখ্যালঘুর রক্ত লেগে যাচ্ছে। আমার লজ্জা করছে, আমার লজ্জা করছে, আমার লজ্জা করছে। আমার বমি পাচ্ছে।

আমি জানি না আমার, আমাদের কী করা উচিত.. আমি জানি না শেষ পর্যন্ত কী হবে.. আমি কোনও বিপ্লব, বিদ্রোহ, অভ্যূত্থানের বিষয়ে জানি না। জানতে চাইও না। সেসব করার জন্য অনেকে আছেন। আমি কেবল আমার লজ্জাটুকু জানিয়ে গেলাম। সংখ্যালঘু কেউ কি এই প্রলাপ পড়লেন? যদি পড়ে থাকেন, আমায় ক্ষমা করুন আপনারা। আমি ক্ষমা চাইছি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status