শেষের পাতা

মায়ের দাফনেও থাকতে পারছে না সন্তানেরা

গ্যাসের আগুনে পুড়লো পুরো পরিবার

শুভ্র দেব ও কাজী আল-আমীন

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, মঙ্গলবার, ৯:৩০ পূর্বাহ্ন

সকাল বেলা সন্তানেরা কাজে বের হবে। তাই মা ভেবেছিলেন ভোরে উঠেই রান্নার কাজটা সেরে নেবেন। তাইতো ফজরের নামাজ শেষ করে চুলা জ্বালাতে রান্নাঘরে যান। দিয়াশলাই হাতে নিয়ে ঠুকা দিতেই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠে। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে  পড়ে বাসার সবকটি কক্ষে। শুরু হয় বাঁচার আকুতি। পরিবারের সবাই বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার করছিলেন। দরজা বন্ধ থাকায় কেউ বাসা থেকে বের হতে পারছিলেন না। সবাই আগুনে পুড়ছিলেন তাই কেউ কাউকে বাঁচানোর অবস্থা ছিল না। চোখের সামনে স্বজনরা পুড়ছিলেন। সহ্য করতে না পেরে  শরীরে আগুন নিয়ে স্বজনদের বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। যখন প্রতিবেশী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে ঘটনাস্থলে পৌঁছালো ততক্ষণে ওই বাসার ১০ জনের মধ্যে আটজনই মারাত্বকভাবে দগ্ধ হন। আর দুজনকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা যায়। চিকিৎসার জন্য আহতের আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে। আহতদের মধ্যে একজন গতকাল চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নির্মম এই ঘটনাটি ঘটেছে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড সাহেব পাড়া এলাকায়। মায়ের সঙ্গে সন্তানেরাও দগ্ধ হওয়াতে এখন মায়ের লাশ দাফনের সময় সন্তানেরা উপস্থিত থাকতে পারছেন না। উল্টো তারা যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন হাসপাতালের বেডে।
জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ সাইনবোর্ড সাহেবপাড়া এলাকার একটি ৫ তলার ভবনের নিচ তলায় বাসায় জমে থাকা গ্যাস থেকে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।  বিস্ফোরণে একই পরিবারের ৮ জন দগ্ধ হয়েছেন। গতকাল সোমবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। দগ্ধরা হলেন, নুরজাহান বেগম (৭০), আবুল হোসেন ইমন (২৩), তার ছোট ভাই মাদ্রাসা ছাত্র আপন (১০), তাদের বাবা মো. কিরণ মিয়া (৫০), চাচা মো. হিরন মিয়া (৩০), হিরনের স্ত্রী মুক্তা বেগম (২০), তাদের মেয়ে ইলমা (৩) এবং ইমনের ফুপাতো ভাই স্কুল ছাত্র কাউছার আহমেদ (১৩)। এদের মধ্যে ৯৯ শতাংশ বার্ন নিয়ে গতকাল সকাল ১১টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নুর জাহান বেগম। বাকি ৭ জনের মধ্যে চার জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ঢামেক বার্ন ইউনিটসূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসাধীন দগ্ধদের মধ্যে ইমনের শরীরের ৪৫ শতাংশ, কিরণের ৭০ শতাংশ, হিরনের ২২ শতাংশ, কাউছারের ২৫ শতাংশ, মুক্তার ১৫ শতাংশ, ইলমার ১৪ শতাংশ, আপনের শরীরের ২০ শতাংশ পুড়ে গেছে। এদের মধ্যে কিরণ মিয়া ও আবুল হোসেন ইমনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনিস্টিটিউটে ও হিরণ মিয়া ও আপনকে ঢামেক বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে। এছাড়া হিরণের স্ত্রী মুক্তা বেগম, তাদের মেয়ে ইলমা ও হীরণের বোনের ছেলে কাওসার আহমেদকে বার্ন ইউনিটের এইচডিইউতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
দগ্ধ নুরজাহান বেগমের মেয়ের জামাই মো. ইলিয়াস জানান, নিহত নুরজাহানের স্বামীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার শীবপুর উপজেলার কুমড়াদি গ্রামে। ১৮ বছর আগে নুরজাহানের স্বামী মারা যান। এরপর থেকে দুই ছেলে, তাদের স্ত্রী ও নাতি-নাতনীর নিয়ে তিনি নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকার সাহেবপাড়ার একটি বাড়ির নিচ তলায় ১৪ বছর ধরে ভাড়া থাকেন। তার ছেলে হীরণ ও কিরণের সাইনবোর্ডে ‘নরসিংদী গার্মেন্টস’ নামে একটি গেঞ্জির কারখানা আছে। আর ওই কারখানারই শো-রুম রাজধানীর গুলিস্তানের ‘ঢাকা ট্রেড সেন্টারের’ আন্ডারগ্রাউন্ডে। পুরো ব্যবসাটি হীরণ, কিরণ ও কিরণের ছেলে ইমন সামলান। তারা সবাই একসঙ্গেই থাকেন। ৫ মাস আগে ইমন বিয়ে করেছেন। তার স্ত্রীর নাম শামীমা সিদ্দিকী। ঘটনার তিন দিন আগে তিনি বাবার বাড়িতে চলে যান।
নিহত নুরজাহানের প্রতিবেশী ও মেয়েদের সঙ্গে সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাহেবপাড়া  এলাকায় দিনের বেলা গ্যাস থাকে না। মধ্যে রাত থেকে ভোরবেলা পর্যন্ত গ্যাস থাকে। বছরের বেশিরভাগ সময়ই ওই এলাকার বাসিন্দরা গ্যাস সংকটে ভোগেন। বেশিরভাগ সময় গ্যাস না থাকার কারণে অনেকই চুলার সুইচ সচল করে রাখেন। সোমবারও নুরজাহান বেগমদের চুলার সুইচ দেয়া ছিল। ভোরবেলা তড়িগড়ি করে রান্না শেষ করার জন্য নুরজাহান বেগম প্রথমে চুলায় যান। চুলার সুইচ দেয়া থাকায় পুরো ঘরে আগে থেকেই গ্যাস ছড়িয়ে যায়। কারণ ঘরের সবকটি দরজা জানালা বদ্ধ অবস্থায় ছিল। সেটি আন্দাজ করতে পারেননি বয়ষ্ক নুরজাহান। তাই তিনি আগুন ধরাতে গেলেই বিস্ফোরণ হয়ে যায়। আগুনের ধাক্কা এসে প্রথমে তার ওপর লাগে। পরে তিনি চিৎকার করতে থাকেন। এছাড়া গ্যাসের আগুন হওয়াতে দ্রুত বাসা সবকটি কক্ষে আগুন ছড়িয়ে যায়। এতে করে বাসার অন্যান্য স্বজনরাও টের পেয়ে যান। পরে তারাও দগ্ধ হয়ে যান। নাসিমা বেগম নামের এক প্রতিবেশী জানান, ছেলেরা তাদের বয়স্ক মাকে বাঁচানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু তিনিই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়ে যান। ভোর বেলা হওয়াতে আশেপাশের বাসিন্দাদের অনেকেই ঘুমের মধ্যে ছিলেন। তাই আগুন লাগার বিষয়টি অনেক দেরীতে টের পান সবাই। হীরণ ও কিরণদের কারখানার কর্মচারী মোসা. রাহেলা বেগম বলেন, আমি হীরণ ও কিরণদের কারখানায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করি এবং আমার বাসাও সাহেবপাড়া এলাকায়। ওই এলাকায় শীত-গরম সবসময়ই গ্যাসের সমস্যা। গ্যাসের চুলা চালু দিলেও গ্যাস আসে না। এজন্য ওই এলাকার সবাই রাতে ঘুমানোর আগে চুলার সুইচ বন্ধ করে না। তবে তাদের বাসায় গ্যাস আসার পর আর বন্ধ করা হয়নি। তাই গ্যাস ছড়িয়ে যায় বাসায়। তিনি বলেন, আগুনের লাগার সময় ওই বাসায় কিরণের স্ত্রী লিপি বেগম ও মেয়ে ইকরাও ছিলো। ঘরে আগুন লেগে যাওয়ায় ইমন তাদেরকে দরজা দিয়ে না বের করে শাবল দিয়ে বারান্দার গ্রিল ভেঙে তার নিচ দিয়ে বের করেন। এজন্য তারা ২ জন দগ্ধ হয়নি। তবে তাদের বের করতে গিয়ে ইমন দগ্ধ হয়। পরে তাকেও রুম থেকে বের করা হয়। ইমনের ফুপাতো ভাই কাউছার স্থানীয় নিরাপদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ৮ম শ্রেণিতে পড়ে। তার বাবা সৌদি প্রবাসি। তারা ৩ ভাই ২ বোন। মা বাকি ভাই বোনদের নিয়ে কুমিল্লাতে থাকেন। আর কাউসার নানি নুরজাহানের কাছে থাকতো।
নুরজাহানের তিন মেয়ে। তাদের প্রত্যেকেরই বিয়ে হয়েছে আরো অনেক আগে। আগুন লাগার খবর পেয়ে তারা সবাই ছুটে এসেছেন বার্ন ইউনিটে। একদিকে ভাই, ভাবী ও তাদের সন্তানদের আইসিইউসে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে দগ্ধ হয়ে তাদের মা না ফেরার দেশে চলে গেছেন। এই শোকে তারা নিজেদেরকে ধরে রাখতে পারছিলেন না। তাদের আহাজারিতে ঢামেকের পরিবেশ ভারী হয়ে আসছিলো। নুরজাহানের মেয়ে কুলসুম বলেন, আগুনে পুড়ে সব ছাই হয়ে গেছে। আমার ভাইদের আর কিছুই রইলো না। এখন আবার নতুন করে সবকিছু কিনতে হবে। আমাদের মাকেও আগুন কেড়ে নিয়েছে। আরেক মেয়ে পারভিন বলেন, খবর পেয়ে কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে এসেছি। এ ঘটনায় আমার বড় ছেলে কাওসার আহমেদও দগ্ধ হয়েছে। তিনি বলেন, কাউকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলেছেন, জমে থাকা গ্যাস থেকেই এই বিস্ফোরণ হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক সার্জন আ ফ ম আরিফুল ইসলাম নবীন বলেন, আহতদের শরীরের অবস্থা দেখে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status