শেষের পাতা

স র জ মি ন

‘ভোট দেয়া লাগবে না বাসায় চলে যান’

রুদ্র মিজান

২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, রবিবার, ১০:০৭ পূর্বাহ্ন

বাইরে-ভেতরে কর্মীদের কড়া পাহারা। বাইরে দাঁড়িয়ে শতাধিক যুবক। তাদের প্রত্যেকের বুকে নৌকার ব্যাজ। ভোটার দেখলেই কাছে ডেকে নিচ্ছেন। এ যেন এক ইন্টারভিউ। জিজ্ঞাসাবাদের পর কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছেন, কাউকে বিদায় করে দিচ্ছেন। হুমকি-ধমকিরও স্বীকার হচ্ছেন ভোটারদের অনেকে। একই অবস্থা কেন্দ্রের ভেতরে। সংখ্যায় বাইরের চেয়ে কম হলেও তারাও ভেতরে বসে খোশ-গল্প করছিলেন। ভোটারদের ডেকে নিয়ে কথা বলছেন। আবার অনেকে ভোট না দিতে পেরে ফিরেছেন বুথ থেকেও। ইভিএম মেশিনে সমস্যার কারণে ভোট দিতে পারেননি তারা। এই চিত্র দেখা গেছে ঢাকা উত্তরের প্রায় ১৭টি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করে।

সকাল ১০টা। উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের শেরেবাংলা নগর এলাকার ভোট কেন্দ্র লায়ন্স অগ্রগতি শিক্ষা নিকেতনের সামনে বিপুল ভিড়। বিদ্যালয় ফটক থেকে শুরু করে পুরো গলিজুড়ে ছিলো তাদের অবস্থান। নৌকা, ঘুড়ি ও গ্লাস প্রতীকের ব্যাজ পরিহিত এই যুবকরা ভোটার দেখলেই কাছে ডেকে নিচ্ছিলেন। নৌকা ব্যতিত অন্য প্রতীকে ভোট দিবেন বুঝতে পারলেই ফিরিয়ে দিচ্ছেন বলে ভোটাররা অভিযোগ করেন। এই কেন্দ্রে নৌকাসহ বিভিন্ন প্রার্থীর এজেন্ট থাকলেও ধানের শীষের কোনো এজেন্ট পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা জানান, সকালে ধানের শীষের এজেন্ট ঢুকতে চাইলে আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয়। প্রিজাইডিং অফিসার তারিকুল ইসলাম জানান, ধানের শীষের কোনো এজেন্ট আসেনি। তার কাছে কেউ কোনো অভিযোগও করেননি। ওই কেন্দ্রের আটটি বুথে সকাল ১০টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে মাত্র ২৪টি। এই কেন্দ্রে মোট ভোটার ৩ হাজার ৬৪। সারাদিনে ভোট প্রয়োগ হয়েছে মাত্র ৩শ’৫৪টি। এরমধ্যে নৌকা পেয়েছে ২শ’৭৩ এবং ধানের শীষের প্রার্থী পেয়েছেন ৭১টি।

একই অবস্থা ছিলো উত্তর সিটি করপোরেশনের রামপুরার খালেদ হায়দার মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়, ব্রাইট স্টার গ্রামার হাই স্কুল, মিরপুরের কালশি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রসহ বিভিন্ন কেন্দ্রে। খালেদ হায়দার উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে যুব মহিলা লীগের কর্মীদের কড়া পাহারা। চিৎকার করে তারা বারবার বলছিলেন, উন্নয়নের স্বার্থে নৌকায় ভোট দিতে হবে। ধানের শীষে ভোট দিতে চাইলে আসার দরকার নাই। বাসায় ঘুমান। খালেদ হায়দার মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে একটি বুথ ব্যতিত কোথাও ধানের শীষের এজেন্ট খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ধানের শীষের এজেন্ট নুরুজ্জামান ও স্থানীয় বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলরের এজেন্ট হোসনে আরা বেগম জানান, অনেকটা জোর করেই কেন্দ্রে ঢুকেছেন। কেন্দ্রের ঢুকার পর থেকেই হুমকি দেয়া হচ্ছিলো। আধা ঘন্টার মধ্যে চলে যেতে বলা হয় তাদের। ভোট কেন্দ্রে ঢুকতে না পেরে বিষণ্ন হয়ে বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন সাইফুর রহমান (এনআইডি ৯১৩০৯৮৬৮৭১ ) তিনি ব্রাইট স্টার গ্রামার হাই স্কুল কেন্দ্রের ভোটার। সাইফুর রহমান জানান, কেন্দ্রের ফটক থেকে নৌকার কর্মীরা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। বলেছে, ‘আপনার ভোট দিতে হবে না। বাসায় গিয়ে ঘুমান।’ ওই কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ৫শ’ ১০ জন। এই কেন্দ্রে পাঁচটি কক্ষ পরিদর্শন করে নৌকা, হাতপাখার এজেন্ট পেলেও ধানের শীষের কোনো এজেন্ট পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা জানান, সকালে কেন্দ্রে ঢুকার চেষ্টা করলে নৌকার ব্যাজ পরিহিত কর্মীরা বাধা দেয়। বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে ধাওয়া দিয়ে তাদের সরিয়ে দেয়।

কালশি ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে বাইরে যেমন কর্মীদের ভিড়, ভেতরেও তাই। ফটকের ভেতরে চেয়ারে বসে গল্প করছিলেন তারা। বাইরে থাকা কর্মীদের নির্দেশনা দিচ্ছিলেন ‘আমাদের ভোটার ছাড়া কাউকে ঢুকতে দিবা না।’ বিদ্যালয়ের নিচতলা এমনকি দ্বিতীয় তলার বারান্দাতেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো তাদের অবস্থান। এই কেন্দ্রে ধানের শীষের এজেন্ট ছাড়া অন্য প্রায় সকল প্রার্থীর এজেন্ট ছিলো। ঢাকা উত্তরের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের মিরপুর বাংলা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও ধানের কোনো এজেন্ট পাওয়া যায়নি। বাইরে-ভেতরে ছিলো নৌকা ও ঠেলাগাড়ি প্রতীকের ব্যাজ সম্বলিত লোকজন। এই বিদ্যালয়ে একটি কেন্দ্রে বেলা ২টা পর্যন্ত ভোট প্রয়োগ হয়েছে ৫৩৪টি। ওই কেন্দ্রের মোট ভোটার ১ হাজার ৮শ’ ৭৪ জন। উত্তরের তিন নম্বর ওয়ার্ডের শহীদ আবু তালেব উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রে বেলা ৩টা পর্যন্ত ভোট পড়ে ৭শ’৫৩টি। এই কেন্দ্রের মোট ভোটর ২ হাজার ৩শ’ ২৯ জন। এই কেন্দ্র থেকে অনেকেই ফিরে গেছেন আঙুলের ছাপ না মেলার কারণে। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও তারা ভোট দিতে পারেননি। তাদের মধ্যে একজন মো. খালিদ (এনআইডি ২৬৯৬৪০৩৭০৯৩৪১)। একইভাবে ভোট দিতে পারেননি শাওন হোসেন। ২৮ বছরের এই যুবক জানান, হাতের ছাপ না মেলায় তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে এসব বিষয়ে অবগত না বলে জানান প্রিসাইডিং অফিসার আশরাফ আলী খান।

তিন নম্বর ওয়ার্ডের শাহীন স্কুল কেন্দ্রে দুপুরে ছিলো দীর্ঘ লাইন। কয়েক ঘন্টা দাঁড়িয়ে ভোট দিতে পারছিলেন না লাইনের লোকজন। প্রিজাইডিং কর্মকর্তা জানান, ইভিএম মেশিন হ্যাং হয়েছিলো অল্প সময়। তাছাড়া ভোটারদের ভোট নিতে সময় লাগছিলো বেশি। সবাইকে শিখিয়ে দিতে হচ্ছিলো কিভাবে ভোট দিতে হবে। ভোটগ্রহণের মধ্যে কখনও কখনও উত্তেজনা ছড়াচ্ছিলেন প্রার্থীরা। আবু তালেক উচ্চ বিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর লোকজন ঢুকেছেন বিকাল ৪টার পর। খবর পেয়ে কেন্দ্র ঘেরাও করে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও তার লোকজন। পরে বাইরের লোকজনকে বের করে দেয়া হয়। একইভাবে তিন নম্বর ওয়ার্ডের প্রগতি উচ্চ বিদ্যালয়ের কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মীরা ভেতরে অবস্থান নিলে অন্য প্রার্থী কর্মীরা ভেতরে যেতে চেষ্টা করেন। এসময় পুলিশের হামলার শিকার হন সৈয়দ হাসান সোহেল নামে স্বতন্ত্র প্রার্থীর এক কর্মী। পরে ভেতরে অবস্থানকারীদের বের করে দেয় পুলিশ।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status