শেষের পাতা

সিলেটে ‘স্টিকার’ বাণিজ্যে যেভাবে কোটিপতি রেজাউল

ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে

২৭ জানুয়ারি ২০২০, সোমবার, ৯:২৪ পূর্বাহ্ন

পণ্যবাহী ট্রাকের স্টিকার বিক্রি করে কোটিপতি হওয়া এক রেজাউলের কাছে জিম্মি সিলেটের পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। বাধ্য হয়ে তার কথামতো মালিকরা স্টিকার মাসোহারা  চুক্তিতে ফি দিয়ে ও নির্দেশিত পাম্প থেকে গাড়িতে তেল লোড করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যথায় সিলেট-ঢাকা-চট্রগ্রাম রোডের বিভিন্ন স্থানে হাইওয়ে পুলিশ কর্তৃক গাড়ি আটক করে মোটা অংকের আদায় নতুবা মামলা দিয়ে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে চালকদের। রেজাউলের ‘নিশি মটরস’র স্টিকার থাকলে ট্রাকে ওভারলোড পণ্য পরিবহন করার সুযোগ থাকে। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানয়েছেন- প্রতি মাসে দুই থেকে আড়াই হাজার গাড়ি সিলেট-ঢাকা-চট্টগ্রাম’সহ দেশের অন্যান্য রোডে চলে ‘নিশি মটরস’ স্টিকার দিয়ে। প্রতি স্টিকারের মাসিক ফি ৩ হাজার টাকা। শুধু স্টিকার বিক্রি করে প্রতিমাসে আয় হয় প্রায় অর্ধকোটি টাকা। এছাড়া চট্টগ্রাম রোডে ওভারলোড বন্ধে থাকা স্কেলেও কোন ট্রাক অতিরিক্ত মালামাল নিয়ে পারাপারের জন্য গাড়ি প্রতি ৫ হাজার টাকা দিয়ে কন্ট্রাকের মাধ্যমে ছাড়িয়ে দেন রেজাউল। প্রতিদিন এভাবে কমপক্ষে ৫০-৬০ ট্রাক পারাপার করে। রাস্তায় চলাচলে গাড়িগুলো রেজাউলের ভাড়া নেয়া পেট্রোল পাম্প থেকে তেল ক্রয় না করলে তাকেও বিভিন্নভাবে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করে বাধ্য করা হয় তেল ক্রয় করাতে।

পুলিশের সঙ্গে রেজাউলের চুক্তি ও সখ্যতা থাকায় ভয়ে কেউই প্রতিবাদ করছেন না। সম্প্রতি ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা দিয়ে ক্রয় করা রেজাউলের বিল্ডিং ভাড়া করে অফিস পরিচালনা করছেন হাইওয়ে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তরা। রেজাউল অনিয়ম ও চরম স্বেচ্ছাচারিতায় অতিষ্ঠ সিলেটের ট্রাক-মালিক শ্রমিক ও জেলা পেট্রোলিয়াম অনার্স এসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ। ইতোপূর্বে প্রশাসনের রেজাউলের কর্মকাণ্ড নিয়ে পুলিশ প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেয়া হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নাটোর জেলা শহরের কায়কোবাদ এলাকার অধিবাসি রেজাউল করিম সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে একটি ওয়ার্কসপের হেলপার হয়ে শুরু করেন কাজ। ২০১৫ সালে পপুলার স্টোন ক্রাশারের মালিক সাজু ও তাঁর বাবার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরী করে ঢাকার সিকদার এন্টার প্রাইজ’সহ কয়েকটি কোম্পানির কাছে পাথর বিক্রি শুরু করে।

এই সুবাদে ‘নিশি মটরস নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্টানের মালিক হয়ে যান তিনি। আর পাথর চালানের টাকার রসিদ বই ব্যবহার করতেন নিশি মটরসের নামে। এতে করে প্রায় ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন রেজাউল। তবে পপুলার স্টোন ক্রাশারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে- পায় ১ কোটি টাকা আত্মসাত করা হয়েছে। এরপর থেকে আর পিছনে থাকাতে হয়নি রেজাউলের। ৫-৬টি ট্রাক এক সঙ্গে ক্রয় করে রাস্তায় নামিয়ে দেন নিশি মটরস’র নামে। বর্তমানে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০টি ট্রাক রয়েছে। সিলেটের কয়েকটি পেট্রোল পাম্পের মালিককে জিম্মি করে রেখেছেন রেজাউল। মাসের পর মাস পাম্প থেকে তেল ক্রয় করে বকেয়া রেখেছেন প্রায় কোটি টাকার মতো। পাম্প মালিকরা কিছুতেই টাকাগুলো আদায় করতে পারছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। বিগত দেড় বছর ধরে রেজাউল শুরু করেছেন স্টিকার বাণিজ্য। হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে গোপন চুক্তি করে ‘নিশি মটরস’ নামে মাসিক ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করছেন স্টিকার। দুই থেকে আড়াই হাজার ট্রাকে লাগানো হয়েছে সেই স্টিকারগুলো। যে ট্রাক গাড়ি নিশি মটরসের স্টিকার ব্যবহার করে না তাদের শেরপুর ও শায়েস্তাগঞ্জে পুলিশ আটক করে মামলা বা ডাম্পিং সহ নানা রকম ঝামেলায় ফেলা হয় ট্রাক চালককে। চট্টগাম রোডের সীতাকুণ্ড নামক স্থানে রয়েছে ওভারলোড মাপার স্কেল।

সেখানে অতিরিক্ত মালামাল হলে রেজাউলের সাথে চুক্তি করলে তা ছেড়ে দেয়া হয়। সেই টাকা বিকাশের মাধ্যমে জমা হয় তার কাছে। সময় মতো সেই টাকা বণ্টন করে দেয়া হয় স্ব-স্ব কর্মকর্তার কাছে। রেজাউল সম্প্রতি ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার বিনিময়ে সিলেটের দাসপাড়ায় ক্রয় করেছেন একটি অত্যাধুনিক বহুতল ভবন। সেই ভবনটি ভাড়া নিয়ে হাইওয়ে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রশাসনিক সকল কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন সেখান থেকে। এই সুবাদে হাইওয়ে পুলিশের সখ্যতা গড়ে উঠে রেজাউলের। তাছাড়া অর্থনৈতিক সম্পর্কে আরো কাছে চলে গেছেন তিনি। সিলেটের ট্রাক মালিক-শ্রমিকরা জানান- নিশি মটরসের নামে স্টিকার বাণিজ্যের ফলে তার কাছে মালিক-শ্রমিকরা জিম্মি। সরকার যেখানে ওভারলোড বন্ধে কঠোর অবস্থানে সেখানে রেজাউল বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। প্রতি মাসে হাতিয়ে নিচ্ছে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা। অতি অল্প দিনে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার নেপথ্যের সন্ধানে দূর্ণীতি দমন কমিশনের দৃষ্টি কামানা করেছেন ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। নিশি মটরসের স্বত্বাধিকারী রেজাউল করিম জানিয়েছেন- ‘আমি স্টিকার ব্যবসা করি না। নিজের কিছু গাড়িতে শুধু সেই স্টিকার লাগিয়ে থাকি।’ বহুতল ভবন ক্রয় প্রসঙ্গে তিনি বিল্ডিংটির মালিক নয় বলে অস্বীকার করলেও পরে তিনি স্বীকার করে বলেন- ‘আমি কিনে ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছি। টাকা আত্মসাতের বিষয় ও ট্রাক চালকদেরকে হয়রানির ঘটনাটি তিনি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন।’

বলেন- ‘আমার তেমন কোন সম্পদ নেই। তবে যা সম্পদ আছে তা ব্যাংক লোনের মাধ্যমে অর্জন।’ সিলেট জেলা ট্রাক পিকআপ কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি শ্রী আবু সরকার জানান- নিশি মটরস’সহ আরো ৮ প্রতিষ্ঠান হাইওয়ে পুলিশের সহযোগিতায় স্টিকার ব্যবসা করছে। যার কারণে ওভারলোড বন্ধ হচ্ছে না। কিছুদিন পূর্বে আমরা দুই স্টিকার ব্যবসায়ীকে আটক করে পুলিশে দিয়েছি। স্টিকার বন্ধে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে দরখাস্ত দেয়া হয়েছে। কোন ফলাফল এখনো আসেনি।’ সিলেট চেম্বার অব কর্মাসের পরিচালক ও ট্যাংকলরী অনার্স এসোসিয়েশন সিলেট বিভাগীয় কমিটির সভাপতি মো. হুমায়ুন আহমদ বলেন, ‘ট্রাকে নিশি মটরস’র স্টিকার না হলে চলাচলে পুলিশ বিভিন্ন রকম সমস্যা করছেন বল অভিযোগ এসেছে। আমরা বসে ব্যবস্থা নিবো।’
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status