প্রথম পাতা

ঢাবিতে ছাত্রলীগের ‘রিমান্ডে’ ৪ ছাত্রকে রাতভর নির্যাতন

বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার

২৩ জানুয়ারি ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৯:৩১ পূর্বাহ্ন

বিচারের দাবিতে নির্যাতিত শিক্ষার্থীর অবস্থান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে চার শিক্ষার্থীর ওপর রাতভর নির্যাতন চালিয়েছেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। মারধরের একপর্যায়ে ভোররাতে আহত অবস্থায় ওই শিক্ষার্থীদের পুলিশের হাতে 
তুলে দেয়া হয়। মঙ্গলবার রাতে হলটির অভ্যন্তরে এক আবাসিক শিক্ষকের উপস্থিতিতে এ ঘটনা ঘটে। মারধরের পর ওই শিক্ষার্থীদের হল প্রশাসন ও প্রক্টরিয়াল বডির মাধ্যমে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়। শিবির করার অভিযোগে তাদের আটক করে পুলিশে দেয়া হয় বলে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হলেও ওই শিক্ষার্থীদের শিবির সংশ্লিষ্টতার কোন প্রমাণ না পেয়ে পুলিশ তাদের ছেড়ে দিয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে বুয়েটের শেরে বাংলা হলে শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ওই ঘটনার দাগ কাটতে না কাটতেই ঢাবিতে এ নির্যাতনের ঘটনা ঘটল। এদিকে চার শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনায় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছে নবগঠিত সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্র ঐক্য।

অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন এক ভুক্তভোগী। ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর অবিলম্বে মারধরে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আর, কোন শিক্ষার্থীর গায়ে অন্য কারো হাত তোলাকে সমর্থনযোগ্য নয় উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন বলেছেন, তার সংগঠনের কেউ মারধরে যুক্ত থাকার প্রমাণ মিললে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এদিকে ঘটনার পর থেকেই সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রেখেছেন হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন। মুঠোফোনে একাধিকার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রাব্বানী জানিয়েছেন, কেউ মারধরের শিকার হয়েছে উল্লেখ করে অভিযোগ করলে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। ভুক্তভোগী চার শিক্ষার্থী হলেন- মকিমুল হক চৌধুরী (টুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট), সানোয়ার হোসেন (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), মিনহাজ উদ্দিন (ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি) ও আফসার উদ্দিন (আরবী)। এরা সবাই দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। মারধরের বিষয়ে রাতে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দিয়েছেন।

আর মারধরে অভিযুক্তরা হলেন- শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমির হামজা, সাংগঠনিক সম্পাদক শাহীন আলম, সহ-সভাপতি ও হল সংসদের সাহিত্য সম্পাদক কামাল উদ্দীন রানা, কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য ও হল সংসদের ভিপি সাইফুল্লা আব্বাছী অনন্ত, কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য মাহফুজুর রহমান ইমন। আর ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী মুকিমুল হককে গেস্টরুমে ডেকে আনেন হল শাখার সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন। তবে তিনি মারধরে অংশ নেননি বলে একজন জানান। চার শিক্ষার্থীকে মারধরের সময় হল সংসদের জিএস তৌফিকুল ইসলাম, এজিএস সুরাপ মিয়া সোহাগ, পদপ্রত্যাশী রিফাত উদ্দিন, রুবেল হোসেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। জানা গেছে, ফেসবুকে ম্যাসেঞ্জারের কিছু স্ক্রীনশর্টের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টায় মুকিমুল হককে গেস্টরুমে ডাকেন হল সংসদ ও হল ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী (সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক) নেতারা। এরপর ওই শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় যে তিনি শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কিনা। একই সাথে তার ম্যাসেঞ্জারের চ্যাট লিস্টে থাকা আরো তিন শিক্ষার্থীকেও গেস্টরুমে ডাকা হয়।

এরপর সবাইকে শিবিরের রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট বলে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ভুক্তভোগীরা এতে অস্বীকৃতি জানালে মারধর শুরু হয়। মারধরে অংশ নেন হল সংসদে ভিপি সাইফুল্লা আব্বাছী অনন্ত, শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমির হামজা, সাংগঠনিক সম্পাদক শাহীন আলম, হল সংসদের সাহিত্য সম্পাদক কামাল উদ্দিন রানা, কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য মাহফুজুর রহমান ইমন। অভিযুক্তরা সবাই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয়, সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের অনুসারী। ভুক্তভোগী মুকিমুল হক বলেন, প্রথমে আমাদের থেকে যখন স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারছে না তখন তারা আমাদের মারধর করে হল সংসদের কক্ষে নিয়ে যায়। এরপর সেখানে দ্বিতীয় দফায় মারধর করা হয়। এতে হল সংসদ ও শাখা ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী নেতারা অংশ নেন। এরপর দ্বিতীয় দফায় হল সংসদের কক্ষে মারধরের পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় হলের তিন তলার ছাদে। সেখানে হল সংসদ ও ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী প্রায় ২০ নেতা উপস্থিত ছিলেন। এসময় আমাদের স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে অমানবিকভাবে মারধর করা হয়। মারধরে হাতুড়ি, রড, লাঠি ও স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হয়।

শরীরের জয়েন্টে জয়েন্টে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েছেন হল সংসদের ভিপি ও শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহীন আলম। তিনি বলেন, ছাদে মারধরের পরে ফের হলের গেস্টরুমের সামনে আমাদের আনা হয়। সেখানেও আমাদের মারধর করা হয়। এসময় হলের আবাসিক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. বিল্‌লাল হোসেন উপস্থিত থাকলেও তিনি ছাত্রলীগ নেতাদের নিবৃত করেননি। মুকিম জানান, এরপর রাত ২টার দিকে হল প্রশাসনের মাধ্যমে তাদের শাহবাগ থানায় দিয়ে দেয়া হয়। মারধরে আহত চার শিক্ষার্থীকে পুলিশ ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা শেষে থানায় নিয়ে আসেন। মুকিম বলেন, তারা আমাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছে তা দেখে আমরা পুরোই হতবাক। তারা হাতুড়ি, রড, স্টাম্প দিয়ে আমাদের উপর নির্যাতন করেছে। তিনি আরও বলেন, এর আগে গত অক্টোবরে তারা আমাদের তিনজনকে শিবির সন্দেহে হয়রানি করে। এবং একপর্যায়ে পুলিশে দেয়। তখনও পুলিশ আমাদের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ পায়নি।

এদিকে অভিযোগের সতত্যা না পেয়ে গতকাল দুপুরে ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের উপস্থিতিতে মুচলেকা নিয়ে চার শিক্ষার্থীকে ছেড়ে দেয় শাহবাগ থানা পুলিশ। পরে তাদের তিনজন বাসায় চলে যান। আর মুকিম রাজু ভাস্কর্যে বিচারের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। এদিকে চার শিক্ষার্থীকে মারধরের বিষয়ে জানতে চাইলে হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, আমার গ্রুপের এক ছোট ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসায় আমি সেখানে গিয়েছিলাম। এরপর জিজ্ঞাসাবাদে সে স্বীকার করেছে যে সে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তখন হলের জিএস প্রভোস্টকে ফোন দিলে আবাসিক শিক্ষক আসার পর আমি রুমে চলে আসি। এরপর মারধর হয়েছে কিনা আমি জানিনা। তবে আমি মারধরে অংশ নেইনি। আর হল সংসদের ভিপি সাইফুল্লা আব্বাছী অনন্ত বলেন, জুনিয়রদের কাছ থেকে ওসব শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে শিবির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এসেছিল। পরে আমরা তাদের গেস্টরুমে ডেকে কথা বলি।

এরপর তারা স্বীকার করায় হল প্রভোস্টকে ফোন দিয়ে হল প্রশাসনের কাছে তুলে দেয়া হয়। মারধরের কোন ঘটনা ঘটেনি। এদিকে শিক্ষার্থীকে মারধরের সময় নিজের ভূমিকার বিষয়ে জানতে হলটির আবাসিক শিক্ষক অধ্যাপক ড. বিল্‌লাল হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান তিনি একটি প্রোগ্রামে আছেন, দেড় ঘণ্টা পর কল দিতে। কিন্তু দেড় ঘণ্টা পর কল দেয়া হলে তিনি আর কল রিসিভ করেননি। এ বিষয়ে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন বলেন, কোনভাবেই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়াকে সমর্থন করি না। কেউ কারো গায়ে হাত তুলবে, সেটি কোনভাবেই কাম্য নয়। আমরা চাই সকলের সহিষ্ণু আচরণ।

কেউ যদি কোন ধরণের অপরাধে জড়িত থাকে, তাহলে সেটি হল প্রশাসন দেখবে। কোন শিক্ষার্থী যেন নিজের হাতে আইন তুলে না নেয়। একই সঙ্গে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানাবো তারা যদি কাউকে মৌলবাদী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত দেখে, তাহলে সেটি হল প্রশাসনকে অবহিত করার। কেউ যেন আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়। নিজ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে সাদ্দাম হোসেন বলেন, যদি মারধরের সঙ্গে আমাদের সংগঠনের কেউ জড়িত থাকে, তার বিরুদ্ধে আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। কারণ ছাত্রলীগ কোনভাবেই উচ্ছৃঙ্খল কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করে না। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানী বলেন, আমরা যখনই জানতে পেরেছি যে এমন অভিযোগে চারজনকে থানায় দিয়েছে হল প্রশাসন, তখনই আমি থানায় ফোন দিয়ে বলেছি যে যদি তাদের বিরুদ্ধে উত্থপিত অভিযোগের কোন সংশ্লিষ্টতা না থাকে তাহলে যেন ছেড়ে দেয়া হয়। থানা ইতোমধ্যে আমাদের নির্দেশনা অনুযায়ী ওই চার শিক্ষার্থীকে ছেড়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, কোন শিক্ষার্থীকে মারধরের বিষয়ে এখনো আমার কাছে লিখিত কিংবা মৌখিক কোন অভিযোগ আসেনি। যদি এমন কোন অভিযোগ কেউ আমাদের কাছে দেয়, তাহলে আমরা সেটির আলোকে হল প্রশাসনসহ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

ডাকসু ভিপির প্রতিবাদ, বিক্ষোভ: ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর বলেছেন, আমি ডাকসুর ভিপি হয়েও ডাকসু ভবনে ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছি। তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা কোথায়। ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নেই। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ছাত্রলীগ থেকেও ভয়ঙ্কর। গতকাল বিকেলে চার শিক্ষার্থীর ওপর হামলার প্রতিবাদ ও অভিযুক্তদের বিচারের দাবিতে এক বিক্ষোভ শেষে এসব কথা বলেন তিনি। এসময় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ প্রক্টরের পদত্যাগ,  গেস্টরুম-গণরুমে নির্যাতন বন্ধ, প্রথম বর্ষ থেকে হলে বৈধ সিট দেয়াসহ ৪ দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ারও ঘোষণা দেন তিনি। নুর বলেন, দলকানা প্রশাসন ছাত্রলীগের নির্মম নির্যাতনের পরেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। জহুরুল হক হলে গতকাল রাতে চারজনকে ছাত্রলীগ নির্যাতন করে। তারা বেধড়ক পিটিয়েছে। যে নির্যাতন করেছে তা আমি শাহবাগ থানায় গিয়ে দেখেছি। তাদেরকে আবরারের মত পিটিয়েছে। হাতুড়ি দিয়ে, স্টাম্প দিয়ে পিটিয়েছে। হয়তো এই চারজনের মধ্যে কেউ একজনের আবরারের মতো পরিণতি হতে পারত। তিনি আরো বলেন, ছাত্রলীগের নির্যাতন নিপীড়ন থেকে কেউ রেহাই পাচ্ছে না।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status