প্রথম পাতা

ভাড়ায় মিলে মামলার বাদী!

মোহাম্মদ ওমর ফারুক

১৯ জানুয়ারি ২০২০, রবিবার, ৯:২৪ পূর্বাহ্ন

সাত বছরের শিশু আলাউদ্দিন। মানব পাচার মামলার আসামি। পাঁচ বছর আগের ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে ২০১৮-তে। ওই মামলায় আসামি করা হয় কক্সবাজারের রামু উপজেলার চাকমার ইউনিয়নের এ শিশুকে। ঘটনার সময় তার বয়স ছিলো সাত। মামলার অভিযোগে বলা হয়, বিনা খরচে, ভালো বেতনে মালয়েশিয়ায় কাজ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ২০১৪ সালে ২১শে জুন বাদী ও অন্যান্য ভিকটিমকে কক্সবাজারের লাবনী চর থেকে জাহাজে তুলে দেয় এই শিশুসহ অন্য আসামিরা। পরে থাইল্যান্ডে পৌঁছালে দালাল চক্রের লোকজন মুক্তিপণ দাবি করে। মোবাইল ফোনে স্বজনদের কাছ থেকে এই আসামি (শিশু), মামলার প্রধান ও দ্বিতীয় আসামি ২ লাখ টাকা নেয়। পরবর্তীতে আসামিদের আরো ১ লাখ টাকা দেয়ার পর মালয়েশিয়া পৌঁছান মামলার বাদী নুরুল ইসলাম। পরে সেদেশে জেলখেটে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এরপরই তিনি মামলা করেন। এই মামলায় হাইকোর্টে আত্মসমর্পণ করে জামিন চান ওই শিশু। গতবছর হাইকোর্ট তাকে আট মাসের আগাম জামিন দেন। এই মামলায় আরো একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়। শিশুর মা রেজিয়া বেগম বলেন, সাত সন্তানের পরিবার আমার। মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতে হয়। আমার এই ছেলেটির বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাদের জীবনটা শেষ করে দিয়েছে। মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলে আমি ঢাকায় এসেছি। হাইকোর্টে গিয়েছিলাম। খোঁজ নিয়ে জানা যায়,ওই শিশুসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ৬ জনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে-২ এ মানব পাচারের মামলা করেন  প্রতিবেশী নুরুল ইসলাম। এই মামলা আরো ৫ আসামি তারাও চিনেন না বাদীকে। বাদীও চিনেন না তাদেরকে। এই মামলার আরেক আসামি নরসিংদী বাটিক দোকানী জয়নাল আবেদীন। তার কাছে প্রশ্ন কক্সবাজারের মামলায় তিনি কিভাবে জড়ালেন। জয়নাল আবেদীন বলেন,আমি নিজেও জানি না। আমি এই মামলায় জেল খেটেছি। আমার সঙ্গে অন্য আসামিদেরও আমি চিনি না।

আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে সবার সঙ্গে পরিচয়। তবে এই মামলার বাদী নূরুল ইসলাম ভুগছেন অনুশোচনায় । তিনি বলেন, ঢাকা থেকে একটি চক্র এসে আমাকে দিয়ে মিথ্যা মামলা করান। বিনিময়ে আমি এক লাখ ২০ হাজার টাকা পাই। এবং মামলার প্রতিটি হাজিরার দিন আরো হাজার দশেক টাকা করে পেয়েছিলাম। আরেক মামলার আসামি রাজধানী শেওড়াপাড়ার আকরামুল আহসান কাঞ্চন। তিনি এসিড নিক্ষেপ, মানবপাচার, নারী নির্যাতনসহ প্রায় ৪৭টি মামলার আসামি। ২০১০ সাল থেকে প্রায় দশ বছর রয়েছেন কারাগারে। গত বছর ডিসেম্বরে কিছু দিনের জন্য ছাড়া পেলেও গত কয়েকদিন আগে আবার গ্রেপ্তান হন তিনি। তার স্ত্রী তামান্না আকরাম বলেন, আমাদের সম্পত্তি ভোগদখল করার জন্য চক্রটি আমাদের বিরুদ্ধে এই মামলাগুলো দিয়েছে। প্রথমে একটি মিথ্যা মামলায় জেলে যাওয়ার পর বাকি মামলাগুলো হয়েছে কারাগারে থাকা অবস্থায়। এই অবস্থা থেকে বাঁচার আকুতি জানান তিনি। ওয়ারীর আরেক বাসিন্দা ব্যবসায়ী সাইফুল্লাহ। তার বিরুদ্ধে রয়েছে ৬০টি মামলা। গত ১৫ বছর ধরে অসংখ্যবার জেল খেটেছেন তিনি। এখনো তিনি রয়েছেন কারাগারে। শিশু আলাউদ্দিন, শেওড়াপাড়ার আকরামুল আহসান কাঞ্চন বা সাইফুল্লাহই নন। এরকম মিথ্যা মামলার সিন্ডেকেটে বন্দী অনেকেই।

পুলিশের দাগী অপরাধীর তালিকায় নাম নেই বা কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত এমন তথ্য জানা নেই পরিবারের কারোর। তারপরেও একের পর এক মামলা আসামি হচ্ছেন তারা। কোনো অপরাধ না করেও বছরের পর বছর জেল খাটছেন ভোক্তভোগীরা। কেউ কেউ ঘর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, হয়েছেন সম্বলহীন। অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব মামলার বাদীরা ভাড়ায় মামলা করেন। এই সাজানো বাদীরা কখনো এক কালীন আবার কখনো মাসিক বেতনে কাজ করেন। এমন বাদী যেমন চেনেন না আসামিকে, আবার আসামিরা চেনেন না বাদীকে। তবে এসব বাদীরা মিথ্যা মামলার করতে গিয়ে উল্টো মামলা খাওয়ার নজির রয়েছে এই প্রতারকদের বিরুদ্ধে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্বেচ্ছায় কিংবা দালালচক্রের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নি:স্ব হয়ে দেশে ফিরেছেন এমন মানুষদের বাদী হিসেবে বেছে নেয় মামলাবাজ চক্র। ২০১৭ সালের ১৬ই মার্চ এমন সাজানো মামলা করতে গিয়ে উল্টো ফেঁসে যান প্রতারকচক্রের সদস্য সাকেরুল কবিরসহ পাঁচজন। কক্সবাজারের তৈয়ব উল্লাহ, খাগড়াছড়ির নূরুল আলম ও খলিল হাওলাদারের বিরুদ্ধে মানপাচারের ভুয়া মামলার বাদী হিসেবে নাহিদা বেগম,সুমি বেগম ও আরজু আক্তারকে নিয়ে সাতক্ষীরায় কলারোয়া থানায় যান এই চক্রটি। তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক হওয়া উল্টো সাকেরুল কবিরসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে নাহিদা বেগমকে দিয়ে পাল্টা মামলা করান পুলিশ। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কলারোয়া থানা। এদিকে, সাকেরুলের বড় ভাই শাহেদুল এই প্রতিবেদক’কে বলেন, এই ঘটনায় একবছর আগে সাকেরুল এক মাস জেলে ছিলো। পরে ঢাকা থেকে একটি দরবারের লোকজন তাকে জামিন করে নিয়ে আসে। এখন তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। যতটুকু জানি ঢাকার ওই কথিত দরবারে তার আসা যাওয়া। তবে ভুক্তভোগী অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীর একটি চক্র বিভিন্ন ভাবে বিভক্ত হয়ে এই কার্যক্রম পরিচালনা করে। চক্রটি রাজধানীর কথিত একটি পীরের দরবার।

এই চক্রের অন্যতম সদস্য সাকেরুল কবীর। সাকেরুলকে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি কথা না বলে ফোন কেটে দেন। পরে তাকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। জানা যায়, রাজধানীর টিকাটুলির ৬৩ বছর বয়সী এম সাইফুল্লাহ। এ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে প্রতারকচক্র মামলা করেছে ৬০টি। যা অধিকাংশই ভুয়া বলে খারিজ করে দিয়েছে আদালত।এমন আরেকজন মিথ্যা মামলার বাদী লাকী আক্তার আদালতে হলফ নামা দেন। তিনি বলেন,মামলা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। তাকে দিয়ে ওই চক্রটি মামলা করিয়েছেন। আরেক ভোক্তভোগী রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক প্রাপ্ত মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সোহেল চৌধুরী। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে মানবপাচার একাধিক মামলা। খেটেছেন জেল। এখন ফেরারী হয়ে ঘুরছেন।তার একটি মামলার বাদী হামিদা বেগম নামে এক নারী।

বিভিন্ন মামলার নথি ঘেটে দেখা যায়, হামিদা আক্তার একেক সময় একেক মামলার স্বাক্ষী আবার একেক মামলার বাদী হিসেবে কাজ করেন। তবে ওই নারী নানান সময় নানান ঠিকানা দেয়ার ফলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এমন আরেকজন লাকী আক্তার।তিনি সাতক্ষীরায় মানবপাচার মামলার বাদী, আবার তিনিই চট্রগ্রামে সাইফুল ইসলামের করা মামলায় ৫ নম্বর স্বাক্ষী। তার মেয়ে নূরে জান্নাত নূপর সাতক্ষীরা মামলার ভুক্তভোগী,চট্রগ্রামের সাইফুল মামলায় ৪ নম্বর স্বাক্ষী। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,রাজধানীর এই চক্রটি সারাদেশে মামলা ভাড়ায় বাদী ম্যানেজ করে টার্গেট করে মামলা দেয়। বিশেষ করে জমি,বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের টার্গেট করে মামলার জালে জড়াচ্ছে এই চক্রটি। ভুক্তভোগীদের মামলা থেকে রেহাই দেয়ার কথা বলেও এই চক্র তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

ভুক্তভোগীদের মানববন্ধন: গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সারাদেশ থেকে  আসা এমন বিশটি পরিবারের  সদস্যরা এসব মামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। বিশটি পরিবারের প্রায় ১৩৩ জন সদস্য এসব মামলায় ভুক্তভোগী। সমাবেশে আসা প্রায় প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তেমনি একজন আশুলিয়ার মেঘলা। তিনি দাবি করছেন,তার ছোট ভাই উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফজলে হামিম সায়মন ও বাবা ড. সোহরাব হোসেন মিথ্যা মামলায় জেল খাটছেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৫টি। তাদের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বান্দরবান ও সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এই মামলাগুলো দায়ের করা হয়। তাদের সঙ্গে জেল খাটছেন একই পরিবারের মাহবুবুর রহমান খোকন। মেঘলা বলেন , পরিবারের কোনো পুরুষ সদস্য বাড়ি থাকতে পারে না। আতংকে থাকতে হয় আমাদের। আমার ছোট ভাই অনেক মেধাবী ছিলো। তার এখন গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার কথা। অথচ সে এখন কারাগারে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status