খেলা

অর্ণবের জন্য ভালোবাসা

নোমান মোহাম্মদ

১৫ ডিসেম্বর ২০১৯, রবিবার, ৯:০৬ পূর্বাহ্ন

দীপায়ন অর্ণবকে দেখলেই আমার রশীদ করীমের সেই উপন্যাসটির কথা মনে হত, ‘মায়ের কাছে যাচ্ছি’।
বড্ড মা ন্যাওটা ছেলে। বাবা মারা গেছেন আগেই। মা ওর সবচেয়ে বড় বন্ধু। বয়স বেড়েছে, পায়ের তলায় খড়ম পড়ে নেত্রকোণা থেকে ঢাকায় এসেছেন, বন্ধুত্বের তালিকা নাতিদীর্ঘ থেকে হয়েছে অতিদীর্ঘ- তবু মা ছাড়া যেন গতি নেই। সারাক্ষণ ছটফট করতেন মায়ের কাছে যাবার জন্য। সেই অর্ণব অগ্রহায়ণের শীতের রাত্রিতে শেষবারের মতো গেলেন মায়ের কাছে। চিরতরে মায়ের কোল শূন্য করে।

অর্ণবের সবটাতেই বড্ড বাড়াবাড়ি। চলে যাবার বেলায়ও তাই। নইলে কী প্রয়োজন ছিল, মাত্র ২৭ বছর বয়সে মৃত্যুর ওই রহস্যঘেরা জগতে যাত্রার! দিব্যি ভালো মানুষটি আগের রাতে শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সে ছিলেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ক্রীড়া বিভাগের সহ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেলেন। পর দিন সকালে পেট ব্যথা। বরাবরের ভরসা মাকে ফোন দিলেন। তাঁর পরামর্শে ওষুধ কেনার জন্য গেলেন ফার্মেসিতে। হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়ে যান রাস্তায়। সব শেষ!

ওই যে বাড়াবাড়ির কথা বলছিলাম। বলুন তো, ফিল হিউজকে নিয়ে অমন বাড়াবাড়ি আর কার রয়েছে? সেই ২০১৪ সালে বলের আঘাতে মৃত্যু ওই অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানের। পাঁচ বছর পরও তা মেনে নিতে পারেন না অর্ণব। তাই তো নিজের ফেসবুক প্রোফাইলের কাভার ফোটোতে এখনো হিউজ। তিনি নিজে দেয়ালে ঝোলানো ছবি হয়ে যাবার দিনেও!
ডন ব্রাডম্যান নিয়েও খুব আদিখ্যেতা। তাঁর সমপর্যায়ের কোনো ব্যাটসম্যান কেউ কোনো দিন হতে পারবে, বিশ্বাসই করতেন না। শচীন-লারা তো বটেই, ভিভ রিচার্ডসকে পর্যন্ত অর্ণব ‘শিশু’ মনে করতেন ওই অস্ট্রেলিয়ানের তুলনায়। শিশুসুলভ সে বিতর্ক উসকে তাঁকে কত খেপিয়েছে বন্ধুরা!

বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসা বঙ্গবন্ধুর প্রতিও। এ নিয়ে সামান্যতম সমাঝোতার সুযোগ নেই। বর্তমান বাংলাদেশের অনেক কিছুতেই আপত্তি কিন্তু রাজনৈতিক আলোচনার শুরুতে যদি বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ব মেনে না নেন, তাহলে অর্ণব কথা চালাতেই আগ্রহী হবেন না। আর বঙ্গবন্ধু মানেই তো স্বাধীনতা। সে স্বাধীনতার পক্ষে প্রগতিশীলতার মিছিলে সামনে সারিতে ছিলেন বরাবর। সঙ্গে পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণা কিংবা পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের প্রতি বিদ্রূপের সুর ছিল তাঁর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে। তা নিয়ে আড্ডায় শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের চৌহদ্দিতে কত সুবর্ণ সময় কেটেছে আমাদের!
আড্ডায়ও অর্ণব অতুলনীয়। আমার কাছে সবচেয়ে চমক জাগানিয়া ছিল পুরোনার প্রতি তাঁর প্রেম। দৈনিক কালের কণ্ঠতে বাংলাদেশের কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদদের নিয়ে পূর্ণ পৃষ্ঠা সাক্ষাৎকার নিয়েছি অনেক। ছাপা হবার পরবর্তী দেখায় অবধারিতভাবে তা নিয়ে অর্ণবের সঙ্গে আলোচনা। সত্যিই কি নেহাল হাসনাইন অত বড় ব্যাটসম্যান ছিলেন? সালাউদ্দিন-এনায়েতের মধ্যে কেন বেশিরভাগ সালাউদ্দিনকে এগিয়ে রাখেন? আরো কত কত প্রশ্ন! সময় কম বলে যেন খুব তাড়াতাড়ি সব জেনে নেবার তাড়া অর্ণবের!

বাড়াবাড়ি লিভারপুল নিয়েও। অর্ণবের মৃত্যুর পর আমি জেনেছি, ফুটবলের প্রতি তাঁর আগ্রহ বেশি দিনের নয়। অথচ রাশ-ডালগ্লিস-বার্নস নিয়ে তর্কবিতর্কে কখনো তা বুঝিনি। বুঝিনি তাঁর সঙ্গে আমার ওই কথোপকথনটাই হয়ে থাকবে শেষ স্মৃতি। ‘লিভারপুলের ইংলিশ লিগ চ্যাম্পিয়ন হতে দেখার চেয়ে আমার তো মরে যাওয়াও ভালো’- বলছিলাম অর্ণবকে। কী আশ্চর্য, আমি এখনো বেঁচে আছি। অর্ণবের যাত্রা অনন্তলোকে।

তাঁর আরেক ভালোবাসা সত্যজিৎ রায়। ফেলুদার ট্র্যাকগুলোতে ভ্রমণের শখ ছিল। জটায়ুর সেই বিখ্যাত ডায়লগ অর্ণব শরীর দোলানো হাসিতে শুনিয়েছে বহুবার, ‘আপনাকে তো কালটিভেট করতে হচ্ছে মশাই।’ আফসোস, আমরা অর্ণবকে খুব একটা ‘কালটিভেট’ করতে পারলাম না। বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিতাও ওর পরিসংখ্যানসমৃদ্ধ লেখনীতে ঋদ্ধ হবার সুযোগ পেলো না তেমন।

তবে এই যে অর্ণবের এত বাড়াবাড়ির কথা বললাম, সব তুচ্ছ মায়ের প্রতি ভালোবাসায়। মায়ের জন্মদিনে ঢাকা থেকে কেক কিনে গভীর রাত্রে নেত্রকোণায় হাজির হয়ে চমকে দিয়েছেন। মাকে ফেসবুক চালানো শিখিয়েছেন; এ নিয়ে মাকে কী যে খ্যাপাতেন! মা ওসব পাত্তা দেবেন কেন! তাঁর ভোজনরসিক ছেলে ঢাকা থেকে ফিরলে ওর প্রিয় সব খাবারের যোগারযন্ত্রে বরং ব্যস্ত হতেন আনন্দ নিয়ে। সেই অর্ণবই কিনা কফিনবন্দী হয়ে মায়ের কোলে ফিরেছেন শেষবারের মতো।

অর্ণব অর্থ সমুদ্র। ওর মায়ের দুচোখের অশ্রুতে তাই অর্ণব বইতে থাকবেন চিরকাল। আর দীপায়ন অর্ণব আমাদের কাছে অনির্বান দীপালোক হয়েই বেঁচে রইবেন অনন্তকাল।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status