প্রথম পাতা

আদালতে চোখ ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের

কত রক্ত বইলে তাকে গণহত্যা বলা যায়

পিয়াস সরকার ও সরওয়ার আলম শাহীন, কুতুপালং, উখিয়া থে

১৩ ডিসেম্বর ২০১৯, শুক্রবার, ৯:২৯ পূর্বাহ্ন

মিনহাজুল আবেদিন। মিয়ানমারে ছিলেন স্কুলশিক্ষক। সেনা বাহিনীর গুলিতে মারা গেছেন বাবা ও ২ ভাই। ৭ জনের পরিবারের ৩ জনকে মৃত অবস্থায় রেখে পালানোর সময় বোনকে হারিয়ে ফেলেন। ২ দিন পর বোনকে বিধ্বস্ত অবস্থায় আবিষ্কার  করেন। তিনি বলেন, বোনটাকে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেও বাঁচাতে পারিনি। নির্যাতনের শিকার হয়ে ভয়ানক অসুস্থ হয় সে। পেটে বাচ্চা নিয়েই মারা যায়। এভাবে বলতে বলতে কান্নায় মুর্ছা যান তিনি। কান্না জড়িত কন্ঠে তার আবেদন, বিচার চাই। দেশে ফিরতে চাই।  ঘর ছাড়া। দেশ ছাড়া। স্বজনের লাশ রেখে জীবন বাঁচাতে ছেড়েছেন নিজ ভূমি। সম্ভ্রম হারানো নারীরা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন ক্ষত। হত্যা, নির্যাতন চালিয়ে তাদের দেশছাড়া করার ঘটনাকে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমার গণহত্যা বলে স্বীকার না করায় ক্ষুব্ধ তারা।

নেদারল্যান্ডের হেগে চলছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞের বিচার। কিন্তু মিয়ানমারের সেই হত্যাযজ্ঞকে অস্বীকার করেছেন দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচি। তার এই ‘অসত্য’ বক্তব্যে ক্ষিপ্ত নির্যাতিত জনগোষ্ঠীরা। উখিয়া কুতুপাংলয়ের একাধিক ব্যক্তি এই মিথ্যাচারের নিন্দা জানান। তারা সর্বোচ্চ বিচার দাবি করেন সূচির। গাম্বিয়ার করা আন্তর্জাতিক আদালতের মামলার রায়ের অপেক্ষায় আছেন তারা। মামলায় সুষ্ঠু বিচার দাবি করে মসজিদে বিশেষ মোনাজাত করেন অনেকে। পুরো ক্যাম্প জুড়ে রায়ের জন্য অপেক্ষা। তাদের আশা ন্যায়বিচার পাবেন তারা।

আলী ইমাম ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ঈমাম। রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও ঈমামতি করছেন। গতকাল প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর সমবেত সবাইকে নিয়ে আয়োজন করেন বিশেষ মোনাজাতের। মোনাজাতের সময় আমিন আমিন ধ্বনিতে গমগম করে উঠে চারপাশ। নামাজ শেষে এই ঈমাম জানান, একদিন এশার নামাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎ শোনেন আর্মির আক্রমণের কথা। বাড়ি ফিরে দেখেন স্ত্রী ও ছেলের লাশ। ছেলের শরীরের কাপড় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন। তার মেয়ে ও মেয়ের জামাই আগেই এসেছিলেন বাংলাদেশে। তখন তিনিও চলে আসেন বাংলাদেশে। তিনি বলেন, সূচি শান্তিতে নোবেল পাওয়ার পরেও এত বড় মিথ্যা কথা কি করে বললেন?

স্ত্রী ও মেয়ের লাশ মাটি দেবার আগেই ফিরতে হয়েছে মকবুল হোসেনকে। আর্মির আক্রমণ আসে তার পরিবারের ওপর। ফসলি জমিতে লুকিয়ে পড়েছিলেন। একরাত সেখানে কাটানোর পর ভোরবেলা আবিষ্কার করেন স্ত্রী ও মেয়ের লাশ। স্ত্রীর মাথায় ও মেয়ের গুলি লাগে পিঠে। লাশ কবর দেবার জন্য খুড়েছিলেন। কিন্তু আবার গোলাগুলির শব্দ শুরু হওয়ায় কবর দেয়া হয়নি। মাটি চাপা দিয়ে আসতে হয়েছে।

স্থানীয় হোপ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এসেছেন এক নারী। তিনি ২ বছর আগে তার সাথে ঘটে যাওয়া ভয়াবহতার চিহ্ন এখনো বয়ে বেরাচ্ছেন? তার স্বামীকে তার সামনে পিটিয়ে ও গুলি করে মারার পর ধর্ষণ করা হয় তাকে। বাংলাদেশে শ্বশুরের সাথে পালিয়ে আসেন। এই নারীর একটাই কথা স্বামী হত্যার বিচার চাই। নিজের দেশে ফিরতে চাই।

গতকাল সন্ধ্যা থেকেই টেলিভিশনের সামনে ভিড় করতে দেখা যায় রোহিঙ্গাদের। অনেকেই কী চলছে না বুঝলেও মনোযোগ তাদের টেলিভিশনের পর্দায়। দু একজন কিছু সময় পরপর বুঝিয়ে দিচ্ছেন তাদের। আর সকলেই জপ করছেন আল্লাহর নাম। ক্যাম্পের চা দোকানদার ইব্রাহিম আহমেদ বলেন, নিজের মাটি ছেড়ে অন্যের জমিতে। বাংলাদেশের মানুষ ও সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা। তারা জায়গা না দিছে বলেই জান নিয়ে বেঁচে আছি। আমরা আর অন্যের দেশে থাকতে চাই না। আমরা নরপশুদের বিচার চাই। আমরা নাগিরিকত্ব নিয়ে দেশে ফিরতে চাই। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, কোন রকম জীবন বাঁচিয়ে এসেছেন। তার সামনে ২ জন মাইনের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়েছেন। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এটা জেনোসাইড না?

ক্যাম্পের একাধিক ব্যক্তি বলেন, তারা দীর্ঘ ২ বছর পর আশার আলো দেখছেন। গাম্বিয়ার লোকজনের প্রতি তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রোহিঙ্গা নেতা বলেন,  গাম্বিয়া যা করল তা নজিরবিহীন। শক্তিশালী দেশগুলো শুধু খাবার দিয়ে গেল, কাপড় দিল। আমাদের তারা খাবার না দিয়ে যদি আগে থেকেই সোচ্চার হতো, তবে এদেশে আসতে হতো না। আর হত্যাযজ্ঞও হতো না।

কুতুপালং বাজারের ৪ টি টেলিভিশনের সামনে বসে ১২৬ জন মানুষ দেখছেন হেগের শুনানি? তারা পিনপতন নীরবতা নিয়ে চেয়ে আছেন আর অপেক্ষা করছেন। থেকে থেকে নিজেদের ভাষায় গালি দিচ্ছেন সুচির উদ্দেশ্যে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status