শেষের পাতা

রসনা বিলাস নয়

সুলতানার নতুন আইডিয়া

কাজল ঘোষ

২ ডিসেম্বর ২০১৯, সোমবার, ৯:৩৪ পূর্বাহ্ন

সুলতানা। পুরো নাম সুলতানা রাজিয়া। পেশায় শিক্ষক। পাশাপাশি ছাত্র পড়ান। কিন্তু নানা অভিনব চিন্তা সব সময় কাজ করে তার মাথায়। ভবিষ্যতে স্কুল করার চিন্তা। মানসম্মত শিক্ষাবিস্তারে কাজ করবেন এমনটাই ভাবনার মধ্যে আছে। শিক্ষকতা তো করছি কিন্তু এর বাইরে আর কি করা যায়? ভাল কিছু উদ্ভাবন করা দরকার। এমন কিছু যা মানুষের কাজে লাগবে আর আয়ত্ত হবে। টুকটাক নানান পরিকল্পনা সহকর্মীদের সঙ্গে শেয়ারও করেন। পুরনো ঢাকার গেণ্ডারিয়াতে কসমোপলিটন ল্যাব স্কুল অ্যান্ড কলেজে ইংলিশ ভার্সনে শিক্ষকতা করছেন সুলতানা। সেখানেই এক সহকর্মীর সঙ্গে রান্না নিয়ে টুকটাক আলাপ। এছাড়া স্কুলের কোন অনুষ্ঠান হলেই ডাক পড়ে তার। নানা স্বাদের খাবার-দাবার আয়োজনের দায়িত্ব পড়ে তার উপর। পরিবার আর এর বাইরে তার রান্না নিয়ে অনেকের ঔৎসুক্য কৌতূহলভরে উপভোগও করেন তিনি। ধীরে ধীরে আশপাশের বন্ধু স্বজন মহলে ছড়িয়ে পড়ে ভাল রান্না আর নানান পদের রান্নার সুনাম। চাপ বাড়তে থাকে সুলতানার। কিন্তু এভাবে ঘরোয়াভাবে না করে সকলের জন্য কিভাবে করা যায় তা নিয়ে আলোচনাও চলতে থাকে। এক দু’জন থেকে এভাবে আলোচনা এগুতে থাকে। ধীরে ধীরে মাথায় থাকা পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ পেতে থাকে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও নতুন উদ্যোগ নিয়ে কথা হয়। উৎসাহ পান। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজের গতিও বাড়ে। নতুন এই উদ্যোগে সমমনা ক’জনকে নেয়ার আলোচনাও চলতে থাকে। একে একে এগারো জন যুক্ত হন নতুন এই উদ্যোগে। বলা যায় ‘ওরা এগারো জন’। সমপরিমাণ মূলধন নিয়ে এগিয়ে আসেন। উদ্যোক্তাদের মধ্যে সাইদুর রহমান বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। নাম নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঘরোয়া বৈঠকে আলোচনা হয়। একজন অংশীদার তোরাব আলী প্রস্তাব রাখেন সুলতানা ম্যাডামের নামেই হোক এই কিচেন। নাম হবে ‘সুলতানাস কিচেন’।

নিজের কথায় সুলতানা রাজিয়া: জীবনের শুরুতে রান্না ছিল ভীতিকর কাজ। কখনও কিচেন বা রান্না নিয়ে মশগুল হবো এমনটি ভাবনার মধ্যেই ছিল না। বিয়ের আগে রান্নাঘরে খুব একটা গিয়েছি মনে পড়ে না। বাবা-মায়ের আক্ষেপ ছিল শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে কি করবি? বিয়ে হলেও প্রথম প্রথম শাশুড়ির সহযোগিতা পেয়েছি। একবার শাশুড়ি অসুস্থ হলে বেকায়দায় পড়ে যাই। স্বামী ইলিশ মাছ আর পুঁই শাক এনে বললেন, রান্না কর। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। যে কিনা রান্নাই করতে পারে না সে আবার করবে ইলিশ দিয়ে পুঁই। কোনো গত্যান্তর নেই। মাথায় তখন কল্পনা করতে থাকি মা যখন রান্না করতেন তখন কেমন হতো এর রঙ? ধীরে ধীরে মশলা সহযোগে পুঁই আর ইলিশ রান্না বসিয়ে দিই। রান্না কিছু হলো কিনা এমন ভয় নিয়ে পরিবেশন করি। খেয়ে সবাই প্রশংসা করলে উৎসাহ পাই। পরদিন সকালে নাস্তা তৈরিও আমাকেই করতে হয়। তখন কোন বইপত্র ছিল না হাতের কাছে। যা দেখে রান্না শিখব। বাসায় এনটিভিতে নিয়মিত সিদ্দিকা কবীরস রেসিপি দেখতাম। বলা যায়, সিদ্দিকা কবীরস রেসিপি ছিল আমার রান্না শেখার স্কুল। একদিন এভাবেই পাশের বাসার মামী শাশুড়ি আলুর চপ পাঠালেন। তা ওনার কাছ থেকে জেনে নিয়ে বাসায় বানানোর চেষ্টা করি।

এরপর একদিন তাড়াহুড়া করে আমার এক মামা বাসায় এলেন। তিনি দেশের বাইরে যাবেন। হাতে সময় খুব বেশি নেই। মামা জানালেন, হাতে মাত্র ঘন্টাখানেক সময় আছে। বাসায় ডিপ ফ্রিজে থাকা গরুর মাংশ বের করে দেখি বরফ হয়ে আছে। এই জট খুলতে অনেক সময় লেগে যাবে। কি করা যায়? পুতা দিয়ে এই মাংশ ছেঁচে মশলা সহযোগে ওভেনে দিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করি। পরে এই রান্নায় মামার প্লেটে দিলাম। তিনি খেয়ে খুব প্রশাংসা করলেন। এর নাম দিলাম ছেঁচা কাবাব।

এভাবেই রান্নার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে জন্মদিন বা অনুষ্ঠানে রান্না ও খাবারের দায়িত্ব আমাকে দেয়া শুরু হয়। স্কুলের সহকর্মী সাইদুর রহমান প্রস্তাব দিলেন, বন্ধু সহযাত্রী তোরাব আলীকে সঙ্গে নিয়ে একটি জায়গা দেখে এসেছি। আপনি না করতে পারবেন না। সেখানে একটি রেস্টুরেন্ট করতে পারেন। আমি প্রথমদিকে রাজি হতে পারিনি। কিন্তু সাইদুর রহমান উৎসাহ দিতে লাগলেন। বললেন, আপনাকে সামনে রেখেই আমরা এগুচ্ছি। পরিবারের সঙ্গে কথা বললে সকলেই উৎসাহ দিলেন। আমার শশুড়বাড়ির লোকজন বিশেষত আমার দেবররাও আমাকে উৎসাহ দিলেন। দেবররা আমার কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে রাজি হলেন। আমাদের কোচিং সেন্টার স্যাটেলাইট কোচিং সেন্টারে বসে ভাবলাম পাশেই শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চেম্বার। নাম তার ড. রিয়াজ মোবারক। সতের বছর ধরে চিনি। তার কাছেই ছেলেমেয়েদের নানান সমস্যা নিয়ে যাই। ওনাকে বলে দেখি না তিনি আমাদের সঙ্গে থাকতে রাজি আছেন কিনা? প্রস্তাব দিলে তিনি রাজি হন। এভাবে আমরা এগারো জন হই। আর এই কিচেনের যাত্রা শুরু হয় ২০১৯ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর।

শিক্ষকতার পাশাপাশি রেস্টুরেন্ট কেন?: শিক্ষকতা একটি সেবামূলক পেশা। একইভাবে ভাল খাবার মানুষের জন্য তৈরি এটিও সেবা। মানুষ রেস্টুরেন্টে এসে নানান মশলাযুক্ত খাবারে রসনাপূর্তি করে। কিন্তু বাসায় ফিরে পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়। এটা নিয়েই ভাবনা। তাহলে এর সমাধান হতে পারে, মানুষকে সহনীয় মূল্যে পুষ্টিকর খাবার পরিবেশন। যেভাবে বাসায় খেয়ে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বাসায় খাবারের যে স্বাদ তার খোঁজ মিলবে। বাসায় যেভাবে যত্ন নিয়ে রান্নার চেষ্টা হয় এখানেও তাই করা হবে। এজন্য প্রথম থেকেই আমরা কোনধরণের টেস্টিং সল্ট ব্যবহার করছি না। বাজারে ঘুরে ঘুরে চেষ্টা করছি ভেজালমুক্ত পণ্য দিয়ে খাবার তৈরি। এক্ষেত্রে মানের প্রমাণই আমাদের কাছে সবার আগে।

কেমন সাড়া পেলেন?: সেপ্টেম্বরে শুরু। প্রচার খুব করিনি। কিন্তু সাড়া পেয়েছি। বাইরের দিক দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না ভেতরে কি। আসলে আমরা বাইরের চাকচিক্য দিয়ে কিছু করতেও চাইনি। চেয়েছি যারা একবার খেতে আসবেন যায় তারা যেন আবার আসেন আমাদের এখানে। এখন প্রতিনিয়ত চাহিদা বাড়ছে। ফোনেও আমরা অর্ডার নিচ্ছি। এরজন্য বাড়তি কোন টাকাও আমরা নিচ্ছি না। শুধুমাত্র ওবারে করে পাঠাতে যা খরচ আসবে তাই দিতে হবে ভোক্তাকে।

সহযাত্রীদের কথায়: সুলতানা রাজিয়ার এই কিচেনে সহযোগীদের মধ্যে অন্যতম সাইদুর রহমান। প্রথমদিন থেকে যার ব্যাপক উৎসাহ আর নিরলস সহযোগিতা পেয়ে আসছেন। সাইদুর রহমান বলেন, আমরা একই বৃত্তে ঘুরছি। কিন্তু ভাল কিছু করার চেষ্টা করছি না। এই আক্ষেপ থেকেই ‘সুলতানাস কিচেনে’। বাজার থেকে ভাল কিছু নিয়ে ভাল কিছু পরিবেশনই উদ্দেশ্য। এখানে খাবারের অর্ডার পেলে খাবার তৈরি করা হয়। ভবিষ্যতে এখানকার আয় থেকে কিছু হলেও সাধারণের মানুষের কল্যাণে ব্যয় করার ইচ্ছেও আছে যোগ করলেন সাইদুর।

এই উদ্যোগে সহাস্যে যুক্ত হয়েছেন শিশু বিশেষজ্ঞ ড. রিয়াজ মোবারক। তিনি বলেন, পুরোনো ঢাকায় স্বাস্থ্যসন্মত খাবার পরিবেশনের লক্ষ্য নিয়েই যাত্রা শুরু করেছে সুলতানাস কিচেন। কম তেলে, ভাল মশলায় কিভাবে পুষ্টিকর খাবার তৈরি করা যায় তার চেষ্টা করবে সবসময় সুলতানাস কিচেন।

মটকা কাচ্চি আর ছেঁচা কাবাব: পুরনো ঢাকার মানুষের বাহারি রসনার খ্যাতি দুনিয়া জোড়া। অধিক তেল আর মশলাযুক্ত খাবার পছন্দের তালিকায় বরাবরই। কিন্তু সুলতানাস কিচেন নিয়ে এসেছে একেবারেই বিপরীত অথচ স্বাস্থ্যসন্মত কম তেলে তৈরি মটকা কাচ্চি আর ছেঁচাকাবাব। মটকা কাচ্চি পরিবেশনেও রয়েছে ভিন্নতা। সাধারণত কাচ্চি বড় হাড়িতে রান্না হয়ে থাকে। কিন্তু সুলতানা রাজিয়া তা করেন ছোট ছোট মটকায়। মাটির হাড়িতে একজনের জন্য প্রয়োজনীয় কাচ্চি রান্না হয়ে থাকে। আর তা বিশেষ কায়দায় গরম রাখা হয়। মাংশ ছেঁচে ঘরোয়া কায়দায় তৈরি হয়ে থাকে কাবাব। এর বাইরে গরুর কালো ভূনা, খিচুড়ি, বিরিয়ানি ছঅড়াও অন্যান্য খাবার তো রয়েছেই।  

অবস্থান কোথায়?: পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী গেণ্ডারিয়ায়। মতিঝিল পেরিয়ে টিকাটুলি, স্বামীবাগ ছাড়িয়ে সূত্রাপুরের কে বি রোডে। যা নতুন রাস্তা বলেই পরিচিত। মূল রাস্তার ওপর সাইনবোর্ড চোখে পড়বে ‘সুলতানাস কিচেন’। হোল্ডিং নম্বর ১৮/১, কেবি রোড, সূত্রাপুর।

শেষ কথা: ভিজিটরস বুকে লেখা কথা সাহিত্যিক আনিসুল হকের স্বীকৃতিটাই উল্লেখ করছি। সুলতানাস কিচেনের সবকিছু ভাল। খাবার ভাল। ব্যবহার ভাল। পরিবেশ ভাল। পরিবেশন ভাল। সবচেয়ে মজার হলো মটকা বাসমতি কাচ্চি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status