দেশ বিদেশ

রেলের ত্রুটি সর্বত্র

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম থেকে

১৬ নভেম্বর ২০১৯, শনিবার, ৮:৩৯ পূর্বাহ্ন

রেলওয়ের উন্নয়নে সরকারের আন্তরিকতার কমতি নেই। নেয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। চলমান আছে অর্ধশত প্রকল্প। সেই সঙ্গে আছে ৩০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনাও। এরই অংশ হিসেবে নেয়া হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দ্রুতগতির বুলেট ও বৈদ্যুতিক ট্রেন পরিচালনা। এ ছাড়া প্রতিবছরই বিভিন্ন রুটে নামছে নতুন নতুন আন্তঃনগর ট্রেন। সবকিছুই যেন নিষ্ফল। ইঞ্জিন ও বগি সংকট, জরাজীর্ণ রেললাইন, ঝুঁকিপূর্ণ সেতু, অরক্ষিত লেভেলক্রসিং, সিগন্যাল বাতির দুরবস্থা সবমিলিয়ে রেলের সর্বাঙ্গে শুধু ঘা আর ঘা। এ জন্য দুর্ঘটনা।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ভোরে চট্টগ্রাম-সিলেট-ঢাকা রেলপথে কসবা উপজেলার মন্দাবাগ রেলস্টেশনে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটে। এতে ৩ শিশুসহ নিহত হন ১৬ যাত্রী। আহত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন শতাধিক। দুর্ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রাম ছেড়ে যাওয়া ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেন তূর্ণা-নিশীথা ও সিলেট ছেড়ে আসা চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেসের মধ্যে। অবশ্যই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে রেল চালকের ঘুমের কারণে। চোখে ঘুম আসায় সিগন্যাল বাতি দেখেননি বলে জানান তূর্ণা নিশীথার সহকারী লোকোমাস্টার অপু দে। প্রশ্ন উঠেছে, ঘুম থেকে জাগাতে পারে না, এমন সিগন্যাল বাতি ব্যবহারের দরকারই বা কি? তবে সিগন্যাল বাতির ত্রুটি নিয়ে ৩ মাস আগে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন বলে জানান অপু দে। সিগন্যাল বাতির ত্রুটি: অপু দে বলেন, মন্দবাগসহ একাধিক স্টেশনের সিগন্যাল বাতির ত্রুটি ও অসপষ্টতার বিষয়ে তিন মাস আগেই অভিযোগ করেছিলেন ট্রেনচালকরা। চলমান ডাবল লাইন প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের রাখা নির্মাণসামগ্রী, বালি ও ইট রাখার কারণে দূর থেকে সিগন্যাল বাতি দেখা যেত না। এছাড়া বড়তাকিয়া, মুহুরীগঞ্জ স্টেশনের আপ আউটার গাছের জন্য সিগন্যাল বাতি দেখতে পান না চালক। হাসানপুর, গুণবতী স্টেশনের লুপ লাইন থেকে অ্যাডভান্স স্টার্টার সংকেতও দেখা যায় না। সিলেট সেকশনের মনতলা, শাহাজীবাজার, কুলাউড়া, মাইজগাঁও স্টেশনের আউটার হোম সিগন্যাল রেলপথ সংলগ্ন গাছের ডালপালার কারণে দৃশ্যমান হয় না। ভৈরব আপ আউটার, আখাউড়া-গঙ্গাসাগর সেকশনের ডাউনের এটি বোর্ড থেকে আউটার এবং আউটার থেকে হোমের রিপিটার, শশীদলের ডাউন আউটার, ভানুগাছ স্টেশনের আপ আউটার ও রশিদপুর স্টেশনের ডাউন আউটারে রিপিটার সিগন্যাল বসানোর দাবি জানানো হয়েছিল। পাশাপাশি সিজিপিওয়াই-ফৌজদারহাট সেকশনের এটি বোর্ড থেকে হোম সিগন্যাল দেখা না যাওয়ায় রিপিটার সিগন্যাল বসানোর প্রস্তাব দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি রেলের সংকেত ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক নাসির উদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার পর রেলের বিভিন্ন সংগঠন আমার সঙ্গে দেখা করেছে। তারা সিগন্যাল বাতিসহ যেসব দাবি দিয়েছিল, সেগুলো নিশ্চিতভাবেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয় পাঠানো হয়েছে। সমস্যা থাকলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো সমাধান করবে।
জরাজীর্ণ রেলপথ: দেশের প্রায় ৩ হাজার ৩৩৩ কিলোমিটার রেলপথের বিভিন্ন স্থানে প্রায় সময়ই খোলা থাকে ফিশপ্লেট, ক্লিপ, হুক, নাট-বল্টুসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ। এমনকি রেললাইন মজবুত ও স্থিতিশীল রাখতে স্থাপিত স্লিপারগুলোর অবস্থাও নাজুক। স্লিপারকে যথাস্থানে রাখতে যে পরিমাণ পাথর থাকা প্রয়োজন, অধিকাংশ স্থানে তাও নেই। কোনো কোনো স্থানে পাথরশূন্য অবস্থায় আছে স্লিপারগুলো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক প্রকৌশলী বলেন, পুরো রেলে হাজার হাজার স্লিপার জরাজীর্ণ রয়েছে। নাটবল্টু, হুক-ক্লিপ, ফিশপ্লেট খোলা অবস্থায় রয়েছে পদে পদে। এসব মেরামত কিংবা পূরণে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মাথাব্যথা নেই। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তথা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ শুধু প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। মাঠ পর্যায়ে যে কাজের স্বল্পতা রয়েছে সেদিকে খেয়াল নেই। তিনি বলেন, নিয়মানুসারে একটি স্লিপার কিংবা নাটবল্টু, ক্লিপ-হুক-ফিশপ্লেট খোলা থাকলে প্রয়োজনে ট্রেন দাঁড় করিয়ে হলেও তা সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই নাটবল্টু, হুক-ক্লিপ-ফিশপ্লেট খোলা থাকতে পারে না। ওয়েম্যানরা প্রতিদিন লাইন পরিদর্শন করবে, এমন ত্রুটি দেখা মাত্রই তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানাবে এবং সেই সমস্যা সমাধান করবে। রেলে এ নিয়মটাই এখন নেই! পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী আবদুল জলিল বলেন, আমাদের সব অর্জন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জরাজীর্ণ রেলপথের জন্য। লাইন হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এ লাইনই যদি ঝুঁকিপূর্ণ থাকে, ত্রুটি থাকে তাহলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না। পুরো রেলে একটি হুক-ক্লিপ কিংবা ফিশপ্লেট খোলা থাকলেও সেটি মারাত্মক ঝুঁকি। পুরো রেলওয়েতে যেসব সেকশনে এমন অবস্থা পাওয়া যাবে, সেই সব সেকশনের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ঝুঁকিপূর্ণ রেলসেতু: বাংলাদেশ রেলওয়ের অধিকাংশ সেতুই নির্মিত হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। এসব সেতুর বেশিরভাগই ঝুঁকিপূর্ণ-জরাজীর্ণ। জোড়াতালি দিয়ে মেরামত করা এসব সেতুর উপর দিয়েই চলছে ট্রেন। ফলে, একটু উনিশ-বিশ হলেই ঘটছে দুর্ঘটনা।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রেলসেতু ভেঙে যাওয়া বা দেবে যাওয়ার এমন ঘটনা নতুন নয়। ৩ হাজার ৩৩৬ কিলোমিটার রেলপথে লাইনচ্যুতের ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে। কিন্তু ভয়াবহ দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে রেলসেতু কেন্দ্রিক।
ঢাকা-সিলেট, সিলেট-চট্টগ্রাম রুটে গত দেড় বছরে ৯টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে গত বছরের ১লা ফেব্রুয়ারি সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ-কুশিয়ারার মধ্যস্থলের রেলসেতু ভেঙে দুই দিন ওই পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। একই পথে ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ মাধবপুরের ইটাখলা রেলব্রিজ ভেঙে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ট্রেন। ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ পাঁচ দিন বন্ধ ছিল। পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আবরার হোসেন বলেন, পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে ১ হাজার ৬৩৯টি ব্রিজ রয়েছে; যার প্রায় ৮৫ শতাংশই ব্রিটিশ আমলের। এসব ব্রিজের কোনোটাই রড-সিমেন্ট দিয়ে তৈরি নয়। এসব ব্রিজ মেরামত করেই আমাদের ট্রেন চালাতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম নতুন যে রেলপথ হচ্ছে সেই পথের সেতুগুলো আধুনিক এবং খুবই মজবুত করে নির্মাণ করা হয়েছে। পুরনো ব্রিজগুলোকে মেরামত করে টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হয়। এসব ব্রিজ দিয়ে নির্ধারিত গতিতে ট্রেন চালানোর নির্দেশও দেয়া হয়।
মৃত্যুফাঁদ রেলক্রসিংগুলো: চট্টগ্রামে তিনটি রুটের অন্তত ১৫০টি রেলক্রসিং রয়েছে। যেগুলো এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। এরমধ্যে অর্ধেকই অবৈধ। লোকবল সংকট, ট্রেন চলাকালেও খোলা থাকা, গাড়ি ও পথচারী পার হওয়াসহ নানা কারণে অহরহই দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনায় গত এক বছরে মারা গেছেন ১৫ জন। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। জানা যায়, চট্টগ্রাম থেকে তিনটি রেল রুটের অধিকাংশ ক্রসিংই অবৈধ। রুটগুলো হচ্ছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইনের মিরসরাই পর্যন্ত, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট ও চট্টগ্রাম-দোহাজারী। তিন রুটে হাতেগোনা কয়েকটি ক্রসিংয়ে গেটম্যান থাকলেও তাদের অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে কাজে গাফেলতির অভিযোগ। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ ফারুক আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, বৈধ ক্রসিংগুলোতে লোকজন রয়েছে। কিছু গেটম্যান নিয়োগ হয়েছে। আরো কিছু নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কর্মী সংকট সমাধান হলে সমস্যা লাঘব হবে। কোনো কোনো স্থানে অবৈধভাবে রেল ক্রসিং নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোতে দুর্ঘটনা ঘটছে। এগুলো বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, রেল ক্রসিংগুলোতে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে। গত এক বছরে মারা গেছেন ১৫ জন। এর অধিকাংশই পথ পার হতে গিয়ে নয়তো গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে।


 
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status