অনলাইন

উপকূলে বুলবুলের হানা

স্টাফ রিপোর্টার

৯ নভেম্বর ২০১৯, শনিবার, ১১:৫৪ পূর্বাহ্ন

  • রাত ৯টায় খুলনা উপকূলে আঘাত
  • আশ্রয়কেন্দ্রে কয়েক লাখ মানুষ
  • সাতক্ষীরায় সেনা মোতায়েন
বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। কিছুটা দুর্বল হয়ে রাত ৯টার দিকে ঘূর্ণিঝড়টি খুলনা উপকূলে আঘাত হানে। এসময় এটির গতিবেগ ছিল ১০০-১২০ কিলোমিটার। রাত দেড়টায় এ রিপোর্ট লেখার সময়, ঘূর্ণিঝড় বুলবুল উপকূল অতিক্রম করছিল। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া বইছে। রাত ১১টার কিছু পরে আবহাওয়া অধিপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, কিছুটা দুর্বল হয়ে উপকূলে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। ভোরনাগাদ এটি উপকূল অতিক্রম করতে পারে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়, উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আরও উত্তর পূর্ব দিকে প্রতি ঘণ্টায় আট কিলোমিটার বেগে অগ্রসর হয়ে কিছুটা দূর্বল হয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড় আকারে রাত ৯টা নাগাদ পশ্চিমবঙ্গ-খুলনা উপকূল (সুন্দরবনের নিকট দিয়ে) অতিক্রম শুরু করেছে। এটি বর্তমানে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের দক্ষিণপশ্চিম এলাকায় (২১.৪ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.৩ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ) অবস্থান করছে। এটি আরও উত্তর পূর্ব দিকে অগ্রসর ও ক্রমশ দুর্বল হয়ে মধ্যরাত নাগাদ পশ্চিমবঙ্গ-খুলনা (সুন্দরবনের নিকট দিয়ে) উপকূল অতিক্রম সম্পন্ন করতে পারে।
রাত ৮টার কিছু পর থেকেই উপকূল এলাকায় বুলবুলের আঁচ পাওয়া যায়। আমাদের বাগেরহাট প্রতিনিধি জানিয়েছেন,  রাতের শুরুর দিকে বুলবুলের অগ্রবর্তী অংশ সুন্দরবনের বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড, হিরন পয়েন্ট, দুবলারচর, মেহের আলীর চর, অফিসকিল্লা, মাঝেরচর, আলোরকোল, মরণের চরে আছড়ে পড়েছে।

এসময় ১২০ কিলোমিটার বেগে ঝড় বয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) দুবলারচর ভিএইচএফ স্টেশনের অপারেটর মো. কাশেম জানিয়েছেন, ঝড় তছনছ করে দিয়েছে দুবলারচরের অস্থায়ী শুঁটকি পল্লী। এরআগে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ধ্বংসাত্মক শক্তি নিয়ে উপকূলে আছড়ে পড়বে এমন শঙ্কায় মোংলা ও পায়রা বন্দর এবং আশপাশের জেলাগুলোতে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলে আবহাওয়া অফিস। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম সমূদ্র বন্দর, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুর জেলায় ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়। প্রবল ঝড়ের আশঙ্কায় সকাল থেকেই উপকূলের মানুষ ছুটছিলেন বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রের দিকে। শুকনো খাবার, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও গবাদি পশু নিয়ে লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রের দিকে ছুটতে দেখা যায়। গত সন্ধ্যার মধ্যেই অন্তত ১৭ লাখ মানুষ বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেন বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়। ঝড় পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলা ও ত্রাণ কার্যক্রম চালাতে সাতক্ষীরায় সোনাবাহিনী মোতায়েণ করা হয়। এছাড়া মোংলা ও পায়রা বন্দর এলাকায় প্রস্তুত রাখা হয় উদ্ধাকারী ও ত্রাণবাহী জাহাজ। গতকাল দুপুরে শ্রমিক লীগের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, বুলবুলের ঝুঁকি মোকাবিলায় সব ধরণের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আয়েশা খাতুন জানান, ঘূর্ণিঝড়েরর গতি কিছুটা কমলেও তা ১১০ থেকে ১৪০ কিলোমিটার গতি নিয়ে স্থলভাগে প্রবেশ করবে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ব্যাস ছিল ২০০ থেকে ২৫০ কিলোমিটার। মূল কেন্দ্রের ব্যাসও ছিল ২০ কিলোমিটারের মতো।

প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো সকাল থেকেই সাধারণ মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়ার কাজ শুরু করে। শুরুতে অনেকে কেন্দ্রে যেতে না চাইলেও ঘূণিঝড়ের ক্ষতির শঙ্কা বাড়ায় দিনের শেষে অনেককে হাসপাতালে ছুটতে দেখা যায়। এদিকে বুলবুল মোকাবিলায় নৌবাহিনীর ১০টি যুদ্ধজাহাজ প্রস্তুত বলে জানানো হয়। প্রবল শক্তি নিয়ে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ এর সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি ও পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় চট্টগ্রাম, সেন্টমার্টিন ও খুলনাসহ উপকূলীয় এলাকায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ১০টি যুদ্ধজাহাজ ও  নৌ কন্টিনজেন্ট প্রস্তুত রাখা হয়। গতকাল সন্ধ্যায় নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের উদ্ভব: সুদূর প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্ট উষ্ণম-লীয় ঝড় মাতমো গত অক্টোবরের শেষে ভিয়েতনাম হয়ে স্থলভাগে উঠে আসে। সেই ঘূর্ণিবায়ুর অবশিষ্টাংশই ইন্দোনেশিয়া পেরিয়ে ভারত মহাসাগরে এসে আবার নিম্নচাপের রূপ নেয়। বার বার দিক বদলে নিম্নচাপটি আবার শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগরে এসে বুধবার রাতে তা ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নেয়। তখন এর নাম দেয়া হয় বুলবুল। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাগর তীরের আট দেশের আবহাওয়া দপ্তরের নির্ধারিত তালিকা থেকে ধারাবাহিকভাবে এই অঞ্চলের ঝড়ের নাম দেয়া হয়। বুলবুল নামটি নেয়া হয় পাকিস্তানের প্রস্তাবিত নামের তালিকা থেকে।
এদিকে, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগে উপকূল এলাকায় দেখা দেয় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এ নিয়ে আমাদের রিপোর্টারদের পাঠানো রিপোর্ট-
২১১৪টি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ১৮ লাখ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল থেকে জানান, আতঙ্কে দক্ষিণের কোটি মানুষ। আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে কয়েক লাখ উপকূলবাসী। ধেয়ে আসছে বুলবুল। শুধু উপকূলের জনপদই নয়, এরই মধ্যে ফাঁকা হয়ে পড়েছে বরিশালের সব সড়ক। ঘরের মধ্যে বসে চোখ রাখছে টিভির পর্দায়। সাগর-নদ-নদী উত্তাল হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে ফেরি চলাচলও। শুক্রবার রাত ৯টায় নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে কয়েকটি লঞ্চ বরিশাল থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেও আজ (গতকাল) সব ধরনের লঞ্চ চলাচল বন্ধ রেখেছে কর্তৃপক্ষ। এদিকে এখনো বহু মাছ ধরার ট্রলার সাগরে রয়ে যাওয়ায় উৎকণ্ঠা বাড়ছে জেলে পরিবারগুলোর মাঝে। বরিশালের সব বিদ্যালয়কে আশ্রয়কেন্দ্র হিসাবে ঘোষণা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। খোলা রাখা হয়েছে শ্রেণিকক্ষগুলো।

ঘূর্ণিঝড় ফেনিকে নিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো হলেও তেমন কোনো প্রভাব রাখতে পারেনি এ ঝড়। ফলে এবারও কিছু মানুষের মাঝে অনীহা ছিল প্রথমে। কিন্তু আবহাওয়ার গতিবেগ এবং প্রাকৃতিক অবস্থা ক্রমেই বিরূপ হতে থাকায় শেষ মুহূর্তে তারাও ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ে। তবে এখনো কিছু মানুষ রয়ে গেছে তাদের শেষ আশ্রয়ে। এ বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে প্রশাসনও।
দুপুর ১২টায় ব?রিশাল সার্কিট হাউস মিলনায়তনে বরিশাল বিভাগীয় দুর্যোগ বিষয়ক জরুরি সভায় এই নির্দেশ দিয়ে বিভাগীয় ক?মিশনার মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী বলেন, মানুষের জীবন রক্ষার জন্যই তাদের জোর করে নেয়ার কথা বলা হ?চ্ছে। কারণ উপকূলীয় বেশকিছু এলাকার মানুষ তাদের মালপত্র ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার ক্ষে?ত্রে অনীহা প্রকাশ করে। তিনি জোর করে এসব মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়ার নির্দেশ দেন।

বরিশা?ল বিভা?গে দুই হাজার ১১৪টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়ে?ছে। সেখানে ১৭ লাখ ৮৩ হাজার মানুষ আশ্রয় নি?তে পার?বে। এ ছাড়া গৃহপালিত প্রাণীদের জন্যও নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হ?চ্ছে। দুর্যোগ পরবর্তী জরুরি সেবা দেয়ার জন্য বিভাগের ছয় জেলায় ৩১৭টি চিকিৎসক দল গঠন করা হয়েছে। বিভাগের সব জেলার সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরগুলোকে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হ?য়ে?ছে।
জানা গেছে এখনো সাগরে বহু মাছধরা ট্রলার রয়ে গেছে। তাদের ফিরিয়ে আনতে অস্থির হয়ে উঠেছে তাদের পরিবারগুলো। মহা দুর্যোগ উপেক্ষা করেই সাগরে আছে কয়েক হাজার জেলে। এতে যেকোনো সময় বড়ধরনের দুর্ঘটনা আর প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন ভোলার মনপুরার উপজেলা চেয়ারম্যান শেলিনা আকতার চৌধুরী।
সকাল থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান শেলিনা আকতার চৌধুরী ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার বশির আহমেদ মেঘনা পাড়ে গিয়ে সতর্ক করতে নিজেরা মাইকিং করছেন।

বরগুনার উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা শুক্রবার রাতে আশ্রয়কেন্দ্রে না গেলেও গতকাল শনিবার সকাল থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছেন। গভীর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় বুলবুল এর ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে উপকূলীয় বরগুনার মসজিদে মসজিদে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বরগুনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মানুষের আশ্রয়ের জন্য ৩৪১টি সাইক্লোন শেল্টারসহ মোট ৫০৯টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যাতে ৫ লক্ষাধিক মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। এছাড়াও পর্যপ্ত খাবার মজুদ রাখা হয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ৪২টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়াও ৩৩০ জন স্বেচ্ছাসেবক মাঠে কাজ করছেন।
শুধু উপকূলই নয় বুলবুল আতঙ্কে এখন মহানগরীর মানুষও। তারও গতকাল দুপুরের পর আর ঘর থেকে নামেননি। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ। স্কুল কলেজগুলোর নৈশপ্রহরীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে শ্রেণিকক্ষগুলো খোলা রাখার। মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর নির্দেশে বিসিসির সব কর্মী মাঠে রয়েছেন।

এরই মধ্যে বরিশাল পটুয়াখালী বরগুনা ভোলায় ১০ নম্বর মহা বিপদ সংকেত জারি হয়েছে। ৫-৭ ফুট জলোচ্ছ্বাসের সংবাদে উপকূলজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আয়লা আর সিডরের ক্ষত এখন বয়ে বেড়াচ্ছেন বহু মানুষ। দিনভর বৃষ্টির মাঝে ছিল মৃদু হাওয়া। তবে সন্ধ্যা হতে না হতেই বাতাসের গতিবেগ বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে আতঙ্ক।

সুন্দরবন উপকূলে উদ্ধার তৎপরতায় প্রস্তুত ২৩ জাহাজ
বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, সুন্দরবনসহ বাগেরহাটের উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতা চালাতে নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ ও সুন্দরবন বিভাগের ২৩টি জাহাজ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বাগেরহাটে ৩০ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার ও পর্যাপ্ত বোতলজাত খাবার পানি প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতায় জন্য প্রস্তুত রয়েছে রেড ক্রিসেন্টসহ সরকারি বেসরকারি ১৭ হাজার ১৩০ জন স্বেচ্ছাসেবক। জেলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে, ৮৪টি মেডিকেল টিম। বাগেরহাটের ২৩৪টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের ধারণ ক্ষমতা ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৭৫ জন। জেলার সব আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেয়া হয়েছে। বাগেরহাটে বইতে থাকা ঝড়ে হাওয়া ও বৃষ্টির মধ্যে বিকাল পর্যন্ত এসব আশ্রয়কেন্দ্র প্রায় ১৫ হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু আশ্রয় নিয়েছে। সুন্দরবনসহ বাগেরহাটের উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতা চালাতে নৌবাহিনীর ৪টি জাহাজসহ ৪ শত নৌসেনা, মোংলা বন্দরের ৩টি জাহাজ এমটি সুন্দরবন, এমটি শিপসা ও এমটি অগ্নিপ্রহরী প্রস্তুত রয়েছে।

একই ভাবে কোস্টগার্ডের সিজিএস কামরুজ্জামান, মুনসুর আলী, স্বাধীন বাংলা, সোনার বাংলা, অপারেজয় বাংলাসহ ১০টি জাহাজ প্রস্তুত রাখা হয়েছে উদ্ধার তৎপরতায়। বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ জানান, বাগেরহাটে ১০ নম্বার মহাবিপদ সংকেত জারির পর উপজেলা, পৌর কর্তৃপক্ষ, কোস্টগাড পুলিশ, আনসার, বন্দর কর্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস, ইউনিয়র পরিষদ ও মসজিদ থেকে দুর্গতদের আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার ব্যপারে দফায় দফায় সতর্কতামূলক মাইকিং করা হচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবক বাড়ি-বাড়ি গিয়ে দুর্গতদের বাঁচাতে আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে বলছেন। আশ্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি জেলার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠার দুর্গত মানুষের আশ্রয়ের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার কমান্ডার শেখ ফকর উদ্দিন জানান, শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে মোংলা বন্দরে রাত থেকে জাহাজে পণ্য ওঠানামা ও বন্দরে জাহাজ আগমন-নির্গমন বন্ধ রয়েছে।

মোংলা বন্দরে অবস্থানরত সকল দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে জেটি থেকে সরিয়ে পশুর চ্যানেলে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সব ধরনের লাইটার জাহাজকে বন্দরের পশুর চ্যানেল ত্যাগ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এদিকে, ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড এই ম্যানগ্রোভ বনের জীববৈচিত্র্য উপভোগ করতে গিয়ে সুন্দরবনে আটকা পড়েছে ১ হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক। বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনে আটকা পড়া এসব দেশি-বিদেশি পর্যটকদের এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এসব পর্যটকদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও রয়েছে। ছোটবড় ২০টির অধিক পর্যটকবাহী নৌযানে করে তারা এখন সুন্দরবনের ছোট ছোট খাল ও নদীতে নোঙ্গর করে আছে। তবে, বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা সুন্দরবনের কটকা ও কচিখালী বনের ছোট ছোট খাল ও নদীতে নৌযানে নোঙ্গর করে থাকা দেশি-বিদেশি পর্যটকরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।

সুন্দরবনের বিভিন্ন ট্যুর অপারেট ও সুন্দরবন বিভাগ এতথ্য নিশ্চিত করে জানায়, বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের মৃগমারী, তাম্বুলবুনিয়া, কটকা ও কচিখালীর বনের ছোট ছোট খাল ও নদীতে নৌযানে নোঙ্গর করে থাকা দেশি-বিদেশি পর্যটকবাহী নৌযানগুলো ঝড়ো হাওয়ার কারণে বঙ্গোপসাগর ও নদী উত্তাল থাকায় তারা লোকালয়ে ফিরতে পারছে না। কোস্টগার্ডসহ উদ্ধারকারীরা সেখানে যেতে পারছে না। চরম ঝুঁকির মধ্যে থাকা পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের ৫টি ফরেস্ট অফিস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. মাহমুদুল হাসান সাংবাদিকদের জানান, পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শ্যালারচর, কটকা, কচিখালী, আলোরকোল ও দুবলা ফরেস্ট অফিস জরাজির্ন অবস্থায় রয়েছে। গতকাল শনিবার সকালে ১০নং মহাবিপদ সংকেত জারির পর ওই ৫টি ফরেস্ট অফিসের সকল কর্মকর্তা ও বনরক্ষীদের অফিসগুলো বন্ধ করে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তবে, ঘূর্ণিঝড়ের পর দ্রুততম সময়ে ওইসব অফিস চালু করা হবে।

সোনাগাজীতে ৪৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রস্তুত
ফেনী প্রতিনিধি জানান, বুলবুল মোকাবিলায় সোনাগাজীতে ৪৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রস্তুত থাকলেও আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে যেতে চাচ্ছে না উপকূলের লোকজন। গতকাল শনিবার দুপুর পর্যন্ত কোন আশ্রয়কেন্দ্রে উপকূলের লোকজনকে সরিয়ে নেয়া যায়নি। বুলবুলের প্রভাবে সকাল থেকে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থাকলেও দুপুর থেকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে বাতাসের গতিবেগ বাড়তে শুরু করেছে।
ফেনী জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুজ্জামান জানায়, ঘূর্ণিঝড় বুলবুল মোকাবিলায় তাদের পক্ষ থেকে সর্বাতœক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। উপজেলার সব সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় মানুষের জন্য ৫ হাজার টন চাল, ৬শ টন গম, চিড়া, মুড়িসহ বিশুদ্ধ পানির মজুদ রাখা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে যাওয়ায় জন্য সকাল থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা মাইকিং করছেন। প্রতিটি আশ্রয় কেন্দ্রে শুকনো খাবার পাঠানো হয়েছে।

উপকূলীয় সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে প্রশাসনের একাধিক টিম সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন। তবে সন্ধ্যার মধ্যেই নদী পাড়ের লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নিতে কাজ করছে প্রশাসন। সোনাগাজী উপকূলীয় রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটের প্রায় দেড় হাজার স্বেচ্ছাসেবকসহ দুই হাজার কর্মী কাজ করে যাচ্ছেন।
জেলা সিভিল সার্জন মো. নেয়াতুজজামান জানান, ঘূর্ণিঝড় বুলবুল মোকাবিলায় ৭৬টি মেডিকেল টিম প্রস্তুতি রয়েছে। প্রতিটি টিমে চিকিৎসকসহ ৫ জন করে সদস্য রয়েছে। প্রয়োজনীয় খাবার স্যালাইনসহ প্রাথমিক ওষুধ মজুদ রাখা হয়েছে। প্রস্তুত রয়েছে একাধিক অ্যাম্বুলেন্স।

সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অজিত দেব জানান, ঘূর্ণিঝড় ও দুর্যোগ মোকাবিলায় এবং জানমাল ও গবাদিপশুর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনাসহ জনগণকে সতর্ক করার লক্ষ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলের জেলেদের দুর্যোগকালীন নদীতে মাছ ধরা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। উপজেলায় একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে এবং ১০টি চিকিৎসক দল, ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দুপুরে পর থেকে থেমে থেমে দমকা বাতাস বইছে। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিও পড়েছে কয়েক দফা। তারা চেষ্টা চালাচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বেই উপকূলের লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যেতে। সকালে দুর্যোগপ্রবণ এলাকা পরিদর্শন করছেন ফেনী-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী।


রাঙ্গাবালী (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি জানান, নিম্নচাপে বঙ্গোপসাগর উত্তাল হয়ে উঠেছে। এ কারণে পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করা হয়েছে। এই নিম্নচাপের প্রভাবে পটুয়াখালী উপকূলীয় রাঙ্গাবালী উপজেলার সর্বত্র গুমোট আবহাওয়া বিরাজ করছে। শুক্রবার বিকেল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এরপর গতকাল শনিবার ভোর থেকে টানা বর্ষণ শুরু হয়। দিনভর একটানা বর্ষণ হলেও আজ বিকেল থেকে থেমে থেমে মাঝারি-ভারী বৃষ্টি চলছে। সন্ধ্যা পরে আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। তবে দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত রাঙ্গাবালী উপজেলা প্রশাসন। মানুষের আশ্রয়ের জন্য ৫৮টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সেখানে ইতিমধ্যে তিন হাজারের অধিক লোক আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে আবার সন্ধ্যার আগে আশ্রয়কেন্দ্রে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

এদিকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি হওয়ার পরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপকূলীয় চরাঞ্চলের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে আনতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে অধিকাংশ লোকজনই আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে অনীহা প্রকাশ করছে। সাগর তীরবর্তী লোকজন প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করতে করতে অনেকটা অভ্যস্ত। যার কারণে চরম পর্যায় না পৌঁছা পর্যন্ত অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্র যেতে চাচ্ছে না।

বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী এলাকা থেকে রাঙ্গাবালী ইউপি চেয়াম্যান সাইদুজ্জামান মামুন খান জানান, তাদের এলাকার লোকজন পানি ও ঝড়ের সঙ্গেই বসবাস করে থাকেন। দিনের বেলায় তাদের ভয় কম, এই কারণে লোকজন এখন সাইক্লোন শেল্টারে আসতে অনীহা প্রকাশ করছে। রাতের বেলায় লোকজন আশ্রয় কেন্দ্রে চলে আসবে। তবে ইতিমধ্যেই বেড়িবাঁধহীন বিচ্ছিন্নদ্বীপ চর কাশেম থেকে ২শ’ পরিবারকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হয়েছে। তার এলাকায় ১৬টি স্কুল কাম সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে।

রাঙ্গাবালী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাশফাকুর রহমান জানিয়েছেন, রাঙ্গাবালী উপজেলায় ৫৮টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। তাতে ইতিমধ্যে তিন হাজার লোক আশ্রয় নিয়েছেন। সন্ধ্যার পরে ঝড় আঘাত হানতে পারে তাই অনেকেই বিকালের দিকে আশ্রয়কেন্দ্রে আসবে। তবে এখন মাত্র ভাটা শুরু হয়েছে সন্ধ্যার দিকে পুরো ভাটা থাকবে। জোয়ারের সময় থাকলে ঝড় শুরু হলে জলোচ্ছ্বাসের পরিমান বৃদ্ধি পায়। তখন বেশি ক্ষতি হয়। তিনি আরো জানান, আজও আগুনমুখা নদীতে এ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া উপেক্ষা করে মাছ শিকাররত কমপক্ষে ৫০টি মাছ ধরা নৌকার জেলেদেরকে নদী থেকে জোর করে উঠিয়ে দিয়েছেন তারা।
এ দিকে, পটুয়াখালী আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে বৃহস্পতিবার রাত ১২টা থেকে গতকাল দুপূর ১২টা পর্যন্ত ৪০.৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

মির্জাগঞ্জে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় প্রস্তুত
মির্জাগঞ্জ (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে মির্জাগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন। ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়া শুরু হয়েছে। গতকাল শনিবার দুপুর পর্যন্ত ৭ হাজারের বেশি লোকজনকে উপজেলার ৪২টি আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। অন্যদের সন্ধ্যার মধ্যে নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা প্রশাসন। এদিকে মির্জাগঞ্জ উপজেলা সংলগ্ন পায়রা নদীতে বড় বড় ঢেউ দেখা যাচ্ছে। গতকাল ভোর থেকে বৃষ্টির গতি বেড়েছে। বইতে শুরু করেছে ঝোড়ো হাওয়া। চারপাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান খান মো. আবু বকর সিদ্দিকী বলেন, ২০০৭ সালের সিডরের আতঙ্ক এখনো কাটেনি। সিডরে মির্জাগঞ্জ উপজেলায় ১১৫ জন নারী-পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছিল। তাই নভেম্বর মাসে কোনো ঘূর্ণিঝড়ের খবরে এলাকার মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। মানুষকে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় উপজেলা প্রশাসনের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীদের নিয়ে কয়েকটি গ্রুপ করে মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিতে কাজ করছি। তাদের জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
মির্জাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. সরোয়ার হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় উপজেলায় মোট ৪২টি আশ্রয়কেন্দ্র এবং একাধিক মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে উপজেলার সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

এদিকে, অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের রামপুর, সুন্দ্রা কালিকাপুর, মেহেন্দিয়াবাদ, চরখালী, গোলখালী, ভিকাখালী, কাকড়াবুনিয়া, ভয়াং এলাকার বেড়িবাঁধ। জলোচ্ছ্বাসে যেকোনো সময় এসকল গ্রামের বেড়িবাঁধ ভেঙে ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ফসল, মাছ ও ঘরবাড়ি। সুন্দ্রা কালিকাপুর গ্রামের ইউপি সদস্য মো. জাহিদ হোসেন বলেন, সুন্দ্রা কালিকাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন বেড়িবাঁধ অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যেকোনো সময় জলোচ্ছ্বাসে তা ভেঙে যেতে পারে।

৫০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ
স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা থেকে জানান, দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় তিন জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় ৫০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। শনিবার সকালে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা খুলনার কয়রা-দাকোপ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর-আশাশুনি ও বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকায়। সিডর-আইলাসহ বিভিন্ন দুর্যোগে সাধারণ মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন আতঙ্কে। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে জোয়ারে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হলে বাড়িঘর, ফসল, মাছের ঘের ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

উপকূলীয় জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। ঘূর্ণিঝড় বুলবুল মোকাবিলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৮৫৩টি সাইক্লোন শেল্টার।
খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ড ইউপি সদস্য  বেলাল হোসেন বলেন, কয়রার বেড়িবাঁধের  বেশকিছু এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ। পানির যে চাপ তাতে যেকোনো সময় বাঁধ ভেঙে গ্রাম তলিয়ে সিডর-আইলার মতো ক্ষতি হতে পারে। এ অবস্থায় মানুষ নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন।

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, আতঙ্কের নাম বেড়িবাঁধ, শঙ্কার নাম বেড়িবাঁধ, দুঃখের নাম বেড়িবাঁধ, নির্ঘুম রাতের নামও এই  বেড়িবাঁধ।  আবহাওয়ার সংকেত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শঙ্কিত আমরা। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে বেড়েছে বৃষ্টির সঙ্গে বাতাসের গতি।  জোয়ারের পানি বৃদ্ধিতে ভাঙন আতঙ্কে কয়রার মানুষ।
দক্ষিণাঞ্চলে দমকা বাতাস আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। উপকূলজুড়ে সিডরের পূর্ব মুহূর্তের পরিস্থিতি বিরাজ করছে। স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ও সিপিপি’র স্বেচ্ছাসেবকরা মাইকিং করে সতর্কতামূলক প্রচারণায় নেমেছে।

উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ঘূর্ণিঝড়  মোকাবিলায় নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার জন্য মাইকিং করায় অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন সাইক্লোন শেল্টারে যেতে শুরু করেছেন।
এদিকে এ তিন জেলার প্রতিটি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মাইকিংসহ সব সাইক্লোন শেল্টার ও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সার্বক্ষণিক খোলা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।
মংলা সমুদ্রবন্দরে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। একইসঙ্গে খোলা হয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষের কেন্দ্রীয় একটিসহ দুইটি সাব- কন্ট্রোল রুম। জাহাজের পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে।

এদিকে খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি ও বরগুনাসহ উপকূলীয় জনপদে ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতার জন্য খুলনা নৌঘাঁটি তিতুমীরে পাঁচটি জাহাজ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) খুলনার উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় বুলবুল মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। বেড়িবাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান জরুরি মেরামত করে মোটামুটি একটি পর্যায়ে নিয়ে এসেছি। আমাদের কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। সেখান থেকে প্রতিনিয়ত জোয়ারের পানি কতদূর পর্যন্ত আসছে তা রেকর্ডিং করা হচ্ছে। আমাদের প্রধান প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী আমরা এসডি লেভেলে যারা আছি সবাই মাঠপর্যায়ে রয়েছি।

ভোলায় আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে সোয়া লাখ মানুষ
লালমোহন (ভোলা) প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে ভোলার পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। শনিবার রাত ১২টা নাগাদ ঘূর্ণিঝড়টি ভোলায় আঘাত হানতে পারে বলে ধারণা করছেন স্থানীয় আবহাওয়া অফিস। এদিকে ভোলার ৬৬৮টি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসন। দুর্গম ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার যে সকল বাসিন্দা আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে চাইছে না তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে আনতে মাঠ পর্যায়ে পুলিশ কাজ করছে বলেও জানান জেলা প্রশাসক মাসুদ আলম ছিদ্দিক। এ ছাড়াও ভোলার কলাতলি, চর নিজাম, ঢাল চর, কুকরি-মুকরি, হাজীপুর, মদনপুরসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের ট্রলারযোগে মূল ভূখণ্ডে আনা হচ্ছে।
আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষের খাদ্য ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে ৯২টি মেডিকেল টিম ও জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের সমন্বয়ে ১৩ হাজার স্বেচ্ছাসেবক কাজ করে যাচ্ছেন।

বিকাল তিনটায় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি সভা করেছেন। সেখানে ঘূর্ণিঝড় বিষয়ে পরবর্তী কার্যক্রম সম্পর্কে বিভিন্ন দপ্তরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।    
জেলা প্রশাসক মাসুদ আলম ছিদ্দিক জানান, ঘূর্ণিঝড় বুলবুল শনিবার রাত ৮টা থেকে ১২টার মধ্যে ভোলায় আঘাত হানতে পারে। ইতিমধ্যে ভোলার প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। বিকাল নাগাদ তা ২ লাখ অতিক্রম করবে। আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষের মধ্যে শুকনো খাবার (চিড়া, মুড়ি) বিতরণ করা হয়েছে। স্ব স্ব ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা খিচুড়ি রান্না করছে। আশ্রয় নেয়া মানুষের মধ্যে খিচুড়ি বিতরণ করা হবে। এখানে আসা লোকজনের জন্য সকাল, দুপুর এবং রাতে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারা যতদিন আশ্রয় কেন্দ্রে থাকবেন তাদেরকে তিন বেলা খাবার বিতরণ করা হবে। যাতে আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষ ক্ষুধার্ত না থাকে তা নিশ্চিত করা হবে।

তিনি আরো জানান, ভোলার ৩৯টি মুজিব কেল্লায় গবাদিপশু রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে যাতে করে একজন মানুষ ও একটি পশুরও প্রাণহানি না ঘটে সেদিকে কঠোর নজরদারি রয়েছে। আমরা ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি এড়াতে নৌ, বিমান ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে কথা বলেছি। প্রয়োজনে তারাও আমাদের সহযোগিতা করবে বলে নিশ্চিত করেছে। এ ছাড়াও জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা হয়েছে। সেখান থেকে মানুষ ঘূর্ণিঝড় বিষয়ে বিভিন্ন সেবা ও বিভিন্ন তথ্য জানতে পারবে।

এ ছাড়াও আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষকে নিরবচ্ছিন্ন সেবা দেয়া ও মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে আনার ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। জেলা রেডক্রিসেন্ট ইউনিটের সদস্যরাও মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন জেলা রেডক্রিসেন্টের সাধারণ সম্পাদক মো. আজিজুল ইসলাম। তিনি জানান, তাদের স্বেচ্ছাসেবীরা মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা, প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

কয়রায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি
কয়রা (খুলনা) প্রতিনিধি জানান, খুলনার সুন্দরবন উপকূলীয় জনপদ কয়রায় ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। গতকাল শনিবার বেলা ১১টায় উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিমুল কুমার সাহা। সভায় উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যানবৃন্দ, সাংবাদিক, বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাবৃন্দ, থানা অফিসার ইনচার্জ, এনজিও কর্মী, সিপিপি কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় করণীয় বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। জনসাধারণকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে নিরাপদে পৌঁছাতে জনপ্রতিনিধিসহ সরকারি কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করার তাগিদ দেয়া হয়। ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় জনসাধারণকে সতর্ক থাকতে এলাকায় মাইকিং অব্যাহত রয়েছে।

সভায় উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের ১১৬টি সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয়গ্রহণকারী লোকজনের রাতে শুকনা খাবার চিড়া, মুড়ি ও গুড় বিতরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মেডিকেল টিমের সদস্যদের জনসাধারণের চিকিৎসা দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়।  উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. জাফর রানা বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সকল ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। উপজেলা সিপিপি’র টিম লিডার ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্যাহ আল মামুন লাভলু জানান, সাধারণ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়ার জন্য বিভিন্ন ইউনিটে তাদের সদস্যরা কাজ করছে। এদিকে পাউবোর বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় জলোচ্ছ্বাসের আশংকা করছেন বলে জানান কয়রা সদরের ইউপি চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন কবির। পাউবোর সেকশন কর্মকর্তা মো. মশিউল আবেদিন জানান ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের অবস্থা সরজমিন দেখতে পাউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলী আংটিহারা ও বানিয়াখালি পোল্ডার পরিদর্শনে রয়েছেন।  

চাঁদপুরে ব্যাপক প্রস্তুতি
চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’-এর সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবিলায় চাঁদপুরের জেলা প্রশাসন ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। শনিবার দুপুর থেকে চাঁদপুর নদীবন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। চাঁদপুর থেকে ঢাকাগামী লঞ্চসহ সকল নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। লঞ্চ, লাইটার জাহাজসহ অন্যান্য নৌযান নিরাপদে রাখা হয়েছে।
চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়কে কেন্দ্র করে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। জেলা পুলিশ, নৌ-পুলিশ, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস, বিআইডব্লিউটিএ, স্কাউটসহ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ৫৮টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য ১৮৪ টন চাল, নগদ এক লাখ ৭০ হাজার টাকা, ৭৩৬ ব্যান্ডিল টিন এবং প্রতি ব্যান্ডিলের জন্য ৩ হাজার টাকা করে মজুত রাখা হয়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status