শেষের পাতা

ঝুঁকি কমাতে প্রয়োজন ট্রান্সফ্যাট নির্মূল

বছরে হৃদরোগে পৌনে ৩ লাখ মৃত্যু

স্টাফ রিপোর্টার

৭ নভেম্বর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৯:২৯ পূর্বাহ্ন

উচ্চমাত্রায় ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণে হার্ট অ্যাটাকসহ হৃদরোগজনিত মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ছে। বিশ্বে প্রতিবছর ১ কোটি ৭৯ লাখ মানুষ হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করে। যার মধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আর বাংলাদেশে প্রতিবছর ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করে। খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে উচ্চমাত্রায় ট্রান্স ফ্যাটি এসিড বা টিএফএ নামক একধরনের চর্বি জাতীয় পদার্থ গ্রহণই হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ। এ বিষয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের অবহিত করার  লক্ষ্যে ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস্‌ (সিটিএফকে)-এর গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের সহায়তায় প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স (আত্মা) যৌথভাবে গতকাল বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ভবন-এর শহীদ ডাক্তার শামসুল আলম খান মিলন সভাকক্ষে ‘ট্রান্স ফ্যাট ও হৃদরোগ ঝুঁকি এবং গণমাধ্যমের করণীয়’ শীর্ষক কর্মশালার আয়োাজন করে। কর্মশালায় খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটি এসিড (টিএফএ), হৃদরোগ ঝুঁকি এবং গণমাধ্যমের করণীয় বিষয়ে আলোচনা করা হয়। কর্মশালায় বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপনা তুলে ধরেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি জেম্‌স পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ’র অ্যাসোসিয়েট সায়েন্টিস্ট আবু আহমেদ শামীম ও ন্যাশনাল হার্টফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট ট্রান্স ফ্যাট প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটর ডা. শেখ মো. মাহবুবুস সোবহান।

কর্মশালায় ট্রান্স ফ্যাট এর সাধারণ বৈশিষ্ট্য, উৎস এবং এর উৎপত্তি নিয়ে আবু আহমেদ শামীম বলেন, ট্রান্স ফ্যাট এক ধরনের অসম্পৃক্ত চর্বি বা আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট যা মূলতঃ আংশিক জারিত তেল বা Partially Hydrogenated Oils-PHOতে বিদ্যমান থাকে, যা ডালডা কিংবা বনস্পতি ঘি নামে দেশে পরিচিত। এতে ২৫ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত ট্রান্স ফ্যাট থাকে। খাদ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো খাবার সংরক্ষণের সুবিধার্থে এবং বিভিন্ন ভাজা পোড়া ও বেকারি খাদ্য পণ্যের স্বাদ, ঘ্রাণ এবং স্থায়ীত্ব বাড়ানোর জন্য আংশিক হাইড্রোজেনেটেড তেল ব্যবহার করে। এছাড়া ভাজা পোড়া খাদ্যে একই ভোজ্য তেল উচ্চ তাপমাত্রায় বারবার ব্যবহারের কারণেও খাদ্যে স্বল্পমাত্রায়  ট্রান্স ফ্যাট সৃষ্টি হয়।

তিনি বলেন, ঢাকার স্থানীয় বাজার থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে সংগৃহীত ১২ ধরনের বেকারি বিস্কুট নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় নমুনা বিস্কুটগুলোতে ৫ শতাংশ থেকে ৩৯ শতাংশ পর্যন্ত ট্রান্স ফ্যাটের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। অনুষ্ঠানে টিএফএ এর স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে ডা. শেখ মো. মাহবুবুস সোবহান বলেন, বিশ্বব্যাপী হৃদরোগজনিত মৃত্যু আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার রক্তে ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল হিসেবে পরিচিত Low Density Lipoprotein বা এলডিএল কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে, অপরদিকে High Density Lipoprotein বা এইচডিএল কোলেস্টেরল (যাকে ‘ভালো’ কোলেস্টেরল বলা হয়) কমিয়ে দেয়। এইচডিএল কোলেস্টেরল রক্তনালী থেকে খারাপ কোলেস্টেরল সরিয়ে দেয়। কিন্তু ট্রান্স ফ্যাটের কারণে এইচডিএল কমে যায় এবং খারাপ কোলেস্টেরল রক্তবাহী ধমনিতে জমা হয়ে রক্তচলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। এভাবে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়াও ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবারের কারণে স্ট্রোক এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস-এ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। উচ্চমাত্রায় ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণের কারণে সার্বিকভাবে মৃত্যুঝুঁকি ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ২১ শতাংশ এবং হৃদরোগজনিত মৃত্যুঝুঁকি ২৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, একজন ব্যক্তির দৈনিক ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণের পরিমাণ হওয়া উচিত মোট খাদ্যশক্তির ১ শতাংশের কম, অর্থাৎ দৈনিক ২০০০ ক্যালোরির ডায়েটে তা হতে হবে ২ দশমিক ২ গ্রামের চেয়েও কম।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ডেনমার্ক ২০০৩ সালে আইন করে খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা মোট ফ্যাটের ২ শতাংশ নির্ধারণ করে। অস্ট্রিয়া, নরওয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, ইরান, ভারতসহ মোট ২৮টি দেশে খাদ্য দ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ কার্যকর করায় এসব দেশে ইতিমধ্যে শিল্পোৎপাদিত খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটের পরিমাণ ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া আরো ২৪টি দেশ ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রণ বাধ্যতামূলক করেছে, যা আগামী দুই বছরের মধ্যে কার্যকর হবে। অন্যদিকে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর আমেরিকা এবং কানাডা ট্রান্স ফ্যাটের প্রধান উৎস চঐঙ এর উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ২০১১ সাল থেকে তেল ও বনস্পতি ঘি বা ডালডা জাতীয় পণ্যে ট্রান্স ফ্যাটের মাত্রা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা হয় এবং ২০১৫ সালে এটি ৫ শতাংশে কমিয়ে আনা হয়। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে ভারতের ফুড সেফটি অ্যান্ড স্টান্ডার্ডস অথরিটি ২০২২ সালের মধ্যে ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা ২ শতাংশে কমিয়ে আনার পাশাপাশি খাবারে শিল্পোৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাট পরিহার করার ঘোষণা দেয়।  আলোচনায় পর্বে ট্রান্স ফ্যাটের ক্ষতিকর প্রভাব এবং এটি নির্মূলে আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী। বাংলাদেশে ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রণে করণীয় বিষয়ের উপর আলোকপাত করে গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর এর বাংলাদেশ কান্ট্রি কোঅর্ডিনেটর মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২৩ সালের মধ্যে টিএফএ-এর ব্যবহার নির্মূল অর্থাৎ ২ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার এক বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এটি একইসাথে ২০৩০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগজনিত অকাল মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই লক্ষ্য অর্জনে জঊচখঅঈঊ অ্যাকশন প্যাকেজ অনুসরণ করার কথা বলছে। তাই হৃদরোগ প্রতিরোধসহ জনস্বাস্থ্যের কার্যকর উন্নয়নের জন্য ট্রান্স ফ্যাট নির্মূলের কোনো বিকল্প নেই।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status