শেষের পাতা

সিলেটে সন্ত্রাসের রাজা মনফর যেভাবে গ্রেপ্তার

ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে

১৩ অক্টোবর ২০১৯, রবিবার, ৯:২২ পূর্বাহ্ন

উত্তর সিলেটের ত্রাস মনফর চেয়ারম্যান। এলাকায় একক রাজা সে। তার ভয়ে তটস্থ মানুষ। প্রতিবাদ তো দূরের কথা মুখ খুলতেও সাহস পান না কেউ। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরেন। সঙ্গে থাকে তার গ্যাংয়ের সদস্যরা। তার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় পুলিশ গেলেই হয় হামলা। এতে আহত হয়েছেন অনেক পুলিশ সদস্য। অস্ত্র তৈরির কারখানাও খুলেছেন। নদীপথে চাঁদাবাজির মহোৎসব চালাতেন। তার মুখ থেকে যে অর্ডার দেয়া হতো তাই ছিল আইন। নিজে জালালাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। একাধিক মামলার আসামি হয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।- কিন্তু শেষরক্ষা হলো না মনফর আলীর। শুক্রবার রাতে স্থানীয় ইসলামগঞ্জ বাজার থেকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে। এ সময় মনফর পুলিশের দিকে অবৈধ অস্ত্র তাক করেছিল। কিন্তু গুলির ভয় না করে পুলিশ তাকে বাজারের শ’শ’ মানুষের সামনে আটক করে। মনফর চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার হওয়ার পর এলাকায় স্বস্তি ফিরেছে। গতকাল ইসলামগঞ্জ বাজারে হয়েছে মিষ্টি বিতরণ। নিজেকে সব সময় আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয় দিতো উত্তর সিলেটের ত্রাস মনফর চেয়ারম্যান। অনেক আগে থেকেই মনফর হাটখোলা-জালালাবাদ এলাকার ত্রাস নামে পরিচিত। বাহিনী গড়ে তোলে তিনি এলাকায় প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। মদ, জুয়া ও নারী- এই তিন মনফরের নিত্যসঙ্গী। রাত হলেই তার আস্তানায় নিজে বসতেন। একদিকে বসতো জুয়া, অন্যদিকে মাদক সেবন। আর নারীদের নিয়ে নিজেই মেতে উঠতেন রঙ্গশালায়। এই অবস্থায় গত ইউপি নির্বাচনে তিনি জালালাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন- নদী ও হাওর বেষ্টিত এলাকা হওয়ায় নিজের লোকজনকে নিয়ে সেন্টার দখল করে মনফর চেয়ারম্যান বিজয়ী হন।

তিনি পরাজিত করেছিলেন জামায়াতের প্রার্থীকে। এ কারণে আওয়ামী লীগের মৌন সমর্থন পেয়ে তিনিও বনে যান আওয়ামী লীগ। তবে- স্থানীয় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা মোশাহিদ আলীসহ কয়েকজন জানিয়েছেন- মনফর আওয়ামী লীগের কেউ না। সে নিজেকে আওয়ামী লীগ দাবি করলেও তার সঙ্গে কোনো কালেই আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা ছিল না। বরং তার সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, নারীবাজির বিরুদ্ধে সব সময় আওয়ামী লীগ ছিল প্রতিবাদী। মনফরের কাছে কোনো দল নয়, টাকাই ছিল সব কিছু। এদিকে- নদী থেকেই প্রতিদিন মনফরের আয় ছিল কয়েক লাখ টাকা। নদী থেকে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করতো। আর নদীপথে অন্য এলাকা থেকে আসা নৌকা থেকেও ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা হারে চাঁদাবাজি করতো তার লোকজন। শুধু চাঁদাবাজিতেই তার আয় হতো প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকা। ওদিকে- গতকাল সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে মনফরকে আটকের কথা জানিয়ে গণমাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে। এডিসি (মিডিয়া) জেদান আল মুছা স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়- মনফরের বিরুদ্ধে অস্ত্র, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, পুলিশ অ্যাসল্টসহ ১০টি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় মনফর ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। জালালাবাদ থানার ওসি অকিল উদ্দিন আহমদ মানবজমিনকে জানিয়েছেন- মনফর চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করা ছিল পুলিশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ- সম্প্রতি সময়ে পুুলিশ তার সহযোগীদের গ্রেপ্তার করতে গিয়ে দু’দফা আক্রান্ত হয়েছে। গত শুক্রবার বিকাল থেকে তারা মনফরকে গ্রেপ্তারের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সন্ধ্যার একটু পর তারা জানতে পারেন সঙ্গে অবৈধ অস্ত্র ও লোকজন নিয়ে মনফর অবস্থান করছে ইসলামগঞ্জ বাজারে। তখন ওসি তদন্ত শাহ আলমের নেতৃত্বে পুলিশ দল সেখানে অভিযান চালায়। মনফর আটক হওয়ার আগে পুলিশের দিকে অস্ত্র তাক করেছিল। কিন্তু পুলিশের কৌশলের কাছে সে পরাজিত হয়। এবং শত শত মানুষের সামনে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। গ্রেপ্তারের সময় তার কাছে বিদেশি পিস্তল ও ৭ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি বলেন- মনফর গ্রেপ্তার হওয়ার পর এলাকায় স্বস্তি ফিরেছে।

গতকাল জালালাবাদ ইউনিয়নের মানুষ বিজয় উদযাপন করেন। এ সময় তারা মিষ্টি বিতরণও করেন। মনফরকে গ্রেপ্তারের আগে পুলিশ তার ৬ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছিল। তারা বিভিন্ন মামলায় মনফরের কুকীর্তি তুলে ধরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। গণমাধ্যমে প্রেরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে পুলিশ জানায়- সিলেট সদরের চেঙ্গেরখাল নদীতে পাথরবাহী বিভিন্ন নৌযানে চাঁদাবাজি করতো মনফর। পুলিশ প্রতিরোধ করতে গেলে গত ১৯শে জুন জালালাবাদের খাশরগাঁও এলাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে সে। পরবর্তীতে ২৫শে জুলাই তার সহযোগীকে ধরতে গেলে আবারো পুলিশের ওপর গুলিবর্ষণ করেন মনফর। এ সময় কয়েকজন পুলিশ আহত হয়। চেয়ারম্যান মনফর আলী ও তার ভাই আনফর আলীসহ ৪০-৫০ জনের সন্ত্রাসী গ্রুপ ‘বর্ষা মৌসুম’ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিন পাথরবাহী ও বালুবাহী নৌযান থেকে চাঁদাবাজি করছে। নদীতে চলাচলরত নৌযানকে মনগড়া রশিদ দিচ্ছে, আবার কোনো কোনো নৌযানকে রশিদ ছাড়াই জোর পূর্বক চাঁদা আদায় করতো সে। পুলিশ জানায়- চাঁদাবাজি বন্ধে জালালাবাদ থানা পুলিশ একাধিকবার চেঙ্গেরখাল নদীতে অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু যাতায়াত ব্যবস্থা দুর্গম হওয়ায় পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছার পূর্বেই অপরাধীরা পালিয়ে যায়। নদীপথে চাঁদাবাজির ঘটনায় স্থানীয় শিবের বাজার পুলিশ ফাঁড়ির এসআই চন্দ্র শেখর বড়ুয়া বাদী হয়ে জালালাবাদ থানায় মামলা করেন। এ মামলায় মনফর চেয়ারম্যান ও তার ভাই আনফরসহ ২১ জনকে আসামি করা হয়। এই মামলা দায়েরের পর গত ২৪শে জুলাই রাতে কালারুকা এলাকায় অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযানকালে পুলিশ মনফরের সহযোগী কুখ্যাত আসামি জয়নাল আবেদীনকে গ্রেপ্তার করে। জয়নালকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসার দিন মনফরের নেতৃত্বে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় মনফর ও তার লোকজন পুলিশের ওপর হামলা ছাড়াও ৮-৯ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। এতে পুলিশ সদস্য এসআই আশরাফুল সিদ্দিক, কনস্টেবল শুকুর আলী, শাহ আলম আহত হয়। এ হামলার ঘটনায়ও জালালাবাদ থানায় মামলা হয়। ওই দিন গ্রেপ্তারকৃত জয়নাল আবেদীন মনফরের অপরাধের ফিরিস্তি তুলে ধরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।

জয়নাল জবানবন্দিতে জানিয়েছে- মনফরের নেতৃত্বে তাকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য তার দলের সন্ত্রাসীরা পুলিশের ওপর আক্রমণ ও গুলিবর্ষণ করেছে। তার জবানবন্দিতে মনফর চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে নদীতে চাঁদাবাজির কথাটিও প্রকাশ পায়। এ ছাড়া মনফর রাতের আঁধারে তার নিজের আস্তানায় সন্ত্রাসী বাহিনী ও ভাড়া করা কারিগর দিয়ে অস্ত্র তৈরি করতো। আর এসব অস্ত্র দিয়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিচালনা করে। পুলিশ আরো জানায়- মনফর ও তার সহযোগীদের ধরতে গত ১লা সেপ্টেম্বর পুলিশ কালারুকার অভিযান চালায়। এ সময় মনফর পালিয়ে গেলেও তার সহযোগী একরাম আলী ও জবান আলীকে দেশীয় তৈরি পাইপগানসহ আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। এ ঘটনার পরও মনফরের কুকীর্তি তুলে ধরে একরাম আলী ও জবান আলী আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে তারা জানায়- জালালাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনফর আলী তার আস্তানায় রাতের বেলা ভাড়াটিয়া কারিগর দ্বারা আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করে। তৈরিকৃত আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে নদীতে চলাচলরত পাথরবাহী ও বালুবাহী নৌযানের লেবার ও মালিকপক্ষদের ভয়ভীতি দেখিয়ে দৈনিক ৬০-৭০ হাজার টাকা চাঁদাবাজি করতো। জালালাবাদ থানার ওসি জানান- মনফর আলীর বিরুদ্ধে মোট ১০টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ৩টি মামলায় তার ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। শুক্রবার রাতেও তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে আরেকটি মামলা হয়েছে বলে জানান তিনি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status