বিশ্বজমিন

কম পাবার বিনিময়ে ভারতকে অনেক বেশি দেয়ায় সমালোচিত হাসিনা

পারুল চন্দ্র

১২ অক্টোবর ২০১৯, শনিবার, ১:৪৫ পূর্বাহ্ন

পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ভারসাম্য বিপজ্জনক হতে পারে। যখন তার সাম্প্রতিক ভারত সফরে ‘স্বল্প-পরিবর্তন’ (শর্ট চেঞ্জড) নিয়ে বিরোধী পক্ষ, নাগরিক সমাজ এমনকি মিডিয়ার সমালোচনার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন তখন এ বিষয়টি খুব ভালভাবেই জানেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

উদ্বেগের বড় কারণটি হলো তার দেশে প্রধান প্রকৌশল বিষয়ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন ছাত্র হত্যা। তার দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সদস্যরা ওই ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। নিহত ওই ছাত্রের নাম আবরার ফাহাদ। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। নয়া দিল্লির অনুরোধে ফেনি নদীর পানি দেয়ার বিষয়ে ফেসবুকে শেখ হাসিনার সমালোচনা করে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন ফাহাদ।

নয়া দিল্লি ও ঢাকা সম্পাদিত ৭টি চুক্তির ঘোষণা দেয়ার মাত্র কয়েক ঘন্টা পরেই তিনি ওই পোস্ট আপলোড করেছিলেন। এতে তিনি ভারতে এলপিজি রপ্তানি ও মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতকে অনুমোদন দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করেছিলেন।

বাংলাদেশের বহু মানুষের অনুভূতি আবরারের মধ্য দিয়ে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এসব মানুষ দীর্ঘদিন তিস্তার পানির জন্য অপেক্ষায় আছেন। ফলে তারা মনে করেন, নয়া দিল্লির সঙ্গে চুক্তি করে ঢাকা বড় মাপের ‘লুজারে’ পরিণত হয়েছে। কিন্তু ফাহাদ সম্ভবত ধারণা করতে পারেন নি তার ওই পোস্টের কারণে কি সহিংস প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

রিপোর্ট অনুযায়ী তার ওপর হামলা করেছিল ছাত্রলীগের বুয়েট ইউনিটের সদস্যরা। তারা তাকে প্রহার করেছিল। তারা বিশ্বাস করতো আবরার ইসলামপন্থি বাংলাদেশ ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত। এই ছাত্রশিবির হলো জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন। এ দলটি গত বছর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজেরা প্রার্থী দিতে সক্ষম হয়নি। কারণ, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন তাদের নিবন্ধন বাতিল করেছে। শেখ হাসিনা জামায়াতপন্থিদের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন চালিয়েছেন।

ওদিকে, প্রহারের ফলে ২২ বছর বয়সী ফাহাদ মারা যান। এতে দেশে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের তরফ থেকে তীব্র সমালোচনা আসছে। সেই সমালোচনা শুধু এই হত্যাকা- নিয়ে নয়। একই সঙ্গে ভারতকে অনেক বেশি দিয়ে সামান্য পাওয়ার অভিযোগেও হচ্ছে সমালোচনা। এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে হাসিনাকে। নিকট প্রতিবেশী ভারতের কাছে সব সময়ই একজন বন্ধু শেখ হাসিনা। ভারতের বর্তমান ও অতীত নেতারা সব সময়ই ‘চীনা কার্ড’ ব্যবহার করেছেন সক্রিয়ভাবে ।

শেখ হাসিনা বর্তমানে তার দেশে টানা তৃতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী। তিনি ভারতের প্রত্যাশা অব্যাহতভাবে পূরণ করেছেন। সেটা হোক ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন অথবা ইসলামপন্থি উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় তিনি কি দেশের ভিতর তার সুনাম হারাচ্ছেন?

আসামের এনআরসি ইস্যু এবং ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অনুপ্রবেশকারীদের (বাংলাদেশী) ঘুনপোকা বলে আখ্যায়িত করায় বাংলাদেশের অনেকের মনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা সরকারিভাবে স্বীকার করেছে তারা এনআরসি প্রক্রিয়ার ওপর দৃষ্টি রাখছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুও ঢাকায় বুদবুদ তুলছে। এর ফলে তাদেরকে ফেরত নেয়ার জন্য মিয়ানমারের ওপর ভারত চাপ সৃষ্টি করুক এমনটা চায় ঢাকা।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ককে ‘সোনালী অধ্যায়’ বলে বর্ণনা করেছেন। তবে শেখ হাসিনার জন্য এর অর্থ সামান্যই। কারণ, তারা অপেক্ষা করেন ভারতের দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর বাস্তবায়নের জন্য।

শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক সফরে আলোচনায় আসেনি বহুল প্রতিক্ষীত তিস্তা নদীর পানি বন্টন চুক্তির কার্ড। এই চুক্তিটি বাস্তবায়ন করতে নয়া দিল্লির রয়েছে নিজস্ব আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যা। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই চুক্তি না হওয়ায় উত্তাপের মুখে রয়েছেন শেখ হাসিনা।

ঢাকায় একটি ইংরেজি পত্রিকার শিরোনাম ‘ফেনি নদীর পানি দেয়া হয়েছে, তিস্তার জন্য অপেক্ষা’। এখানে শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতির দিকে দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। তিনি এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রতিবেশী ত্রিপুরার সাব্রুম শহরে বসবাসকারীদের জন্য ফেনি নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহারের অনুমোদন দিয়ে। ডেইলি স্টার পত্রিকায় সুপরিচিত অর্থনীতিবিদ নজরুল ইসলাম স্বীকার করেছেন, পানির এই পরিমাণ অল্প। কিন্তু তিনি পয়েন্ট আউট করেন যে, প্রতীকী অর্থে এর পরিমাণ বিশাল। অভিন্ন নদী নিয়ে যখন উদ্বেগ রয়েছে তখন ভারত যা চাইছে তখন তারা তাই পাচ্ছে, যখন ঢাকা শুধু দাবিই জানিয়ে আসছে। পানি ভাগাভাগির বিষয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়ে খুব সামান্যই অগ্রগতি হয়েছে।

তিনি এতে তিস্তার পানি বন্টন চুক্তির বিষয়ে বোঝাতে চেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণে থমকে আছে এই চুক্তি। নজরুল ইসলাম আরো লিখেছেন, তিস্তা নদীর পানি বন্টনের চুক্তির বিষয়ে নিশ্চয়তা বা আশ্বাসের মূল্য যথেষ্ট নয়। কারণ, বছরের পর বছর এমন আশ্বাস পেয়ে আসছে বাংলাদেশ। অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এ সময়ের মধ্যে যদি এমন একটি চুক্তিতে পৌঁছা যায়, তাহলে তখন তিস্তা নদীতে গজলডোবা ব্যারেজের কারণে শীতকালে প্রবাহ থাকবে খুবই সামান্য।

ভারতের কাছে এলপিজি রপ্তানির সিদ্ধান্তও তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশে। এমন আশঙ্কায় এ সমালোচনা যে, মনে করা হচ্ছে প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি করা হবে। তবে শেখ হাসিনা এ বিষয়ে পরিষ্কার করেছেন তার সংবাদ সম্মেলনে। তিনি বলেছেন, বিপুল পরিমাণে আমদানি থেকে এলপিজি ভারতে রপ্তানি করা হবে।

আরো একটি আবেগি ইস্যু হলো ফেনি নদীর পানি শেয়ার করা। শেখ হাসিনা একে মানবিক কারণে দেয়ার কথা বলেছেন। বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো তাকে উদ্ধৃত করে বলেছে, যদি কেউ খাবার উদ্দেশে পানি চান এবং আমরা যদি তা না দেই তাহলে তা ভাল দেখায় না। তিনি আরো বলেছেন, ফেনি নদী থেকে যে পানি দেয়া হবে তা তত বেশি নয়।

শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন। কিন্তু যখন সেন্টিমেন্ট এবং আবেগ চলে আসে তখন সব কারণ এবং যুক্তি ম্লান হয়ে যায়। বাংলাদেশ থেকে এখনও অনেক দূরে সরে যায়নি ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট। হাসিনা এটাকে চেকে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু ভারতের অন্যায় আবদার যত দীর্ঘায়িত হবে, তত বেশি দিল্লির প্রতিবেশীদের মধ্যে হাসিনা শ্রেষ্ঠ বন্ধু হওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতার মুখোমুখি হবেন।

( লেখক: ভারতের স্ট্রাটেজিক নিউজ ইন্টারন্যাশনালের ডেপুটি এডিটর। তার লেখাটি ওই সাইট থেকে নেয়া)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status