এক্সক্লুসিভ

কেন সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে এত দ্বন্দ্ব?

মানবজমিন ডেস্ক

১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, বুধবার, ৭:৪৯ পূর্বাহ্ন

বহুদিন ধরেই সৌদি আরব ও ইরান এক তিক্ত দ্বন্দ্বে লিপ্ত। মাঝেমধ্যেই সেই দ্বন্দ্ব উস্কে ওঠে। যেমন, সম্প্রতি সৌদি আরবের গুরুত্বপূর্ণ তেল স্থাপনায় ড্রোন ও সম্ভাব্য মিসাইল হামলা চালানো হয়েছে। এতে দেশটির দৈনিক তেল উৎপাদন ক্ষমতা অন্তত বেশ কয়েকদিনের জন্য অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলশ্রুতিতে বিশ্বজুড়ে তেলের দাম গেছে ব্যাপকভাবে বেড়ে। হামলার জন্য ইরানসমর্থিত ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা দায় স্বীকার করলেও, যুক্তরাষ্ট্র বলছে এ হামলায় সরাসরি জড়িত ইরান। ইরান এ দাবি অস্বীকার করেছে। সৌদি আরব এখনো ইরানকে সরাসরি দায়ী করেনি। তবে দেশটি প্রাথমিক তদন্ত শেষে বলছে, হামলায় ব্যবহৃত সমরাস্ত্র ইরানের তৈরি ও হামলা অন্তত ইয়েমেন থেকে করা হয়নি।
ইরান ও সৌদি আরবের দ্বন্দ্ব ঐতিহাসিক ও দীর্ঘকালের। তবে সাম্প্রতিক সময়ের মতো এতটা তীব্র বোধ হয়নি কখনোই। বিবিসি ইরান-সৌদি দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে বলা হয়, ক্ষমতাধর এই দুই প্রতিবেশী দেশ দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক আধিপত্যের এক তীব্র লড়াইয়ে লিপ্ত। আঞ্চলিক অনেক মতপার্থক্যের কারণে দুই দেশের মধ্যে কয়েক দশক ধরে এই দ্বন্দ্ব প্রায়ই তীব্র হয়ে ওঠে। দুই দেশ অনুসরণ করে ইসলামের প্রধান দুই শাখার একটি। ইরান হলো শিয়া মুসলিম অধ্যুষিত। অপরদিকে সৌদি আরব নিজেকে সুন্নি মুসলিমদের নেতা হিসেবে বিবেচনা করে।
এই ধর্মীয় মতপার্থক্যের প্রতিফলন দেখা যায় মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে। শিয়া ও সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো যথাক্রমে ইরান ও সৌদি আরবের দিকেই সমর্থন বা পরামর্শের জন্য তাকিয়ে থাকে।
ঐতিহাসিকভাবে সৌদি আরব নিজেকে মুসলিম বিশ্বের নেতা মনে করে। রাজপরিবার শাসিত এই দেশটিই ইসলামের আঁতুড়ঘর। তবে সৌদি আরবের এই দাবির প্রতি প্রথম চ্যালেঞ্জ আসে ১৯৭৯ সালে, যখন ইরানে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে এই অঞ্চলে নতুন ধরনের এক রাষ্ট্রের সূচনা ঘটে। এ যেন অনেকটা বিপ্লবী ধর্মবাদী রাষ্ট্র। এই নতুন ইরান চেষ্টা করতে থাকে নিজেদের এই মডেল যেন অন্যত্রও বাস্তবায়ন করা যায়।
বিশেষ করে গত ১৫ বছরে ইরান ও সৌদি আরবের মতপার্থক্য নানাবিধ কারণে বৃদ্ধি পায়। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা চালিয়ে সেই দেশের শাসক সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করে। সুন্নি ধর্মাবলম্বী ও আরব ছিলেন সাদ্দাম। তিনি আবার ছিলেন নিকট প্রতিবেশী ইরানের বড় এক শত্রু। তাকে উৎখাতের ফলে ইরানের এক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রতিপক্ষ সরে যায় দৃশ্যপট থেকে। এর মধ্য দিয়ে বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত হয় শিয়া আধিপত্যশীল একটি সরকার। এরপর থেকেই দেশটিতে ইরানের প্রভাব কেবল বেড়েই চলেছে।
২০০৩ থেকে ২০১১। আরব বিশ্বজুড়ে শুরু হলো আন্দোলন আর বিক্ষোভ। এতে করে পুরো অঞ্চলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিলো। এই উত্তাল অবস্থাকে ব্যবহার করে নিজের মতো করে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলো সৌদি আরব ও ইরান। সবচেয়ে বেশি হয়েছে সিরিয়া, বাহরাইন ও ইয়েমেনে। এতে করে দুই পক্ষের বিরোধ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইরানের সমালোচকরা বলেন, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নিজেকে বা নিজের প্রক্সি মিত্রদের প্রতিষ্ঠা করতে চায় দেশটি। ইরানের লক্ষ্য নিজ দেশের সীমান্ত থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত স্থল করিডোরের নিয়ন্ত্রণ নেয়া।
কৌশলগত এই দ্বৈরথ ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে এ কারণে যে, এই আঞ্চলিক সংঘাতে নানা দিক থেকেই জয়ী হচ্ছে ইরান। সিরিয়ায় ইরান ও রাশিয়ার সমর্থনে দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের অনুগত বাহিনী সৌদি আরব সমর্থিত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর আধিপত্য দূর করতে সক্ষম হয়েছে। সৌদি আরব একদিকে ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ন্ত্রণে আনার জোর চেষ্টা করছে। অপরদিকে দেশটির তরুণ ও ক্ষেপাটে যুবরাজ (কার্যত দেশের শাসক) মোহাম্মদ বিন সালমানের সামরিক হঠকারিতাও এই আঞ্চলিক উত্তেজনার পালে হাওয়া দিচ্ছে। মোহাম্মদ বিন সালমান প্রতিবেশী ইয়েমেনে বিদ্রোহী হুতি আন্দোলনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। এর একটি কারণ ছিল, শিয়া হুতি-বিদ্রোহীদের মধ্যে ইরানের প্রভাব দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু ৪ বছর হয়ে যাওয়ার পর এখন দেখা যাচ্ছে এই যুদ্ধ বেশ ব্যয়বহুল।
ইরান এই অভিযোগ অস্বীকার করছে যে, হুতিদের কাছে সমরাস্ত্র পাচার করছে তারা। তবে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের দাখিল করা একাধিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রযুক্তি ও সমরাস্ত্রের দিক থেকে ইরানের কাছ থেকে প্রচুর সহায়তা পেয়েছে হুতিরা।
ওদিকে লেবাননে, ইরানের মিত্র শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ব্যাপক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বিপুল এক দক্ষ যোদ্ধাবাহিনী। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, ২০১৭ সালে আঞ্চলিক সংঘাতে হিজবুল্লাহর সম্পৃক্ততার কারণেই নিজেদের সমর্থনপুষ্ট লেবানিজ প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে সৌদি আরব। তবে পরবর্তীতে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যস্থতায় সাদ হারিরি লেবাননে পৌঁছেন ও পদত্যাগ স্থগিত করেন।
বহিঃশক্তিও আছে এই দৃশ্যপটে। ট্রাম্প প্রশাসনের সমর্থন পেয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী বোধ করছে সৌদি আরব। অপরদিকে ইসরাইল মনে করে ইরান তাদের জন্য বড় হুমকি। ফলে সেই দিক থেকে ইরানকে নিয়ন্ত্রণে যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সৌদি আরব তাতে সমর্থন দিচ্ছে ইসরাইল। ইহুদি রাষ্ট্রটি মনে করে, সিরিয়াতে ইরানপন্থি বাহিনী আরো গেঁড়ে বসলে নিজেদের সীমান্ত ক্রমেই আরো অরক্ষিত হয়ে উঠবে।
২০১৫ সালে যখন ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প সীমিত করতে আন্তর্জাতিক চুক্তি সই হয়, তখন এর বিরোধিতায় সবচেয়ে বেশি মুখর ছিল সৌদি আরব ও ইরান। তাদের বক্তব্য ছিল ইরান যেন কোনো অবস্থাতেই পারমাণবিক বোমা হাতে না পায়, তা নিশ্চিত করার জন্য ওই চুক্তি যথেষ্ট ছিল না।
মোটাদাগে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বিভক্ত শিয়া-সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। সৌদিপন্থি শিবিরে রয়েছে উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্যান্য প্রভাবশালী সুন্নি দেশগুলো, অর্থাৎ সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন। পাশাপাশি আছে মিশর ও জর্ডান। ইরানের শিবিরে রয়েছে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। ভিন্নধর্মী শিয়া উপগোত্রের সদস্য বাশার আল আসাদ হিজবুল্লাহ সহ ইরানপন্থি শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠীর ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। অপরদিকে সুন্নি আধিপত্য রয়েছে তার বিরুদ্ধে লড়াইরত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে। ইরাকের শিয়া-প্রধান সরকারও ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। তবে অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, এটি ওয়াশিংটনেরও ঘনিষ্ঠ মিত্র। ওয়াশিংটনের সহায়তাতেই ইরানের সরকার জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটকে হটিয়েছে। উপসাগরীয় সুন্নি দেশ হলেও সমপদশালী ক্ষুদ্র দেশ কাতারের সঙ্গে বিরোধ চলছে সৌদি আরব ও  সংযুক্ত আরব আমিরাতের। দুই পক্ষের মধ্য সব ধরনের সমপর্ক বিচ্ছিন্ন অবস্থায়। অভিযোগ কাতারের সঙ্গে ইরানের সমপর্ক অতিরিক্ত মাখামাখি। কাতার ও ইরান মিলে একসঙ্গে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গ্যাসের মজুত পরিচালনা করে। এই অঞ্চলের আরেক সুন্নি দেশ তুরস্কের অবস্থান এখানে বেশ জটিল। তুরস্ক দীর্ঘদিন ধরে ইরানের মিত্র আসাদের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত বিদ্রোহীদের সহায়তা দিচ্ছে। তবে নানা কারণে সৌদি-আমিরাতের সঙ্গেও সমপর্ক বেশ খারাপ তুরস্কের। কাতার সংকট চলাকালে কাতারকে সহায়তা দিয়েছে তুরস্ক; ইরানও দিয়েছে সমর্থন। এ ছাড়া কাতারে একটি সামরিক স্থাপনা তৈরি করছে তুরস্ক, যেটিও সৌদি-আমিরাতের মাথাব্যথার কারণ। কাতার ও তুরস্ককে সুন্নি রাজনৈতিক আন্দোলনের মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি সহানুভূতিশীল ভাবা হয়। মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে ইরানের সমপর্ক খুব মধুর না হলেও, সুন্নি-আমিরাত শিবির তাদেরকে নিজেদের ক্ষমতার জন্য হুমকি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বলে মনে করে। এ কারণেও তুরস্ক-কাতারের সঙ্গে কিছুটা কৌশলগত হৃদ্যতা তৈরি হয়েছে ইরানের। সিরিয়ায় দুই পক্ষের বিরোধপূর্ণ স্বার্থ থাকলেও তুরস্ক, রাশিয়া ও ইরান শিগগিরই এ বিষয়ে আলোচনায় বসছে। তুরস্ক-ইরানের সমপর্ক উষ্ণ হওয়ার আরেকটি লক্ষণ দেখা যায় যখন মার্কিন অবরোধ এড়িয়ে তেল রপ্তানিতে ইরানকে তুর্কি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা করে। মূলত, তুরস্কে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য আমিরাতসমর্থিত একটি সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পরই এরদোগান রাশিয়া ও ইরানের প্রতি ঝুঁকেছেন অনেক বেশি।  
নানা দিক থেকেই সৌদি-ইরান দ্বন্দ্বকে শীতল যুদ্ধের মধ্যপ্রাচ্য সংস্করণ বলা যায়। ইরান ও সৌদি আরব একে অপরের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়ছে না। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বহু প্রক্সি লড়াইয়ে তারা লড়ছে। তাদের সমর্থনপুষ্ট বাহিনী বা গোষ্ঠী একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছে। সিরিয়া এখানে সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ। সৌদি আরবের অভিযোগে ইয়েমেনে বিদ্রোহী হুতি আন্দোলনকে ব্যালেস্টিক মিসাইল দিয়েছে ইরান। যা ব্যবহার করে সৌদি ভূখণ্ডে হামলাও চালিয়েছে হুতিরা।
ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উপসাগরীয় কৌশলগত সমুদ্রপথেও পেশীশক্তির নমুনা দেখাচ্ছে দেশটি। এই পথ দিয়েই সৌদি আরবের তেল পরিবহন হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় বিদেশি কিছু ট্যাংকারে সাম্প্রতিক যেসব হামলা হয়েছে তার জন্য দায়ী ইরান। তবে ইরান এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এখন পর্যন্ত তেহরান ও রিয়াদ প্রক্সি বাহিনীর মাধ্যমেই একে অপরের বিরুদ্ধে লড়েছে। দুই দেশের কোনোটিই সরাসরি যুদ্ধ করতে চায় না। তবে সৌদি রাজধানীতে হুতিরা বড় ধরনের আক্রমণ করে বসলে, বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক স্থাপনায় হামলা হলে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য উপসাগরীয় অঞ্চলে চলাচলের স্বাধীনতা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, আন্তর্জাতিক জাহাজ ও তেল পরিবহনের জন্য এই অঞ্চল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, কোনো সংঘাতে যদি এই সমুদ্রপথ বন্ধের উপক্রম হয়, তাহলে খুব সহজেই সংঘাতে জড়িয়ে যেতে পারে মার্কিন নৌ ও বিমান বাহিনী।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status