বাংলারজমিন

জেসমিনের গল্প

এক সুবিধাবঞ্চিত শিশুর স্বপ্নের পথযাত্রা

স্টাফ রিপোর্টার

২২ আগস্ট ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৮:২০ পূর্বাহ্ন

মিরপুর-১০ নম্বরে মা-বাবা আর দুই ভাইকে নিয়ে একটা ছোট্ট কুঁড়েঘরে থাকে জেসমিন আখতার। ছোটবেলা থেকেই মেয়েটা বাস্তবতা বুঝতে শিখেছে। সে জানে তার বাবা গরিব, তাই লেখাপড়া তার কপালে নেই। রিকশাচালক বাবার পক্ষে পাঁচ সদস্যের পরিবারের জন্য দু’মুঠো খাবার জোগাড় করাই কঠিন, লেখাপড়ার চিন্তাটা সেখানে তাই বিলাসিতা। জেসমিন ধরেই নিয়েছিল, লেখাপড়া শুধু বড়লোকদের জন্যই। জেসমিনের ভাগ্যের এক নাটকীয় পরিবর্তন ঘটল। একদিন সে জানতে পারল মামাবাড়ি ট্রাস্ট সম্পর্কে। প্রথমে সে বুঝতে পারেনি এই প্রতিষ্ঠানটি কী কাজ করে। পরে জানতে পারল তার মতো সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চাদের পড়াশুনার খরচ, বই কেনার খরচ, তিনবেলা খাওয়ানোসহ দেখভালের সব খরচ বহন করে মামাবাড়ি ট্রাস্ট। এ তো পুরো মামাবাড়ির আবদার! সব জেনেও যেন জেসমিনের বিশ্বাস হতে চায় না। এত ভালো জায়গাও দুনিয়ায় আছে? জেসমিনের মনে প্রশ্ন জাগে।
এই ট্রাস্টের উদ্যোক্তা সমাজসেবক মাহবুব রাব্বানী ও আয়েশা রাব্বানী দম্পতি। তারা মামাবাড়ি ট্রাস্টের পরিবারে জেসমিনকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। তাই স্বপ্নটাকে ডানা মেলে উড়ে যাওয়ার সুযোগ নিতে জেসমিন লেখাপড়া শুরু করেছে। সে এখন মিরপুর গার্লস আইডিয়াল স্কুলের ছাত্রী।

মামাবাড়ি ট্রাস্টের সহযোগিতায় জেসমিনের মতো এমন প্রায় ১০০ জন শিশু জীবনে খুঁজে পেয়েছে নতুন আশার আলো, পেয়েছে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়, স্বপ্ন দেখার সাহস। এই আশার আলো যেন তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

২০০৯ সালে মাত্র সাতজন সুবিধাবঞ্চিত শিশু নিয়ে মাহবুব রাব্বানী ও আয়েশা রাব্বানী এই ট্রাস্টের কার্যক্রম শুরু করেন। বর্তমানে এই ট্রাস্টটি প্রায় ৯৭ জন শিশুর লেখাপড়ার খরচ, স্কুল ইউনিফর্ম, খাবারসহ তাদের সব খরচ বহন করছে। এখন পর্যন্ত ট্রাস্টের অনেক ছাত্র-ছাত্রী সফলতার সঙ্গে এসএসসি, এইচএসসি ও কারিগরি পরীক্ষায় পাস করেছে।

সুবিধাবঞ্চিত এই শিশুরা এখন প্রাইমারি ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশুনা করতে পারছে। মামাবাড়ি ট্রাস্টটি মিরপুর-ভিত্তিক একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যারা মূলত মিরপুরের বস্তি এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। শিক্ষার আলোয় শিশুদের আলোকিত করাই তাদের মূল লক্ষ্য।

রাব্বানী দম্পতিদের এই নিঃস্বার্থ উদ্যোগ বেশ সাড়া ফেলেছে। তাই বিভিন্ন সময়ে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছে দেশের অনেক সমাজসেবক ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। তারা মামাবাড়ি ট্রাস্টকে সহযোগিতা করতে চেয়েছে, যেন আরও অনেক সুবিধাবঞ্চিত শিশু এখানে যুক্ত হতে পারে।

শিশুরা রাতে ট্রাস্টের নির্ধারিত বাড়িতে থাকে না, তবে বাকিটা সময় তাদের ওখানেই কাটে। ছেলেমেয়েরা এখানে খাওয়া-দাওয়া করে, হোমওয়ার্ক শেষ করে, গোসল করে, এমনকি এক্সট্রা কারিকুলার বিভিন্ন কাজে অংশ নেয়। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, কিছু মেয়ে শিশু এখানে কারাতে এবং তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণও নিচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ খুব সুন্দর গান গায়, কেউ খুব সুন্দর ছবি আঁকে, আবার কেউ খেলাধুলায় দুর্দান্ত। প্রাথমিকভাবে এই ট্রাস্টের কোনো নাম ছিল না। পরবর্তীতে মামাবাড়ি নামটা ঠিক করা হয়, বাচ্চাদের আত্মীয়স্বজনরা ট্রাস্টকে এই নামে ডাকতেই পছন্দ করে। বাংলাদেশে মামাবাড়ি মানে মায়ের ভাইয়ের বাড়ি, আর যেখানে শিশুরা খুব আনন্দে, যত্নে দিন কাটায়।  

ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড এই ৯৭ জন সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য একটি অনন্য উদ্যোগ নিয়েছে। সুবিধাবঞ্চিত এই ৯৭ জন বাচ্চাকে সাহায্য করার জন্য ব্র্যাক ব্যাংক একবছর তাদের সিএসআর ফান্ড থেকে ট্রাস্টকে আর্থিক সুবিধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডেপুটি ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিআরও চৌধুরী আখতার আসিফ, কমিউনিকেশনস বিভাগের প্রধান ইকরাম কবীর, সাসটেইনেবল ফিন্যান্স বিভাগের প্রধান তাহমিনা জামান খান সমপ্রতি মিরপুর-১০ নম্বরের মামাবাড়ি ট্রাস্ট পরিদর্শন করেন। তাঁরা বাচ্চাদের প্রতিদিনের ব্যস্ততা, সময় কাটানো, আনন্দ, এক্সট্রাকারিকুলার কাজ সম্পর্কে জানতে পারেন। সবকিছু দেখে তাঁদের মুগ্ধতার রেশ যেন কাটতে চায় না। সামাজিক এই উদ্যোগ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে চৌধুরী আখতার আসিফ বলেন, ‘বৃহৎ ব্র্যাক পরিবারের অংশ হিসেবে ব্র্যাক ব্যাংকের ডিএনএ’তে কর্পোরেট দায়িত্ব যুক্ত আছে। আমরা আজ মামাবাড়ি ট্রাস্টকে যে সহযোগিতা করছি, তা ভবিষ্যতে সুন্দর সমাজ নির্মাণে বিনিয়োগ হিসেবে কাজ করবে। ইউনাইটেড নেশনস গ্লোবাল কমপ্যাক্টের সদস্য হিসেবে এবং সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল পূরণের প্রতিজ্ঞা থেকে ব্র্যাক ব্যাংক সব সময় সিএসআর প্রকল্পগুলোকে বাড়তি গুরুত্ব দেয়। যার ফলাফল সুদূরপ্রসারী।’

‘একটি ব্যাংক হিসেবে আমরা তারুণ্যের স্বপ্ন, আশা ও সম্ভাবনার উপর আস্থা রাখি। আমরা বিশ্বাস করি আমাদের এই ছোট অবদানের মাধ্যমে সুযোগবঞ্চিত শিশুরা সামনের দিকে এগিয়ে যাবে, দেশের জন্য তারা আর বোঝা থাকবে না, হবে সম্পদ।’ তিনি আরো বলেন, ‘সমাজকে বদলে দেয়ার লক্ষ্যে মামাবাড়ি ট্রাস্টের মতো আরো অনেকেই এমন উদ্যোগ  নেবেন বলে আমরা আশা করি।’
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status